সংস্কৃতির ভিত রচনায় তাওহীদ

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল মান্নান ৩১ মে, ২০১৬, ০১:০১:৫৪ দুপুর

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজের জনগোষ্ঠী নানা ধরণের সংস্কৃতি লালন করে। কিন্তু কোনো সমাজে নিজে থেকেই কোনো সংস্কৃতি জন্ম নেয় না। সময়ের পরিক্রমায় মানবীয় কিছু মূল্যবোধের ভিত্তিতে সংস্কৃতির রূপ বিকশিত হয়। মূলতঃ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বস্তুবাদী চিন্তা এই মূল্যবোধ সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধগুলির মধ্যে ভূমন্ডল ও নভোমন্ডল এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌র একক পরিকল্পনায় সৃষ্ট ও একক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ধর্মীয় বিশ্বাস হলো অন্যতম। মহান এক পরিকল্পনাকারী বিশেষ উদ্দেশ্যে মহাবিশ্বের সকল কিছুর সাথে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, ধর্মীয় এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সাথে বস্তুবাদী অথবা ডারউইনের বিবর্তনবাদের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভবে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। শুধু তাই নয় সৃষ্টিকর্তাতে বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা একত্ববাদ তথা তাওহীদে বিশ্বাসী তাদের সংস্কৃতি এবং বহু ইশ্বরবাদে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির রূপের মধ্যেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

আমাদের অনেকের ধারণা সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা ইত্যাদি হচ্ছে সংস্কৃতির মূল কথা। এই সংকীর্ণ চিন্তার বাইরেও এর ব্যাপকতা প্রণিধানযোগ্য। প্রচলিত অর্থে কোনো স্থানের মানুষের পরিচ্ছন্ন জীবন-চেতনা, আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি।

কোনো একটা জনগোষ্ঠী কোনো স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকলে তাদের মানবীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে সেখানে এক ধরণের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সেখানকার সংস্কৃতির রূপ কেমন হবে তা ঐ জনগোষ্ঠীর মানুষের দুনিয়াবী জীবন সম্পর্কে ধারণা, জীবনের চরম লক্ষ্য, মৌলিক ধর্মবিশ্বাস (বুনিয়াদী আকিদা) ও চিন্তাধারা, ব্যক্তিপ্রশিক্ষণ এবং সমাজব্যবস্থা এই পাঁচটি মূল উপাদানের উপর নির্ভর করে। উল্লেখিত মৌলিক উপাদানগুলিতে তাওহীদ অর্থাৎ আল্লাহ্‌র একত্ববাদের প্রভাব পড়লে এক উন্নতমানের সংস্কৃতির সৃষ্টি হতে বাধ্য।

অনেকে বলে থাকেন তাওহীদে বিশ্বাসীগণের অর্থাৎ মুসলিমদের আলাদা কোনো সংস্কৃতি নেই এবং থাকতে পারেনা। তাঁদের মতে, যে এলাকাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস, সেখানকার সংস্কৃতিই তাঁরা ধারণ করেন। তাঁদের এ ধারণা মোটেও ঠিক না। ভৌগলিক সীমা রেখা দ্বারা তাওহীদের মূলনীতিকে বেঁধে ফেলা যায়না। মুসলিম জনগোষ্ঠী যে এলাকাতেই বাস করুননা কেনো, তাওহীদ নির্ভর সংস্কৃতিই মূলতঃ তাঁদের সংস্কৃতি। মুসলিমদের এ উপলব্ধি যতই প্রখর হবে, তাঁদের সংস্কৃতি ততটাই তাওহীদ নির্ভর হবে। একই সাথে ঈমানের দাবি হিসাবেও তাওহীদ ভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য তাঁদেরকে মনোযোগী হতে হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের অধিকাংশের মধ্যে তাওহীদের ধারণা খুবই সীমিত। ফলে কুর’আনের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কিছুকেই সাবলীলভাবে গ্রহণ করি এবং একটি বারের জন্য আমাদের মনেও হয়না যে আমরা তাওহীদ বিরোধী শিরকের ন্যায় মহা অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ছি। অথচ কুর’আনের একটি শব্দকে প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা আমাদের কারোর নেই। প্রতিস্থাপনের অর্থ এই নয় যে, কুর’আন থেকে কোনো একটি আয়াত সরিয়ে ফেলে অন্য কিছু ঢুকিয়ে দেয়া। এর অর্থ এই যে, কোনো আয়াতের হুকুমকে অবজ্ঞা করে নিজের অথবা অন্য কারো মত বা পথকে গ্রহণ করা। মহান আল্লাহ বলেছেনঃ “যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।” (সুরা আহযাবঃ ৩৬)। আরো মনে রাখতে হবে আল্লাহ, ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ মূলতঃ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্যই। যেহেতু আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রতিচ্ছবিই হচ্ছে সংস্কৃতি, সেহেতু আমাদের সংস্কৃতিতে তাওহীদের ছাপ থাকা আবশ্যক।

মুসলিমদের আনুষ্ঠানিক ইবাদত, সামাজিক বিধান, পারিবারিক আচরণ সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নীতিমালা সহ অন্যান্য সকল বিধিবিধান আবর্তিত ও অর্থপূর্ণ হয় একটি মূল ধারণাকে কেন্দ্র করে। আর

তা হচ্ছে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিকের বিষয়াদি সম্পর্কে বিধানদাতা মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার তাওহীদের ধারণা। বর্তমানে মুসলিম সমাজ তাওহীদের দর্শনকে সঠিকভাবে ধারণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। একই সাথে বিজ্ঞান, সাহিত্য, বিজাতীয় দর্শন এবং অন্যান্য ধর্মের প্রভাব বলয়ে আবদ্ধ হয়ে তাওহীদ বিরোধী সংস্কৃতির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। উল্লেখ্য আমাদের সার্বিক কর্মের যেখানেই তাওহীদের মূলনীতির বিচ্যুতি ঘটবে সেখানেই আল্লাহ্‌র সাথে শির্‌ক বা অংশীদারীত্ব সৃষ্টি হবে। সুতরাং মুসলিমগণের কর্তব্য হলো শিরকের মায়াজালে আকৃষ্ট না হয়ে তাওহীদের মূলনীতিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা।

এই দর্শনের আলোকে সংস্কৃতি গড়তে হলে অথবা প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে যা দরকার তা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতিতে কোন পথে শিরক অথবা আকিদা পরিপন্থী চিন্তার এবং কর্মকান্ডের অনুপ্রবেশ ঘটছে তা নির্ণয় করা। এ মর্মে নিম্নে কিছু বিষয় তুলে ধরা হলোঃ

শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। বৃহত্তর অর্থে শিক্ষা এমন একটি কাজ বা অভিজ্ঞতা যা কোনো ব্যক্তির মন, চরিত্র অথবা শারীরিক ক্ষমতার উপর একটি গঠনমূলক প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা সংস্কৃতির অন্যান্য বিভাগকেও সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করে। আধুনিকতা ও অসাম্প্রদায়িতার ধুয়া তুলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এতটায় নাজুক করে ফেলা হয়েছে যে, তাওহীদের মূল নীতির সাথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর পক্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে অন্য ধারার আরো একটি শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু থাকলেও বাস্তব কিছু কারণে তা আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাওহীদের আলোকে সকল প্রকার জ্ঞান দান এবং প্রয়োগের পদ্ধতি প্রদর্শন করতে পারছেনা। সুতরাং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঈমান-আকিদার দৃষ্টিতে ঢেলে সাজাতে হবে। বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে আপামর জনতা এবং শিক্ষিত মহলকেও বুঝাতে হবে আধুনিকতার অর্থ যদি বেহায়াপনা বা অনৈতিকতা না হয় তাহলে তাওহীদের সাথে এর কোনো বিরোধ নেই। যতদিন পর্যন্ত আমরা শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে না পারব ততদিন নিজেদের ঈমান-আকিদা রক্ষার জন্য আমাদেরকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অথবা সামষ্টিকভাবে তাওহীদ ভিত্তিক জ্ঞানার্জন এবং বিতরনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্রচেষ্টা সংস্কৃতি বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আবহমানকাল থেকে আমাদের সমাজে রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের সংস্কৃতি চালু আছে। কিছু লোক ওরশ মোবারক, কবর পূজা, মিলাদ মাহ্‌ফিল ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে শিরক ও বিদায়াতের সংস্কৃতির চর্চা চালু রেখেছে। তার সাথে যোগ হয়েছে ‘ধর্ম যারযার উৎসব সবার’ তত্ত্ব। এ তত্ত্বের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তাওহীদের খেলাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। নিজনিজ ধর্ম সবাই পালন করবে, এতে কোনো বাধা নেই। তাইবলে অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে আকিদা পরিপন্থী কাজ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারেনা।

কোনো দিবসের সাথে সম্পর্কিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে করনীয় কি, সে ব্যাপারে ইসলামের সুন্দর দিক নির্দেশনা থাকলেও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দিবস বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ ও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে আমাদের দেশের সংস্কৃতি এতটাই কলুষিত যে, তাওহীদবাদী হিসাবে পরিচিত সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে এটা কল্পনাও করা যায়না। এগুলির সাথে আরো যোগ হয়েছে জন্ম দিন পালন, ভালোবাসা দিবস, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বিধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব। নাটক, চলচ্চিত্র এবং আকাশ সংস্কৃতির অনেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও তাওহীদের চিন্তা থেকে মুলমানগণ দূরে চলে যাচ্ছেন।

প্রতিকৃতি, মূর্তি, ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করা, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এগুলো স্থাপন করা, এগুলোকে সম্মান করা, এগুলোর উদ্দেশ্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠানের মশাল প্রজ্জ্বলন, অমুসলিমদের অনুকরণে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বা কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন উপলক্ষে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

বস্তুবাদী চেতনা দ্বারা আকৃষ্ট এবং ইসলামী আকিদা থেকে বিচ্যুত মানুষেরা বিভিন্ন কর্ম-কান্ডের মাধ্যমে একত্ববাদের মূলে আঘাত হানে এবং এদের মধ্যে থেকে কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ ছদ্মবেশী রূপ ধারণ করে তা করে। উল্লেখ্য আমাদের সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতির অনেক কিছু সংস্কারযোগ্য হলেও অবশিষ্টগুলি পরিত্যাজ্য। তাই ভ্রান্ত চিন্তা ও আকিদা থেকে আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য মুসলিমগণ তাওহীদের মূল বাণী কালেমা তাইয়্যেবা পড়ার মধ্য দিয়ে কি স্বীকার করে নেন তা হৃদয়ঙ্গম করবেন। আর তখনি সক্ষম হবেন তাওহীদের মূল নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অপসংস্কৃতির সংস্কার অথবা মূলোৎপাটন করতে।

তাওহীদের আলোকে তথা ইসলামী সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করা। অর্থাৎ মানুষ মহান আল্লাহ্‌র খলীফা হিসেবে এ পৃথিবীতে কুরআন সুন্নাহ্‌র নির্দেশানুযায়ী তার সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করবে। এবং এরই আলোকে মানবাত্মার সার্বিক উৎকর্ষ ও উন্নতি সাধন করে পরকালের মুক্তি অর্জন করবে। কুর’আনের ভাষায়, একেই ‘তাযকিয়া’ বলা হয়েছে। আর তাওহীদ ভিত্তিক বা ইসলামী সংস্কৃতির মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন,

“হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু কর, সেজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর এবং সৎকাজ সম্পাদন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার”। (হাজ্জঃ৭৭) । আল্লাহ্‌ আমাদেরকে তাওহীদের আলোকে জীবন গড়ে সফলকাম হওয়ার জন্য তাওফিক দান করুন। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৭৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

370531
৩১ মে ২০১৬ দুপুর ০১:০৬
মোস্তাফিজুর রহমান লিখেছেন : আল্লাহ্‌ আমাদেরকে তাওহীদের আলোকে জীবন গড়ে সফলকাম হওয়ার জন্য তাওফিক দান করুন। আমীন।
৩১ মে ২০১৬ দুপুর ০১:১৬
307455
আব্দুল মান্নান লিখেছেন : আল্লাহ্‌ আপনার সহায় হোন।
370641
০১ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:০১
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : মন্তব্যটি পোস্ট রিলেটেড নয়।
রমজান নিয়ে ব্লগীয় আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অংশ নিতে পারেন আপনিও। বিস্তারিত জানতে-
Click this link

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File