বিদআত (পর্বঃ চার)
লিখেছেন লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ১০ মার্চ, ২০১৫, ০৪:৪৯:৫১ বিকাল
(প্রথমে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি দীর্ঘ বিরতির জন্য। ব্যস্ততার জন্য এই অপারগতা আশা করি সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বিদআত নিয়ে চলমান আলোচনাটি পীর মুরিদী প্রসঙ্গে ছিল। উক্ত আলোচনা শেষ হতে আরো কয়েকটি পর্ব লাগবে। আপাতত ‘পীর-মুরিদী’ সংক্রান্ত আলোচনাটি স্থগিত রেখে অন্য একটি বিদআত নিয়ে আলোচনা করছি। আজকের পর্বের আলোচ্য বিষয়- “রাজনীতি না করার বিদআত”।)
রাজনীতি ইসলামের অপরিহার্য অংশ। রাসূল (সাঃ) রাজনীতি করেছেন, আমিরুল মোমিনীনরা করেছেন, তার সাহাবায়ে কিরাম করেছেন, তাবেঈ, তাবেই তাবেঈনরা করেছেন। তাদের পথ ধরে যুগে যুগে রাজনীতি করে গেছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, হাসান আল বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদর, আবদুল কাদের মোল্লারা। হ্যাঁ, সেই রাজনীতি অবশ্যই কুরআন ও হাদীসে নির্দেশিত ইসলামী রাজনীতি। সেই রাজনীতির জন্য তাঁরা জান মাল বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে, জালিমের ফাঁসির দড়িতে ঝুলে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন মৃত্যুকে আর ইসলামী বিপ্লবী আদর্শের চেতনা জাগ্রত করে গিয়েছেন মুসলিম উম্মাহর কাছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা সাহসী কন্ঠে উচ্চারণ করে গিয়েছেন, “মৃত্যুর ফায়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়।”
তাসাউফ এর নামে ইসলামের বিকৃত মতবাদের অপপ্রচারের জবাবে ইসলামী রাজনীতির বিষয়টি খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছিলেন হাসান আল বান্না।
“আমরা তোমাদের ডাকি আল্লাহর পথে , আমরা তোমাদের ডাকি রাসুল (স) এর পথে, আমরা তোমাদের ডাকি কোরআনের পথে , আমরা তোমাদের ডাকি হদীসের পথে, আমরা তোমাদের ডাকি ইসলামের পথে ।
এটা যদি রাজনীতি হয় , তাহলে এটিই আমাদের রাজনীতি।”
খুব দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলামী রাজনীতির ওপর গণতন্ত্রের অপবাদ দিয়ে আজ এক শ্রেণীর আলেম/শায়খ ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ইসলাম কায়েম হচ্ছে আল্লাহর সৈনিকদের মূল লক্ষ্য, সেই লক্ষ্যেই তাদের রাজনীতি, আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন কায়েমই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাদের সেই নেক নিয়্যতকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে অপবাদ দেয়া হচ্ছে-তারা গণতন্ত্র কায়েম করতে চান।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, জনৈক পীর নিয়ন্ত্রিত একটি দল আছে যেটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাদের ছাত্র সংগঠনও আছে। কিন্তু একই কারণে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ইসলামী দলটির ওপর তারা গণতন্ত্রের অপবাদ দেয়।
হ্যাঁ, গণতন্ত্র মানে যদি ইনসাফ কায়েম হয়, ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে হয় তবে সে গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের বিরোধ নেই। যে গণতন্ত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে সে গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের বিরোধ শতভাগ এবং এদেশের ইসলামী রাজনীতিবিদরাও তার বিরোধিতা অবশ্যই করেন। (গণতন্ত্র নিয়ে পরবর্তীতে ভিন্ন একটি পোস্ট দেব ইনশাল্লাহ, আজ মূখ্য বিষয়টি নিয়েই আলোচনা সীমিত রাখবো)।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা দ্বীনের মূল বিষয়গুলি উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্ক করি, ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করি। দ্বীনের সহজ বিষয়গুলিকে কঠিন করে ফেলি এবং কঠিন ও কষ্টসাধ্য বিষয়গুলিকে সহজ বানিয়ে ফেলি।
মূলত কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ এড়িয়ে যাওয়ার মত সুবিধাবাদী প্রবণতা হতেই ইসলামী রাজনীতি না করা বা ইসলামী রাজনীতির সমালোচনার সৃষ্টি।
এ বিষয়টি উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলেম মাওলানা আবদুর রহীম খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন তাঁর "সুন্নাত ও বিদআত" বইয়ে।
" আমরা যারা আহলি সুন্নাত হওয়ার দাবি করছি এবং মনে বেশ অহমিকা বোধ করছি এই ভেবে যে, আমরা কোনো গোমরাহ ফির্কার লোক নই; বরং নবী করীম(স)-এর প্রতিষ্ঠিত ও সুন্নাত অনুসরণকারী সমাজের লোক। কিন্তু আমাদের এই ধারণা কতখানি যথার্থ, তা আমাদের অবশ্যই গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
আমরা আহলি সুন্নাত অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসরণকারী। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা রাসূলে করীম(স) এর কোন সুন্নাতের অনুসরণকারী? কঠিন ও কষ্টের সুন্নাতের, নাকি সহজ, নরম ও মিষ্টি মিষ্টি সুন্নাতের।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাসূলে করীম(স) এর জীবনে ও চরিত্রে এ উভয় ধরনের সুন্নাতেরই সমাবেশ ঘটেছে। তিনি একজন মানুষ ছিলেন। তাই মানুষ হিসেবেই তাঁকে এমন অনেক কাজই করতে হয়েছে, যা এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য দরকার। যেমন খাওয়া, পরা, দাম্পত্য ও সাংসারিক জীবন যাপন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে যে কাজ করেছেন শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তা-ও সুন্নাত বটে। তবে তা খুবই সহজ, নরম ও মিষ্টি সুন্নাত। তা করতে কষ্টতো হয়-ই না; বরং অনেক আরাম ও সুখ পাওয়া যায়। যেমন, কদুর তরকারী খাওয়া, মিষ্টি খাওয়া, পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা, মিস্ওয়াক করা, আতর-সুগন্ধী ব্যবহার করা, বিয়ে করা, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, লম্বা জামা-পাগড়ী বাঁধা, দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি।
কিন্তু রাসূলে করীম(স) এর জীবনে আসল সুন্নাত সেইসব কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ, যা তাঁকে সেই মুশরিক আল্লাহদ্রোহী সমাজে তওহীদি দাওয়াত প্রচার ও দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টার সাথে করতে হয়েছে। এই পর্যায়ে তাঁকে ক্ষুধায় কাতর হতে, পেটে পাথর বাঁধতে ও দিন-রাত অবিশ্রান্তভাবে শারীরিক খাটুনী খাটতে হয়েছে। শত্রুদের জালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে, পায়ে কাঁটা লাগাতে এবং তায়েফে গিয়ে গুন্ডাদের নিক্ষিপ্ত পাথরে দেহ মুবারককে ক্ষত-বিক্ষত করে রক্তের ধারা প্রবাহে পরনের কাপড় সিক্ত করতে ও ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন হয়ে রাস্তার ধারে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতে হয়েছে। এক সময় বনু হাশিম গোত্রের সাথে মক্কাবাসীদের নিঃসম্পর্ক ও বয়কট হয়ে আবু তালিব গুহায় ক্রমাগত তিনটি বছর অবস্থান করতে হয়েছে। সর্বশেষে পৈতৃক ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছে। কাফির শত্রু বাহিনীর মোকাবিলায় মোজাহিদদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ণ পরাক্রম সহকারে যুদ্ধ করতে, দন্ত মুবারক শহীদ করতে ও খন্দক খুদতে হয়েছে।
রাসূলে করীম(স) এর এসব কাজও সুন্নাত এবং সে সুন্নাত অনুসরণ করাও উম্মতের জন্য একান্ত কর্তব্য। তবে এ সুন্নাত অত্যন্ত কঠিন, দুঃসাধ্য ও প্রাণান্তকর চেষ্টার সুন্নাত।
সহজেই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই সুন্নাত পালন করছি? যদি না করে থাকি-করছি না যে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়- তাহলে রাসূলের সুন্নাত অনুসরণের যে দাবি আমরা করছি, তা কি সত্য বলে মনে করা যায়? বড়জোর এতটুকুই বলা চলে যে, হ্যাঁ, আমরা রাসূলের সুন্নাত অনুসরণ করছি বটে, তবে তা মিষ্টি, সহজ ও নরম নরম সুন্নাত। কিন্তু কঠিন, কষ্ট, প্রাণে ও ধন-সম্পদে আঘাত লাগে এমন কোনো সুন্নাত পালনের দিকে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তাও যে আমাদেরকে অবশ্য পালন করতে হবে, না করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট কঠিন জবাবদিহি করতে হবে, সেকথা স্মরণ করতেও যেন আমরা ভয় পাই।"
একটি প্রাসঙ্গিক বক্তব্যঃ
"যে কোন যুগে তুমি যদি কোন সঠিক ইসলামপন্থী দল খুঁজে না পাও, তাহলে চিহ্নিত ইসলাম বিদ্বেষী এবং ইসলামের পরীক্ষিত শত্রুদের দিকে তাকাও, তারা কোন দলটির প্রতি সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত। কেননা সঠিক ইসলামপন্থী দল মুসলমানরা চিনতে ভুল করলেও, ইসলামের চিহ্নিত শত্রুরা কখনো ভুল করে না।" --- ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ)।
রাজনীতি বিষয়ে আমার পরবর্তী আলোচনাটি সরাসরি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আবদুর রহীম এর বক্তব্য হতে তুলে ধরছি।
"রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে, তার সাথে কোনোরূপ সম্পর্ক না রেখে চলা আর এক প্রকারের বড় বিদয়াত, যা বর্তমান মুসলিম সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর লোকদের গ্রাস করে আছে। এ লোকদের দৃষ্টিতে রাজনীতি সম্পূর্ণ ও মূলগতভাবেই দুনিয়াদারীর ব্যাপার। দুনিয়াদার লোকেরাই রাজনীতি করে। আর যারাই রাজনীতি করে তাদের দুনিয়াদার হওয়ার একমাত্র প্রমাণই এই যে, তারা রাজনীতি করে। এই শ্রেণীর লোকদের মধ্যে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়, তারা বলে বেড়ায়ঃ ‘আমি রাজনীতি করিনা’ কিংবা ‘রাজনীতি অনেকদিন করেছি, এখন আর করিনা’ আবার কেউ কেউ বলেঃ ‘আমরা ধার্মিক লোক, রাজনীতির সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক্ নেই।’
এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি যে বিদয়াত, তার কারণ এই যে, তা স্বয়ং রাসূলে করীম(স) এর আদর্শ, কর্মনীতি ও আকীদার সম্পূ্র্ণ বিপরীত। রাসূলে করীম(স) এর নব্যুয়তের জিন্দেগীটি অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি রাজনীতি করেছেন, রাষ্ট্রের সাথে তাঁর কাজের সংঘর্ষ হয়েছে এবং শেষ পর্য্ন্ত তিনি সকল বাতিল রাষ্ট্র ও গায়র ইসলামী রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে পুরোপুরি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেছেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইসলামী আদর্শের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাসূলের জীবদ্দশায় ও তাঁর পরে এ রাজনীতি সাহাবায়ে কিরাম করেছেন, রাষ্ট্র চালিয়েছেন এবং রাষ্ট্র সংক্রান্ত যাবতীয় কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনরাও রাজনীতি করেছেন।
রাজনীতির কথা কুরআন মজীদে রয়েছে, রয়েছে হাদীসে, আছে এ দুয়ের ভিত্তিতে তৈরী ফিকাহ শাস্ত্রের মাসলা-মাসায়েলে। কাজেই রাজনীতি করা সুন্নাত। ইসলামী আদর্শের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রাজনীতি সুন্নাত, ইসলামী আদর্শ মোতাবিক-শুধু তাই নয়, তা হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। দুনিয়ায় নবী প্রেরণের মূলেও রয়েছে জমিনের বুকে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করা। নবীগণ দুনিয়ায় এ কাজ করেছেন পূর্ণ শক্তি দিয়ে, জীবন ও প্রাণ দিয়ে আর আধুনিক ভাষায় এ-ই হচ্ছে রাজনীতি।
আল্লাহর নিকট মানুষের জন্য মনোনীত জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে একমাত্র ইসলাম, অন্য কিছু নয়। এই হচ্ছে আল্লাহর ঘোষণাঃ
ইন্নাল্লাজিনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম।
এর অর্থও তাই। আর এ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করে মানব সমাজে আল্লাহর বিধান মোতাবিক ইনসাফ কায়েম করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ পাঠিয়েছেন আম্বিয়ায়ে কিরামকে।
আল্লাহ্ নিজেই ইরশাদ করেছেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ
-নিশ্চয়ই আমরা নবী রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে। তাদের সঙ্গে নাযিল করেছি কিতাব ও ইনসাফের মানদন্ড যেন লোকেরা হক ও ইনসাফ সহকারে বসবাস করতে পারে। আর দিয়েছি ‘লৌহ’। এর মধ্যে রয়েছে বিপুল ও প্রচন্ড শক্তি এবং জনগণের জন্য অপূর্ব কল্যাণ।
এ আয়াত থেকে যে মূল কথাটি জানা যাচ্ছে তা হলো, দুনিয়ার মানুষ সুষ্ঠু ও নির্ভূল ইনসাফের ভিত্তিতে জীবন যাপন করা সুযোগ লাভ করুক-এ উদ্দেশ্যে আল্লাহতা‘আলা নবী রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ যাতে করে দুনিয়ায় সঠিক ইনসাফ ও সুবিচার কায়েম করতে সক্ষম হন, তার জন্যে রাসূলগণকে আল্লাহর নিকট হতে প্রধানত দুটি জিনিস দেয়া হয়েছে বৈশিষ্ট্য ও আল্লাহর সরাসরি প্রেরণের নিদর্শন হিসেবে। তার একটি হলো-মোজেযা-অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ, যা লোকদের সামনে নবী-রাসূলগণের নব্যুয়ত ও রিসালাতকে সত্য বলে প্রমাণ করে দেয়। আর দ্বিতীয় হচ্ছে আল্লাহর কালাম-আসমানী কিতাব, যা নাযিল করা হয়েছে মানুষের জীবন যাপনের বাস্তব বিধান হিসেবে।
এছাড়া আরো দু’টি জিনিস দেয়া হয়েছে। একটি হলো ‘মীযান’ মানে মানদন্ড, মাপকাঠি; যার সাহায্যে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা যায়। আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতের তাফসীরে ‘মীযান’ শব্দের ব্যাখ্যা হিসেবে লিখেছেনঃ ‘মীযান’ মানে মুজাহিদ এবং কাতাদার মতে ‘সুবিচার ও নিরপেক্ষ ইনসাফ’। আর তা হচ্ছে এমন এক সত্য যা সুস্থ, অনাবিল ও দৃঢ় জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক হতে প্রমাণিত। আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে আল হাদীদ। ‘হাদীদ’ মানে চলতি কথায় ‘লৌহ’। আর এর শাব্দিক অর্থ ইমাম রাগেবের ভাষায় ধারালো, তীক্ষ্ম, শক্তভাবে প্রভাব বিস্তারকারী জিনিস। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এসব বিভিন্ন অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
অতএব এর অর্থ আমরা বুঝতে পারি, প্রথমত লৌহ ধাত, দ্বিতীয়ত এক শক্ত শাণিত ও অমোঘ প্রভাব বিস্তারকারী ও ক্ষমতা প্রয়োগকারী জিনিস। আর নবী রাসূলের প্রসঙ্গে এর অর্থ অনায়াসেই বুঝতে পারিঃ ‘জবরদস্ত শক্তি’। ইংরেজীতে যাকে বলা হয় Coercive Power বা অন্য কথায় ‘রাষ্ট্রশক্তি’।
নবী-রাসূলগণ আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে তীব্র তীক্ষ্ম শক্তিসম্পন্ন ও অমোঘ কার্য্কর রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতেন, তারই সাহায্যে লৌহ নির্মিত অস্ত্র ব্যবহার করে সমস্ত অন্যায় ও জুলুমের পথ বন্ধ করতেন, আর নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের ওপর নিরপেক্ষ ইনসাফ কায়েম করতেন। কাজেই নবী-রাসূলগণকে যে ইনসাফ কায়েমের উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল, খতমে নব্যুয়তের পর সে ইনসাফ কায়েম করা এবং তারই জন্য তীব্র শক্তি প্রভাবশালী রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্টিত করা নবীর উম্মতের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর এ শক্তি অর্জন করতে চেষ্টা করা, এ শক্তি অর্জন করে তার সাহায্যে ইনসাফ কায়েম করাকেই আধুনিক ভাষায় বলা হয় রাজনীতি। এ কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাসূলে করীম(স) এ বাণীতেঃ
নিশ্চয়ই আল্লাহতা‘আলা রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে এমন অনেক কাজই সম্পন্ন করেন, যা কুরআন দ্বারা তিনি করাননা।(কোনো কোনো মনীষীর মতে এ কথাটি হযরত উসমান(রা) এর, হযরত মুহাম্মদ(স) এর নয়। সেটা হতেও পারে, তিনি কথাটি রাসূলের নিকটই শুনেছিলেন হয়তো। আর তা না হলেও সাহাবীদের কথারও গুরুত্ব অনস্বীকার্য্। তাও হাদীস হিসেবে গণ্য। সাহাবীগণ রাসূলে করীম(স) এর নিকট হতেই দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞান লাভ করেছিলেন।)
তার মানে আল্লাহর চরম লক্ষ্য হাসিলের জন্য কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র শক্তি অপরিহার্য্। কুরআনকে কার্য্কর করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশক্তিকে প্রয়োগ না করলে কুরআন আপন শক্তির বলে মানব সমাজে কার্য্কর হতে পারবেনা।
এছাড়া কুরআন মজীদে নির্দেশ রয়েছেঃ
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ ۖ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ ۚ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ ۚ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ [٤٢:١٣]
-আল্লাহতা‘আলা তোমাদের দ্বীনের জন্য সে পন্থাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যার হুকুম তিনি দিয়েছিলেন নূহকে, আর অহীর সাহায্যে – হে মোহাম্মদ-এখন তোমার দিকে পাঠিয়েছি, আর যার হেদায়াত আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছি এই তাগিদ করে যে, কায়েম করো এই দ্বীনকে এবং এ ব্যাপারে তোমরা বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্নপন্থী হয়ে যেওনা। হে নবী, তুমি যে জিনিসের দাওয়াত দিচ্ছ তা মুশরিকদের নিকট বড়ই দুঃসহ ও অসহ্য হয়ে উঠেছে। আল্লাহ যাকে চান যাচাই করে আপনার বানিয়ে নেন এবং তাঁর নিজের দিকে যাওয়ার ও পৌছার পথ তাকেই দেখান, যে তাঁর দিকে রুজু হবে। (আশ শুরাঃ13)।
এ আয়াত স্পষ্ট বলছে যে, হযরত নূহ(আ) হতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(স) কেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর দেয়া এ দ্বীনকে পুরোপুরি কায়েম করো। হযরত মুহাম্মদ(স) সব বাতিল আদর্শে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চূর্ণ করে এ দ্বীনকে কায়েম করার এবং দ্বীনের ভিত্তিতে সমাজ, জীবন ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গড়ে তোলারই দাওয়াত দিচ্ছিলেন তখনকার সময়ের লোকদের মধ্যে। আর এ জিনিসই ছিল মুশরিকদের জন্য বড় দুৎসহ। দ্বীন কায়েমের দাওয়াত ও চেষ্টা মুশরিকদের পক্ষে সহ্য করা এ জন্য দুঃসহ ছিল যে, তার ফলে মানুষের জীবন থেকে শিরকের নাম নিশানা পর্য্নত মুছে যাবে। আর শিরকই যদি না থাকলো, তাহলে তো মুশরিকদের অস্তিত্বই নিঃশেষ হয়ে গেল। তার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এখানে দ্বীনকে কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, দেয়া হয়েছে রাসূলে করীমের নবুয়্যতী জিন্দেগীর প্রথম দিকেই। দ্বীনকে শুধু প্রচার করার নির্দেশ কোরআন মজীদে কোথাও নেই। আর দ্বীন কায়েমের মানে হলো মানুষের মন, জীবন, আকীদা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পলিসি ও ব্যবস্থাকে দ্বীনের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং আল্লাহর দেয়া আইন বিধানকে বাস্তবভাবে জারী ও কার্য্কর করা, তারই ভিত্তিতে শাসন, বিচার, শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পূর্ণমাত্রায় রূপায়িত করা।
(কুরআন মজীদে আল্লাহ নির্ধারিত ফৌজদারী আইনকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর দ্বীন’। সূরা আন-নূর এ যিনাকারী পুরুষ ও নারীকে শরীয়তী দন্ড হিসেবে কোড়া মারার নির্দেশ দেয়ার পর বলা হয়েছেঃ আল্লাহর দ্বীন জারী ও কার্য্কর করার ব্যাপারে সে দুজনের প্রতি দয়া ও মায়া যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাকো। এ আয়াতে কোড়া মারা ফৌজদারী আইনকে ‘আল্লাহর দ্বীন’ বলা হয়েছে।)
অতএব দ্বীন কায়েম করা, কায়েম করার চেষ্টা করা হযরত মুহাম্মদ(স) এর প্রতি ঈমানদার মুসলমানের মাত্রেরই দ্বীনি ফরয, যেমন ফরয নামায কায়েম করা, যাকাত দেয়া ইত্যাদি। হাদীসেও দ্বীন কায়েম করার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।
একটি হাদীসে নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ কেউ যদি তার যিনার অপরাধ আমাদের সামনে প্রকাশ করে দেয় তাহলে আমরা তার ওপর আল্লাহর কিতাব কায়েম করে দেবো।
‘আল্লাহর কিতাব কায়েম করে দেব’ কথার অর্থ আল্লাহর কিতাবে লিখিত যিনার শাস্তি তার ওপর কার্য্কর করে দেবো, তাকে সেই শাস্তি দেবো, যা আল্লাহর কিতাবে লিখিত রয়েছে। এখানে আল্লাহর কিতাব কায়েম করার মানে হলো আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী আইন জারী করা। অনুরূপভাবে দ্বীন কায়েম করার মানে হলো দ্বীন অনুযায়ী পূর্ণ জীবন পূণর্গঠিত করা। রাসূলে করীম(স) এ নির্দেশ পেয়েছিলেন তাঁর নব্যুয়তের প্রাথমিক পর্যায়েই। পূর্বোক্ত আয়াতটি হলো সূরা আশ শুরার। আর তা মক্কা শরীফেই অবতীর্ণ হয়েছিলো। উক্ত সূরায় পূর্বোদ্ধুত আয়াতের একটু পূর্বেই রয়েছে এ আয়াতটিঃ
وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّتُنذِرَ أُمَّ الْقُرَىٰ وَمَنْ حَوْلَهَا وَتُنذِرَ يَوْمَ الْجَمْعِ لَا رَيْبَ فِيهِ ۚ [٤٢:٧]
-এমনিভাবে হে মুহাম্মদ! তোমার প্রতি আরবী ভাষার কিতাব এ কুরআনকে ওহী করে পাঠিয়েছি এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি এ কিতাবের মাধ্যমে মক্কাবাসী ও তার আশেপাশের লোকদের ভয় দেখাবে, ভয় দেখাবে একত্রিত হওয়ার সেই দিনটি সম্পর্কে, যে দিনের উপস্থিতির ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।
এ আয়াতে নবী করীম(স) কে ভয় দেখাবার কাজ করতে বলা হয়েছে আর তারই ভিত্তিতে পরবর্তীতে দেয়া হয়েছে দ্বীন কায়েমের নির্দেশ। তার মানে দ্বীন কায়েম করা বা সেজন্য চেষ্টা করা পরকালের প্রতি ঈমানের অপরিহার্য্ দাবি। তা করা না হলে সে দিন আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। আর এ-ই ছিল নবী করীম(স) এর নব্যুয়তের প্রাথমিক পর্যায়ের দাওয়াত ও সাধনা। এ ছিলে সে জিহাদ, যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল নবী করীম(স) কে মক্কার জীবনেই এ আয়াতেঃ
فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُم بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا [٢٥:٥٢]
- হে নবী কাফির লোকদের আনুগত্য স্বীকার করবেনা কখনো এবং কিছুতেই। বরং কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী কাফিরদের সাথে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগে ও সর্বাত্মকভাবে জিহাদ করবে।
কাফিরদের আনুগত্য স্বীকার না করার-তা অস্বীকার ও অমান্য করার এবং এ বাতিলপন্থীদের পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করে তাদের ক্ষমতাচ্যূত করার সাধনাই ছিল প্রথম দিন থেকে বিশ্বনবীর সাধনা।(এ পর্যায়ে আল্লামা ইবনূল কাইয়্যেম লিখেছেনঃ যেদিন প্রথম তাঁকে নবী রূপে নিয়োগ করলেন, সেদিনই আল্লাহ তাঁকে জিহাদ করার নির্দেশ দিলেন।
আর কোরআনের পূর্বোক্ত আয়াত সম্পর্কে তিনি লিখেছেনঃ এ সূরাটি মক্কায়ই অবতীর্ণ। এতে আল্লাহতা‘আলা রাসূলকে কাফির (এবং মুনাফিকদের) সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।)
আর আজকের ভাষায় এই হচ্ছে দ্বীন কায়েমের রাজনীতি। নবীর এ সাধনারই বাস্তব ফল পাওয়া গেছে হিজরতের পরে মদীনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থারূপে।
এ দৃষ্টিতে তাঁদের কথা ভুল প্রমাণিত হয় যারা বলে বেড়ান যে, ‘নবী করীম(স) দ্বীন কায়েম করার-ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার- কোনো দাওয়াত দেননি বা সেজন্য কোনো চেষ্টা করেননি।’ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রতো ছিল আল্লাহর দান মাত্র। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করার দাওয়াত সব নবীরই মৌলিক দাওয়াত ছিলো, সর্বশেষ নবীর সাধনাও ছিল তারই জন্য।
একথা আজকের দিনে কেবল কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণেই জানা যাচ্ছে তা নয়; খোদ সাহাবীগণ একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন যে, রাসূলে করীম(স) কে দ্বীন কায়েমের এ মহান উদ্দেশ্যেই দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এবং সাহাবায়ে কিরাম (রা) ছিলেন এ কাজের জন্যেই তাঁর সঙ্গী ও সাথী। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের কথা পূর্বেই উদ্বৃত হয়েছে।
তিনি সাহাবীদের সম্পর্কে বলেছেনঃ আল্লাহতা‘আলা তাঁদের বাছাই করে মনোনীত করে মনোনীত করে নিয়েছেন তাঁর নবীর সঙ্গী সাথী হওয়ার জন্য এবং তাঁর দ্বীনকে কায়েম করার উদ্দেশ্যে।
এখানে দুটো কথা বলা হয়েছে। প্রথম কথাটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের ফযীলত ও মর্যাদা-শ্রেষ্টত্বের একমাত্র ভিত্তি হলো রাসূলে করীমের সোহবত লাভ করা, তাঁর সঙ্গী ও সাথী হওয়া। তাঁরা কি কাজে রাসূল(স) এর সঙ্গী ও সাথী ছিলেন? সকলেই জানেন, রাসূলে করীমের(স) রিসালাতের মূল দায়িত্ব পালনের ব্যাপারেই তাঁরা ছিলেন রাসূলের সঙ্গী ও সাথী। আর এ এত বড় মর্যাদা ও শ্রেষ্টত্বের ব্যাপার যে-ঈমান, আমল ও তাকওয়া-তাহরাতের উচ্চতম মর্যাদাও এর সমতুল্য হতে পারেনা।
আর দ্বিতীয় কথা বলা হয়েছে, আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে কায়েম করার উদ্দেশ্যেই রাসূলের সাহাবীদেরকে মনোনীত করেছেন। সাহাবীদের ব্যাপারে এ হলো আল্লাহর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য। আর এ উদ্দেশ্য প্রথম উদ্দেশ্যেরই পরিপূরক। বরং বলা যায়, তাঁদের নবীর সঙ্গী ও সাথী বানিয়ে দেবার মূল লক্ষ্যই ছিলো আল্লাহর দ্বীন কায়েম করা। একথা থেকে স্বয়ং নবী করীম(স) এর আগমনের উদ্দেশ্যও স্পষ্টভাবে বোঝা গেল। জানা গেল যে, নবীর জীবন লক্ষ্য ও ছিল আল্লাহর দ্বীন কায়েম করা এবং সাহাবীদের উদ্দেশ্যও ছিল তা-ই। নবীর আগমন, লক্ষ্য ও সাহাবীদের জীবন উদ্দেশ্য দু’রকমের ছিল কিংবা পরস্পর বিপরীত ছিলো-তার ধারণাও করা যায়না। যে মহান উদ্দেশ্যে আল্লাহতা‘আলা সাহাবায়ে কিরাম(রা)-কে নবী করীম(স) এর সঙ্গী ও সাথী বানিয়ে দিয়েছেন, তা হলো আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করা আর এ কারণেই নবী করীম(স) এর ইন্তিকালের সঙ্গে সঙ্গে সাহাবীদের এ দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। বরং তা ছিল তাঁদের জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্য্ন্ত শাশ্বত কর্তব্য। এ থেকে এ কথাও বোঝা গেল যে, আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে সাহাবীদের বাছাই ও মনোনীত করেছিলেন, তা কেবল মদীনাতেই মনোনীত ছিলনা, করণীয় ছিল মক্কায়ও। বরং মক্কী জীবন থেকেই যারা রাসূলে করীম(স) এর সাহাবী হয়েছিলেন, সাহাবীদের মধ্যে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা ছিল সর্বাধিক। এ থেকে একথাও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, নবী করীম(স) ও সাহাবীদের জীবন উদ্দেশ্য মক্কী জীবনেও তাই ছিলো, যা ছিল মাদানী পর্যায়ে। মদীনায় গিয়ে যেমন কোনো নতুন লক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি, তেমনি মদীনায় যাওয়ার পর মক্কী পর্যায়ের লক্ষ্য ও বদলে যায়নি। এমন হয়নি যে, নবী করীম(স) সাহাবায়ে কিরাম মক্কায় এক ধরনের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিলেন আর মদীনায় গিয়ে ভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। অতএব গোটা মুসলিম উম্মতের উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব তা-ই ছিলো যা ছিলো স্বয়ং রাসূলে করীম(স) ও সাহাবায়ে কিরামের। তাঁদের পদাংক অনুসরণ করা, শুধু ‘দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে কওম ও হুকুমাতকে রাহমুনায়ী’ করে এ কর্তব্য পালন হতে পারেনা। বরং সেজন্য প্রত্যক্ষভাবে দ্বীন কায়েমের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য।(এখানে মনে করতে হবে যে, যারা শুধু কলেমার তাবলীগ করেন এবং বলেন, আমরা নবীর মক্কী পর্যায়ের কাজ করছি, তারা কিন্তু মোটেই সত্যি কথা বলছেননা। বরং নবীর মক্কী পর্যাযের কাজকে এরূপ বিকৃতরূপে পেশ করে তারা বড় অপরাধ করছেন। মক্কী পর্যায়ে রাসূল(স)ইসলামী রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে আদর্শ পেশ করেছেন, মাদানী পর্যায়ে তা-ই কায়েম করেছেন। কাজেই তাঁর কাজ এক অখন্ড ও অবিভাজ্য আদর্শ, তাকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়না। বিভক্ত করা হলে তা নিঃসন্দেহে বিদয়াত হবে।)
এ যদি রাজনীতি হয়ে থাকে, তবে এ রাজনীতি তো দ্বীন-ইসলামের হাড়মজ্জার সাথে মিশ্রিত, ইসলামের মূলের সাথে সম্পৃক্ত। সব নবী এ দ্বীনই নিয়ে এসেছিলেন এবং সব নবীর প্রতি এ রাজনীতি করারই নির্দেশ ছিল আল্লাহর তরফ থেকে। আজ যাঁরা এ রাজনীতিকে ক্ষমতার লোভ বলে দোষারোপ ও ঘৃণা প্রকাশ করছেন, তাঁরা বুঝতে পারেননা যে, এ দোষারোপ কার্য্ত রাসূলে করীম(স) এর ওপরই বর্তায়। বর্তায় মহান আদর্শ স্থানীয় সাহাবায়ে কিরামের ওপর, বর্তে দুনিয়ার মুজাদ্দিদীন ও ইসলামের মুজাহিদীনের ওপর। এ রাজনীতি ছাড়া দ্বীন, কোনোভাবেই দ্বীন ইসলাম নয়, সে দ্বীন নয়, যা নিয়ে এসেছিলেন আখেরী নবী। এ রাজনীতি পরিহার করে চলা এবং একে ‘ক্ষমতার লোভ’ বলে ঘৃণা করা ও গালাগালি করাই হলো এক অতি বড় বিদয়াত। এ বিদয়াত খতম করা না হলে ইসলাম রক্ষা পেতে পারেনা। এহেন রাজনীতিকে অস্বীকার করা, তাকে পাশ কাটিয়ে চলা এবং ‘‘দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে জনগণ ও সরকারকে শুধু রাহমুনায়ী করা কিংবা রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থেকে ধর্মের কিছু অংশ প্রচার করাকে যে নিঃসন্দেহে কুরআন হাদীসের মূল ঘোষণা তথা ইসলামের প্রাণ শক্তিকেই অস্বীকার করার শামিল, তা কে অস্বীকার করতে পারে?”
নবী করীম(স) এর প্রতি ঈমান এনেই আমরা মুসলিম হতে পেরেছি। তিনিই আমাদের একমাত্র আদর্শ। আর তাঁর সাহাবী সে আদর্শানুসারী লোকদের প্রথম কাফেলা, আমাদেরও অগ্রপথিক? তাঁরা কি রাজনীতি চর্চা করেছেন? না তাঁরা দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে শুধু রাহনুমায়ী-ই(?) করে গেছেন, না নিজেরাই রাজনীতির মাঝদরিয়ায় ঝাঁপ দিয়ে মানুষকে গায়রুল্লাহর গোলামী থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর বন্দেগীর পথে নিয়ে গেছেন? যে কেউ রাসূলের জীবন কাহিনী ও সাহাবীদের দিন রাতের ব্যস্ততার কথা জানেন, তাঁদের মনে এ ব্যাপারে কোনো অস্পষ্টতা থাকতে পারেনা। তাঁরা নিঃসন্দেহে জানেন, রাসূল করীম(স) ও সাহাবায়ে কিরাম রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করেছেন, তাঁর সাহায্যে ইসলামী জীবন বিধানকে বাস্তবায়িত করেছেন, অন্যায় ও জুলুমের প্রতিরোধ করেছেন এবং ন্যায় এর প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই আল্লাহর দ্বীনকে কায়েম করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর বিধান মোতাবিক ও রাসূলের দেখানো পথে ও নিয়মে যে রাজনীতি, সে রাজনীতি করা প্রকৃতই সুন্নাহ এবং তা বাদ দিয়ে চলা, আর এ রাজনীতিকে বাদ দিয়ে চলার রাজনীতেকে সুন্নাত বা ‘ইসলামের রীতি’ বলে বিশ্বাস করা সুস্পষ্টভাবে বিদয়াত। এ বিদয়াত ইসলামকে এক বৈরাগ্যবাদী ধর্মে পরিণত করেছে। শুধু তা-ই নয়, মুসলিমদের উপর ফাসিক ফাজিরদের কর্তৃত্ব, জুলুম ও শোষণ চলার স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বস্তুত নবী করীম(স) যদি এদের মতো নীতি অনুসরণ করতেন, যদি তদানীন্তন আরব সমাজের প্রধান আবু জেহেল ও আবু লাহাব এর প্রতি তাদের শুধু ‘রাহনুমায়ী’ করার নীতিই গ্রহণ করতেন, তাহলে মুশরিক কাফিরদের তরফ হতে এত বিরুদ্ধতা হতোনা, রাসূলকে হিজরত করতে, জিহাদে দাঁত ভাঙতে ও সাহাবীদের শহীদ হতে হতোনা কখনো। বরং তাঁরা এ ধরনের নীতি গ্রহণ করে লাখ লাখ টাকা পেতে পারতেন, যেমন একালের এক শ্রেণীর আলিম ও পীরেরা পাচ্ছে এ যুগের আবু জেহেল ও আবু লাহাব এর কাছ থেকে। আর তা-ই যদি তাঁরা করতেন, তাহলে এ যুগে ইসলামের কোনো অস্তিত্বই থাকতোনা, হতো না ইসলামের কোনো ইতিহাস- কোনো গৌরবোজ্জ্বল জীবন্ত কাহিনী।
প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের রাজনীতি করা ইমাম মুজতাহিদগণের মতে এবং ফিকাহ ও আকাঈদের দৃষ্টিতেও ঈমানেরই তাগিদ-একান্তই কর্তব্য।"
বিষয়: রাজনীতি
২২৮৭ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অর্থ;-নিশ্চয় আমি আমার রসুলগণকে স্পষ্ট প্রমান সহ প্রেরণ করেছিলাম৷ এবং তাদের সাথে নাজিল করেছি কিতাব ও ন্যায় দণ্ড৷ যাতে মানুষ ইনসাফ কায়েম করে৷ আর আমি লৌহ নাজিল করেছি, যাতে রয়েছে প্রচণ্ড রণশক্তি৷ এবং মানুষের জন্য আরও বহুবিধ উপকার৷ এটা এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নেবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসুলগণকে সাহায্য করে৷ আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী৷
# এ আয়াতটি এ সুরার মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরেছে৷ দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিজয়ের পথে এমন উদ্দিপক ও উন্মুক্ত আয়াত সারা কোরআনে দ্বিতীয়টি নাই৷ এ আয়াতের অধিক ব্যাখ্যা সুরা ‘সাফ’ এ পাওয়া যাবে৷
ইসলাম আচরণ সর্বস্য ধর্ম নয়৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় ইসলাম কয়েকটি আচরণে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, রোজা, নামজ, ঈদ, ওমরা, হজ্জ, মিলাদ, জিকির, গাস্ত, ইজ্তেমা ইত্যাদীতে৷ অথচ কোরআন এ গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার জন্য আসেনি৷ তাইবলে এ গুলো অস্বীকার করার উপায় নেই৷ ব্রিটীশ ভারতে এক মহা বিজ্ঞ আলেম ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, শাসকের বিরুদ্ধাচাণ করা অন্যায়, কারণ তারা আমাদের মাজহাবী অধিকার দিয়েছেন৷ জবাবে আল্লামা ইকবাল লিখলেন যে, মৌলানার মতে সেজদার অধিকারই ইসলামের স্বাধিনতা৷
এ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি রসুলগণকে বাইয়েনাত, (মোজেজা) কিতাব ও মিজান (ন্যায়দণ্ড) সহ পাঠিয়েছিলাম, যাতে তারা মানুষের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে’৷ সুরা ‘আলে ইমরানে’ আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কায়েমাম বিল কিসতে’, তিনি ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান আছেন৷ সুরা ‘নিসা’য় বলা হয়েছে. (১৩৫) ‘কুনু কাউয়মিনা বিল কিসতে’, সুরা ‘মাঈদায়’ বলা হয়েছে, ‘কুনু কাউয়ামিনা লিল্লাহে শুহাদাআ বিল কিসতে’, সুরা ‘আশ শুরা’য় বলা হয়েছে, ‘আনা উমিরতো লে আ’দেলা’৷ এ ছাড়া সুরা ‘মাঈদার ৬৮ আয়াতে, কিতাব, তাওরাতও ইঞ্জীলের যায়গায় কোরআন শব্দটা বসিয়ে দেখি, আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে আহলে কিতাব গণ, তোমাদের কোন গ্রহণযোগ্যতা (হাইসিয়াত) নেই যতক্ষণ না তোমরা তাওরাত, ইঞ্জীল ও আল্লাহ যা পাঠিয়েছেন তা প্রতিষ্ঠা কর’৷ এতে বিষয়টি পরিষ্কার যে কিতাব ও কোরআনের আসল দাবী দুনিয়ায় ইনসাফ (ন্যায়) প্রতিষ্ঠা করা৷
সোনার কালিতে কোরআন লিখে, রমজানে কোরআন খতম, কোরআনের বড় বড় তাফসীর লিখে, সাবিনা খতম দিয়ে, তাবিজ করে গলায় ঝুলিয়ে কোরআনের দাবী পুরণ হবে না৷ তাকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ তার জন্য চাই ইসলামী নেজাম বা শাসণ ব্যবস্থা৷ যা মোটেও সহজ কাজ নয়৷ বাতিল বা তাগুত, যারা অন্যের অধিকার হরণ করে, তারা জায়গা ছেড়ে দেবে না৷ তাদের শায়েস্তা করার জন্যই আল্লাহ লোহা নাজিল করেছেন, যাতে সমরাস্ত্র ছাড়া ও হাতা, বেড়ী, খুন্তি তৈরী হয়৷ একই আয়াতে এ ঘোষণাও দিয়েছেন৷ তবে, এর জন্য শক্তির প্রয়োজন৷ এ শক্তি সঞ্চয় করতে রসুল সঃ মক্কায় বারো বছর ব্যয় করেছেন৷ তার পর বাতিলের মাথা তেঁতলে দিয়েছেন৷ আল্লাহ বলেন, ‘আমি হক্কের আঘাতে বাতিলকে গুঁড়িয়ে দিই৷
এটিও একটি পরীক্ষা৷ আল্লাহ দেখতে চান যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে না দেখেও কারা এ কাজে তাঁর নাজিলকৃত লৌহনির্মিত সমরাস্ত্র নিয়ে জান হাতে নিয় ময়দানে নামে৷ যদিও এ কাজ রসুল সঃ এর জন্যই ছিল ফরজ৷ তাঁকে সাহায্য করার জন্যও তাঁর উম্মতকে আহবান করা হয়েছে, ‘কুনু আনসারুল্লাহে’৷
সুন্দর বিশ্লেষণ। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
আমাদের জনগন ইসলামী রাজনীতি নিয়ে যে বিভক্তি তার জন্য দায়ী - যারা তাদের চরিত্র প্রকাশিত হল।
ইসলামে রাজনীতি নেই - বা আগ্রহ না থাকা - এগুলো নিফাকের লক্ষণ।
শাইখ আল্লামা তিলমেসানী বলেছেন - ইসলামী আন্দোলন যে ঈমানদার সম্পৃক্ত নয় তার ঈমানদার হিসাবে গর্ব করার মত আর কিছু থাকে না।
মত্ত করিয়া রাখ ইহাদের উপাসনা আর জপের মাঝে,
"খানকা-মেজাজ" দৃঢ়তর কর,উদাসিন রাখ সকল কাজে।
(ইবলিশ কি মজলিশ ই শুরা- ইকবাল)
ইবলিশের প্রতিনিধি হয়েই কিছু লোক মুসলিম দের প্রশাসন ও রাজনিতি হতে দুরে রাখতে চায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন