নারী নেতৃত্ব জায়েজ (পর্ব - ১)

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১১:১২:১০ রাত

পটভুমি : চরমোনাই পীরের লোকরা প্রায়ই কথায় কথায় বলে থাকেন : "যারা মহিলাকে নিজেদের নেতা বানাবে তারা অবশই ধংস হবে" । তারা বলে থাকেন এটা সহিহ হাদিস । আজকের পোস্ট আমি এই কথাটা ভুল বলে প্রমাণ করবো । তারা বলেন – নারী নেতৃত্ব হারাম ।

নারী নেতৃত্ব সম্পর্কিত হাদিস :

নারী নেতৃত্ব হারাম এবিষয়ে অসস্পষ্ট দলিল হিসেবে একটা হাদিস উপস্হাপন করা হয় ।এটা হলো বুখারী শরীফের ৫ম খন্ডের ৭০৯ নং হাদিস । হাদিসটা হলো : আবু বাকরা বলেছেন, জমাল যুদ্ধের সময় আমি সাহাবীদের সঙ্গে যোগ দিয়া প্রায় নেমে পড়েছিলাম । কিন্তু রাসুল সা. এর একটা কথায় আল্লাহ আমাকে বড়ই উপকৃত করেছেন । যখন রাসুল সা. কে বলা হলো যে ইরানের সম্রাট খসরুর মৃত্যুর পরে ইরানের লোকেরা তার কন্যার উপর নেতৃত্ব অর্পণ করেছে । তখন তিনি বল্লেন, যে জাতির লোকেরা তাদের নেতৃত্ব কোন নারীর উপর অর্পণ করে সেই জাতি কখনো উন্নতি করবে না ।“

হাদিসটির গ্রহণযোগ্যতা :

আমি বিভিন্ন তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে এই হাদিসটা জাল ও অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করছি ।

কে এই আবু বাকরা ? ইতিহাস গ্রন্হ তারিখ আল তাবারিতে হতে জানা যাচ্ছে :

১. ৮ম হিজরীতে রাসুল (সা.)-এর তায়েফ বিজয়ের সময় কিছুতেই দুর্গ ভাঙ্গা যাচ্ছিল না বলে তিনি ঘোষনা করেছিলেন দুর্গের ভিতর হতে কোন কৃতদাস পালিয়ে এলে মুক্ত করা হবে । আবু বাকরা ছিলেন তায়েফ শহরের কৃতদাস । রাসুল (সা.)-এর এই ঘোষণা শুনে তিনি দুর্গ হতে পালিয়ে আসেন । এর কয়েক কয়েক বছর পর রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন । তার দুর্গ হতে পালিয়ে এসে মুসলিমদের দলে যোগ দেওয়ার ২৫ বছর হয়ে গেলো । আর আবু বাকরাও ইরাকের বসরা শহরের বিখ্যাত নাগরিক হিসেবে উপস্হিত হলেন ।

২. এরপর ঘটে গেল মুসলমানদের ইতিহাসে নিজেদের বিরোদ্ধে নিজেদের তিনটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ ।

ওসমান (রা.) খুন হওয়ার পর আলী (রা.) এর বিরোদ্ধে আয়েশা-তালহা-যুবায়ের (রা)-এর দল আয়েশা (রা.) নেতৃত্বে আলী (রা)-এর বিরোদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেছিলেনের উটের উপর বসে । এজন্য এযুদ্ধের নাম হয়েছে উটের যুদ্ধ বা জামাল যুদ্ধ ।

এই যুদ্ধে আলী (রা.) জয়ী হলে আবু বাকরা তাকে এহাদিস শোনান । তাহলে আমরা এহাদিসের প্রেক্ষাপট হিসেবে যা পাচ্ছি :

১.এহাদিস তিনি বলেছেন আয়েশা (রা.) যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ।

২.আবু বাকরার উচিত ছিল তার শোনা রাসুলে (সা.)-এর কথাকে কাজে লাগানোর জন্য আয়েশা (রা.)-এর বিরোদ্ধে যুদ্ধ করা । কিন্তু তিনি তা করেননি ।

৩.তিনি তার শোনা রাসুল (সা.)-এর কথাটা বলেছিলেন রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের সুদীর্ঘ ২৫ বছর পর জামাল যুদ্ধ হওয়ার পর ।

৪.তার কথায় বোঝা যায় তিনি নাকি রাসুল (সা.)-এর এই কথায় ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হয়েছিলেন ।

৫. অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত সাহাবীর কাছে রাসুল (সা.)অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস বর্ণনা করেছেন । কিন্তু এ অসাধারণ হাদিস তিনি শুধুমাত্র তার মতো অখ্যাত সাহাবীর কাছেই বর্ণনা করলেন, এই কথাই বা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য ।

জামাল যুদ্ধ না হলে তিনি হয়ত এহাদিস বলতেন না । আর তিনি সুদীর্ঘ ২৫ বছর এহাদিস কারো কাছে বলেনও নাই ।

আর জামাল যুদ্ধে আয়েশা (রা.) জিতে যেতেন তাহলে এহাদিস কি তিনি প্রকাশ করতেন ? বোধ হয় না । তিনি যুদ্ধে আলী(রা.) পক্ষে যোগও দেননি ।

অনেকে বলে থাকেন আবু বাকরা নাকি আয়েশা (রা.)-কে নেতৃত্ব হতে সরে আসার জন্য নাকি তার কথিত হাদিস উল্লেখ করে চিঠি লিখেছিলেন । তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি :

আবু বাকরার কথিত চিঠি নাকি পড়ার পরও আয়েশা (রা.) নেতৃত্ব ছেড়েও দেননি ।কারণ তিনি জানতেন হাদিসটা জাল । উপরন্তু আয়েশা (রা.) নিজেই রাসুল (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীদের একজন এবং তার বাবা আবু বাকর (রা.) প্রথম খলিফা এবং রাসুল (সা.)-এর শীর্ষ ও একনিষ্ঠ সহচর । সুতরাং আয়েশা (রা.) হাদিস সম্পর্কে ভাল করেই জানেন । তাছাড়া আয়েশা (রা.) নিজেই হাদিসবিদ্যায় সবচেয়ে বেশী পারদর্শী লোক ।

ইসলামের ইতিহাসে অনেক মুসলিম রাণীর বা শাসিকা রাজত্ব করেছেন । এসব মুসলিম সার্বভৌবম রানীদের সময় কোন মাওলানা এক বারও এসব হাদিসের ভিত্তিতে রানীদের বিরোধীতা করেননি । আসলে এধরনের হাদিস কেউ বিশ্বাস করেননি ।

পাকিস্তান আমলে সেনা শাসক আইয়ুবের বিরোদ্ধে নির্বাচনে ফাতিমা জিন্নাহর সমর্থক জামায়াতের পতিষ্ঠাতা মওদুদীসহ সব ইসলামী দলের মাওলানারাও বিশ্বাস করেননি ।

কারণ তারা জানতেন আবু বাকরা নারী ব্যবিচারের মিথ্যা স্বাক্ষী দেওয়ার জন্য হযরত ওমর(রা.)সুরা নুরের ৪ নং আয়াত অনুযায়ী ৮০ টা বেত্রাঘাত করেছিলেন । সুরা নুরের এই আয়াতে বলা আছে : যারা স্বতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্হিত করেন না তাদের ৮০ টা বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না ।

যুগে যুগে মুসলিম নারী নেতৃত্ব ও শাসিকা :

ইসলামের ইতিহাসে কম করে হলেও শতাধিক মুসলিম সার্বভৌম নেত্রী রয়েছে । তাদের মদ্যে ১২ জনের নামে মসজিদে খুতবা পড়া হতো এবং তাদের অনেকের নামে মুদ্রা প্রচলিত ছিল । এর মধ্য ভারতের সুলতানা রাজিয়ার প্রতি তৎকালীন খলিফার সমর্থনে মুদ্রা কলকাতা মিউজিয়ামে রাখা আছে । এসব রানিরা হলেন –

১. সুলতানা রাজিয়া ১২৩৬ সাল হতে রাজত্ব করতেন । তার নামে মুদ্রা প্রচলিত ছিল । এই মুদ্রাতে তিনি খলিফার প্রতিনিধি বলে উল্লেখ থাকতো ।

২. ১২৫০ সাল হতে মিসরের জনৈক মহিলা কয়েক বছর রাজত্ব করেন । তার নামে মসজিদে খুতবা পড়া হতো ।

৩. তুরকান খাতুন ইরানের তুরকান অঞ্চলে ১২৫৭ হতে ১২৮২ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করতেন । তার নামে মসজিদে খুতবা পড়া হতো ।

৪. তুরকান খাতুনের কন্যা পাদিশা খাতুন । তার নামে মুদ্রা প্রচলিত ছিল ।

৫. ইরানের সিরাজ অঞ্চলে আবশ খাতুন ১৩৬৩ হতে ১২৮৭ সাল পযন্ত রাজত্ব করতেন । তার নামে মুদ্রা প্রচলিত ছিল । তার নামে মসজিদে খুতবা পড়া হতো ।

৬.ইরানের লুরিস্তান অঞ্চলের রানি ১৩৩৯ হতে ১২৮৭ সাল পযন্ত রাজত্ব করতেন ।

৭.রানি তিন্দু ১৪১১ হতে ১৪১৯ পযন্ত রাজত্ব করতেন ।

৮. সুলতানা খাদিজা মালদ্বীপ ।

৯. সুলতানা মরিয়ম মালদ্বীপ ।

১০. সুলতানা ফাতিমা মালদ্বীপ ।

সুলতানা খাদিজা, সুলতানা মরিয়ম এবং সুলতানা ফাতিমা ১৩৪৭ হতে ১৩৮৮ একটানা ৪১ বছর মালদ্বীপ শাসন করেন । এসময় বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা মালদ্বীপের বিচারপতি ছিলেন ।

১১. ইয়েমেনের সুলাহি বংশের রানী আসমা

১২ ইয়েমেনের সুলাহি বংশের রানী আরোয়া

রানী আসমা ও রানী আরোয়া ইয়েমেন শাসন করেন প্রায় ৫০ বছর । তাদের নামে মসজিদ খুতবা পাঠ হতো । ১৫৯১ হতে ১৯২৫ প্রায় ৩৩০ বছরে পুরুষ রাজারা ইয়েমেনে যত রাস্তাঘাট. দালান কোঠা, মসজিদ গম্ভুজের যা উন্নতি করেছিলেন রানী আসমা ও আরোয়া তাদের চেয়ে অনেক বেশী উন্নতি করেছিলেন ।

[পরবর্তীতে আমি আমার ধারাবাহিক নিবন্ধ “যুগে যুগে মুসলিম নারী নেতৃত্ব “ আরো মুসলিম নারী নেতৃত্বের তথ্য উপস্হাপন করা হবে । আশা করি আমার সাথেই থাকবেন । ]

উপসংহার : "যারা মহিলাকে নিজেদের নেতা বানাবে তারা অবশই ধংস হবে" – যা এই উদৃতি দেন তারা সঠিক কথা বলেন না । কারণ এসম্পর্কিত হাদিসটি জাল ও অগ্রহণযোগ্য । কারণ ইসলামের কোন যুগের ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা এই হাদিসটিকে হাদিস গ্রহণ ও বর্জনের নীতি অনুসারে গ্রহণ করেননি । তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে ।

উৎস :

১. দ্য ফরগটেন কুইন অব ইসলাম : ফাসিম মার্নিসি ।

২. সাবমিশন ডট কম ।

৩.উইমেন এন্ড পলিটিক্স ইন ইসলাম ।

৪.উইমেন রাইট ইন ইসলাম :শরীফ চৌধুরী ।

বিষয়: বিবিধ

৫০৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File