...এবং তাহারা অতঃপর আমরা কতিপয় আগাছা!
লিখেছেন লিখেছেন সর্বহারা ১৯ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৯:৩৫:১৩ রাত
খুব সকালে আজ ঘুম থেকে উঠেছেন জিসান চৌধুরী। সাধারণত এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেন না তিনি। তাড়াতাড়ি কিংবা দেরিতে যখনই বিছানায় যান না কেন ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল আটটা। তারপর বিছানায় হালকা লিকারের এক মগ চা পান আর বিছানায় বসেই কয়েকটা পেপারের পাতায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া। তিনি বাসায় তিনটি পেপার রাখেন কিন্তু কোন খবরই তার পুরোপুরি পড়া হয়না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হেডিং দেখেই রেখে দেওয়া হয়।
জিসান চৌধুরীর আজ সকালে ওঠার অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। শুধু কারণ বললে পুরো অর্থটা বুঝা মুশকিল, বলা উচিৎ মহা কারণ। নইলে তো এত সাধের ঘুম থেকে ওঠার কথা নয়। মহাকারণটা হচ্ছে- সন্ধ্যায় একটা পাঁচ তারা হোটেলে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেবেন তিনি। এর জন্য একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক, কোন কোন পত্রিকার সম্পাদক স্বয়ং, নামকরা কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, সাধারণ সম্পাদকসহ সাধারণ সদস্যরাও উপস্থিত থাকবে সেই পার্টিতে।
সব কয়টি পত্রিকায় রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উপলক্ষে অনুষ্ঠানের খবর ছাপা হওয়ার কথা, সম্ভবত হয়েছেও। কারণ জিসান চৌধুরী দেশের প্রায় সব কয়টি পত্রিকায় বছরে কয়েক লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন দেন, টিভিতেও দেন। সব কয়টি টিভি চ্যানেলও এ অনুষ্ঠান কভার করতে পার্টিতে আসবে।
মূলত, জিসান চৌধুরী জানেন না যে ঠিক কয়টার সময় হকার পেপার দিয়ে যায়? কিন্তু আজ তিনি অধির আগ্রহে হকারের আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। হকার পেপার দেওয়ার সময় কলিং বেলে চাপ দেয়। সেই কলিং বেলের শব্দের জন্য আজ তার এই অপেক্ষা। পেপারে নিজের ছবি দেখা, নিজের সম্বন্ধে ছাপা হওয়া খবর পড়া, খুবই মজার ব্যাপার। তবে একজন মানুষের সবসময় যে ভাল খবর ছাপা হয় তা নয়, মাঝে মাঝে খারাপ খবরও ছাপা হয়। একবার তার কোম্পানীর নামে মধ্যম সারির একটা দৈনিক পত্রিকা খারাপ খবর ছেপেছিলো। খবরটা তিনি পড়েনওনি। তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ব্যাপারটা জানায় তাকে।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক’কে ফোন করেন, সম্পাদক নিজেই সেটা রিসিভ করে দালাল টাইপের একটা হাসি দিয়ে বলেন, ‘স্যার আপনিতো জানেন, পত্রিকা চালানোর জন্য মাঝে মাঝে এমন খবর আমাদেরকে ছাপাতে হয়।’ ‘শুধু খবর ছাপলেই তো আর হয় না, আরো কিছু তো লাগে।’ জিসান চৌধুরী গলাটা গম্ভীর করে বলেন-‘আমার অফিসে চলে আসুন।’
আধা ঘন্টার মধ্যে ওই সম্পাদক জিসান চৌধুরীর অফিসে চলে আসেন। বড় একটা বিজ্ঞাপন ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘খবর-টবর একটু বুঝে শুনে ছাপবেন। আরো বিজ্ঞাপন পৌঁছে যাবে আপনার পত্রিকায়।’ ওই পত্রিকাতে আর কোনদিন কোনো খারাপ খবর ছাপা হয়নি বরং সম্পাদক সাহেবই তার খোঁজ খবর রাখেন এবং মাঝে মধ্যে এটা-ওটা গিফট পাঠান।
কলিংবেল বেজে ওঠল। একটু পর নিচ থেকে পেপার নিয়ে এলো কাজের ছেলেটা। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি এবং তিনটি পত্রিকাতেই তার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার খবরটা ছাপা হয়েছে, ছবিও ছাপা হয়েছে। মনটা এতক্ষণ গুমোট ছিলো কিন্তু ভাল হয়ে গেলো পত্রিকার খবরগুলো দেখে। কাজের ছেলেটাকে আর এক কাপ চা দিতে বললেন।
জিসান সাহেবের এক ছেলে, রাহাত। রাহাত তার এলোমেলো চুলগুলো একটু গুছিয়ে নিয়ে জিসান চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। হাই তুলে গুড মর্নিং জানাতেই তিনি বললেন, ‘স্যরি বাবা, এত সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবার জন্য। ‘নো প্রবলেম ড্যাড। কোথাও বের হচ্ছো নাকি?’ ‘হ্যাঁ, তোমাদের সাথে নাস্তাটা সেরে বের হতে হবে আমাকে। বেশ কয়েকজনের বাসায় যেতে হবে। অনেককে এখনো জানানো হয়নি, যদিও তারা জানে, কিন্তু আমার নিজে গিয়ে একটু বলতে হবে। রাহাত হাসতে হাসতে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছো তুমি!’ তিনি বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি রাজনীতিতে নামার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না। বলতে পারো চাপে পড়েই রাজনীতিতে নামতে হচ্চে আমাকে’!
রাহাত খুব সরল ভাবে বলল, ‘রাজনীতিতে না নামলে কি হয় ড্যাড?’ জিসান চৌধুরী একটু ঝুকে গিয়ে বললেন, ‘অনেক কিছু হয় রাহাত, অনেক কিছুই হয়। রাজনীতি হচ্ছে এক ধরনের ঢাল।’
আচ্ছা ড্যাড, তবে রাজনীতিবিদরা কি ভালো মানুষ?’
হেসে ফেললেন জিসান চৌধুরী। ব্রেডের একটুকরো মুখে দিয়ে তিনি ছেলের দিকে তাকালেন। রাহাত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তিনি আরো এক টুকরো মুখে দিয়ে বললেন, ‘রাজনীতিবিদরা হচ্ছে একটা দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। তারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ডাকাত, লুটেরা, দখলবাজ। একটা দেশে যতরকম অন্যায় হয়ে থাকে তার প্রায় সব কিছুতেই রাজনীতিবিদদের অবদান থাকে। দেশে যত সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে সেটাও রাজনীতিবিদেরা করে থাকে। একটা দেশকে যত রকম ভাবে ক্ষতি করা যায়, তার সবটুকূ ক্ষতি করে রাজনীতিবিদরা।’
‘মানুষ তাহলে রাজনীতিবিদদের সম্মান করে কেন’?
‘সম্মান করে না, ভয় করে।’ জিসান চৌধুরী সোজা হয়ে বসে বলেন, ‘ভয় এবং সম্মান দুটো দুই জিনিস, রাহাত।’
‘রাজনীতিবিদরা তো এটা জানে, ড্যাড?’
‘জানে।’
‘তাদের লজ্জা করে না?’
শব্দ করে হেসে ফেললেন জিসান চৌধুরী। ‘লজ্জা থাকলে রাজনীতি করা যায় না, রাহাত। শুধু লজ্জা না, তোমার ভেতর দেশপ্রেম থাকা যাবে না, মানুষের কল্যাণ করার ইচ্ছে থাকা যাবে না, সুস্থ্য চিন্তা করার মনোভাব থাকা যাবে না। আপদমস্তক তোমাকে হতে হবে ভন্ড, ধূর্ত এবং মিথাবাদী।’
‘তুমি তাহলে এর ভেতর যাচ্ছো কেন, ড্যাড! এর চেয়ে কি তোমার ব্যবসা করাই ভালো না?’
ছেলের হাতের উপর একটা হাত রেখে জিসান চৌধুরী বললেন, ‘তোমাকে শেষ কথাটা বলবো আমি।’ একটু থেমে গিয়ে জিসান চৌধুরী বললেন, ‘পৃথিবীর কোথাও, কোনো দেশে, রাজনীতির চেয়ে বড় ব্যবসা আর নেই। একমাত্র রাজনীতিবিদ হয়ে তুমি খারাপ কাজ করলেও মানুষ তোমার জন্য হাততালি দিবে, তোমার পিছন পিছন ঘুরবে, তোমার পক্ষে শ্লোগান দিবে।’
জিসান চৌধুরী ঘুরে দাঁড়ালেন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত। এগিয়ে এসে ছেলের কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, ‘কিছু বলবে?’
‘তুমিও কি তাহলে খুব খারাপ একজন মানুষ হয়ে যাচ্ছো, ড্যাড?’
গভীর চোখে ছেলের দিকে তাকালেন জিসান চৌধুরী। কিছু বললেন না, শুধু মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন তিনি নিজের ঘরে।
পুনশ্চঃ উপরের গল্পটির সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই, মিল খুঁজে পেলে সেটা কাকতালীয়।
পাদটিকাঃ
আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে আজ সমাজের এই অবক্ষয়। সমাজে আজ শুধুই অনিয়ম আর অরাজাকতার ছড়াছড়ি। সে কারনেই আজও প্রতিনিয়ত আমরা, আমাদের সমাজ, দেশ, বিশ্ব আহত হচ্ছে, ব্যর্থ হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে অধিকার থেকে। ভাল গুনগুলো মানুষের হৃদয় থেকে অনাকাংখিত ভাবেই বিলিন হয়ে যাচ্ছে। যারা সৎ হিসাবে বাঁচতে চান, আসলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা কি তাদের ভাল থাকতে দিচ্ছে? ভাল মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকাটাও যেন সমাজের কাছে দৃষ্টিকটু। হিংসা আর বিদ্বেষে বিষিয়ে গেছে মানুষের মন, সমাজ এবং জাতি।
আসুন আমদের নৈতিকতা দিয়ে আমাদের সমাজটাকে বদলে দিই। আর সাহায্য করি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে। আমাদের সবার স্বউদ্যোগই পারে বাংলাদেশের এই ঋজু অবস্থা থেকে উত্তরণের।
বিষয়: বিবিধ
১৫১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন