সুখের অসুখ
লিখেছেন লিখেছেন সর্বহারা ২০ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:১৩:০৫ সকাল
লোকটা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
শুধু আজকে এভাবে তাকিয়ে আছেন ব্যাপারটা সেরকম না। তিনি প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকেন। এতে নাকি তার কর্মের সাথে ব্যক্তিগত ইমেজ ঠিক থাকে। যিনি বসে আছেন তার নাম ফকির মিয়া। ভাল নাম শমসের আহমেদ ফকির শাহ্ কিন্তু সবাই ফকির নামেই ডাকে। নামের সাথে তার আর্থিক অবস্থার দারুণ মিল। এজন্য সবাই তাকে ‘ফকির’ নামে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
মুখ ভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি। এলোমেলো চুল- দেখতে অনেকটা পাখির ভাঙ্গা বাসার মত। লোকটিকে দেখলেই বুঝা যায় -অতি দূর্দশাগ্রস্থ অবস্থা। পেশায় তিনি একজন মন্ত্রসাধক। বর্তমানে আয়-উপার্জন কম। দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধহারে কাটছে। এ জামানায় মন্ত্রসাধকদের কদর খুব কম। আধুনিক যুগের ঔষধের কাছে ঝাড়ফুঁক এখন নস্যি পর্যায়ে চলে গেছে। ফকির মিয়ার এখন আর আগের মত কেউ ডাকে না। একসময় তাকে ছাড়া রোগমুক্তি অসম্ভব ছিলো। ঝাড়ফুঁক করেই কোনরকমে সংসারটাকে এই পর্যন্ত টেনে এনেছে।
ফকির মিয়ার স্ত্রীর নাম বিউটি বেগম। নাম বিউটি হলেও বর্তমানে অবস্থা বিপরীত। রোগাক্রান্ত জীর্ণ অবস্থা। সারাদিন মেজাজ থাকে খিটখিটে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গালা-গালি করে। ফকির মিয়ার স্ত্রীর অধিক রাগ জন্ম নিয়েছে তার স্বামীর উপর। কারণ, সে যদি ঝাড়ফুঁক করেই অন্যের রোগ ভাল করে দিতে পারে, তাহলে সে কেন আমার রোগ ভাল করে দিতে পারে না! আসলে লোকটা ঝাড়ফুঁক এর নামে মানুষকে ঠকায়। স্ত্রী গালা-গালি করে এজন্য তিনি পারতপক্ষে স্ত্রীর আশেপাশে থাকতে চা না। কারণ এসব নাকি তার ভাল লাগে না! বয়সের একটা পর্যায়ে এসে মানুষ অন্যের কথা শুনতে পছন্দ করে না। বয়সের ভারে বিষন্নতা বাড়তে থাকে। মেজাজ হয় চড়া। চড়া মেজাজ অনেকে কন্ট্রোল করতে পারে। বেশিরভাগই পারেনা। আজ ফকির মিয়া তার স্ত্রীর উপর ত্যাক্ত-বিরক্ত তাই মেজাজটাও চড়া!
‘মনে কয় তোমারে বান মাইর্যা মুখটা বন্ধ করে দিই চিরতরে।’
‘দেন, দেন না কেনো? বান জানলেতো বান মারবেন।’
‘অসুস্থ্য মানুষের উপর বান মারার নিয়ম নেই, নইলে কবেই দিতাম তোমারে ভ্যানিশ করে।’
‘আপনের ঝাড়ফুঁক আমি ভালই টের পেয়েছি, আসলে আপনি কিছুই জানেন না।’
‘তুমি বলতে চাচ্ছো আমি মন্ত্র পারিনা!
‘কি পারেন সেটা অন্য কেউ না জানলেও আমি জানি। আপনেরর মত ভন্ড লোকের সাথে সংসার করতে হবে বিবাহের আগে জানলে গলায় ফাঁস নিতাম’।
বুঝতে আর বাকি রইলো না বিউটি বেগম চরম মানের ক্ষিপ্ত। তার মেজাজও ক্ষিপ্ত কিন্তু সহ্য নিয়ে কথা বলছে। সাধারণত কেউ তার বিদ্যা নিয়ে কথা বললেই তিনি ভেঙ্গে পড়েন। মেজাজ কন্ট্রোল করেন। যুক্তি এবং গল্প দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন তার মন্ত্র বিদ্যা নকল না। আসল। তাহলে তোমাকে একটা গল্প বলি, শোনো! এই গল্পটা ফকির মিয়া প্রায় বলে। তার গ্রামের মোটামুটি সবাই জানে।
মাঘ মাসের শেষের দিকের ঘটনা। গল্পটা অবশ্য একটা ইতিহাস। প্রচন্ড শীতের মধ্যে চেয়ারম্যান মতি খাঁ আমাকে খবর পাঠালেন। সাথে ঘোড়ার গাড়ি..’ সবার জন্য কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব ঘোড়ার গাড়ি পাঠায় না। আমাকে একটু বেশী মান্য করে বলেই ঘোড়ার গাড়ি!
‘আপনের গল্প থামান, নইলে কিন্তু হেস্ত-নেস্ত হয়ে যাবে।’
‘আরে শোনো, মন ভাল হয়ে যাবে। চেয়ারম্যানের বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি মানুষ গিজ-গিজ করছে। মনে হচ্ছে মানুষের দোকান বসেছে। ঘটনা হল, তার পুত্রের সাপে কেটেছে। সব ডাক্তার-হেকিম ফেল! এজন্য আমার ডাক পড়েছে।’
এপর্যন্ত বলার পরপরই ফকির মিয়ার স্ত্রী বিউটি বেগম হাতের পাশে থাকা ঝাঁটা ছুড়ে মারে। অল্পের জন্য রক্ষা।
‘আপনি আর কখনো এসব গাল-গল্প আমার সাথে করবেন না। আপনের উপর ঘিন ধরে গেছে।’
স্ত্রীর উপর অভিমান করে রাস্তার পাশে উদ্ভ্রান্তের মত গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ফকির মিয়ার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, আজ বাড়িতে খাওয়ার কিছু নেই। এজন্য তার উপর বিউটি বেগম অতি ক্ষিপ্ত। শুন্য উননে দিন পার হবে ভাবতেই তার খারাপ লাগছে। নিজের উপর নিজেই ত্যাক্ত-বিরক্ত। একমাত্র ছেলেটিকেও না খেয়ে থাকতে হবে। ফকির মিয়ার নিজের জন্য তেমন চিন্তা হয় না। সমস্ত চিন্তা এই ছেলেকে নিয়ে।
ফকির মিয়ার একমাত্র ছেলে ‘শান্ত’। ভাল নাম শান্ত ইসলাম। নামের সাথে তার ব্যবহারেও রয়েছে দারুণ মিল। শান্ত ‘অতি’ ভাল ছেলে। শুধু একটা ‘অতি’ বললেও কম করে বলা হবে। কমপক্ষে তিন বার ‘অতি’ বলা উচিৎ। শান্ত একটা অতি অতি অতি ভাল ছেলে। এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। পড়ালেখায় মাশাল্লাহ লেবেলের ভাল। সংসারে অশান্তি থাকলেও এই ছেলেটা নিজ প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত এসেছে। পিতা ফকির মিয়ার ইচ্ছে ছেলেকে মস্ত মন্ত্রসাধক বানাবেন। কিন্তু ছেলে এবং ছেলের মা বিষয়টা মানতে রাজি না। যেখানে পিতার মন্ত্রবিদ্যায় নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থা সেখান থেকে বড় কোন স্বপ্ন দেখাও দুঃসাধ্য! স্বপ্ন দেখতে হলে যতটুকু উদ্যমী হওয়া দরকার শান্ত তার থেকেও বেশী উদ্যমী।
আষাঢ়ের কোন এক মধ্যদুপুর। চারিদিকে ঝুম বৃষ্টি। প্রকৃতি তার আপন আলোয় উদ্ভাসিত। ফকির মিয়া’র মাঝে মধ্যে বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস আছে। এতে নাকি তার ব্যামো কমে। কিন্তু আজ তার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে অন্য কারনে। স্ত্রীকে নিয়ে ভিজতে পারলে ভাল হত। পরক্ষণেই চিন্তা করলো একজন অসুস্থ্য মানুষের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার মধ্যে কোন ফায়দা নেই। ফায়দা ছাড়া পুরুষ মানুষের কিছু করা ঠিক না! শেষমেশ বৃষ্টিতে ভেজার চিন্তাটা বাদ দিলেন। মন খারাপ করে ঘরের বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে খারাপ লাগছে না তার। অনেক ধনীরাও মন খারাপ করে দুঃখী দুঃখী ভাব ধরার অভিনয় করেন। সুখকে উপলব্ধি করার জন্য। গরীবদের অভিনয়ের সুযোগ নেই। যা আছে তার সবটাই বাস্তব।
প্রকৃতি মাঝে মাঝে কারো কাছে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। কখনো বা ধরা দেয় কপালের দ্বার উন্মোচন করে। সময়ের ধারাবাহিকতায় কপাল খুলেছে ফকির মিয়ার। তিনি আজ একটা বায়না পেয়েছেন। বায়নার খুশিতে তার চোখ চক-চক করছে। খুব ইচ্ছে এবার যদি কিছু আয় হয় তাহলে পোলাও ডিম খাবে। মোরগ পোলাও খাওয়ার সাধ্য তার নেই। গরীবের ঘোড়া রোগ থাকতে নেই এটা ফকির মিয়া ভাল করেই জানে। জগতে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের হিউমার সেন্স অনেক শিক্ষিত মানুষের চেয়ে ভাল। ফকির মিয়া তাদের একজন।
দিনশেষে হাতে মাইনে আসার পর হঠাৎ ফকির মিয়ার চিন্তায় ছেদ পড়ে। তার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আনন্দ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন চোখে পানি আসে। এই পানি সবার আড়ালে রাখতে হয়। ফকির মিয়ার চোখের কোণা ভেজা। কেউ দেখার আগেই সেটা হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে ফেলেন। মুছে ফেলার পরও পানি আসছে। মাঝে মাঝে মানুষ তার চোখের পানির উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। কারণে-অকারণ পানি পড়তেই থাকে। ফকির মিয়া বেজায় আনন্দ নিয়ে বাজার করলেন। এত আনন্দ গত কয়েক বছরে পেয়েছেন বলে মনে করতে পারছে না। সন্ধ্যার একটু আগে বাজারের থলে এনে তার স্ত্রীর হাতে দিলেন। স্ত্রীর মন ভাল করার উপায় তিনি ভুলে গেছেন। ভুলতে বসেছেন জাগতিক মোহ-মায়া। একটু ভাল থাকার তাগিদে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করেও বেঁচে থাকাটা আজ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাজারের থলে হাতে পেয়ে- মলিন চেহারাতে বিউটি বেগমের চোখেও আনন্দের রেখাপাত সুস্পষ্ট। বিদ্যুৎ যেমন সারা বাড়ি আলোকিত করে। একটা বাজারের ব্যাগও তেমনি তাদের মুখে আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। অনেকদিন পর আজ তাদের ঘরে ভাল খাবারের আয়োজন হচ্ছে। শুধু এতটুকু ভেবেই মনে-মনে সবাই বিমলানন্দ অনুভব করছে। একটু ভাল থাকার আনন্দ, বেঁচে থাকার আনন্দ।
মন্ত্রসাধক আজ মনের খুশিতে সাবান দিয়ে গোসল করে চোখে সুরমা লাগিয়েছেন। বালিশের নিচে টান-টান করে রাখা জামাটা পরেছেন। আয়নায় নিজের চেহারাটাও চিনতে কষ্ট হচ্ছে। সবকিছুকেই আগের চেয়ে সুন্দর লাগছে, আকাশের চাঁদটাও আজ তার কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশী অরুণিমা। এমন কি রোগাক্রান্ত বিউটি বেগমকেও নব-বধূর মত লাগছে। রাতের আহার শেষে স্ত্রীর সাথে বসে এক খিলি পান খাবে এবং অনেক গল্প করবেন- এই চিন্তাটাও তিনি করে রেখেছেন।
পেটে ভাত থাকলে মনে শান্তি আর অসুন্দর কেও সুন্দর লাগানো যায়। এই চিন্তাটা তার মাথায় ছিলো না। দুঃসময় আসে বলেই সু-সময়গুলো মানুষ মনে রাখতে চায়। রাতের কোন এক প্রহরে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। স্ত্রী চোখ কচলাতে-কচলাতে বলে- খারাপ লাগছে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো? ফকির মিয়ার নতুন ভাবের উদয় হয়- জীবনটাতো আসলে খারাপ না!
শেষকথাঃ
আমার ধৈর্যের খুব অভাব। লিখতে বসলে বেশিদূর লিখতে পারিনা। মাথা ঝিম-ঝিম করে। মাথা ব্লক হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করে একটা প্লট দাড় করিয়ে বড় একটা গল্প অথবা উপন্যাস টাইপ কিছু একটা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিয়তি আমার পক্ষে থাকলো না! লেখাটার খসড়া টাইপ করে ল্যাপটবে রেখেছিলাম। কিছুদিন আগে কেউ একজন ল্যাপটবটাই নিজের মনে করে নিয়ে গেছে। লেখায় পড়লো ‘ফুলস্টপ’! অনেক খোঁজা-খুজির পর মেইলে এই লেখাটার অংশবিশেষ খুঁজে পেলাম। সাঁট-কাট করে আজ উপস্থাপন করলাম।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
প্রায় ১ বছর দুই মাস পর ব্লগে এলাম।
একসময় সারাক্ষণ ব্লগে ব্লগে ঘুরতাম। এখন সময় পাল্টে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে হয়ে ওঠে না।
ভাল লাগলো আপনার মন্তব্য পেয়ে।
সুখ এবং দুঃখ কে সাথে নিয়েই জীবন চলতে হয়।
জীবন যার দায়িত্ব তাঁর।
একলা জীবন, একটা জীবন, তবুও সুন্দর।
যাইহোক ধন্যবাদ।
আশায় বুক বাঁধলাম। নিশ্চিন্ত মনে জীবন পথের পথিক হলাম।
আগের মত মজা পাই না এখন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন