জিনিস যেটা দামের, হতে হবে কামের
লিখেছেন লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ২৭ আগস্ট, ২০১৪, ১২:০১:০৮ দুপুর
টিভির অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপন এর শ্লোগান, ''জিনিস যেটা ভালো দাম তার একটু বেশি''। বলা বাহুল্য, এ অর্ধসত্য কথাটি শ্লোগান হিসাবে বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং বর্তমানে অনেক মানহীন পণ্যের বিজ্ঞাপনেও এটি বা এজাতীয় বাক্য ব্যবহৃত হয়।
কেউ কি ভেবে দেখেছেন, মানুষের অবচেতন মনে একটি ভুল বিশ্বাস কিভাবে প্রোথিত করা হচ্ছে? এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিয়ে কেউ একটু চিন্তা করেছেন গভীরভাবে? পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে এবং নিম্নমানের পণ্যের জন্য এ বিজ্ঞাপন বেশ ভূমিকা রাখছে।
একটু বিশ্লেষণ করা যাক। বিজ্ঞাপনের ভাষাটি যে আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে তাতে বেশি দামের উপর জোর পড়ছে। অর্থাৎ ‘দাম বেশি হলে তার মান ভাল হবে’- এ বার্তাটি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এতে অবচেতন মনে একটি বিশ্বাস তৈরি হয়ে যাচ্ছে- ‘দামি জিনিসটিই তবে ভাল। মান বুঝতে হলে দাম বিবেচনা করতে হবে।’
মানুষের অবচেতন মনের এই ভুল বিশ্বাসকে পুঁজি করে চুটিয়ে ব্যবসা করছে দেশি বিদেশী কর্পোরেট হাউজগুলি। বহুজাতিক কোম্পানীগুলোই এক্ষেত্রে এগিয়ে। দাম এবং মান- দুই ভাবেই এরা প্রতারণা করছে ভোক্তার সাথে। বিভিন্ন কায়দায় তারা মনোপলি মার্কেট তৈরি করে নিয়েছে আগেই। দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে পণ্যের ইচ্ছেমত, তার বিপরীতে কমিয়ে দিচ্ছে পণ্যের গুণগত মান এমনকি পরিমাণও। আর ভোক্তারা আনন্দচিত্তে বা বাধ্য হয়ে কম পরিমাণের কম মানের পণ্য বেশি দামে কিনছে।
শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়। কয়টি দেব? তবুও দু/একটি তুলে ধরছিঃ
১। বছর কয়েক আগে জনপ্রিয় ব্রান্ডের (বোম্বে সুইটস) একটি চানাচুর এর ৪০০ গ্রাম এর প্যাকেট পাওয়া যেত ১২ টাকায়। সে প্যাকেট ছোট হতে হতে এখন ৩৫০ গ্রাম, মান ও কমেছে। আর দাম? ৫৫ টাকা!
২। একটি বহুজাতিক কোম্পানীর (ইউনিলিভার) ১৫৫ গ্রাম ওজনের কাপড় কাঁচা সাবান এর দাম ছিল ৮ টাকা। মানে কমেছে, ওজনে কমেছে অর্ধেকেরও বেশি, মাত্র ৭৫ গ্রাম। আর দাম? ২২ টাকা! তাদের তথাকথিত সৌন্দর্য সাবান ও অন্যান্য পণ্যের এর ক্ষেত্রে ও একই কথা প্রযোজ্য।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলেও এটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ঐকিক নিয়মে হিসেব করলে বুঝবেন কি পরিমাণে ঠকছেন।
৩। বছর কয়েক আগে দেশী ব্রান্ডের যে শার্টগুলি এক হাজার টাকার আশেপাশে পাওয়া যেত, সেগুলি এখন ২,৫০০ টাকা বা তার বেশি। আর মানও আগের মত নেই মোটেই।
৪। আজ হতে আরো তিন বছর আগের কথা। মগবাজার (ওয়ারলেস মোড়ে) বিশাল সেন্টার নামে একটি মার্কেট আছে। সেখানে একবার একটি হাফশার্ট পছন্দ হয়েছিল (স্টোরটির নাম মনে পড়ছে না এখন)।
সেলসম্যান প্যাক করার পর দাম দিতে গিয়ে বিপত্তি। ১,৪০০ টাকা মনে করে যে শার্টটি নিয়েছিলাম সেটির দাম শুনি ১৪,০০০ টাকা। বিব্রত হয়ে না কিনেই ফিরে এলাম। অথচ ১,৪০০ টাকাই আমার কাছে বেশি মনে হচ্ছিল।
পোষাক এর ক্ষেত্রে ব্রান্ড ইমেজ নিয়ে হরিলুট চলছে। একই কাপড়ে শুধু ব্রান্ড ট্যাগ দিয়ে আলোকোজ্জ্বল শো-রুমে তুলে কয়েকগুণ বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। ক্রেতারাও ভাবছে, দাম যখন বেশি, মানতো তবে ভাল। সেলুকাস! এক্ষেত্রে আরো বেশি প্রতারণা করছে বিভিন্ন নামী বিপণী বিতান এর নির্দিষ্ট প্রাইস ট্যাগ ছাড়া (অর্থাৎ দাম উল্লেখ থাকে না) যেসব পোষাকের দোকান-সেগুলি। এদের প্রতারণার শিকার বেশি হয় নারীরা। চকটদার কথার ফাঁদে পড়ে নারীকূল মানহীন পণ্যও অধিক দামে কিনে নিয়ে আসে।
দেখা গেল, একজন মহিলা কোনো এক শোরুমে ঢুকে শাড়ির দাম জিজ্ঞেস করল। দুই হাজার টাকা দাম শুনে পছন্দ হলো না। ভাবল নিশ্চয়ই ভাল শাড়ি নয়, দাম এত কম কেন? কয়েক দোকান ঘুরে দেখা যায়, একই মানের ভিন্ন রঙের শাড়ি ৫ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছে। এবার বুঝুন অবস্থা!
প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ যারা দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে তারা তো 'দামি' বা 'একটু দামি' পণ্য ক্রয় করতে অপারগ, বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক- তাদের কি হবে? যাদের কারণে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল থাকে- তাদের কি হবে? তারা কি তাহলে ভালো পণ্য বা সেবা থেকে বঞ্চিত থাকবে? বড় কোম্পানিগুলোর পণ্য ও সেবা কি শুধু উচ্চবিত্তদের জন্য? সরকার কি তাহলে নিম্নবিত্তদের ভালো পণ্যের চাহিদা পূরণে উদ্যোগ নেবে? নাকি এসব দামি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলবে, 'আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ নিম্নবিত্ত, তোমরা যদি তাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের মানসম্মত পণ্য উৎপাদনই করতে না পারো তাহলে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নাও?'
আমাদের সচেতন হতে হবে। জনগণের কষ্টার্জিত পয়সা যেন মানহীন পণ্য গছিয়ে দিয়ে প্রতারকরা হাতিয়ে নিতে না পারে।
নতুন শ্লোগান তুলতে হবে- “জিনিস যেটা দামের, হতে হবে কামের”।
বিষয়: বিবিধ
১৫৮৮ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিজ্ঞাপনের নামে আরো অনেক প্রতারণা আছে। শুধু দামের বিষয় নয়, আমাদের বিশ্বাস/আস্থার জায়গাগুলিতেও তারা কৌশলে আক্রমণ করে যাচ্ছে। সচেতন হতে হবে সবাইকেই।
ব্র্যান্ডের দোকানের শার্টের দাম তার পড়নের শার্টের দামের প্রায় দ্বিগুন ছিলো।
************************************************************
এখনকার চিপস্ গুলোর কথাই বা বলেন না কেন ? ১০ -১২ টাকায় চিপস্ কিনছি না বাতাস কিনছি তাতে দ্বন্দ্ব লেগে যায় । কারণ প্যাকেটের > ৫০% জায়গাই বাতাস দিয়ে ভরা থাকে ।
**************************************************************
মেয়েরা একই জিনিস ২০০০ টাকায় চাইলো বলে কমদামী মনে করে আরেক দোকানে গিয়ে একই জিনিস ৫০০০ টাকা কেন , ৫০০০০ বা ৫০০০০০ টাকাতেও কিনতে পারে । কারণ ১ টাকাই হোক বা ১০০০০০০ টাকাই হোক টাকা তো তার পার্স থেকে যাচ্ছে না !
গনতন্ত্র আর পুঁজিবাদের ঘেরাটোপে বন্দী সবচেয়ে বেশি আমরা বাঙ্গালী।
সত্যি বলতে কি, আপনার লেখা পড়তে শুরু করেও প্রথমে বুঝতে পারি নি কি এমন ভুল বিশ্বাষ প্রোথিত করা হচ্ছে এর মাধ্যমে।
সত্যিই আমাদেরকে ধোঁকা দেয়ার কত মোক্ষম অস্ত্রই না ওরা তৈরী করে! কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ (এমন কি বড় মানুষেরাও) বুঝতেই পারি নি। তারই একটি হলো নারী অধিকারের নামে নারীদেরকে রাস্তায় নামিয়ে সংসার ভাঙনের চটকদার মেকি কান্না।
ধন্যবাদ আপনাকে অনেক অনেক...।
মন্তব্য করতে লগইন করুন