দয়া করে একবার পড়েন
লিখেছেন লিখেছেন গরমিল ০৭ মার্চ, ২০১৩, ১১:২৩:০২ সকাল
কারা খেলছে হিন্দু কার্ড?
স ঞ্জী ব চৌ ধু রী
পালে হাওয়া এখনও পুরোপুরি লাগাতে না পারলেও বাংলাদেশে ‘হিন্দু কার্ড’কে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহারের খেলা যে শুরু হয়ে গেছে, এ সত্য দেশের সচেতন মানুষমাত্রেরই অনুভব করতে পারার কথা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে অভিযুক্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে তার ফাঁসি দাবি করে রাজধানী ঢাকার শাহবাগ চত্বরে একদল তরুণের নেতৃত্বে সমাবেশ শুরু হয়। এ সমাবেশ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এ পর্যন্ত অভিযুক্ত ১২ জনের প্রত্যেককে ফাঁসি দেয়ার দাবি জানানো হতে থাকে। এদিকে শাহবাগ চত্বরে অনুষ্ঠানরত সমাবেশের উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ফেসবুকে দীর্ঘদিন ধরে নিজ নিজ ব্লগে ইসলামবিরোধী কুিসত লেখালেখি করে আসছিল—একথা জানাজানি হওয়ার পর পর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তো বটেই, যারা নিয়মিত ধর্মীয় আচারাদি পালন করে না, তেমন মুসলমানরাও মর্মাহত এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এই বিক্ষোভ মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থান নিলে পরিস্থিতি রক্তাক্ত হয়ে অবনতির দিকে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের তৃতীয় রায়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলে জামায়াতে ইসলামী হরতালের ডাক দেয় এবং পুলিশের গুলিতে, বিক্ষোভকারীদের হামলায়, ভয় থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত কয়েক দিনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে।
এ পটভূমিতে খবর আসতে থাকে যে, দেশের কোনো কোনো এলাকার হিন্দু ও বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা ব্যাপকতা লাভ করেনি—এ কথা যেমন সত্য, বুধবারের পত্রিকাতেও আগের দিন হিন্দুবাড়িতে ও মন্দিরে হামলার বিবরণ ছাপা হয়েছে এ কথাও সমান সত্য। এক কথায়, যারা হামলার শিকার হননি, তাদের দৃষ্টিতে ‘ছোটখাটো’ মনে হলেও এ ধরনের হামলা থামছে না। এবারকার চলমান হামলার বৈশিষ্ট্য হলো, কারা এ হাঙ্গামা-হুজ্জত করছে, তা ঠিকমত শনাক্ত করা যাচ্ছে না। সরকার এবং সরকার সমর্থক মিডিয়া বলছে, সংখ্যালঘুদের ওপর এসব আক্রমণ জামায়াত-শিবিরের কাজ। অপরদিকে বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া হিন্দুদের বাড়িঘরে চলমান আক্রমণের জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী কাউকে দায়ী না করলেও বিবৃতি দিয়ে এবং পত্রিকার বিজ্ঞাপন দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে ও মন্দিরে হামলার কঠোর নিন্দা করেছে। এই অপকর্মের সঙ্গে জামায়াত-শিবির যে জড়িত নয়, তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে এবং যে কোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। বর্তমানে চলমান এসব হাঙ্গামার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, হামলা চালানো হচ্ছে অপ্রত্যাশিত জায়গায়। যেসব এলাকায় ধর্মনির্বিশেষে লোকজন সতর্ক আছে, সেখানে কেউ গণ্ডগোল পাকাচ্ছে না।
প্রশ্ন হলো, কেউ না কেউ তো ভাংচুর চালাচ্ছে, অগ্নিসংযোগ করছে। পারস্পরিক দোষারোপের প্রতিযোগিতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে নির্মোহভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে, হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে থাকলে কাদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা। জামায়াতে ইসলামীকে এমনিতে ‘সাম্প্রদায়িক দল’ বলে গালমন্দ করা হয়। তদুপরি এ দলের শীর্ষ নেতারা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাবন্দী আছেন। দলের প্রথম সারির বহু নেতা নানা মামলার আসামি হয়ে কারাগারে। এ পরিস্থিতিতে যদি হিন্দুবাড়ি ভাঙতে গিয়ে অথবা হিন্দুমন্দিরে আগুন লাগাতে গিয়ে কোথাও জামায়াত-শিবিরের একজন সদস্যও ধরা পড়ে, তবে দলটিকে ভীষণ বেকায়দায় পড়তে হবে। এটা সাধারণ আক্কেল-জ্ঞানের কথা। অপরদিকে জনমতের হাওয়া যে এখন বিএনপির দিকে ভালোভাবে ঘুরে গেছে, সেটা যে কোনো নিরপেক্ষ মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে যে মহাজোট সরকারের ‘প্রগতিশীলতায়’ হতাশ এবং বিতশ্রদ্ধ হয়ে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে, সে লক্ষণও অস্পষ্ট নয়। সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের ‘চেক বাউন্স’ হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীর ধরাশায়ী হওয়ার পটভূমিতে বিএনপি হিন্দু সেন্টিমেন্টকে নিজের প্রতি বিরূপ করার জন্য হিন্দুদের বাড়িতে চড়াও হবে, তেমন কষ্টকল্পনাকে প্রশ্রয় না দেয়াই ভালো।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হিন্দুদের ‘কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত’ করে সেই ক্ষতির দায় বিএনপি ও জামায়াতের ওপর চাপাতে পারলে মহাজোট সরকার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো নানামুখী ‘রোগের’ আক্রমণ থেকে রেহাই পাবে। বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিপনার উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে এবং এ আশঙ্কা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় আওয়ামী পতাকাতলে সমবেত হওয়া—এটাই হচ্ছে দেশে-বিদেশে আওয়ামী রাজনীতির পক্ষে সমর্থন সুসংহত করার সবচেয়ে যুত্সই রেটোরিক। হিন্দুর মন্দিরে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠলে ‘দেখ দেখ মুসলমান জঙ্গিরা ধেয়ে আসছে’ বলে প্রচার চালানোর সুযোগ জোরালো হয়। এ সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকার তথা আওয়ামী লীগ হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে আগুন লাগানো এবং ভাংচুরের মতো অপকর্ম করতে পারে বলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অভিযোগ সরকার জোরালোভাবে খণ্ডন করতে পারেনি অথবা খণ্ডন করার প্রয়োজনবোধ করেনি। ফলে একটা প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে যে, হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে ক্রমাগত হামলার পর আমাদের অতিদক্ষ পুলিশ, র্যাব, ডিবি কেন ‘সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত’দের ধরতে পারছে না। এদিকে বগুড়ার শেরপুরে শহীদ মিনার ভাঙতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে এক যুবলীগ নেতা। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কার্যালয়ে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে আওয়ামী লীগের এক কর্মী নিহত ও চারজন আহত হয়েছে। সব মিলিয়ে যে ছবি ফুটে উঠছে, তাতে ‘জঙ্গি এলো দেশে’ স্লোগানটিকে বিশ্বাসযোগ্য করা যাচ্ছে না। বরং উপর দিকে নিক্ষেপ করা থুথু যেন নিজের কপালে এসে পড়তে চাইছে। ফলে ‘হিন্দু কার্ড’ খেলে ফায়দা আদায়ের সুযোগও হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত।
আমি একজন বিশ্বাসী হিন্দু। হিন্দুদের ওপর যে কোনো আক্রমণ অথবা আক্রমণের আশঙ্কা আমাকে উদ্বিগ্ন করে। এখনও সে উদ্বেগ কমেনি। অবশ্য উদ্বেগ যে বাড়েনি, তার প্রধান কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মুসলমান পালা করে হিন্দুদের বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছে বলে আমি খবর পেয়েছি। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখন ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী কুিসত প্রচারণায় বিষণ্ন ও ক্ষুব্ধ। পাশাপাশি এই বিদ্বেষের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নে তারা ক্ষত-বিক্ষত। তারপরও তারা হিন্দু ভাইবোনদের জান-মাল-ইজ্জতের হেফাজত করার জন্য সক্রিয় হয়েছেন। এটাই তো প্রজ্ঞার চেতনার বিজয় অর্জনের ইশারা। সব ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের সমবেত প্রতিরোধে ‘হিন্দু কার্ড’, ‘জঙ্গি কার্ড’সহ সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। ধর্মপ্রাণ মানুষের মিল-মহব্বতের ভিতের ওপর গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ইমারত কোনো ষড়যন্ত্রের ঝড়ো হাওয়ায় ভেঙে পড়বে না—এই বিশ্বাস আমার উদ্বেগকে বাড়তে দিচ্ছে না।
বিষয়: বিবিধ
৯৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন