‘হিমু’র হাতে ধুমায়িত নিকোটিন!
লিখেছেন লিখেছেন সর্বহারা ১৬ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৯:০৭:২৭ রাত
মানুষ হয়ে জন্মেছি একটু ভুল না করলে কি চলে? মনুষ্য জনমতো তাই বারবার ভুল করি, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আবারো ভুল করি। ভাবটা এমন; যেন ভুল করতেই জন্ম নিয়েছি? তারপরও থেমে নেই জীবন নামের এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের একমুখী যাত্রা। অধিক পরিমানে দুঃখ আর কিঞ্চিৎ সুখ নিয়ে কেটে যায় কাঙ্ক্ষিত মানব জনম। সুখের সময়টা মানুষ অতি সহজে পার করে দেয় বলেই মুহুর্তটাকে অধিক ক্ষুদ্র মনে হয়। অপরদিকে দুঃখটাকে বেশী স্থায়ী মনে হওয়ার কারণ হলো -আঘাত থেকে ক্ষতের সৃষ্টি হয় অতঃপর মানসপটে তা কষ্ট হয়ে ভাসে। কষ্টটা সাময়িক হলেও আঘাতটা স্থায়ী। তুঁষের আগুনের মত আঘাত থেকে কষ্ট উৎসারিত হয় অহর্নিশ। সুতরাং ভাবনাটা আসে ‘আসেলেই মানুষ বড্ড বেশী দুঃখী’। মেনেই নিলাম ‘মানুষ একটা দুঃখ মিশ্রিত রক্ত মাংসের আবরন। কথায় আছে- “দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিসের?” তাই দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা কে নিক্ষেপ করে সুখের সন্ধানে চলিলাম।
যখন কিছুই ভাল লাগেনা তখন ইচ্ছে করেই রুমের জানালা-দরজা বন্ধ করে নিজের মত থাকি। জাগতিক পরাকাষ্ঠা থেকে দূরে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করি। গতকাল রাত ছিলো তেমন একটি রাত, তাই অনেকক্ষণ নিজের রুমেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম। কিন্তু রুমেও নিজেকে সেভাবে মানিয়ে নিতে পারছিলামনা। কি করলে এখন নিজেকে প্রগাঢ় প্রশান্তিতে ভাসিয়ে রাখা যাবে? ভাবছিলাম আরো কত কি? অতঃপর মনের বাতায়ন উন্মুক্ত করে রুমের বাতায়ন খুললাম। কি আশ্চর্য! নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছে, এত চমৎকার জোসনা! অথচ আমি ঘরে একা বসে আছি। মনকে আর বাঁধা দিতে পারলাম না। নেমে পড়লাম নিজের আত্নাকে উদ্বেলিত করবো বলে আমার প্রিয় ‘জোসনা বিলাসে’। একা একা জোসনায় হাটার মজাই আলাদা। অন্যরকম ভালো লাগায় নিজেকে মাতিয়ে নিলাম। পুরোপুরি পথিক হয়ে গেলাম ক্ষণিকের মধ্যে জন-মানবহীন খোলা আকাশের নিচে। উদ্দেশ্যবিহীন পথচলা শুরু হলো আমার। নিস্তব্ধ রাস্তা ধরে আমার ক্লান্তিহীন পথচলা চলতে থাকে।
মেঠো পথ ধরে খালি পায়ে শিশির মাড়িয়ে চলে যাবো অনেক দূর। আমার প্রিয় গ্রামের সবকিছুই যেন আমার অতি চেনা। ঘর হতে বের হতেই জোসনার আলোর ঝিলিক। কাঁঠাল গাছের পাতার মধ্য হতে জোসনার আলো ঠিকরে পড়ছে রাস্তায়। হালকা বাতাসে দুলছে গাছের পাতাগুলো আর জোসনার আলোর লুকোচুরি চলছে বিরামহীন নিয়মে। নিজেকে অনেক সুখী ভাবতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু ইচ্ছে করলেও পারলাম না। আজকাল মানুষের কাছ থেকে সুখ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে তাই যাবতীয় আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র এই প্রকৃতির অবিরাম সৌন্দর্য। প্রকৃতির এই বিচিত্র আবহে নিজেকে মানিয়ে নিতে খুবই সহজ হলো। হালকা বাতাসে হৃদয়ে মৃদু স্পন্দন দিয়ে যাচ্ছিলো। জোসনার আলো এবং বাতাস যেন আমার কানে-কানে বলে গেলো- ‘হে পথিক তোমাকে পেয়ে আমরা ধন্য’।
স্কুলের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়ালাম। এই কৃষ্ণচূড়া গাছটা আমার অধিক প্রিয়, নিজ হাতে লাগিয়েছিলাম বলেই বোধ হয় মায়াটা একটু বেশীই। কিবা আনন্দ কিবা দুঃখ সবসময় এখানে আসলেই কেমন জানি মনটা রঙ্গিন রঙ্গে আটকে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। চারিদিকে শুনশান নিরবতা ভেঙ্গে কি আনন্দে যেন ঝিঁঝিঁ পোকারা কালক্ষেপণ না করে ডেকেই চলেছে। হতে পারে তাদের মনে হয় কাল ক্লোজ আপ ওয়ান ‘Singer Hunt’ টাইপের কোন প্রোগ্রাম আছে তাই রেওয়াজ করে কন্ঠের পরিচর্যা করছে। জিততে পারলেই লাখ টাকার পুরষ্কার! কি বিচিত্র হবে সেই কাহিনী। পত্র পত্রিকাতে হর-হামেশায় তাদের নিয়ে প্রচ্ছদ ছাপা হবে। তারপর যে ঝিঁঝিঁ পোকাটা পুরষ্কার জিতবে সে নিশ্চয় সবাইকে ডেকে পার্টি দিবে। আচ্ছা তাদের প্রিয় খাবার কি? তারা কি খাবারে হলুদ, লবন খায়? যদি কোন পুরুষ ঝিঁঝিঁ পোকা পুরষ্কারটা পায় তাহলে নিশ্চয় নারী ঝিঁঝিঁ পোকারা বিবাহের জন্য লাইন দিবে! আর যদি নারী হয় তাহলে পুরুষেরা অত্যাধিক মানের ফান হয়ে ফেইসবুকে হাজার খানিক পেজ খুলবে! কি জনপ্রিয়তা! আচ্ছা তাদের মাঝে কি মাস্তান গোছের কেউ থাকে নাকি? যদি থাকে তাহলে নিশ্চয় তাকে মোটা অংকের টাকা দিতে হবে চাঁদা হিসেবে। যদি দিতে না চায় তাহলে নিশ্চয় তাকে গুম করার হুমকি দিবে।
আপাতত ঝিঁঝিঁ পোকার কাহিনীটা মাথা থেকে ধামাচাপা পড়ে গেলো, কেউ একজন আমার দিকেই আসছে দেখে। অবয়বটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করলো। কিন্তু কাছে আসার পরও তাকে চিনতে পারলাম না। কাছে আসতেই পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম।
-আমি মুহি। আপনি?
- জ্বী আমি পথিক, এক দিকভ্রান্ত ফেরারী পথিক; তবে সুখী মানুষ।
-শুধুই পথিক, নাম নাই?
-আগে ছিলো এখন নাই
-আগে ছিলো এখন নাই, সে আবার হয় নাকি?
-নামটা না জানা থাকলেও কিন্তু আমরা কথা বলতে পারছি তাহলে নামটা নিশ্চয় তেমন জরুরী নয়।
নামের ঝামেলায় না গিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,
- জোসনা দেখতে বের হয়েছেন বুঝি?
- হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।
- আপনিও কি তাই?
- হ্যাঁ
দু’জনের উদ্দেশ্য যেহেতু এক সেহেতু চলেন হাঁটি! নাম না জানা ব্যক্তির কথাকে অগ্রাহ্য না করেই তাকে সঙ্গি করে শুরু করলাম আজকের জোসনা রাতের হন্ঠন প্রক্রিয়া। লোকটাকে কেমন জানি রহস্য মানব টাইপের লাগছে। তবে সাধারণ মানুষ থেকে অনেক আলাদা এবং তাকে এর আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না। বলা যায় নিশ্চুপ থাকতেই বেশি পছন্দ করছে। মলিন একটা পাঞ্জাবী গায়ে,পাঞ্জাবীর রঙটা কি ছিলো বুঝা মুশকিল, মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি। চুলগুলো উস্কোখুস্কো হয়ে পাখির বাসার মত লাগছে। রোগাক্রান্ত বললে খুব একটা ভুল হবে না। বোঝা যাচ্ছে নিজেকে তেমন যত্ন করে না। তারপরও কেমন জানি ভাল লেগে গেলো তাকে। সাধারনত এই ধরনের মানুষের মাঝে ঈর্ষা নামক শব্দের ব্যবহার্য কম থাকে। কি যেন এক টানে লোকটাকেআপন মনে হতে শুরু করলো।
আপন যেহেতু লাগছে তাই অধিক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম;
- থাকেন কোথায়?
- থাকার তেমন স্থায়ী জায়গা নেই তবে থাকতে অসুবিধা হয় না। আপনি যেমন আমার সঙ্গি হলেন আজকের রাতের জন্য, তেমনি সবাই এভাবেই আপন করে নেয়। আর সবার কিন্তু স্থায়ী থাকার জায়গার দরকার হয়না। জায়গা স্থায়ী হওয়া মানেই কিছু স্থায়ী সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া। আমার তেমন স্থায়ী সম্পর্ক কারোর সাথে নেই। হয়তো কোন দিনও হবে না।
- কথার মাঝে কেমন জানি আক্ষেপ খুঁজে পেলাম। বুঝতে দেরী হলোনা নিশ্চয় তিনি কষ্টের নিকোটিনে জর্জরিত। ধরেই নিলাম তিনি কষ্টে আচ্ছন্ন কিন্তু তিনিতো প্রথমেই পরিচয় দিলেন একজন ‘সুখী মানুষ’। তবে কি? না থাক! অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কেন জানি করতে পারলাম না।
আমি তাকে আর কোন প্রশ্ন না করেই চলতে শুরু করলাম। গন্তব্যহীন পথে হাটার মাঝে এক ধরনের আনন্দ আছে। হাঁটতে হাঁটতেই কিসের যেন সু-ঘ্রাণ আমাকে দোলা দিয়ে গেলো। দোলা দিয়ে গেলো কারণ এ যে আমারই প্রিয় কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। শুরুতেই প্রিয় কিছু পেয়ে যাওয়াতেই মনে হলো আজকের রাতের পথিক হওয়াটা স্বার্থক। কতটুকু হেঁটেছি তার হিসাব নেই। বেশ কিছুটা পথ হাটার পরে একটা বট গাছের নিচে দাঁড়ালাম। একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় কিনা চিন্তা করছিলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই আগন্তুক লোকটা শান বাধানো বট গাছের নিচে বসে পড়লেন এবং আমাকেও বসতে বললেন। একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে নিয়ে বললেন- সিগারেট খান নাকি? আমি না বলতেই উনি একটা সিগারেট বের করে আগুন জ্বালালেন। বুঝলেন মুহি সাহেব, আমিও একসময় সিগারেট খেতাম না কিন্তু এখন খায়। কেন খায় এটা জিজ্ঞেস করবেন না। আমার আবার কৌতুহল একটু বেশী তার উপর উনি ‘নিষেধ’ নামক শব্দটা যোগ করাতে কৌতুহলের রাশি দ্বিগুন মাত্রা যোগ হয়ে মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সিগারেট খাওয়ার পেছনেও কোন কাহিনী থাকে নাকি? ভাবনার গভীরে মানুষের উচ্ছলতা নিয়ে ভাবতেই বড্ড বেশী ভালো লাগে। আচমকা ভাবান্তর ঘটালো, আমি যার সাথে হাঁটছি তার নামটা পর্যন্ত এখনো জানা হলোনা। কেন জানি লোকটার নাম খুব জানতে ইচ্ছে করলো কিন্তু তার নামের ব্যাপারে নাক সিটকানি দেখে আর জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলোনা।
হঠাৎ আমার চিন্তার রশি কেটে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি করেন আপনি? আমি অতি সাধারন ভাবে উত্তর দিলাম- ইচ্ছের বিরুদ্ধে পড়ালেখা করি আর ইচ্ছের মধ্যে বলা যায় সুখের অনুসন্ধান করি। আমার উত্তরে উনি খুশি হলেন কিনা জানি না। তাকে খুশি করার জন্য যে আমি উত্তরটা দেয়নি এটা উনি বুঝতে পেরেছেন বোধহয়। ধীরে ধীরে জোসনার উজ্জলতা কমতে শুরু করেছে। কিছু উটকো মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের সাথে মেঘের লুকোচুরি দেখতেও খুব একটা খারাপ লাগছে না। আমি মানুষটাকে দেখছি, তিনি একনিষ্ঠ মনে চাঁদের দিকে চেয়ে আছেন। চাঁদকে তার বড্ড বেশী আপন মনে হলো। যেমন করে সিগারেট খাচ্ছেন তেমন করে চাঁদটাকে গিলে খেতে পারলে উনি মনে হয় খুশি হতেন।
হঠাৎ চোখ মেলেই কাউকে আর কাছে পেলাম না। কোথায় আছি এটাও বুঝতে পারছিনা। কিছুক্ষন চোখ ডলাডলি করে আবিষ্কার করলাম শান বাঁধানো বট গাছের গোড়ায় আমার অবস্থান। তার মানে কি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? না! স্বপ্ন দেখলেতো ঘরের বেডে শুয়ে থাকতাম। কিন্তু আমি যে বট গাছের তলায়! তাহলে কি কাল রাতে হাঁটতে হাঁটতেই এখানে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছি? তাই হবে হয়তো। কিন্তু আমার সাথে যিনি ছিলেন তিনি কোথায়? মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকালাম কিন্তু কোথাও তাকে পেলাম না। শুধু আমার মাথার কাছে একটা ভাঁজ করা কাগজ পেলাম। কাগজটাতে মাত্র দুইটা ভাঁজ। তবে কাগজটার উপর সিগারেটের প্যাকেটটা রাখা আছে যাতে কাগজটা উড়ে যেতে না পারে। সিগারেটের প্যাকেটটা দেখে চিনতে কষ্ট হলো না যে, এটি কাল রাতের অগন্তুকের সিগারেটের প্যাকেট। আর দেরি না করেই কাগজের ভাঁজ খুললাম।
“ মুহি সাহেব, জগতে কিছু ভাল মানুষ আছে বলেই জগতটাকে অনেক বেশী সুন্দর মনে হয় বলতে দ্বিধা নেই বলতে আপনিও তাদের মধ্যে একজন। আমি আপনার নাম শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম অনেক কিছুই। তাই আর নিজের নামটা বলতে ইচ্ছে করছিলো না। পারতপক্ষে এখন আর কাউকে আমার আসল নামটা বলি না। বলতে ইচ্ছে করেনা। আমি জানি, আপনি একজন সুখসন্ধানী মানুষ। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। সুখের খোঁজেই আজও পথে পথে ঘুরি। এবার নাম প্রসঙ্গে আসি, আমার নাম ‘হিমু’ আপনাদের ‘হিমু’। যাকে আপনি নিজের মাঝে ধারণ করেন এবং ‘হিমু’ শব্দটাকে উল্টিয়ে নিজের নাম দিয়েছেন- মুহি । ভাল থাকবেন, হয়তো দেখা হবে অন্য কোন পথের পথিক হয়ে।”
ইতি- ‘হিমু’।
বিষয়: বিবিধ
১৯১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন