নজরুল-ভাবনায় সবার উর্ধ্বে মানুষ ।
লিখেছেন লিখেছেন মহি১১মাসুম ২৬ মে, ২০১৪, ০১:৩৬:২৭ রাত
নজরুল-ভাবনায় সবার উর্ধ্বে মানুষঃ ধর্ম-বর্ণ, নর-নারী ও ধনী-গরীবের ভেদাভেদ ও রেষারেষিকে ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়েছেন, অথচ এক শ্রেনীর কূপমুন্ডুকদের দল কাজী নজরুলকে শুধুই মুসলমানদের কবি বানিয়ে নজরুলকে খন্ডিতকরন করছে ।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বিস্ময়কর প্রতিভা । নজরুলের ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থার জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা, গভীর জীবনবোধ বাঙালীত্বের শক্তিতে বলীয়ান ।
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’
জাতি-ধর্মের পারস্পরিক সম্প্রীতি নজরুল-ভাবনার এক অনবদ্য আলোকশিখা । তাঁর আদর্শ ছিল এমন এক সমাজ, যেখানে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ থাকবে না । শ্রেণীবিভাজনের উর্ধ্বে সকলের পরিচয় হবে অভিন্ন । ‘মানুষ’ হিশেবে পরিচিত হবে সবাই । তিনি বাঙালিকে শুধু বাঙালি বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন । নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন এ দেশের সম্প্রদায়িকতা বিষয়টি হিনদু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের আধা-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা । আর তাই তিনি নিজের সম্প্রদায়ের ভিতরে খুব স্পষ্ট অবস্থানে থেকেই ধর্ম সম্প্রীতির চেতনাকে লালন ও প্রকাশ করতে পেরেছিলেন ।
তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন- ‘ধর্ম আমাদের ইসলাম । কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন । আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের ।’
তিনি কাব্য-জীবনের প্রারম্ভ থেকেই হিন্দু-মুসমানের সংসৃকতি ও ঐতিহ্যকে অভিন্ন বলয়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন । নজরুল তখন বাঙালি জাতির সামনে নিয়ে এলেন মানবতাবাদের শাশ্বত বারতা ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ?/কারী! ডুবছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র ।’সাম্প্রদায়িক বিবাদ প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ । দাঙ্গায় যে উভয় সম্প্রদায়েরই দায় রয়েছে তা তিনি পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে অবলোকন ও উপলদ্ধি করেছেন । কুসংস্কার আর সঙ্কীর্ণ মানসিকতায় আচ্ছন্ন উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িকরা তাঁকে তাঁর সৃষ্টির পথে বার বার বাধা দিয়েছে । দৃঢ়চেতা কবি তখনও থেকেছেন আপোসহীন, প্রবল প্রতিবাদী । প্রসঙ্গত, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া তাঁর ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:
‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের । আমি বলি ও দুটো কিছুই নয় । আমি মাত্র, হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি । গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি ।’
জাগ্রত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ দৃষ্টিগোচর হয়নি তাঁর । দেখাননি জাতিবিদ্বেষও ।
তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ নাই, জাতিবিদ্বেষ নাই, বর্ণবিদ্বেষ নাই, আভিজাত্যের অভিমান নাই । পরস্পরকে ভাই বলিয়া একই অবিচ্ছিন্ন মহাত্মার অংশ বলিয়া অন্তরের দিক হইতে চিনিয়াছি ।’
আর এ প্রসঙ্গেই তাঁর উদাত্ত আহবান-
‘এস ভাই হিন্দু । এস মুসলমান । এস বৌদ্ধ । এস ক্রিশ্চিয়ান । আজ আমরা সব গন্ডি কাটাইয়া, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি । আজ আমরা আর কলহ করিব না । চাহিয়া দেখ, পাশে তোমাদের মহাশয়নে শায়িত ঐ বীর ভ্রাতৃগণের শব । ঐ গোরস্থান-ঐ শ্মশাণভূমিতে শোন শোন তাহাদের তরুণ আত্মার অতৃপ্ত ক্রন্দন ।’
নজরুলের কাছে মানুষের মূল্য এত বেশি যে ধর্মবেত্তাদের একই সারিতে সহজে সাজাতে পারার ঔদার্য ও সাহস দেখিয়েছেন এবং বলতে চেয়েছেন
‘বুদ্ধ-কৃষ্ণ-মোহাম্মদ-রাম’ ধর্মবিশেষের ভাষ্যকার হিশেবে পরিচিত হলেও বিসত্মৃত অর্থে তাঁরা মানুষেরই বন্ধু । নজরুল ওই মহামানবের মানবতাবোধ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘চিনেছিলেন খ্রীষ্ট বুদ্ধ/কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রাম /মানুষ কী আর কী তার দাম ।’
নজরুল তাঁর সাহিত্য ভাবনার অন্যতম প্রধান সুর হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রয়াস । ‘মন্দির ও মসজিদ’ নামক প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন:
‘মানুষের কল্যাণের জন্য ঐ-সব ভজনালয়ের সৃষ্টি, ভজনালয়ের মঙ্গলের জন্য মানুষ সৃষ্টি হয় নাই । আজ যদি আমাদের মাতলামির দরুণ ঐ ভজনালয়ই মানুষের অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠে, যাহার হওয়া উচিৎ ছিল স্বর্গসত্যের সেতু- তবে ভাঙ্গিয়া ফেল ঐ মন্দির-মসজিদ ! সকল মানুষ আসিয়া দাঁড়াইয়া বাঁচুক এক আকাশের ছত্রতলে, এক চন্দ্র-সূর্য-তারা-জ্বলা মহামন্দিরের আঙ্গিনাতলে ।’নজরুল চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান ।
আজ সভ্যতার অগ্রগতির এ আলোয় এবং প্রযুক্তির প্রবল উৎকর্ষের দিনে আবারও যেন ধ্বনিত হতে শুনি নজরুলের সেই ক্ষমা-প্রার্থনা ও শান্তি ভিক্ষা:
‘শান্তি দাও, শান্তি দাও হে ক্ষমাময়, ক্ষমা কর/হে অভেদ ! এই ভেদ ভুলাইয়া উদার বক্ষে ধর ।/ বাংলার এই হিংসালীলা ঢেকে দাও, ভেঙ্গে দাও ! চির সুন্দর ! ক্ষমা প্রসন্ন নয়নে আবার দাও ।’(ঢাকার দাঙ্গা)
গদ্যেও আমরা তাঁর কবিতার মতোই জীবনসত্যের স্পষ্ট, রাখ-ঢাকহীন বিবরণ পাই:
‘সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম-মাতালদের আড্ডা ঐ মন্দির-মসজিদ-গির্জা ভাঙিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজ তলে লইয়া আসিবেন ।’
আর্থিক অনটন- উপার্জনের নিরন্তর চেষ্টায় ক্লান্ত নজরুলের কষ্ট এবং প্রত্যয়ের পরিচয় পাই ১৯২৭-এ এক তরুণকে লেখা চিঠিতে:
‘আমি অর্থ উপার্জন ছাড়া বোধ হয় জগতে সবকিছু করতে পারি । ঐ জিনিসটের মালিক হতে হলে যতটা নিচে নামতে হয়, ততটা নামবার দুঃসাহস আমার নেই ।’
ভারতের চিরপরিচিত দারিদ্র্যকে পাশ কাটিয়ে যে ধর্মান্ধ মাতালরা কেবল নিজেদের মুসলমানিত্ব বা হিন্দুত্ব প্রকাশ ও প্রমাণের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল, তাদের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন এই বিদ্রোহী কবি । লাখ লাখ লোক যখন না খেয়ে মরছে প্রতিবছর, তখন মন্দির ও মসজিদের ইট-কাঠ নিয়ে ব্যস্ত থাকা লেবাসধারী ধার্মিকদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তিনি । সমাজ-পরিপ্রেক্ষেতের বাস্তবতায় তাদের মূর্খতাকে সচেতন মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন । ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধে লিখছেন তিনি: ‘মুহম্মদকে যাহারা মারিয়াছিল, ঈসা-মুসাকে যে-সব ধর্ম-মাতাল প্রহার করিয়াছিল, তাহাদেরই বংশধর আবার মারিতেছে মানুষকে- ঈসা-মুসা-মুহম্মদের মত মানুষকে ।’
মানুষের অকল্যাণ সৃষ্টিকারী এইসব ‘মাতাল পশু’র জন্য তিনি যেন করুণা প্রকাশ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেছেন । নজরুল দেখেছেন অর্থনৈতিক অসাম্য আর শ্রেণিগত বৈষম্যের কারণে মানুষের মৌলিক অধিকার বিপন্ন হয়েছে, নারীর মর্যাদা ও সম্ভ্রম ধুলায় লুটিয়ে পড়েছে ।
টাকার জন্য, সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য নারীকে তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ- ইজ্জত হারাতে হয়েছে । খাবারের অভাবে মরতে হয়েছে শিশু-বৃদ্ধ-যুবা ও যুবতীকে । এমন সব অমানবিক ঘটনায় নজরুল যেন ক্ষেপে উঠেছিলেন । মানুষ কীভাবে মানুষকে মেরে ফেলে ধর্ম-প্রতিষ্ঠার জন্য অন্ধের মতো কেবল ছুটতে পারে, তা তিনি বুঝতে পারেননি । অথবা বুঝেছেন তাদের বোকামি ও লালসার তাৎপর্য । লিখেছেন: ‘মানুষের পশু-প্রবৃত্তির সুবিধা লইয়া ধর্ম-মদান্ধদের নাচাইয়া কত কাপুরুষই না আজ মহাপুরুষ হইয়া গেল ।’
সকল কালে সকল দেশে সকল লাভ-লোভকে জয় করিয়াছে তরুণ । ওগো বাঙলার তরুণের দল- ওগো আমার আগুন খেলার নির্ভিক ভাইরা, ঐ দশ লক্ষ অকাল মৃতের লাশ তোমাদের দুয়ারে দাঁড়াইয়া ! তারা প্রতিকার চায় !
তোমরা ঐ শকুনির দলের নও, তোমরা আগুনের শিখা, তোমাদের জাতি নাই । তোমরা আলোর, তোমরা গানের, তোমরা কল্যাণের । তোমরা বাহিরে এস, এই দুর্দিনে তাড়াও ঐ গো-ভাগারের পড়া শকুনির দলকে ।
আমি শুনিতেছি মসজিদের আজান আর মন্দিরের শঙ্খধ্বনি। তাহা একসাথে উত্থিত হইতেছে ঊর্ধ্বে- স্রষ্টার সিংহাসনের পানে । আমি দেখিতেছি, সারা আকাশ যেন খুশি হইয়া উঠিতেছে ।
প্রকৃতঅর্থে নজরুল বস্ত্তগত ধর্মবিশ্বাসকে দূর করে সত্যিকারের প্রীতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । সমাজে ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্মের যে বিকাশ, তার বিনাশ সাধনও ছিল নজরুলের আরাধ্য । ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা তাঁর ওই অভিলক্ষের একটি দিক মাত্র । অসংখ্য কবিতা, বক্তৃতার মতো তাঁর ‘মন্দির ও মসজিদ’ নামক প্রবন্ধটি মানবতাবোধ ও সামাজিক ইতিবাচকতার পাঠ ও পর্যবেক্ষণে পরিপূর্ণ এক শৈল্পিক পরিবেশনা ।
বিষয়: সাহিত্য
৪৩৭৬ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মেধা আপনার প্রতি রইলো অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।
মতামত শেয়ারের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
আপনার প্রশংসাসূচক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
ধন্যবাদ পরিশ্রমি পোষ্টটির জন্য।
প্রেসিডেন্ট আমি নিশ্চিত আপনি একজন জ্ঞানী ও সভ্য মানুষ। অনুরোধ থাকবে ভুল ধরিয়ে দিয়ে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দিবেন, আহাম্মক,নষ্ট বাম এইসব বিশেষন ব্যবহার করে দুরে সরিয়ে দিবেন না ।
দুঃখিত,কাজী নজরুলকে নিয়ে আমার সীমিত জ্ঞানে পর্যালোচনাধর্মী লিখা তৈরীর দুঃসাহস দেখানোর জন্য।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন