...এবং তিনি
লিখেছেন লিখেছেন সর্বহারা ২৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৭:৫৩:২৪ সন্ধ্যা
প্রত্যেক মানুষ এ জগতে আত্নার তিনটি শক্তি নিয়ে জন্মায়- জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছাশক্তি এবং ক্রিয়াশক্তি। মানুষে মানুষে পার্থক্য এই শক্তি বিকাশের তারতম্যেই ঘটে থাকে। নশ্বর এই পৃথিবীতে তার জীবনে এই তিন শক্তিকে এমন প্রচন্ডভাবে সাড়া জাগিয়েছে যে, সবার মন জয় করার অসাধারণ ক্ষমতা তার কুক্ষিগত। তিনি আর কেউ নন স্বয়ং আমার বড় ভাই। অসাধারণ একটা মানুষ তিনি। শুধু আমি কেন স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ তার সাথে কথা বলে মুগ্ধ হবেন। কিছু ভালোবাসার প্রতিদান কখনো দেওয়া যায়না, তেমনি আমি নিজেই হয়তো কোনদিন তার ভালোবাসা এবং আগলে রাখার প্রতিদান দিতে পারবো না। পারার কথাও না। কারণ সে সামর্থ্য যে আমার নেই। রঙছাড়া এই জীবনে অনেকটা বর্ণীল রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার বড় ভাই, আমিনুর রহমান।
জন্ম থেকে শৈশবটা কেটেছে বড় ভাইয়ের সংস্পর্শে। ‘দাদা’ বলে ডাকতাম তাকে। শুধু ডাকতাম বললে বড্ড ভুল হবে, বলা উচিৎ ‘দাদা’র জন্য পাগল ছিলাম। ‘দাদা’র সাথে ঘুড়ি উড়াতাম, মার্বেল খেলতাম, মাছ ধরতে যেতাম, এহেন কোন জায়গা ছিলোনা যেখানে দাদা আমাকে নিতেন না এমনকি রাতে আমাকে পড়াতেনও। অথচ সেই প্রিয় দাদাকে ছাড়াই অনেকগুলো দিন অতিবাহিত করে ফেললাম। হয়তো সময়ের স্রোতে বহুকাল অতীত হয়েছে কিন্তু আজো সেই মধুর স্মৃতিগুলো আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রস্ফুটিত শতদল মিশ্রিত শৈশবে। কে চাই এমন স্মৃতি ভুলে থাকতে?
তার বিবাহটা যখন হয় তখন আমার বয়স ছয় কিংবা সাত পেরিয়েছে। স্পষ্ট মনে আছে, বরযাত্রীদের সাথে আমিও ছিলাম। দাদা সমস্ত রাস্তা আমাকে তার কোলে রেখেই হবু শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন এবং কবুল যখন বলেছিলেন তখনও আমি তার কোলেই ছিলাম। ফেরার পথেও ঠিক যাওয়ার মতই অবস্থা! দাদাকে ছাড়া দিনগুলিকে কল্পনা করতে পারতাম না। শুনেছি প্রখর মেধা থাকা স্বত্বেও লেখাপড়াটা তার হয়ে ওঠেনি সংসারের টানাপোড়নের কারণে। স্কুল থেকে ফিরেই মুখর থাকতাম দাদার সাথে মাঠে যাওয়ার জন্যে। সেসময়ে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো- বড় হয়ে কি হতে চাও? নিশ্চয় কোন চিন্তা না করেই বলে ফেলেছি ‘দাদা যা করে আমিও তাই করবো!’ আসলে তা তো আর হবার নয় বা পরিবারের অন্য কেহ সেটা মেনেও নিবে না।
আমাদের কয়েক বিঘা খেঁজুর গাছ ছিলো। এককালীন উপার্জনের অত্যতম মাধ্যম ছিলো খেজুর রসের গুড়। কথায় আছে- যশোরের যশ, খেঁজুরের রস। দাদা অনেক সুন্দর করে খেঁজুর গাছ কাটতেন (কাটতেন বলতে বুঝানো হয়েছে খেজুর গাছ থেকে রস বের করার মাধ্যমকে) তাই পিতাজি এই গুরু দায়িত্ব তার উপরেই অর্পন করলেন। আমাদের বাড়ি থেকে মাঠ অনেক দূরে তারপরও বৈকালে দাদার মাঠে যাবার সঙ্গি হতাম। মাটির কলস পরিষ্কার করে খড় জ্বালিয়ে কলসগুলো আগুনে পোড়াতাম যেন জীবানু না থাকতে পারে। এখন করে কিনা জানিনা! অতঃপর কলসগুলো গাছের গোড়ায় গোড়ায় রাখতাম। অনেক কষ্ট হতো তারপরও কেন জানি অন্যরকম এক ভাল লাগা কাজ করতো এই কাজগুলো করতে। দাদা গাছে ওঠার আগে নির্দিষ্ট কলসটাকে একটা খাঁচির সাথে বেঁধে গাছে উঠতেন। দেখলেই তখন কেমন জানি আনন্দ লাগতো। কিছু গাছ ছিলো প্রচুর রস হতো, সেগুলো প্রথমে কাটতে বলতাম যেন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পূর্বে ‘সন্ধ্যার রস’ খেয়ে এবং বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য। সন্ধ্যার খেঁজুরের রস অনেক মিষ্টি হয় যারা খেয়েছেন তারা হয়তো জানবেন।
আমি চতূর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাড়ি ছাড়লাম। ছাড়লাম বললে কেমন রসকষহীন লাগছে বলা উচিৎ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলাম। বাবা চান তার অন্য দুই শিক্ষিত ছেলের মত আমাকেও গড়ে তুলবেন। বাবার চেষ্টাটা অবশ্য এখনও অব্যাহত আছে। যাক সে কথা, বাবা-মা ছাড়া থাকা! এ যেন সত্যিই অবিরল কষ্টের ধারা। আমার অবস্থান তখন মেজো ভাইয়ের বাসা! কি আর করা, নিয়তিকে মেনে নিয়েই চললো আমার আগামীর পথচলা। মাঝে-মাঝে বাবা-মা এসে দেখে যেতেন। আমিও বৃহস্পতিবার স্কুলে থেকে ফিরেই সাইকেল নিয়ে বাড়ি চলে যেতাম। শুক্রবার ফেরার সময় আমার সে কি কান্না! আমার সাথে মা’ও কাঁদতেন। একবার বাবা এলেন আমাকে দেখতে। চলে যাবার সময় হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বললেন, ‘তোমার দাদা তোমার জন্য সুন্দর একটা ঘুড়ি তৈরি করে রেখেছে, তুমি বাড়ি গেলে উড়াবে।’ আমার তখন আর তর সইছিলো না, কখন বাড়ি যাবো? কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে বাড়ি এসে দেখি, দাদা ঘুড়ি হাতে প্রস্তুত! আমি আসা মাত্রই ঘুড়ি উড়াতে গেলাম। অনেকক্ষণ ঘুড়ি উড়িয়ে বাড়িতে ফিরে দেখি দাদা আমার জন্য নিজ হাতে দুইটা লাটিম বানিয়ে মা’র কাছে দিয়ে রেখেছেন সাথে কয়েক’শ মার্বেল। এমনও হয়েছে দুই ভাই একসাথে মার্বেল খেলেছি অন্যদের সাথে। আমি খেলায় হেরে গেলেও বাড়ি এসে সব মার্বেল আমাকে দিয়ে দিয়েছেন।
মাছ ধরা তার নেশা! এখনও তিনি মাছ ধরতে অনেক পারদর্শী। তখন আমি অষ্টম অথবা নবম শ্রেণীতে পড়ি। বরাবরই বৃহস্পতিবার বাড়িতে আসি, সেদিনও এলাম। দাদা বললো, ‘চল মাছ ধরতে যাই’। চৈত্র মাসের কোন এক সময় হবে, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ত্রিভূজ আকৃতির একটা জাল (আমরা বলি ঠেলা জাল) নিয়ে বের হলাম দুই ভাই। দাদা জাল ঠেলবেন আমি জালের সম্মুখভাগ পানি থেকে উচিয়ে ধরবো এটিই আমার কাজ। বিলে প্রচুর পরিমানে কচুরিপনা। এই কচুরিপনার সাথেই আছে নানা ধরনের মাছ। বিশেষ করে টাকি মাছ বেশি পাওয়া যেত। দাদা কচুরিপনা নিয়ে জাল ঠেলছেন আর আমি একটু সামনে গিয়ে জালের অগ্রভাগ টেনে পানির উপরে উঠাচ্ছি। বেশ কয়েকবার মাছের সাথে সাপ উঠলো। আমিতো ভয়ে বারবার শিয়রে উঠছি আর দাদা সাপের লেজ ধরে অনেক দূরে ফেলে দিচ্ছেন। কি সাহস! দাদা পরে বললেন এই সাপের বিষ নাই তবে কামড় দিতে পারে। তারপরও সাপ বলে কথা! অনেক মাছ পেয়েছিলাম সেদিন। পরদিন আবার দাদার সাথে মাছ ধরতে গেলাম তবে এবার সাথে ছিলো আরো এক বড় ভাই, আমার মেজো ভাই। আমি শুধু মাছ রাখার পাত্রটা ধরে রাখবো এটাই কথা ছিলো কারণ আমি পানিতে নামতে নারাজ। আসলে সাপ দেখে ভয়ের চেয়ে নাক সিটকানিটা বেশী তাড়া করছিলো। এই দিনের ঘটনা বলার অবশ্য একটা কারণ আছে। মাছ ধরা যখন শেষ পর্যায়ে। দাদা এবং মেজো ভাই কূলে ওঠার জন্য বিলের মাঝ থেকে হেঁটে হেঁটে আসছেন। সেখানেও গলা পর্যন্ত পানি। কূলের কাছাকাছি এসেই হঠাৎ মেজো ভাই থেমে গেলেন। দাদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ভাই, দেখ আমার পায়ের নিছে মাছ।’ দাদা পানিতে ডুব দিয়ে মেজো ভাইয়ের পায়ের নিচ থেকে বড় একটা শিং মাছ ধরে আনলেন। পানি থেকে মুখ তুলেই দাদা বললেন, ‘তোর পা উঠানোর দরকার নেই, কারণ ওখানে আরো মাছ আছে।’ দাদা একে একে আঠারোটা প্রমাণ সাইজের শিং মাছ ধরেছিলেন সেদিন মেজো ভাইয়ের পায়ের নিচে লুকিয়ে থাকা গর্ত থেকে। এদিকে শিং মাছের শিংয়ে দারুণ বিষ! এক ভাইয়ের পায়ে আর এক ভাইয়ের হাতে হু-হু করে বয়ে চলেছে শিং মাছের বিষের জ্বালা! তবুও তারা ক্ষ্যান্ত দেন নাই। পরে অবশ্য ডাক্তার লেগেছিলো। তারপরও কিসের যেন আনন্দ আছে সেটা ভাষা দ্বারা বোঝানো আসলেই মুশকিল!
দাদা দারুণ হা-ডু-ডূ খেলতে পারতেন। কিছু খেলোয়াড় থাকে প্রতিপক্ষকে ধরার জন্য আর কিছু থাকে প্রতিপক্ষকে ছুঁয়ে দেবার জন্য। ছুঁয়ে দিলে সে ঐ টার্মের জন্য বাদ হয়ে যায়। আমার দাদা ছিলেন ধরার সারিতে। তিনি যদি বলতেন ‘আমি তাকে এবার আর ফিরতে দেবোনা’, তবে তাই করতেন। ফিরে যাবার রেকর্ড ছিলোনা। একবার আমাদের গ্রামে হা-ডু-ডু খেলার টূর্নামেন্ট ছাড়া হলো। দাদা ছিলেন প্রধান আয়োজক। আমি খেলা দেখতে গেলাম। দাদা আয়োজক হওয়াতে আমার কোন টিকেট লাগতো না। তিনি যেহেতু আয়োজক ছিলেন বিধায় তার খেলাও হয়ে ওঠেনি সেবার। মূলকথায় আসি, দাদার কিছু বন্ধুরা সেদিন খেলা দেখতে এসেছিলেন। আমি তখনও দাদার পিছু পিছু ঘুরছি। হঠাৎ তার এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমিনুর ছেলেটা কে? আমি ছোটবেলা থেকে গ্রামের বাইরে থাকি বলে অনেকেই আমাকে চিনতো না। দাদা বললেন, ‘আমার আব্বার ছোট ছেলে।’ দাদা অনেক রসিকতা করেন আমি জানি। কিন্তু লোকটি বুঝতে পারেনি আসলে সম্পর্কটা কি? বেশ খানিকক্ষণ পর সেই লোকটি বললো, ‘আরে! তাহলে সে তো তোর ছোট ভাই।’ দাদা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমি কি বলেছি সে আমার ভাই না?’ এমন মজার মানুষ আমার প্রিয় দাদা।
২০০৫ সালের দিকে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন দিয়ে ফেরার সময় নিউ মার্কেট থেকে একটা কার্গো প্যান্ট (যে প্যান্টের অনেকগুলো পকেট থাকে) কিনলাম এবং সেটা পরেই বাড়ি ফিরলাম। দাদা আমাকে দেখে বললেন, ‘নতুন কিনেছো বুঝি?’ আমি হ্যাঁ জবাব দিলাম। তিনি বেশ একটা ভাব নিয়ে বললেন, ‘প্যান্টটা খুলে রেখে দিও, পরার দরকার নেই।’ আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো, এত শখ করে কিনলাম আর উনি কিনা পরতেই নিষেধ করছেন! আমি মন খারাপ করে বললাম, ‘দাদা আপনার পছন্দ হয়নি, নাকি অন্য কিছু?’ দাদা চোখ বাকিয়ে বললেন, ‘তুমি ছাত্র মানুষ, তোমারতো টাকা-পয়সা তেমন নেই। প্যান্টের এতগুলো পকেটের কি দরকার? তারচেয়ে তুমি এটা কোন ফকির কে দিয়ে দাও সে এই পকেটের সদ্ব্যবহার করতে পারবে। কোন পকেটে চাল, কোনটাই ডাল, কোনটাই টাকা-পয়সা রাখবে। আসলে তোমার এই কার্গো প্যান্টটা তাদেরই বেশী দরকার।’ বুঝেন তাহলে অবস্থা!
ভাল গান করতেন এবং মাঝে মাঝে যাত্রাতেও অভিনয় করতেন। তার অভিনয় ছিলো নজর কাড়া। সাধারণত, খল নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতেন। এখন অবশ্য করেন না। তার ভিলেনি হাসি শুনলে একধরনের ভয় কাজ করতো দর্শকদের মাঝে। আমি নিজেও বহুবার তার অভিনয়ের দর্শক হয়েছি। নিকট অতীতেই একবার আমাকে নায়ক আর দাদাকে খল নায়ক বানিয়ে যাত্রা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু আমি রাজি হইনি। দাদার অভিনয়ের কাছে আমি ছিলাম মশার ডানার ন্যায় তুচ্ছ। আদতে আমি অভিনয়ই জানিনা। যেকোন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে তার। যুবক, বৃদ্ধ কিংবা কিশোর সবার সাথেই তার সক্ষতা চিরদিনের। যেবার প্রথম বিদেশে আসি, তিনি বুঝতে দেননি তার চাপা কষ্ট! কিন্তু বিদায়ের সময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন। আমিও প্রশান্তির ছোঁয়া খুঁজে পেয়েছিলাম দাদার প্রশস্ত বুকে। দাদা আপনার উষ্ণতা উপলব্ধি করি প্রতি মুহুর্তে। এই লেখা হয়তো আপনার দৃষ্টিগোচর হবে না। তবে ছোট ভাই হিসাবে আমার অনেক অহংকার –আপনি আমার বড় ভাই আমার একান্ত দাদা। আল্লাহ আপনাকে সর্বাবস্থায় ভাল রাখুক, দীর্ঘজীবি হন।
পাদটিকাঃ কয়েকদিন আগে দাদার সাথে ফোনে কথা বলার সময় নস্টালজিক কিছু কথা বলছিলাম। এসব বলতে গিয়েই আমি লক্ষ্য করলাম আমার কন্ঠ কেমন জানি ভারী হয়ে যাচ্ছে। হয়ত দাদা সেটা বুঝে ফেলেছিলেন। তাইতো বললেন, ‘ভাল থেকো, মন দিয়ে পড়ালেখা করো।’ দাদা, সৃষ্টিতত্বে যদি আজীবন ছোট থাকার কোন ব্যবস্থা থাকতো তাহলে শুধু আপনার আদরের জন্যই আজীবন ছোট হয়ে থাকতে চাইতাম।
বিষয়: সাহিত্য
১৫৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন