বিদআত (পর্ব এক)
লিখেছেন লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:৪৭:২০ সকাল
আসসালামু আলাইকুম। ‘ডিয়ার মুসলিমস ইসলাম ইজ নট অ্যা ম্যাটার অব জোকস’ শিরোনামে আমার যে ধারাবাহিকটি চলছিল সেটিরই পরবর্তী পর্ব এটি। উক্ত শিরোনাম পুনরুল্লেখ না করে ‘বিদআত’ শিরোনাম দিয়ে এটি চলবে কয়েকটি পর্ব পর্যন্ত।
বিদআত খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের অনেক আলেম এর মাঝেও ভুল বোঝাবুঝি আছে। এছাড়া এ প্রসঙ্গে আমাদের অনেকেরই ধারণা অস্বচ্ছ ও অপূর্ণাঙ্গ।
বেশিরভাগ সাধারণ মুসলমানের ধারণা, বিদআত ইসলামে নাজায়েয ও মন্দ একটি বিষয় কিন্তু সেটি সুনির্দিষ্ট ভাবে কি তা তারা জানেন না।
কেউ মনে করেন, নতুন কিছু মানেই বিদআত। কেউ কেউ বিদআতীদের সরাসরি ‘বাতিল’ বা তাগুত ও বলে ফেলেন। এটিও মূলত বাড়াবাড়ি। শুধু বিদআতী কর্মের জন্য কাউকে তাগুত বলা যায় না। যারা বিদআত করেন বেশিরভাগ করেন অজ্ঞতার কারণে, কুরআন হাদীসের সঠিক জ্ঞানের অভাবে ও বিদআতী আলেমদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে। তারা নিজেরাও জানেন না সেটা বিদআত।
বিদআত সমর্থক একশ্রেণীর আলেম বিদআতকে জায়েয করার জন্য এটিকে ‘ভাল বিদআত ও মন্দ বিদআত’ নামে শ্রেণীবিভাগ করেন যেটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
অনেকে আবার বিদআতের বিরুদ্ধে যতটা খড়গহস্ত, শিরকের বিরুদ্ধেও ততটা নয়। কিন্তু শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গোনাহ যার সাথে অন্য কোন পাপই তুলনীয় নয়। তবে কিছু কিছু বিদআত শিরকের পর্যায়েও পড়ে(পরবর্তীতে আলোচিত হবে ইনশাল্লাহ)। বিষয়টি এভাবে বলা যায়-‘সকল শিরকই বিদআত, কিন্তু সকল বিদআত শিরক নয়’।
তবে নিঃসন্দেহে বিদআত দ্বীনকে বিকৃত করে দেয় এবং ধীরে ধীরে বিদআতী গোমরাহীর দিকে এগিয়ে যায়। এজন্য এ বিষয়টি নিয়ে খুব সতর্কতা জরুরী।
আসুন, এবার আমরা আলোচনা করি বিদআত বলতে আসলেই কি বুঝায়?
‘বিদয়াত’ শব্দের ব্যাখ্যা
এককথায় বলা যায়-বিদআত হচ্ছে ‘সুন্নাত’ এর বিপরীত। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে আদর্শ দুনিয়ার মানুষের সামনে উপস্থাপিত করেছেন, এক কথায় তা-ই সুন্নাত এবং তার বিপরীত যা কিছু তা বিদয়াত এর পর্যায়ে গণ্য।
বিদয়াত সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে রাসূলে করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ
তোমরা নিজেদের দ্বীনে নিত্য নব-উদ্ভূত বিষয়াদি থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। কেননা দ্বীনে প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত জিনিসই বিদয়াত এবং সব বিদয়াতই চরম গোমরাহীর মূল। (আহমাদ)
ইমাম রাগেব ‘বিদয়াত’ শব্দের অর্থ লিখেছেনঃ কোনরূপ পূর্ব নমুনা না দেখে এবং অন্য কোন কিছুর অনুকরণ অনুসরণ না করেই কোনো কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা।
আর দ্বীনের ক্ষেত্রে যে বিদয়াত তার সংজ্ঞা হিসেবে লিখেছেনঃ
দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদয়াত হচ্ছে এমন কোনো কথা উপস্থাপন করা, যার প্রতি বিশ্বাসী ও যার অনুসারী লোক কোন শরীয়ত প্রবর্তক বা প্রচারকের আদর্শে আদর্শবান নয়, শরীয়তের মৌলনীতি ও সুষ্ঠু পরিচ্ছন্ন আদর্শের সাথেও যার কোন মিল নেই।
অর্থাৎ শরীয়ত প্রবর্তক যে কথা বলেননি সে কথা বলা এবং তিনি যা করেননি এমন কাজকে আদর্শরূপে গ্রহণ করা তা-ই হচ্ছে বিদয়াত।
ইমাম নবয়ী বিদয়াত শব্দের অর্থ লিখেছেনঃ
এমন সব কাজ করা বিদয়াত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।
আর আল্লামা মুল্লা-আলী আল কারী লিখেছেনঃ
রাসূলের যুগে ছিলনা এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করা।
ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ
আরবী ভাষায় বলা হয় অমুক লোক বিদয়াত করেছেন। আর এর মানে বোঝা হয়ঃ অমুক লোক নতুন পন্থার উদ্ভাবন করেছে, যা ইতিপূর্বে কারো দ্বারাই অনুসৃত হয়নি।
তার মানে, শরীয়ত মোতাবিক নয়- এমন কাজকে শরীয়ত মোতাবিক বলে আকীদা হিসেবে বিশ্বাস করে নেয়াই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বিদয়াত।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মওলানা আবদুর রহীম (রহ) তাঁর সুলিখিত ও এ বিষয়ে মানবরচিত অদ্বিতীয় গ্রন্থ ‘সুন্নাত ও বিদআত’ এ উল্লেখ করেছেনঃ ‘নবী করীম (সাঃ) এর তেইশ বছরের অবিশ্রান্ত সাধনা ও সংগ্রামের মাধ্যমে যে সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাকে তিনি মুক্ত করেছিলেন সকলপ্রকার বিদয়াত ও জাহিলিয়াতের অক্টোপাশ থেকে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুন্নাতের আলোকোদ্ভাসিত মহান আদর্শের উপর। বিশ্ব মানবতার পক্ষে এ ছিল মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। উত্তরকালে নানা কারণে মুসলিম সমাজ সুন্নাতের আদর্শ হতে বিচ্যূত হয়ে পড়ে, তাদের আকীদা ও আমলে প্রবেশ করে অসংখ্য বিদয়াত।’
মোটকথা দাঁড়াল এই যে, বিদয়াত বলা হয় দ্বীন-ইসলামের এমন কর্মনীতি বা কর্মপন্থা চালু করাকে, যা শরীয়তের বিপরীত এবং যা করে আল্লাহর বন্দেগীর ব্যাপারে আতিশয্য ও বাড়াবাড়ি করাই হয় লক্ষ্য।
আবার প্রকৃত বিদয়াত ও আপেক্ষিক বিদয়াত এর পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ প্রকৃত ও সত্যিকারের বিদয়াত তাই, যার স্বপক্ষে ও সমর্থনে শরীয়তের কোনো দলীলই নেই। না আল্লাহর কিতাব, না রাসূলের হাদীস, না ইজমার কোনো দলীল, না এমন কোনো দলীল পেশ করা যায় যা বিজ্ঞজনের নিকট গ্রহণযোগ্য। না মোটামোটিভাবে, না বিস্তারিত ও খুঁটিনাটিভাবে। এজন্য এর নাম দেয়া হয়েছে বিদয়াত। কেননা তা মনগড়া, স্ব-কল্পিত, শরীয়তে যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।
প্রখ্যাত হাদীসবিদ ইমাম খা্ত্তাবী বিদয়াতের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেঃ
যে মত বা নীতি দ্বীনের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, নয় কোনো দৃষ্টান্ত কিংবা কিয়াস সমর্থিত- এমন যা নবোদ্ভাবিত করা হবে, তাই বিদয়াত। কিন্তু যা দ্বীনের মূলনীতি মোতাবিক, তারই ভিত্তিতে গঠিত, তা বিদয়াতও নয়, গোমরাহীও নয়।
কুরআন ও হাদীসে ‘বিদয়াত’ শব্দের উল্লেখ
কুরআন মজীদে ‘বিদয়াত’ শব্দটি তিনটি ক্ষেত্রে তিনভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
একঃ আল্লাহ সম্পর্কে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে দুটি আয়াতে। একটি আয়াতঃ ‘আসমান জমিনের সম্পূর্ণ নবোদ্ভাবনকারী, নতুন সৃষ্টিকারী। তিনি যখন কোনো কাজের ফায়সালা করেন, তখন তাকে শুধু বলেনঃ হও। অমনি তা হয়ে যায়।’
অপর অায়াতে বলা হয়েছেঃ ‘তিনি তো আসমান জমিনের নব সৃষ্টিকারী। তাঁর সন্তান হবে কোথ্থেকে, কেমন করে হবে তাঁর স্ত্রী? তিনি-ই তো সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সর্ব বিষয়েই অবহিত।’
এ দুটো আয়াতেই আল্লাহ তা’আলাকে ‘আসমান জমিনের বদীউন’- ‘পূর্ব দৃষ্টান্ত, পূর্ব উপাদান ও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সৃষ্টিকার’ বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়, রাসূলে করীম(স) এর জবানীতে তাঁর নিজের সম্পর্কে বলা একটি আয়াতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এভাবেঃ
‘বলো হে নবী! আমি কোনো অভিনব প্রেৃরিত ও নতুন কথার প্রচারক রাসূল হয়ে আসিনি। আমি নিজেই জানিনে আমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করা হবে, তোমাদের সাথে কি করা হবে, তাও আমার অজ্ঞাত।’
আর তৃতীয়, এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বনী ইসরাঈলের এক অংশের লোকদের বিশেষ ধরণের আমলের কথা বলতে গিয়ে। আয়াতটি এইঃ
‘এবং অত্যধিক ভয়ের কারণে গৃহীত কৃচ্ছসাধনা ও বৈরাগ্যনীতি তারা নিজেরাই রচনা করে নিয়েছে। আমরা তাদের উপর এই নীতি লিখে ফরজ করে দিইনি। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধানকেই তাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলাম।’
এ আয়াত হতে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হলোঃ আল্লাহ বান্দাদের জন্য যে বিধি ও বিধান দেননি-বান্দারা নিজেদের ইচ্চেমতো যা রচনা করে নিয়েছে, তা-ই ‘বিদয়াত’।
পক্ষান্তরে আল্লাহ যা কিছু লিখে দিয়েছেন, বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, যা করতে আদেশ করেছেন, তা করা ‘বিদয়াত’ নয়। এখান হতেই ‘বিদয়াত’ সংক্রান্ত মূল সংজ্ঞা ও ভাবধারার স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেল। সূরা ‘আল কাহাফ’ এর এক আয়াতে ‘বিদয়াত’ শব্দের এই অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায়।
আয়াতটি এইঃ
‘বলো হে নবী! আমলের দিক দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কথা কি তোমাদের বলবো? তারা হচ্চে এমন লোক যাদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনাই দুনিয়ার জীবনে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। আর তারাই মনে মনে ধারণা করে যে তারা খুবই ভালো কাজ করেছে।’
অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগীর কাজ-যা করলে সওয়াব হবে এবং যা না করলে গুনাহ হবে বলে মনে করা হবে-এমন সব কাজই হতে হবে আল্লাহর সন্তোষমূলক পন্থা ও পদ্ধতিতে। এই হচ্ছে সুন্নাত। আর তার বিপরীত রীতি ও নিয়মে হলে তা হবে সুস্পষ্ট বিদয়াত। কেননা তা সুন্নাত বিরোধী। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী-করীম (স) ঘোষণা করেছেনঃ
‘যে লোক আমার এই জিনিসে এমন কোনো জিনিস নতুন শামিল বা উদ্ভাবন করবে, যা মূলত এই জিনিসের অন্তর্ভূক্ত নয়, তা-ই প্রত্যাহৃত হবে। ’
‘বিদয়াত’ এর এ সংজ্ঞা হতে স্পষ্ট জানা গেল যে, ব্যবহারিক জীবনের কাজে কর্মে ও বৈষয়িক জীবন যাপনের নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন এবং নবাবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি নির্মাণের সঙ্গে শরীয়তী বিদয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা তার কোনোটিই ইবাদত হিসেবে ও আল্লাহর কাছে সওয়াব পাওয়ার আশায় করা হয়না। অবশ্য এ পর্যায়েও শর্ত এই যে, তার কোনোটিই শরীয়তের মূল আদর্শের বিপরীত হতে পারবেনা।
অনুরূপভাবে যেসব ইবাদত নবী করীম(স) কিংবা সাহাবায়ে কিরাম(রা) হতে কথার কিংবা কাজের বিবরণ এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে ও ইশারা ইঙ্গিতে প্রমাণিত, তাও বিদয়াত নয়।
এই সঙ্গে এ কথাও জানা গেল যে, নবী করীম(স) এর জমানায় যে কাজ করার প্রয়োজন হয়নি; কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো দ্বীনি কাজের জন্য দ্বীনি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই তা করার প্রয়োজন দেখা দিবে, তা করাও বিদয়াত পর্যায়ে গণ্য হতে পারেনা। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্রচলিত নিয়মে মাদ্রাসা শিক্ষা ও প্রচারমূলক সংস্থা ও দ্বীনি প্রচার বিভাগ কায়েম করা, কুরআন হাদীস বুঝাবার জন্যে আরবী ব্যাকরণ রচনা বা ইসলাম বিরোধীদের জবাব দেবার জন্য যুক্তিবিজ্ঞান ও দর্শন রচনা, জিহাদের জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষাদান, দ্রুতগামী ও সুবিধাজনক যানবাহন ব্যবহার। এসব জিনিস এক হিসেবে ইবাদতও বটে যদিও এগুলো রাসূলে করীম(স) এবং সাহাবায়ে কিরামের যুগে বর্তমান রূপে প্রচলিত হয়নি। তা সত্ত্বেও এগুলোকে বিদয়াত বলা যাবেনা। কেননা এসবের এভাবে ব্যবস্থা করার কোনো প্রয়োজন সেকালে দেখা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে এর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলেই তা করা হয়েছে এবং তা দ্বীনের জন্যই জরুরী। আর সত্য কথা এই যে, এসবই সেকালে ছিল সেকালের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় রূপে ও ধরনে। তাই আজ এর কোনোটিই ‘বিদয়াত’ নয়।
এসব সম্পর্কে এ কথাও বলা চলে যে, এগুলো মূলত কোনো ইবাদত নয়। এগুলো করলে সওয়াব হয়, সে নিয়তেও তা কউ করেনা। এগুলো হলো ইবাদতের উপায়, মাধ্যম বা ইবাদতের পূর্বশর্ত। তার মানে এগুলো এমন নয়, যাকে বলা যায় ‘দ্বীনের মধ্যে নতুন জিনিসের উদ্ভাবন।’ এবং এগুলো হচ্ছে –‘দ্বীনি পালন ও কার্যকরকরণের উদ্দেশ্যে নবোদ্ভাবিত জিনিস।’ আল কুরআন ও হাদীসের নিষিদ্ধ হলো দ্বীনের ভিতর দ্বীনরূপে নতুন জিনিস উদ্ভাবন করা। দ্বীনের বাস্তবায়নের জন্য নতুন জিনিস উদ্ভাবনতো নিষিদ্ধ নয় আদৌ। কাজেই এ জিনিসকে না বিদয়াত বলা যাবে, না তা অবশ্যই অপরিহার্য বলে বিবেচিত হবে।
কিয়াস ও ইজতিহাস কি বিদয়াত?
ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন ও হাদীস। এ দুটোকে ভিত্তি করেই ইসলামী জিন্দেগীর নিত্য নতুন প্রয়োজনীয় বিষয়ে শরীয়তের রায় জানতে হবে, দিতে হবে নিত্য নতুন উদ্ভূত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। তাই ইসলামী শরীয়তে কুরআন ও হাদীসের পর কিয়াস ও ইজতিহাদ শরীয়তের অন্যতম উৎসরূপে পরিগণিত, এ দুয়ের সাহায্যেই ইসলাম সকল কালের, সকল মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়ার সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়ে থাকে, দিতে পারে মুসলিম জীবন বিধানের সকল পর্যায়ে ও সকল প্রকার অবস্থায় নির্ভূল পথ-নির্দেশ। তা-ই এ দুটো বিদয়াত নয়। বিদয়াত নয় এ জন্য যে, এ দুটো ইসলামী ব্যবস্থায় কিছুমাত্র নতুন জিনিস নয়। স্বয়ং রাসূলে করীম(স) ও খুলাফায়ে রাশেদীন কর্তৃক এ দুটো পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে ইসলামী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে।
মুজাদ্দেদী আলফেসানী শায়খ আহমদ সরহিন্দী বলেছেনঃ কিয়াস ও ইজতিহাদকে কোনো দিক দিয়েই বিদয়াত মনে করা যেতে পারেনা। কেননা এ দুটো মূল কুরআন হাদীসের দলীলই প্রকাশ করে, কোনো নতুন অতিরিক্ত জিনিস দ্বীনের ভিতরে প্রমাণ করেনা।
ইজমার ভিত্তি স্পষ্টভাবে হাদীসেই স্বীকৃত। হযরত ইবনে মাসউদ(রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ
মুসলিম সমাজ সামগ্রিকভাবে শরীয়তের দৃষ্টিতে যে সিদ্ধান্ত করবে তা আল্লাহর নিকটও ভালোও উত্তমরূপে গৃহীত হবে এবং সে মুসলিমরাই যাকে খারাপ ও জঘন্য মনে করবে, তাই খারাপ ও জঘন্য বলে গণ্য হবে আল্লাহর নিকট।(ইবনে নযীম এ হাদীসটিকে ইবনে মাসউদের কথা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তবুও ইজমার সমর্থনে এ একটি দলীলরূপে গণ্য। কেননা সাহাবীর কথাও শরীয়তের দলীল)।
বিদআতের প্রকারভেদঃ
রাসূলুল্লাহ (সা) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেনঃ ‘সকল বিদআতই গোমরাহী’। এরপর বিদআতকে ‘ভালো বিদআত ও মন্দ বিদআত’-এ দুইভাগে ভাগ করার কোন অবকাশ আদৌ থাকতে পারে না। এ বিভাজন মূলত রাসূল (সা) এর কথার বরখেলাপ ও তাঁর সুন্নাহর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। পরবর্তীতে কোন কোন আলেম ভুল উপলব্ধি হতে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে অপউদ্দেশ্যে বিদআতকে দুই শ্রেণীতে বিভাজন করে ‘বিদআতে হাসানাহ’ বা ‘ভাল বিদআত’ এর নামে সমাজে অনেক বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন।
বিদআতী আলেমরা এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে রেফারেন্স টানেন।
ঘটনাটি হচ্ছে এইঃ একবার হযরত উমর ফারূক (রা) পবিত্র রমযান মাসে রাতের বেলায় মসজিদে গিয়ে দেখেন মুসল্লীরা জামায়াতের সাথে ‘তারাবীহ’ নামায আদায় করছেন। এটি দেখে তিনি খুব খুশী হলেন এবং বললেন-এটিতো বিদআতে হাসানাহ অর্থাৎ এটিতো একটি ভালো প্রথা/ভাল কাজ/ ভাল বিষয়।
উপরের আলোচনায় আমরা বিদআতের শাব্দিক অর্থ ও ইসলামের পরিভাষাগত অর্থ জেনেছি। মূলত আমিরুল মুমিনীন উমর (রা) কথাটি শাব্দিক অর্থে বলেছেন, পারিভাষিক অর্থে নয়। কারণ রাসূল (সা) এর কথার বিপরীত কথা তিনি বলতে পারেন না। উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা) ও তারাবীহ নামায পড়েছিলেন, তবে একাকী। সাহাবীরা কয়েকদিন রাসূলুল্লাহ (সা) এর ইমামতিতে এ নামায আদায় করার পর উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি পরে সেটি বন্ধ করে দেন।
কেউ কেউ ‘তারাবীহ’ নামাযও কি তাহলে বিদআত-এমন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে কথা হলো, যে বিষয়ের একবারও শরীয়তে পূর্ব নজির আছে, তাকে বিদআত বলা যাবে না।
বিদআত প্রতিরোধের উপায়
বিদআত প্রতিরোধের সবচেয়ে উত্তম ও গ্রহণযোগ্য উপায় হচ্ছে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা ও সমাজে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করা।
এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মওলানা আবদুর রহীম তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে লিখেছেনঃ
‘আমরা যারা আহলি সুন্নাত হওয়ার দাবি করছি এবং মনে বেশ অহমিকা বোধ করছি এই ভেবে যে, আমরা কোনো গোমরাহ ফির্কার লোক নই; বরং নবী করীম(স)-এর প্রতিষ্ঠিত ও সুন্নাত অনুসরণকারী সমাজের লোক। কিন্তু আমাদের এই ধারণা কতখানি যথার্থ, তা আমাদের অবশ্যই গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
আমরা আহলি সুন্নাত অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসরণকারী।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা রাসূলে করীম(স) এর কোন সুন্নাতের অনুসরণকারী? কঠিন ও কষ্টের সুন্নাতের, নাকি সহজ, নরম ও মিষ্টি মিষ্টি সুন্নাতের।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাসূলে করীম(স) এর জীবনে ও চরিত্রে এ উভয় ধরনের সুন্নাতেরই সমাবেশ ঘটেছে। তিনি একজন মানুষ ছিলেন। তাই মানুষ হিসেবেই তাঁকে এমন অনেক কাজই করতে হয়েছে, যা এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য দরকার। যেমন খাওয়া, পরা, দাম্পত্য ও সাংসারিক জীবন যাপন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে যে কাজ করেছেন শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তা-ও সুন্নাত বটে। তবে তা খুবই সহজ, নরম ও মিষ্টি সুন্নাত। তা করতে কষ্টতো হয়-ই না; বরং অনেক আরাম ও সুখ পাওয়া যায়। যেমন, কদুর তরকারী খাওয়া, মিষ্টি খাওয়া, পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা, মিস্ওয়াক করা, আতর-সুগন্ধী ব্যবহার করা, বিয়ে করা, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, লম্বা জামা-পাগড়ী বাঁধা, দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি।
কিন্তু রাসূলে করীম(স) এর জীবনে আসল সুন্নাত সেইসব কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ, যা তাঁকে সেই মুশরিক আল্লাহদ্রোহী সমাজে তওহীদি দাওয়াত প্রচার ও দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টার সাথে করতে হয়েছে। এই পর্যায়ে তাঁকে ক্ষুধায় কাতর হতে, পেটে পাথর বাঁধতে ও দিন-রাত অবিশ্রান্তভাবে শারীরিক খাটুনী খাটতে হয়েছে। শত্রুদের জালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে, পায়ে কাঁটা লাগাতে এবং তায়েফে গিয়ে গুন্ডাদের নিক্ষিপ্ত পাথরে দেহ মুবারককে ক্ষত-বিক্ষত করে রক্তের ধারা প্রবাহে পরনের কাপড় সিক্ত করতে ও ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন হয়ে রাস্তার ধারে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতে হয়েছে। এক সময় বনু হাশিম গোত্রের সাথে মক্কাবাসীদের নিঃসম্পর্ক ও বয়কট হয়ে আবু তালিব গুহায় ক্রমাগত তিনটি বছর অবস্থান করতে হয়েছে। সর্বশেষে পৈতৃক ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছে। কাফির শত্রু বাহিনীর মোকাবিলায় মোজাহিদদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ণ পরাক্রম সহকারে যুদ্ধ করতে, দন্ত মুবারক শহীদ করতে ও খন্দক খুদতে হয়েছে।
রাসূলে করীম(স) এর এসব কাজও সুন্নাত এবং সে সুন্নাত অনুসরণ করাও উম্মতের জন্য একান্ত কর্তব্য। তবে এ সুন্নাত অত্যন্ত কঠিন, দুঃসাধ্য ও প্রাণান্তকর চেষ্টার সুন্নাত।
সহজেই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই সুন্নাত পালন করছি? যদি না করে থাকি-করছি না যে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়- তাহলে রাসূলের সুন্নাত অনুসরণের যে দাবি আমরা করছি, তা কি সত্য বলে মনে করা যায়? বড়জোর এতটুকুই বলা চলে যে, হ্যাঁ, আমরা রাসূলের সুন্নাত অনুসরণ করছি বটে, তবে তা মিষ্টি, সহজ ও নরম নরম সুন্নাত। কিন্তু কঠিন, কষ্ট, প্রাণে ও ধন-সম্পদে আঘাত লাগে এমন কোনো সুন্নাত পালনের দিকে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তাও যে আমাদেরকে অবশ্য পালন করতে হবে, না করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্র নিকট কঠিন জবাবদিহি করতে হবে, সেকথা স্মরণ করতেও যেন আমরা ভয় পাই। ”
(চলবে-পরবর্তী পর্বসমূহে আমাদের সমাজে প্রচলিত উল্লেখযোগ্য কিছু বিদআত সম্পর্কে দলিলভিত্তিক আলোচনা হবে ইনশাল্লাহ।)
বিষয়: বিবিধ
২২৪৬ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেকে আবার বিদআতের বিরুদ্ধে যতটা খড়গহস্ত, শিরকের বিরুদ্ধেও ততটা নয়। কিন্তু শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গোনাহ যার সাথে অন্য কোন পাপই তুলনীয় নয়।
সুন্দর চলতে থাকুক। ইনশা আল্লাহ সাথে থাকার চেষ্টা করব। তবে একটু বেশিই বড় হয়ে যাচ্ছে। আর একটু ছোট ছোট করে পোষ্ট দিলে ভাল হয়।
ছোট করে দিলে পর্ব বেশি হয়ে যাবে। এত বড় করে দিলেও মনে হয় পাঁচ/ছয় পর্ব আগে শেষ হবে না।
শেষ প্যারাটি ভাল করে পড়ার আমন্ত্রণ আপনাকে।
একটা কথা ঃ
আমি সালাতুত তাসবিহ নামাজ পড়ি কিন্তু কেউ কেউ এ আমালকে বেদায়াত বলে।- এ ক্ষেত্রে বেদায়াত এর ফতোয়া কতটুকু গ্রহনযোগ্য?
আগের কমেন্টসগুলো ডিলিট হয়ে গেছে তা নাহলে দেখাতে পারতাম এরকম মাশহুর আমালকে বিদায়াত বলে ফতোয়া দেয় এ ব্লগের ব্লগার।
আল্লাহ মাফ করুন।
তবে উক্ত হাদীসটির বিশুদ্ধতা নিয়ে মতভেদ আছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা এটি বিশুদ্ধ নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে আমলযোগ্যও বলেছেন।
(বিস্তারিত দেখতে পারেন ‘সালাতে মোবশ্বির’-আবদুল হামিদ)।
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে-সন্দেহজনক বিষয় আমল না করাই উত্তম। আর আমল করলে মনে মনে এ নিয়্যত থাকতে হবে- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমাকে খুশি করার নিয়্যতেই এ আমলটি সহীহ মনে করি পালন করছি। যদি ভুল হয়ে থাকে ভুল ক্ষমা করে কবুল করে নিও।’
আরেকটা বিষয় আমারও জানা দরকার যে, হযরত ঊমার (রাঃ) জামায়াতে তারাওয়ী নামাজ আদায়কে অনুমোদন করেন এবং তাকে একটা 'উত্তম বিাত'বলে রায় দেন। ওই সময়ে তাঁর এই কাজকে কি কোনো সাহাবী মেনে নেন নাই? কেউ কি এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন? কোনও সাহাবী কি সেই তারাওয়ীর জামাআতে শামীল হতে অস্বীকার করেছিলেন? যদি না করে থাকেন তবে হযরত ঊমার (রাঃ)এর ঐ সিদ্ধান্ত কি সাহাবাদের ইজমা হয়নি? আর সাহাবাদের ইজমা কি দলীল না? সাহাবাদের ইজমাকে কি তাঁর পরবর্তী কেউ বাদ দিতে পারেন?
জ্বি, আপনি যথার্থই বলেছেন। ঈমানদার মুসলমানের গোটা জিন্দেগীটাই ইবাদত হিসেব গণ্য হতে পারে। একজন মুসলমান নিদ্রা পূর্বে আল্লাহকে স্মরণ করলে তার নিদ্রার সময়টুকুও ইবাদত বলে গণ্য হবে, খাওয়ার পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে হালাল খাবার গ্রহণ করলে সেটিও ইবাদত।
তবে আনুষ্ঠানিক ইবাদত আর এ ইবাদতের মাঝে পার্থক্য আছে। সালাত, সাওম, হজ্জ এসব হচ্ছে আনুষ্ঠানিক ইবাদত। আহার, নিদ্রা, যাতায়াত এসব মানুষকে বেঁচে থাকার তাগিদে, দুনিয়াবী প্রয়োজনে করতেই হয় বাধ্য হয়ে। আশা করি এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।
এখন অানুষ্ঠানিক ইবাদত হিসেবে যদি কেউ নতুন কিছু চালু করেন সেটি হবে বিদয়াত। যেমন, হাদীসে অসমর্থিত কিছু নামায, চল্লিশা, ওরশ, পীর মুরিদী সিস্টেম ইত্যাদি।
খাওয়া দাওয়া দস্তরখান বিছিয়ে খাওয়া যায় আবার ডাইনিং টেবিলেও খাওয়া হয়। এখন কেউ যদি বলে ডাইনিং টেবিলে রাসূল (সা) খান নি, এটা বিদআত-তাহলে উক্ত বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং এটা বলা যেতে পারে, দস্তরখান বিছিয়ে খাওয়া সুন্নাত, ডাইনিং টেবিলে খেলে সে সুন্নাতটি মিস হবে কিন্তু গোনাহ হবে না।
হযরত ঊমার (রা) কথাটি শাব্দিক/আভিধানিক অর্থে বলেছেন অর্থাৎ এ বিষয়টি ভাল। পরিভাষাগত অর্থে এটিকে বিদআত বলেন নি।
তারাবীহ নামায সম্পর্কে ইতিহাস নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। রাসূল (সা) এর ইমামতিতে তারাবীহ নামায় কয়েকদিন জামাতে আদায় হয়েছিল।
যে কাজের একবার হলেও পূর্ব নজির আছে সেটিকে বিদআত বলা যাবে না।
সাহাবীদের ইজমার বিষয়টি সমষ্টিগতভাবে নিতে হবে। কোন একক সাহাবীর নয়। এ প্রসঙ্গে মওলানা আবদুর রহীম যে আলোচনাটি রেখেছেন তা নিম্নরূপঃ
-'আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রপুঞ্জের মতোই উজ্জ্বল। এদের মধ্যে যার-ই তোমরা অনুসরণ করবে, হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।'
এই হাদীসের ভিত্তিতে কেউ কেউ বলতে চান যে, নিজেদের ইচ্ছেমতো যে কোনো একজন সাহাবীর অনুসরণ করলেই হেদায়াতের পথে চলা সম্ভব হবে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এই হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করা যুক্তিযুক্ত হতে পারেনা। প্রথম কারণটি এই যে, এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে। একটি সূত্র হলোঃ আ‘মাশ থেকে আবু সুফিয়ান হতে, জাবির(রা) হতে। আর একটি হলো সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব হতে, ইবনে আমর থেকে। আর তৃতীয় হলো হামযা আল-জজী থেকে, নাফে থেকে, ইবনে উমর থেকে। কিন্তু মুহাদ্দিসদের বিচারে এ সব সূত্রে কোনো হাদীস প্রমাণিত নয়। ইবনে আবদুল বার্র এর উদ্বৃতি দিয়ে আল্লামা ইবনুল কায়্যিম লিখেছেনঃ আমাদের নিকট সাঈদের পুত্র ইবরাহীম, তাঁর পুত্র মুহাম্মদ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, তাদের নিকট হামদ ইবনে আইয়ূব আস সামূত বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের নিকট বাজ্জার বলেছেন যে, “আমার সাহাবীরা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো, তাদের মধ্যে যার-ই তোমরা অনুসরণ করবে, হেদায়াত পাবে”। এই অর্থের যে হাদীসটি বর্ণনা করা হয় তা এমন একটি কথা, যা নবী করীম(স) হতেই সহীহ বলে প্রমাণিত হয়নি। (খতীব আল বাগদাদীর উদ্ধৃত হযরত ইবনুল খাত্তাব (রা) এর বর্ণনা থেকে এর বিপরীত কথা জানা যায়।)
হাদীস বিচারে সনদের গুরুত্ব হলো মৌলিক। আর সনদের বিচারে যে হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত নয়, তাকে শরীয়তের দলীল হিসেবে পেশ করার কোনো অধিকার কারোই থাকতে পারেনা।
বিনা শর্তে আনুগত্য মানব সমাজে কেবলমাত্র রাসূলে করীম(স) কে করা যেতে পারে, করতে হবে, অন্য কারো নয়।
রাসূলের (সা) একটি হাদীসের শেষাংশ হচ্ছে এইঃ
আরবী
-বনী-ইসরাঈলীরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল আর আমার উম্মত তিহাত্তর ফির্কায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্যে একটি ফির্কা ছাড়া আর সব ফির্কা-ই জাহান্নামী হবে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেনঃ সে একটি ফির্কা কারা হে রাসূল(স)? তিনি বললেন, “তারা হচ্ছে সেই লোক যারা অনুসরণ করবে আমার ও আমার আসহাবদের আদর্শ”।
এ হাদীসকে ভিত্তি ধরে ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম ইবনুল জাওজী যে কথাটি বলেছেন, তার মর্ম হলো এইঃ এ হাদীসে প্রমাণ রয়েছে যে, ‘এক জামা‘আত’ বলতে সাহাবাদের জামা‘আতকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বিশেষ কোনো একজন সাহাবী নন, নবী করীম(স) এবং সামগ্রিকভাবে সাহাবীদের জামা‘আত যে সুন্নাতকে পালন করে গেছেন, পরিবর্তিত অবস্থায় এবং পতন যুগেও যারা সেই সুন্নাতকে অনুসরণ করবে, তারাই জান্নাতে যাওয়ার অধিকারী হবে। তারা হবে সেই লোক যারা আকীদা, কথা ও বাহ্যিক আমলের রীতি-নীতি সব-ই সাহাবীদের ইজমা থেকে গ্রহণ করবে।
সুন্দর পোষ্টের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
আপনি লেখাটি আবার পড়ুন। যথাস্থানে মওলানা আবদুর রহীম (রহ) এর নাম একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। একক নিবন্ধে রেফারেন্স উল্লেখ করার স্বীকৃত দুটি পদ্ধতি হচ্ছে মূল লেখায় অথবা নিবন্ধের শেষে। মূল লেখায় আমি একাধিকবার সেটি উল্লেখ করেছি। আর সিরিজ শেষে Bibliography হিসেবে সকল গ্রন্থের একটি তালিকা দেব।
এখানে উপস্থাপনা আমার নিজস্ব, লেখার মাঝে উদ্ধৃতিগুলি ছাড়া বাকি অংশটুকুও আমার নিজস্ব। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
থিওরিকাল বা সঙ্গাগত ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা যথেষ্ট করেছেন। জাযাকাল্লাহ।
আগামী পর্বের বিষয়টা হবে আমাদের সকলের জন্য উপকারী।
অপেক্ষায় আছি।
জ্বি ভাইয়া, সাথেই থাকুন।
বিদয়াত দ্বিনের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন। একসময় কুরআন শরিফ ছাপাকেও বিদয়াত বলা হযেছিল। যেটা ছিল কুরআন শরিফ এর লিপিকর দের রুটি রুজি বাচানর চেষ্টা। অথচ এটার সাথে মুল দ্বিনের কোন সম্পর্ক নাই। আবার এটাকে পুজি করে অনেকে প্রয়োজনহিন আমল কে সহিহ বলে প্রমান করে চান।
পরবর্তীতে উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনা হবে। সাথেই থাকুন প্রিয় সবুজ ভাই।
রসুলের কঠিন সুন্নতের মধ্যে প্রধান দুটি হল যে নবুয়তের প্রকাশ হওয়ার পরে তিনি জীবিকার জন্য কোন সময় ব্যায় করেননি সারাটি জীবন, সকল ধ্যান জ্ঞান দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যায় করেছেন৷ আর জীবনে কোন ধন-সম্পদ মজুদ করেননি৷ ধন্যবাদ
পরবর্তীতে উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনা হবে। সাথেই থাকুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন