প্রিয়ংবদা (গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন সর্বহারা ০৪ মে, ২০১৩, ০৯:১৬:২২ রাত
সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলে যায়,বদলে যায় বিচিত্র বর্ণের মানুষের মন।স্বপ্নে বিভোর থাকলেও কালের নির্মম পরিহাসে একসময় মেনে নিতে হয় দুঃস্বপ্নের কঠিন বাস্তবকে।হাসি-কান্না,প্রেম-বিরহ,আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রনের নামই বোধহয় জীবন।সেই জীবন চলার পথে স্মৃতির রোমন্থন সত্যিই বড় কষ্টের।লোকে বলে প্রেম নাকি সত্য এবং চিরন্তন।কিন্তু প্রেমের সংজ্ঞা আমার কাছে ধুসর,প্রেমের কথা মনে পড়লে আমার কাব্য করে বলতে ইচ্ছে করে-দিন যায় দিন আসে,কত স্মৃতি মনে ভাসে।সেই সব ধুসর স্মৃতির কিছু স্মৃতি হৃদয়ের মানসপটে অমলিন রয়ে যায়,কখনো কখনো তা হয়ে ওঠে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর।আমার প্রেমকাহনের সেই অনবদ্য সময়টা ছিল ২০০০ সালের।
আপনাদের হয়তো মনে আছে,২০০০ সালের ৫ই মে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে,এমন একটা গুজব রটেছিল।আমি তখন মাত্র নবম শ্রেণীর ছাত্র।ছাত্র হিসাবে ছিলাম মোটামুটি মানের। ক্লাশে মজা করতে খুব ভাল লাগতো,এই কারনে অবশ্য অনেক মার (পিটুনি)আমাকে হজম করতে হয়েছে। আমাদের স্কুলে ছেলে-মেয়েতে এক সাথে ক্লাশ হতো।দুরন্ত কৈশরে স্বভাবসূলভ সবার সাথে কথা বলতাম, মজা করতাম।বলে রাখি আমি কিন্তু দারুন চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম।অনেক সহপাঠির ভীড়ে আমার একজন বিশেষ সহপাঠিনী ছিল।রত্না নামের আদুরে চাহনীর মেয়েটা দেখতে অপ্সরী না হলেও সুন্দরী বলা যায়।দুরন্ত কৈশরের কাঁচা আবেগে তাকে নিয়ে অজান্তে ভাবতে অবশ্য আমার খারাপ লাগত না।কিন্তু তখনও আমার কাছে বোধগম্য ছিল না যে এটাই ভালোবাসা কি’না!
আসল ঘটনায় ফিরে আসি।সেই সময়টাতে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল পৃথিবী ধ্বংস নিয়ে,বোধকরি সবাই বেশ মজাও পেত ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে,কিন্তু আমার মত দুরন্তপনাদের কেউই সেটা ওভাবে আমলে আনতাম না।গতিময় চাঞ্চল্যে কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় ছিল না আমার,হৈহৈরৈরৈ করে মনের সুখে চলছিলাম আমার বেঁধে দেয়া নিয়মে। সেই নিয়মের পরিধী ছিল নিয়মিত স্কুলে যাওয়া আর ক্লাশ করা পর্যন্ত।মূলতঃ এগুলো করতে বাধ্য করা হয়েছিল আমাকে, বড় ভাইদের রক্তচক্ষু অমান্য করার যথেষ্ঠ সাহস আমার ছিল না।এদিকে আবার আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার মেজভাই।রাগান্বিত চেহারার মেজভাইজানের অগ্নিমুর্তি আমার কাছে আতঙ্কের একটা নাম ছিল,সেই কারনে দুরন্তপনার চরম শিখর থেকেও স্কুল ফাঁকি দেয়ার মত দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ মিলত না কখনোই।বেঁধে দেয়া পড়াশোনা আর বাঁধনহারা দুষ্টুমির ব্যাস্ততায় ৫ই মে সমাগত।চারিদিকের গুঞ্জন আর মাতামাতি আমাদেরকেও কিছুটা কৌতুহলি করে তুললো।৫ই মে এর আগের দিন অর্থাৎ ৪ই মে ছিল বৃহস্পতিবার,যথারীতি সেদিনও স্কুলে গেলাম।হঠাৎ রত্নাকে দেখলাম আমার দিকে ছুটে আসছে।
“কিরে কি হল তোর!” (তখনও তুমি বলা শুরু হয়নি)।ও বললো- “আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবি?”
“দেখা করা মানে? আরে আমিতো তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি, ভনিতা করা বাদ দিয়ে কি বলবি সেটা তাড়াতাড়ি বলে ফেল।”
“আরে ধুর,এভাবে না!” আমিও নাছোড়বান্দা- “তাহলে কিভাবে শুনি?”
“শোন,আজ ঠিক ১২টার সময় জাহিদদের বাসায় তুই আসবি।আমি ওখানে সময়মত থাকব, তুই কিন্তু দেরী করিস না।” রত্নার কথায় অধিকারের সুর।
জাহিদ আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।কখন যে রত্না জাহিদকে বলে রাজি করিয়েছে জানিনা।এদিকে আমি তো ঝামেলায় পড়ে গেলাম; যত দুষ্টূমিই করি না কেন, অপরিচিত একটা জায়গায় গিয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করা বলে কথা। ভিতরে-ভিতরে ভয় এবং লজ্জা দু’টাই কাজ করছিল আমার।জাহিদ আমাকে আশ্বস্ত করল যে কোন সমস্যা হবে না।
সেদিন প্রথম দুইটা ক্লাশের পর জাহিদকে সাথে নিয়ে জীবনের পয়লাবারের মত স্কুল পলয়ন করলাম।ভয়ে ছিলাম যদি ধরা পড়ে যাই,তাহলে নির্ঘাত নির্মম বেত্রাঘাত!বলে রাখা ভাল আমার অগ্রজ ভ্রাতার প্রহারের হাত খুব ভাল ছিল, যথেষ্ট পাকা হাতের শিল্পকর্মে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে প্রহার করত,সেজন্য সবাই তাকে বাঘের মত ভয় পেত। তাছাড়া তিনি গণিত ক্লাশ নিতেন,যার কারনে স্বভাবতই তিনি তাঁর শিল্পকর্ম জাহিরের দারুন সুযোগ পেতেন!
“এই জাহিদ তোর কি মনে হয়,কি জন্য ও আমাকে দেখা করতে বলেছে?”
“কে, রত্না? হবে হয়তো কিছু একটা!”
“হেয়ালী করিস না, তুই কিছু জানিস নাকি?”
“আমি কিভাবে জানব? শেষ দেখা করতে চাই হয়তো।”
“আরে দেখাতো স্কুলে হয়েছেই।অন্য কোন ঘটনা আছে বলে মনে হচ্ছে।”
“তাহলে আর কি? বিশেষ কিছু অপেক্ষা করছে মনে হয়।”
এসব সাত-পাঁচ আন্দাজ করতে করতে আমরা দু’জন সাইকেলে করে পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম।
জাহিদের বাড়িতে গিয়ে দেখি রত্না আর ওর চাঁচাতো বোন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।আমাদের তো আক্কেলগুড়ুম অবস্থা!
জাহিদ আলাদা রুমে থাকতো বিধায় ওর রুমেই গতি হল আমাদের। অনেকক্ষন বাঁধভাঙ্গা আড্ডা দিলাম।দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, এদিকে পেটের ভিতর ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল।আমি মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই ভোজন রসিক,পেট পূজায় ব্যস্ত হলাম সবাই।ভাবলাম এতোটুকই হয়ত শেষ, কাল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে তাই বোধকরি আয়োজন করে শেষ আহার,শেষ কথা আর শেষ দেখা করা।
চলে আসব এমন সময় একরকম হঠাৎ করেই সেই মহেন্দ্রক্ষন “যে জন্য এখানে এসেছি এবং তোকে দেখা করতে বলেছি সেটা হল..।” রত্না মুহুর্তের জন্য থামল। চোখের ইশারায় জাহিদকে রুম থেকে চলে যেতে বলল। আমি জাহিদের দিকে তাকালাম। জাহিদ বেচারার অসহায় চাহনী দেখে আমার মায়া হল। অবশেষে আমার অনুরোধে ও রুমে থাকার অনুমতি পেল।
“আমি তোমাকে আমার জীবনের সাথী করে বাঁচতে চাই।”
রত্নার এলোমেলো কথা আর আমাকে হঠাৎ ‘তুমি’ করে বলা দেখে কিছুটা ভড়কে গেলাম।আমি ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম।
রত্না চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
ও আবার বলা শুরু করল- “এখন তোমার প্রতিউত্তর প্রত্যাশা করছি।”
আমি কি বলব বুঝলাম না, শুধু লক্ষ্য করলাম ওর গলা কাঁপছে।
“হয়তো তুমি আমার দূর্বলতা আগেই টের পেয়েছিলে তাই বেহায়া-নির্লজ্জের মত এমন করে বলে ফেললাম।”
এই উক্তিটি শোনার পর আমার কাছে তৎক্ষনাৎ মনে হচ্ছিল যে এই মুহূর্তে আমিই বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ,কাল যদি সত্যি-সত্যিই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়,তাতেও আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ থাকবে না!
এবার আমার কথা বলার পালা। আমি খুব কষ্ট করে আমার আনন্দ নিজের ভিতরে চেপে রাখার চেষ্টা করলাম।গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে ভরা কন্ঠে করে বললাম- “হুম, বুঝলাম।আমাকে একটু সময় দাও, দু’দিন পরে জানাই?”
রত্নার চোখে অপরাধের চিহ্ণ স্পষ্ট হল।এদিকে রত্নার ক্ষণিক অসহায়ত্ব দেখে আমি মনেমনে খুব মজা পাচ্ছি।চোখের আনন্দঅশ্রু লুকাতে আমি অন্যদিকে তাকালাম।
অনুরোধের সুরে রত্না আবার বলল- “কি হল, বলবা না?”
“আরে বাবা বললাম তো যে দুদিন পর জানাচ্ছি!”
“দয়া করে আজকেই বল!যদি শুনতে না পারি তাহলে শুন্যতা রয়ে যাবে।”
আর দেরি না করে সম্মতিসূচক উত্তরটা জানিয়ে দিলাম।সূচনা হল নতুন এক ভালোবাসার সন্ধিক্ষনের,জন্ম নিল নতুন একটা স্বপ্নের,গাঢ় হল বেঁচে থাকার আশা।সেই স্বপ্নপুরী থেকে বিদায় নিলাম অপরাহ্নে,এক অনিশ্চিত আগামীকে বুকে ধরে।কোন অঘটন ঘটলো না ৫ই মে।আশায় বুক বাধলাম রঙিন স্বপ্ন দেখার।
স্বপ্নপুরীর স্বপ্নদেবীর প্রথম চিঠিখানার কথা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে।
চিঠির প্রথম কয়েকটা লাইন ছিল এমনঃ
“উত্তাপের দিন ফুরিয়ে গেছে, চারিদিকে জমা হচ্ছে মেঘ। ডাকছে গুড় গুড়,ঝরছে অঝর ধারায় বৃষ্টির ফোটা। তপ্ত উন্মাতলা ধরনী এবার হবে শীতল। রুদ্র অকুরণ গ্রীষ্মের প্রগাঢ় শুন্যতা শেষে প্রকৃতি এবার প্রেমে মেতে উঠার দিন।হৃদয় মন একেবারেই নরম, তাই হাতে তুলে নিলাম খাতা আর কলম”।
একটি গানের কয়েকটা লাইন প্রায়ই আমার কানে বাজে- “দিন যায়, কথা থাকে। সে তো কথা দিয়ে রাখল না, চলে যাবার আগে ভাবল না, সে কথা লেখা আছে বুকে।” মন খারাপ হলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটা একা একাই আবৃতি করার চেষ্টা করি।আমার অবশ্য তেত্রিশ বৎসর কাটেনি, কিন্তু দেখতে দেখতে দশ-দশটি বৎসর কেটে গেল।জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজও আমি একা। পুরানো হয়েছে অনেক কিছুই,অতীত হয়েছে সময়,শুধু অতীত হয়নি স্মৃতিগুলো।যে আমাকে পাশে থাকার প্রত্যয় দিয়েছিল সে নিজেই আজ অন্যের। সে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলো সুখী হওয়ার জন্য। সে অনেক কাহিনী। তবে সে খুব সুখে আছে।“মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়,বেঁচে থাকলে বদলায়। কারনে অকারনে বদলায়।” হয়তো সেও বদলে গেছে,সাথে বদলে গেছি আমিও।
বিষয়: সাহিত্য
৩৭৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন