নেক্সাস ৭: স্বাশ্রয়ী মূল্যের সেরা ট্যাবলেট (দুইটি রিভিউ !)
লিখেছেন লিখেছেন নিরাময় ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ১২:২৯:২৫ দুপুর
২০০৮ সালে যখন Eee পিসি একটা বিপ্লব তৈরি করে সকল নির্মাতাদের স্বল্পমূল্যের এবং ছোট আকৃতির ল্যাপটপ তৈরি করার পথে পরিচালিত করছিল তখন সনি বেকে বসেছিল। সনি বলেছিল যে এটা প্রযুক্তি বাজারের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে এবং বাজার সস্তা ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতিতে ভরে যাবে। সনি অবস্থান তখন ভুল ছিল। এবং তারা প্রায় বছর খানেক ধরে তাদের অবস্থানে থাকার পর তারাও স্বল্প মূল্য এবং ছোট আকৃতির ল্যাপটপের বাজারে প্রবেশ করে VAIO W মডেলের মাধ্যমে
এর প্রায় ৫ বছর পর আমরা বেশ ভাল মানের ল্যাপটপ পাচ্ছি বেশ কম মূল্যেই (আগের তুলনায়)। এরপর আসল নেটবুক যা দিনে দিনে কিছুটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আর তারপরেই প্রতিযোগিতায় আসল ট্যাবলেট যা বেশ ভালই বাজার দখল করছে। তবে সবথেকে বড় চমকটি দেখিয়েছিল অ্যামাজন মাত্র ২০০$ এ বেশ ভাল মানের Kindle Fire বাজারে এনে। আর তারপরেই চ্যালেঞ্জ জানাতে সামনে এল ASUS। গুগলের সাথে তারা তৈরি করল নেক্সাস সিরিজের প্রথম ট্যাবলেটটি যা শুধু মূল্যেই বিশ্মিত করেনি কোয়ালিটিতেও চমক দেখিয়েছিল। মাত্র ২০০$ মূল্যের এবং Nexus 7 নামের ট্যাবলেটটি অ্যামাজনের ট্যাবলেট সহ সমমূল্যের সকল ট্যাবকে প্রায় সব দিক থেকেই পিছনে ফেলেছে।
নেক্সাস ৭ নিয়ে রিভিউ অনেকদুর পর্যন্ত লেখার পর চোখে পড়ল প্রিয়টেকেই প্রকাশিত “Shawnchoy.Rahman” এর চমৎকার একটি ইউজার রিভিউ। তিনি ট্যাবটি কিনে ব্যাবহার করছেন এবং সুন্দর একটি রিভিউ লিখেছিলেন। তার রিভিউটি খুবই তথ্য বহুল এবং খুবই বিশ্লেষনধর্মী। এবং আমার ধারনা তার রিভিউটি এই রিভিউ থেকে অনেক বেশি ভাল মানের। তার রিভিউটি পড়তে নিচের লিংক এ প্রবেশ করুন।
নেক্সাস ৭ ট্যাবলেট
হার্ডওয়্যারঃ
ট্যাবটির সমচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য দিক এর মূল্য হলেও সার্বিক ভাবে এটি একটি মাস্টারপিস। প্রথমেই আসি ডিজাইনের দিকে। ডিজাইনের দিক দিয়ে এটা সাধারন হাইএন্ড ট্যাবলেটের সমকক্ষের। এর পিছনে আছে রাবারাইজড ব্যাক প্যানেল। যা খুবই সুন্দরভাবে টেক্সার করা। এমনকি রাবারের হলেও কেউ কেউ সেটাকে লেদারের বলে ভুল করে বসতে পারে। ব্যাকপ্যানেলের উপরের দিকে আছে বেশ বড় NEXUS এর লোগো আর একেবারেই নিচে আছে ছোট করে ASUS এর লোগো। লোগোটির নিচেই আছে বেশ লম্বা আকৃতির একটি স্পিকার। ডিভাইসটির চার পাশেই আছে একটি সিলভার রিং যা মাঝে মাঝে প্লাস্টিকের মতও মনে হতে পারে। কিন্তু এর সলিড এবং মজবুত ডিজাইন একে আসলেই দারুণ ডিভাইসে পরিনত করেছে।
Galaxy Tab 8.0 vs Nexus 7 vs Galaxy Tab 2 7.0
এর মাইক্রো ইউসবি কানেক্টরটি আছে একেবারে নিচের দিকে মাঝখানে। আর তার বাম পাশেই আছে ৩.৫ মিলিমিটার হেডফোন জ্যাক। তবে হতাশার কথা হল যে কোন HDMI আউটপুট নেই ডিভাইসটিতে।
ডিভাইসটির পূরুত্ব ১০.৪৫ মিলিমিটার যা কিন্ডল ফায়ারের চ্চেয়ে মাত্র হাফ মিমি কম। কিন্তু ওজনের দিক দিয়ে আবার এটা বেশ হালকা। এর ওজন ৩৪০ গ্রাম (১২ আউন্স) অপরদিকে কিন্ডলফায়ারের ওজন ছিল ৪১৩ গ্রাম। হালকা ওজন এবং কার্ভ প্রান্তের জন্য এটি বেশ কম্ফোর্টেবল।
Galaxy Tab 8.0 vs Nexus 7 vs Galaxy Tab 2 7.0
নেক্সাস ৭ এ আছে NVIDIA Tegra 3 কোয়াড কোর প্রসেসর যার ক্লক স্পীড 1.2GHz। সাথে আছে ১ গিগাবাইট র্যা ম এবং ১৬/৩২ গিগাবাইট স্টোরেজ ( মূল্যে ৫০$ পার্থক্য )। তবে কোন এক্সটারনাল স্টোরেজ ক্যাপাসিটি নেই যা এর অন্যতম প্রধান একটি দূর্বলতা। আর ইন্টারনেট ব্যাবহার করার একমাত্র উপায় হল Wifi (802.11 b/g/n) অর্থাৎ সিম কার্ড ব্যাবহারের কোন সুযোগও নেই। এটি আরেকটি প্রধান দূর্বলতা যার জন্য অনেকেই মুখ ফেরাবেন এটা থেকে। পরে অবশ্য ৩২জিবি সেলুলার একটা ডিভাইস বাজারে এনেছে গুগল যার মূল্য ২৯৯$ ! আর ডিভাইসটিতে আরো আছে ব্লুটুথ, NFC, GPS, অ্যাক্সেলেরোমিটার, ডিজিটাল কম্পাস এবং এবং জাইরোস্কোপ।
ডিসপ্লে এবং সাউন্ডঃ
স্বল্পমূল্যের ট্যাবলেটের বাজেটের প্রভাব পড়ে এর স্ক্রিনের উপর। যেমনটি পড়েছিল Kindle Fire এর উপর। কিন্তু নেক্সাস ৭ এ ব্যাবহার করা হয়েছে খুবই ভাল ১২৮০*৮০০ পিক্সেলের আইপিএস প্যানেল যার ব্রাইটনেস ৪০০ নিটস। পিক্সেল ডেনসিটি ২১৬ পিপিআই। তবে যেহেতু যত পিক্সেল তত ভাল তাই নতুন আইপ্যাড ডিসপ্লের মান খুবই ভাল। তবে WXGA রেজুলেশনের ডিসপ্লেটি এই ডিভাইসটির জন্য যথেষ্ট। টেক্সট স্পষ্টো দেখা যায় আর ৭২০পি ভিডিওর কোয়ালিটি ও দারুণ এতে। এর ডিসপ্লের ভিউয়িং আঙ্গেল বেশ ভাল তা যে পাশ থেকেই দেখা হোক না কেন। ব্রাইটনেসও খুবই সন্তোষজনক। সবকিছু মিলিয়ে ডিসপ্লের মান খুবই ভাল এর মূল্যের তুলনায়।
এর অডিও কোয়ালিটিও বেশ ভাল মানের। পিছনের স্পিকারটি যথেষ্ট ভাল মানের সাউন্ড দেয়। এনগ্যাজেটের মতে, “It passes the "loud enough to fill a hotel room" test but the quality at those levels will leave you reaching for your earbuds.”। অর্থাৎ জোর বেশ ভালই থাকলেও খুব ভাল সাউন্ড কোয়ালিটি পেতে হেডফোনের বিকল্প নেই।
পারফরমেন্স এবং ব্যাটারি লাইফঃ
আপনি যদি রিভিউটি শুরু থেকে পড়ে থাকেন তবে আপনি দেখে থাকবেন স্বল্পমূল্যের তেমন কোন প্রভাব এখন পর্যন্ত পড়েনি ডিভাইসটিতে। এবং আরো ভাল খবর হল েই বিভাগেও তেমন কোন কম্প্রমাইজ করেনি গুগল বা আসুস।
এটা সত্য ৩৫ সেকেন্ড বুট টাইম আপনার কাছে কিছুটা অস্বস্তিকর লাগবে কিন্তু একবার ওপেন করার পর অ্যাপ্লিকেশান খুব দ্রুত লোড হয় এবং রেসপন্সও দ্রুত করে, এমনকি খুব বেশি গ্রাফিক্স সমৃদ্ধ “Google Play magazine” অ্যাপটি ও। ওয়েবসাইটের কনটেন্ট গুলো খুবই স্পষ্ট এবং নিখুন দেখায় এবং পেজে সুইপিংও হয় কোন ল্যাগ ছাড়া।
এবং যদি বেঞ্চমার্ক রিপোর্ট বিশ্বাস যোগ্য হয় তবে নেক্সাস ৭ এর বড়ভাই (বোনও বলতে পারেন !) নেক্সাস ১০ এর চেয়েও ভাল। SunSpidar টেস্ট এ এর স্কোর ১৭৮৫ এমএস, Vellamo তে স্কোর ১৬৫০ এবং CF- Bench এর স্কোর ১১,৭১৩ যার সবগুলিই খুব ভাল। তবে Quadrant এ স্কোর ৩,৫০১ যা তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম।
Nexus 7 vs ASUS Trans. Pad Inf. TF700 vs ASUS Trans. Prime
Quadrant........................3,501.....4,685........4,137
Vellamo.........................1,650.....1,475........1,418
AnTuTu..........................8,954.....12,027.......10,269
SunSpider 0.9.1 (ms)............1,785.....2,012........1,861
GLBenchmark Egypt Offscr........63 fps....75 fps.......68 fps
CF-Bench........................11,807....7,874........11,861
*SunSpider: lower scores are better
অনেক ভাল ভাল ডিভাইসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে গেমিং বা বড় কোন কাজের সময় গরম হয়ে যাওয়ার। নেক্সাস ৭ ও কিছুটা গরম হয়েছিল যখন বেঞ্চমার্ক পরীক্ষা করা হচ্ছিল তবে তা সামান্যই। উল্লেখ্য বেঞ্চমার্ক পরীক্ষার সময় ডিভাইসের প্রায় সকল হার্ডওয়্যার পরীক্ষা করা হয় তাদের পারফরমেন্স দেখার জন্য।
একটি ট্যাবলেট তখনই ভাল হবে যখন আপনি তা দীর্ঘসময় একনাগাড়ে ব্যাবহার করতে পারবেন। আর এদিক দিয়ে নেক্সাস ৭ এর ব্যাটারি পারফরমেন্স এককথায় চিত্তাকর্ষক। পরীক্ষাগারে একনাগাড়ে ভিডিও চালিয়ে প্রায় ১০ ঘন্টা ব্যাকআপ পাওয়া গেছে যা একটি ৭” বাজেট ট্যাবলেট হিসেবে অনেক বড় বড় দামী ট্যাবলেটকেই হারিয়েছে।
Tablet....................Battery Life
Nexus 7........................09:49
Samsung Galaxy Tab 7.7.........12:01
Apple iPad 2...................10:26
Acer Iconia Tab A510...........10:23
Samsung Galaxy Tab 10.1........09:55
Apple iPad (2012)..............09:52 (HSPA) / 9:37 (LTE)
Samsung GalaxyTab 2 10.1.......08:56
সফটওয়্যারঃ
নেক্সাস ৭ এ প্রথম কোন ডিভাইস যা এন্ড্রয়েড ৪.১ জেলিবিন নিয়ে বাজারে প্রবেশ করেছে। এবং সম্প্রতি এটা ৪.২ তেও আপডেট পেয়েছে। সুতরাং এন্ড্রয়েডের সর্বশেষ ভার্শন পাওয়া যাবে ট্যাবটিতে।
আগেই উল্লেখ করেছি হেভি গ্রাফিক্স সমৃদ্ধ Play Magazines অ্যাপটিও কোন ল্যাগ ছাড়াই স্বাভাবিক ভাবে চালানো যায় ট্যাবটিতে। এটার মত অন্যান্য অ্যাপগুলোও ভাল ভাবে চলে ট্যাবটিতে। পিঞ্চ ইন/আউট হাই কোয়ালিটি ট্যাবের তুলনায় কিছুটা লো কোয়ালিটির হলেও বেশ ভাল মানের। আর এর হাই রেজুলেশনের ডিসপ্লেকে ধন্যবাদ দেওয়াই যায় কারন এর কারনেই ছবি, ভিডিও এবং লেখা স্পষ্টো এবং নিখুঁত দেখা যায় ডিভাইসটিতে।
নেক্সাস ৭ এ আছে অসাধারণ একটি টুল "গুগল নাউ" যা অ্যাপলের সিরি এর চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন
আর নতুন একটী চমক থাকছে ট্যাবটিতে। ব্রাউজার হিসেবে দেওয়া হয়েছে গুগলের জনপ্রিয় ব্রাউজার “ক্রোম” এর এন্ড্রয়েড ভার্শন। এন্ড্রয়েডের আগের বোরিং ব্রাউজার থেকে এবার সবাই মুক্তি পাবেন বলে আশা করা যায়। ক্রোম ব্রাউজারটির এন্ড্রয়েড ভার্শনে রেন্ডারিং পারফরমেন্স বেশ ভাল আর সহজে নতুন ট্যাব খোলার দারুণ সুবিধাও থাকছে এতে। আর আপনি চাইলে আনইন্সটল ও করে দিতে পারেন আপনার ক্রোম ব্রাউজারটি। সম্প্রতি কিছু বিষয়ে অযথা কড়াকড়ি করা গুগল এই বিষয়ে এত উদার হল কেন সেটা আসলেই একটা রহস্য !
ইবুক পড়ার জন্য দারুণ একটি ডিভাইস নেক্সাস ৭
সমাপ্তিঃ
নেক্সাস ৭ আসলেই একটি অসাধারণ ডিভাইস যা বেশিরভাগ ব্যাবহারকারীই পছন্দ করবেন। আর সবথেকে আকর্ষনীয় দিক হল এর স্বল্পমূল্য যা মাত্র ১৯৯$ (১৬ জিবি) বা বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১৬,০০০ টাকা। কিন্তু এর দারুণ স্ক্রিন, সলিড পারফরমেন্স এবং সর্বশেষ ভার্শনের এন্ড্রয়েড ওএস একে মূল্যের তুলনায় খুব ভাল মানের ডিভাইসে পরিনত করেছে। এর হার্ডওয়্যার পারফরমেন্স এর সমপর্যায়ের যেকোন (কিন্ডল ফায়ার বা অন্যকিছু) ডিভাইসের চেয়ে অনেক উন্নত।
সুতরাং আপনি যদি একটি ভাল মানের কিন্তু ছোট স্ক্রিনের এন্ড্রয়েড ট্যাবলেট কিনতে চান এবং তার জন্য যদি খুব বেশি টাকা খরচ করতে অনিচ্ছুক হন তবে নেক্সাস ৭ হবে সবচেয়ে ভাল সমাধান। এর পারফরমেন্স, হার্ডওয়্যার এবং অন্যান্য সবকিছু মিলিয়ে আপনার মনেই হবে না আপনি একটি বাজেট এন্ড্রয়েড ট্যাবলেট ব্যাবহার করছেন।
বাংলাদেশী পাঠকদের প্রতিঃ
যদিও এর ১৬ জিবি ডিভাইসটির মূল্য মাত্র ১৯৯$ বা ১৬,০০০ টাকা (প্রায়) কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে এই ট্যাব বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২৬,০০০ টাকায়। অপরদিকে ২৯৯$ এর ৩২ জিবি সেলুলার (সিম কার্ড সাপোর্টেড) ডিভাইসটি বিক্রি হচ্ছে ৩৬,০০০ টাকায় যা আসলেই হতাশাজনক। একটি বাজেট এন্ড্রয়েড ট্যাবলেট আমাদের কিনতে হচ্ছে চড়া মূল্যে। যেহেতু গুগল আমাদের দেশে কার্যক্রম চালু করেছে সেহেতু আশাকরি দ্রুতই আমরাও যথাযথ মূল্যে তাদের পন্য তাদের কাছথেকে কিনতে পারব।
আর ট্যাবগুলো কিনতে পাওয়া যাচ্ছে বসুন্ধরা সিটির “গ্যাজেট এন্ড গিয়ার”, এলিয়েন ইলেক্ট্রনিকস সহ ভাল মানের প্রায় সকল দোকানে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৪৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন