ছাদ মিটিং
লিখেছেন লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ২৩ মার্চ, ২০১৪, ০২:৩০:০৩ দুপুর
বিকেল বেলা ‘শাহেদ ভিলা’র ছাদজুড়ে বিশাল মিটিং। বিভিন্ন ফ্ল্যাটের ভাবি আর ননদিনীরা এ সভার সম্মানিতা সভ্য। রোজ রোজ এ মিটিং বসিয়া থাকে। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে এ মিটিং চলিয়া আসিতেছে। টপিক কখনো পূর্ব নির্ধারিত থাকেনা। অবশ্য তাই বলে টপিক এর অভাব কখনো হয়না। এদেশীয় রমনীগণ এর বাকপ্রতিভা অতুলনীয়। তাইতো বাইরে মহাক্ষমতাধর পুরুষটিও ঘরের বউ এর কাছে তর্কে হারিয়া মিউ মিউ করিয়া থাকেন। অবশ্য দুষ্টজনেরা কয়- রমণীরা যুক্তি মানেনা, কাঁন্দিয়া আর কূট তর্ক করিয়া জিতিয়া থাকে। পুরুষজাতি আবার রমণীর কান্না সইতে পারেনা। তাই ইচ্ছে করিয়াই হার মানিয়া থাকে। তাতে অবশ্য লাভ ক্ষতি উভয়ই রহিয়াছে। অনুগত স্বামী নাকি রমণীকূলের অতিশয় পছন্দ। স্বামী অনুগত হলে তাহাকে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করিয়া দিয়া থাকে স্ত্রী জাতি। অবশ্য সে ভালোবাসাকে ধরিয়া রাখিতে হইলে আপন পকেট এর স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়া থাকে, স্ত্রীর চাহিবামাত্র স্বামীকে তাহার পছন্দমতো জিনিস কিনিয়া দেয়ার প্রস্তুতি থাকিতে হয়। অন্যথায় সংসারে ঝাঁটা মেরে বিদেয় হওয়ার হুমকি প্রতিনিয়তই শুনিতে হয়। পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি, অমুক কাজিন এর বউ, তমুক বান্ধবীর শাড়ি গয়না ও বিলাসী দ্রব্যের কাল্পনিক তালিকা দিয়ে স্বামী বেচারাকে খোঁটা দিয়ে ঘায়েল করতে ছাড়েনা ঘরের বউটি। অতসব খিটিমিটি আর অশান্তির চেয়ে বউয়ের পোষ মানিয়া থাকাই অতিশয় শ্রেয়।
বলছিলাম আজকের ছাদমিটিং এর কথা। ছাদমিটিং চলিতেছে যথানিয়মে। দিলারা ভাবি রসুনের আচার এর একটা রেসিপি নিয়ে আলোচনা করছেন। মনোযোগী শ্রোতার তালিকায় আছেন আরো তিনজন ভাবি আর দুই জন ননদিনী। একটু পর কাজের মেয়েসহ উপস্থিত হলেন তিনতলার রুমা ভাবি। এ কথা সেকথার পর আলোচনা আবার জমিয়া উঠিয়াছে ভারতীয় সিরিয়াল এর একটি মহিলা ভিলেন চরিত্র নিয়ে।
‘উহ! কি সাংঘাতিক ডেঞ্জারাস মহিলারে বাবা! কাজের মেয়েটাকে কি নির্যাতনটাই না করলো।’ একজন বলে উঠে।
‘একেবারে দাজ্জাল মহিলা। কোন দয়ামায়া নেই। কাজের মেয়ে বলে কি ওরা মানুষনা? গতকাল আমার ইচ্ছে করছিল মহিলার মুখে জুতা মারি। দোয়া করি, আজকের পর্বে যেন মেয়েটা রক্ষা পায়।’ রুমা ভাবি বলেন।
‘ভাবি কি শাড়ি নতুন কিনেছেন?’ দিলারা ভাবি প্রশ্ন করে বসেন। এতক্ষণে রুমা ভাবির মুখে হাসি ফুটে। মূলত নতুন শাড়ি দেখানোর জন্যই আজ ছাদে আসা। নয়তো আজ শরীরটা ভালো লাগছিলনা। দিলারা ভাবির প্রশ্নে নড়ে চড়ে বসেন রুমা ভাবি।
‘জ্বি আপনার ভাই বললো, অনেকদিন মার্কেটে যাওনা, চল আজ তোমাকে কিছু কেনাকাটা করে দিই। এ শাড়িটা কিনলাম, কয়েকটি বেডশীট, কসমেটিকস, পাথরের কিছু গয়না আর কিছু ক্রোকারীজ।’ অতগুলো মিথ্যে কথা বলে থামেন রুমা ভাবি। অনেক কান্নাকাটি ঝগড়াঝাটি শেষে স্বামী বেচারাকে অনেকটা জোর করেই মার্কেটে নিয়ে গেল। বেচারা অনেক অজুহাত আর টাকার সমস্যার কথা বলেও রেহাই পায়নি। আর এখন বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
‘শাড়িটাতো সুন্দর বেশ!’ জিজ্ঞেস করেন দিলারা ভাবি।
‘সুন্দর না ছাই! ভারতীয় সিরিয়ালের ঐ ভিলেন মহিলাটার মতোই লাগছে।’ ননদিনীর কানে ফিসফিস করে বলেন সিতারা ভাবি।
‘সেদিন কি হয়েছে শুনেন। ঐ বাড়ির নাদিয়া ভাবি সাড়ে চার ঘন্টা ধরে সারা মার্কেট ঘুরে যে শাড়িটি শেষ পর্য্ন্ত সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন সেই একই রকম শাড়ি প্রথম দোকানে দেখে গিয়েছিলেন আড়াই হাজার টাকায়। একই শাড়ি গুণে মানে এবং রঙেও এক। হিহিহি। আপনার শাড়িটার দাম কত?’ জিজ্ঞেস করেন দিলারা ভাবি।
‘বারো হাজার টাকা।’ বেশ গর্বের সাথে জবাব দেন রুমা ভাবি।
‘বারো হাজার টাকা? তখন যে কইলেন তিন হাজার টাকা!’- রুমা ভাবির কাজের মেয়েটা বলে উঠে চট করে।
কাজের মেয়ের অকাজের কথায় রুমা ভাবির মুখমন্ডল হইতে হাসির আভা বিদূরিত হইয়া অন্ধকারে ছেয়ে যায়। কি এক বাহানা দিয়া ছাদ হইতে নামিয়া পড়েন। কাজের মেয়েও তাহাকে অনুসরণ করিয়া থাকে। সিঁড়ির এক ধাপ নামিয়াই কাজের মেয়েকে পিটাইতে থাকেন ইচ্ছেমতো। মেয়েটি মাগো বাবাগো বলে চিৎকার করতে থাকে। অপরাধ শাড়ির দাম কেন সবার সামনে বলতে গেল।বাসায় এনে দ্বিতীয় দফা পিটানি ‘ফকিরনীর বাচ্চা, শু- বাচ্চা, তুই সবার সামনে আমার মান সম্মান খাইছোস। তোরে……।’ ক্ষণিককাল পূর্বে ভারতীয় সিরিয়াল এর ভিলেন মহিলার সমালোচনার কথা বেমালুম ভুলে নিজেই এখন ভিলেন এর ভূমিকায়। তাহার রুদ্রমূর্তি এখন ভারতীয় সিরিয়ালের ভিলেন মহিলাটির চেয়েও এক কাঠি সরেস।
কিয়ৎকাল পরে খিলখিল শব্দে দোতলার ননদ ভাবির ছাদে আগমন। তাহাদের হাসির হেতু হচ্ছে-ননদিনী আর ভাবি মিলে আজ এক বোকাসোকা সুদর্শন ছেলের মানিব্যাগ ফাঁকা করিয়াছে। তাহাদের এই নতুন ইস্যুতে ছাদের ঝিমিয়ে পড়া মিটিং আবার সরগরম হইয়া উঠিলো। ঘটনা খোলাসা করিয়াই বলিতে হয়। পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেখিয়া ফোন দিয়েছিল ননদিনী ডালিয়া। অল্প কথাতেই পাত্র খুশিতে গদগদ। ঠিক হলো দ্বি-প্রহরে গুলশান এর ‘ব্যাটন রুজ’ এ হবে পাত্রী দেখা পর্ব। শর্ত দেয়া হলো, পাত্রের সাথে কোন মুরুব্বী থাকতে পারবেনা, তবে পাত্রীর সাথে তার ভাবি ও কয়েকজন বান্ধবী থাকিবেন। উদ্দেশ্য বর জুটিলেও জুটিতে পারে, আর বর না জুটিলেও বিশেষ একটা ক্ষতি নেই। ‘ব্যাটন রুজ’ এর ব্যুফে, আহ! ভাবতেই জিভে পানি চলিয়া আসে বারবার। পাত্রমহাশয় অতি সহজেই এই কঠিন শর্ত মানিয়া নিল।
‘ওহ, তাদের মাটন বারবিকিউ টা যা জোশ!’ স্বগোতক্তির মতো বলে উঠেন ডালিয়ার ভাবি নাসিমা।
‘আমাদেরকেও তো নিমন্ত্রণ করা যেত, নাকি? তা আমাদের ডালিয়াকে কেমন পছন্দ করেছে পাত্র মহাশয়।’ টিপ্পনি কাটেন সিতারা ভাবি।
‘ডালিয়াকে কেমন পছন্দ করেছে জানা যায়নি। তবে ডালিয়ার ভোজনপ্রতিভার বেশ প্রশংসা করেছে পাত্রের বন্ধু মহাশয়। হিহিহি। আগামী বুধবার এর মধ্যে পাত্র সাহেব তার মতামত জানাবেন।’ জবাব দেন নাসিমা ভাবি।
‘অসম্ভব, এ হাবাগঙ্গারাম ছেলেকে আমার পছন্দ হয়নি একদম। বোকাসোকা একটা গোলআলু। এত বোকা থাকে নাকি কেউ আজকাল? আজই ফোন করে না করে দিতে হবে।’ ডালিয়ার জবাব।
এ সময় ছাদে উঠেন হামিদা খানম। সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। হামিদা খানম দর্শনের অধ্যাপিকা। পঞ্চাশোর্ধ মহিলা, এ বাড়ির বর্তমান মালিক। স্বামী শাহেদ সারওয়ার মারা যাওয়ার পর তাঁর রেখে যাওয়া অর্থ ও নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বাড্ডায় এ পাঁচতলা বাড়িটি করেছেন তিনি। বড়মেয়ে স্বামীসহ আমেরিকায় আর বড় ছেলে সস্ত্রীক দুবাইতে। এখানে তিনি আছেন ছোট ছেলে আর ছোটমেয়েকে নিয়ে। ডায়াবেটিস এর রোগী তিনি, ডাক্তার নিয়মিত হাঁটাহাটির পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বিকেলে ছাদে এলেই এদের পরচর্চার সঙ্গি হতে হয় যা তিনি খুব অপছন্দ করেন, আবার বয়সের সাথে মেলেনা বলে তারাও বিব্রত হয়। তাই পারতপক্ষে ছাদে আসা হয়না বিকেলবেলায়। হাঁটাহাটির কাজটা সকালেই সারেন। ছোট ছেলে আবেদ বুয়েট হতে পাশ করে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জব করছে। ছেলের জন্য একটা মনমতো পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছেন হামিদা খানম। কিন্তু মেলাতে পারছেননা। সুন্দরী মেয়ে অনেকই পাওয়া যায়, কিন্তু কথা বলে আর ভালো লাগেনা। দোতলার ডালিয়া মেয়েটা বেশ সুন্দরী আছে। কিন্তু মেয়েটার ধর্মে মতি নেই, পরচর্চার স্বভাব আছে। ভাবেন, তিনিতো দর্শনের অধ্যাপিকা। নিজের এতগুলো ছেলেমেয়েকে মানুষ করার পাশাপাশি এত বছরে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে ন্যায় নীতির দীক্ষা দিয়েছেন। একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে হয়তো নতুন প্রজন্মের ভারতীয় সিরিয়ালের নষ্টামিতে বিভ্রান্ত এসব মেয়েকেও হয়তো লাইনে আনা যেতে পারে।
‘কেমন আছো তোমরা সবাই?’
‘জ্বি ভালো, আপনি কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। কি নিয়ে গল্প হচ্ছে তোমাদের?’
‘তিনতলার রুমা ভাবির কান্ড শুনলে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করবে খালাম্মা। খুব ভাব নিয়া আইছিলেন। তিন হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে বারো হাজার টাকা বলে চালাতে আসছিলো। কাজের মেয়ের কথায় নগদে কট। লজ্জা থাকলে যদি আর এ মুখো হয়।’ সিতারা ভাবি ফুঁসে ওঠেন। অতি ক্ষুদ্র এক বিষয় নিয়ে সিতারা ভাবির সাথে ঝগড়া হয়েছিল রুমা ভাবির কয়দিন আগে। তাই রুমা ভাবির কোনো খুঁত পেলে সেটা খুব বড় গলায় সবাইকে জানিয়ে দেন সিতারা ভাবি।
‘আহ! বাদ দাওনা এসব। পরচর্চা পরিহার করে আমাদের পরকাল নিয়ে একটু ভাবা উচিত। এই দুনিয়া হচ্ছে পরকালের শস্যক্ষেত্র। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে উপযুক্ত শস্য বুনতে ব্যর্থ হলে আখিরাতে তার জন্য ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।….’
‘যখন আপনার মত বয়স্ক হবো তখন ধর্মকর্ম পালন করা যাবে। এখন একটু…’ বলে ডালিয়া।
কুরআন হাদীসের উদ্ধৃতি হামিদা খানম তাদের বোঝান- তরুণ বয়সের প্রার্থণাই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। এছাড়া জীবনের তো কোন নিশ্চয়তা নেই। এইতো সেদিন পাশের বাড়ির তরতাজা যুবক হার্ট অ্যাটাক করলো। হাসপাতালে নেয়ার সময়টুকুও পাওয়া গেলনা।
আরো অনেক কথাই বলেন হামিদা খানম। কিন্তু শ্রোতাদের ভাবান্তর হয়না, বিরক্তি সবার চোখেমুখে। নেহায়েৎ বাড়িওয়ালা, তাই কিছু বলছেনা।
মসজিদে মাগরীব এর আজান হয় এসময়। হামিদা খানম ছাদ হতে নেমে আসেন, নামাজ পড়তে হবে। ভাবি আর ননদিনীর দলও আজকের ছাদ মিটিং এর সমাপ্তি টেনে বাসায় ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাছে আবার টিভি সিরিয়াল মিস হয়ে যায়।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৯১ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে গল্প বলা ভুল হবে ১০০% ই সত্য।
তবে আজকাল নারিরা তর্কে কান্দিয়া জিতে না। জিতে মুখের জোড় আর নারি নির্যাতন আইনের ভয় দেখিয়ে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমাদের সমাজে এখন হামিদা খানমদের খুব প্রয়োজন। চমৎকার শিক্ষণীয় গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
ননদ ভাবির কিচ্ছে তো আপনি রচনা করিয়ালাইছেন। ইশ্ আমি ক্যান পারি না? ওহ্হ আমার তো ভাবি নাই। তই দেখি আপনপার মত ওকি দিতে পারি কিনা! চমৎকার গল্প। লেখায় রস সৃষ্টিকরা এবং বাস্তবতাকে তুলে আনতে পারাই একজন লেখকের প্রধান গুণ। আপনার এই গল্পে আপনি সেটাই করেছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন