রাজনৈতিক ইসলামের গোলক ধাঁধা
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল মান্নান ০৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:৩০:৫৫ দুপুর
অধুনা বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী প্রগতিশীলগণ বিভিন্নভাবে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ এর ধারণা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছ থেকে ‘অরাজনৈতিক ইসলাম’ এর কথা শোনা না গেলেও প্রসঙ্গতই তা চলে আসে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ এর বিপরিত শব্দ হিসাবে। ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা এবং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ইসলামকে একমাত্র জীবন বিধান হিসাবে নির্দিষ্ট করে দেয়ার উদ্দেশ্য বুঝতে না পারার কারণে সৃষ্ট পরিভাষাগুলির গোলক-ধাঁধায় পড়ে আমাদের জন্য পথ খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে পরিভাষাগুলির ব্যবহারের কৌশলটি গ্রহণ করা হয়েছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার জন্য। অর্থাৎ ইসলামকে দিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার ‘ইসলামী রাজনীতি’ ও ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ পরিভাষা দুটি একই অর্থবোধক হিসাবে আমাদের মনকে ঝঙ্কৃত করলেও, পরিভাষা দুটির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম একটি পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সুতরাং এর মধ্যে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সহ জীবনের সকল বিষয়ের বিধান রয়েছে। সেগুলি একজন মুসলিমের জন্য মান্য করাও অপরিহার্য। ‘ইসলামী রাজনীতি’ যাঁরা করেন তাঁরা ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চান। কাজেই ইসলামের স্রষ্ঠা যে রাজনীতি করার ইঙ্গিত দিয়েছেন সেটিই হচ্ছে ‘ইসলামী রাজনীতি’। অপর পক্ষে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ শব্দটির মধ্যে বিভাজনের সুর স্পষ্ট। কুর’আন-সুন্নাহ্র কোথাও ইসলামের প্রকৃত রূপ এমনভাবে প্রকাশ করা হয়নি যে সামাজিক ইসলাম, ধর্মীয় ইসলাম, অর্থনৈতিক ইসলাম বা রাজনৈতিক ইসলাম পৃথকভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে কারো মনে শিকড় গেড়ে বসতে পারে। ইসলামের আগে ও পরে অন্য কোনো শব্দ লাগিয়ে বিশেষায়িত করার কোনোই প্রয়োজন নেই। ‘ইসলাম’ শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রয়োজনীয় সকল অর্থ। ইসলামের নামে যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে তাদেরকে কোনো না কোনোভাবে ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ ধারক-বাহক হিসাবে চিহ্নিত করা এবং ঐ সুত্র ধরে কথার মার প্যাঁচে ‘ইসলামী রাজনীতির’ ব্যাপারে মুসলমানদের মনকে বিষিয়ে তোলা হলো প্রবক্তাদের প্রধান কাজ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফরাসী দার্শনিক এন্টোনি লুইস ক্লদ (Antoine Louis Claude Destutt, comte de Tracy: 20 July 1754 – 9 March 1836) মতাদর্শ (Ideology) শব্দের উদ্ভব ঘটালেও এর রূপ কোনো না কোনোভাবে সমাজে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। সহজভাবে বলা যায় মতাদর্শ হচ্ছে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতামত অথবা বিশ্বাসের ভিত্তিতে তৈরি একটি ব্যবস্থা যা কিনা মানুষ জীবন পরিচালনার জন্য গ্রহণ করে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনে মতাদর্শ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন প্রকারের মতাদর্শ দেখা যায়। ধর্মগুলিও মতাদর্শের অন্তর্ভূক্ত। সে দিক থেকে ইসলামের রয়েছে একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। ইসলাম হচ্ছে একটি পুর্ণাঙ্গ মতাদর্শ বা বিধান যার মধ্যে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার দিক নির্দশনা আছে।
আমরা জোর দিয়েই বলতে পারি মানুষ জাতির ইতিহাস যত পুরাতন বিভিন্ন আদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্বও ততই পুরাতন। তাই ইসলামের সাথে অন্যান্য আদর্শের বর্তমান দ্বন্দ্ব অস্বাভাবিক কিছু নয়। শয়তানের প্রকাশ্য ঘোষণাও ছিল বিভিন্ন রূপে এবং বিভিন্ন দিক থেকে ইসলামের বিরোধিতা করা। আদম (আলাইহিস সালাম) কে পৃথিবীতে প্রেরণের পর থেকে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে শয়তান কুমন্ত্রণার দ্বারা তার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করে আসছে এবং বর্তমান দৃশ্যপট ঐ চক্রান্তেরই অংশ।
পৃথিবীতে এমন কোনো মতাদর্শের বাস্তব রূপ দেখা যাবেনা যা কিনা অন্য কোনো আদর্শের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বিকশিত হয়েছে অথবা বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ধনতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনা এবং একইভাবে উল্টোটাও। ইসলামী আদর্শের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই ইসলামের সৌন্দর্যের বাস্তব রূপ দেখতে হলে ইসলামের আলোকে রাজনৈতিক দর্শনের মধ্য দিয়েই তা প্রস্ফুটিত হতে হবে। আর সে জন্যেই ইসলামে রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন। তা না হলে অন্য আদর্শের নিকট যতটুকু ক্ষতিকর বলে মনে না হবে ততটুকুই তারা পালন করার অনুমতি দেবে। বর্তমান বিশ্বে সেই চিত্রটিই প্রকটভাবে আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে।
বহু আগে থেকেই বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে কিছু দল প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা অব্যহত রেখেছে। ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলির পাশা-পাশি আরও কিছু ইসলামী দল রয়েছে যারা বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ঘোর বিরোধী। এমনকি দলগুলির অনুসারীগণ প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে ইসলামী রাজনীতি যারা করে তাদেরও কঠোর বিরোধিতা করে এবং তারা ঐ রাজনৈতিক দলগুলিকে ইসলামী দল হিসাবে গন্যও করেনা। তারা গণতান্ত্রিক ধারার বিরোধী হওয়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য এমন সব কর্মকান্ডের (সন্ত্রাসী) সাথে লিপ্ত যা ইসলাম কেন সাধারণ মানবিক মূল্যবোধ যাদের মধ্যে রয়েছে তারাও এটাকে সমর্থন করেনা। ইসলাম কায়েমের নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। এ গোষ্ঠী কাদের প্ররোচনায় এবং কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ইসলামের নামে জঘন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তা চিন্তাশীল মানুষদের ভেবে দেখা দরকার।
গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে হানাহানি কাম্য না হলেও অতীত কাল থেকে তা চলে আসছে। ইসলাম ছাড়া অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলগুলির পরস্পরের মধ্যে হানাহানি সংঘটিত হলে খুবই সাদাসিধে ভাবে এগুলিকে রাজনৈতিক হাঙ্গামা হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়। অপরপক্ষে ইসলামী রাজনীতির অনুসারীরা অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আত্ম রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিলেও তাদেরকে আক্রমণকারী, সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী হিসাবে প্রমাণ করার প্রক্রিয়া চালু হয়। একই সাথে এক যোগে স্বঘোষিত আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক মানুষেরা বশংবদ মিডিয়ার মাধ্যমে সোচ্চার হয়ে উঠে। নানা ধরণের অসত্য কাহিনী বার বার প্রচার করে সত্য বানানোর চেষ্টায় মত্ত থাকে।
বিশ্বজুড়ে ইসলাম বিরোধী শক্তির আধিপত্যের বিস্তৃতি থাকাতে সঙ্গত কারণে মিডিয়ার আধিপত্যও তাদেরই হাতে। মুসলিম দেশের অধিকাংশ সরকারগুলি নিজেদের গদি রক্ষার্থে ঐ সমস্ত আধিপতাবাদী ও সম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকে। ফলে পদলেহনকারী সরকারগুলি প্রসাশনকে কাজে লাগিয়ে মিডিয়াগুলিকে একই উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রণ করে। ভিন্ন মতাবলম্বী বিশেষ করে ইসলামের পক্ষের মিডিয়া অথবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদের ধুয়া তুলে খড়গ হস্ত হতে এবং কল্পিত অভিযোগের মাধ্যমে সেগুলি বন্ধ অথবা দখল করতে পিছপা হয়না।
নানান প্রচার-প্রোপাগান্ডার মধ্যেও যুক্তিবাদী এবং পাশ্চাত্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম সম্বন্ধে জানার আগ্রহ এবং ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পাওয়াতে এটা প্রমাণিত যে ভবিষ্যতে ইসলামী আদর্শই হতে পারে মানুষের জন্যে শান্তির চাবি-কাঠি। ইসলাম সম্বন্ধে নেতিবাচক প্রচারণা মূলতঃ ইসলামের ক্রমবর্ধমান অবস্থাকে যেনতেনভাবে রুখে দেয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। দিবালোকের মত এটা স্বচ্ছ যে, বিরোধী মহলের প্ররোচণা এবং মদদেই সৃষ্টি হয়েছে তথাকথিত ইসলামের নামে জঙ্গী গোষ্ঠীর। ইসলামী লেবাসধারী কিছু লোক অজ্ঞতা বশত এবং ইসলামকে ভালোভাবে না বুঝে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের এবং ইসলামের সর্বনাশ করছে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ইসলামের সার্বজনিনতাকে খন্ডিত করার লক্ষ্যেই আগে ও পরে রাজনৈতিক অথবা অরাজনৈতিক তকমা লাগানোর প্রচেষ্টা। আর এ প্রচেষ্টা নিতান্তই শব্দ বিভ্রাট ছাড়া আর কিছুই না। অধিকন্তু রাজনৈতিক ইসলামের গোলক ধাঁধা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার একটা সুন্দর হাতিয়ারও বটে। বিভ্রান্তি মূলক ব্যাখ্যার দ্বারা তাঁরা আনুষ্ঠানিক এবাদত ছাড়া ইসলামের সার্বিক কার্যক্রম, বিশেষ করে ইসলামী রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা তাঁদের প্রচারণার মূল লক্ষ্য।
সেক্যুলারিষ্ট বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীগণ ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপকে আড়াল করার সাথে সাথে এটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই মূলত তথাকথিত ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ জঙ্গী রূপের কল্প-কাহিনী প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁরা সকল ধর্মকে একই পাল্লাতে মেপে থাকেন এবং সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলামী আদর্শকে বিচার করেন। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকাটা যেন তাঁদের অহংবোধের অংশ। ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের আলোকে গঠিত রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের অনুসারীদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানো ছাড়া তাদের কর্ম পদ্ধতিতে ধর্মীয় বিধানাবলীর নির্দেশনা নেই বললেই চলে। প্রচলতি সেক্যুলার রাজনীতির উপকরণই তাদের রাজনীতির মূল হাতিয়ার। এব্যাপারে ইসলামের স্বাধীন ও পৃথক দৃষ্টভঙ্গী রয়েছে তা সেক্যুলারিষ্টগণ বুঝতে অক্ষম। ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধর্মীয় বিধানাবলীর দায়বদ্ধতা থেকেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য যে কাজের আঞ্জাম দিয়েছিলেন তা ‘ইসলামী রাজনীতি’। কাজেই কথিত ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ এর অলীক ধারণা ইসলামে অনুপস্থিত তা আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন