ধর্ম যারযার রাষ্ট্র সবার

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল মান্নান ০৬ জানুয়ারি, ২০১৩, ১২:১৭:৫৪ দুপুর

বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও সমাজবাদীদের নিকট ‘ধর্ম যারযার রাষ্ট্র সবার’ হচ্ছে একটি আকর্ষনীয় স্লোগান। সহজ সরলীকরণের মাধ্যমে এর দ্বারা বুঝানো হয় যেহেতু একটি রাষ্ট্রে বহু ধর্মের অনুসারী রয়েছে সেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংখ্যা গরিষ্ঠ কোনো একটি বিশেষ ধর্মের ব্যবহার কাম্য হতে পারেনা। ধর্ম নিতান্তই একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারেনা। তারা এও বুঝানোর চেষ্টা করে ধর্মের আইন-কানুন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে তা প্রগতিশীল রাষ্ট্র হতে পারেনা। বরং সেটি একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং সংখ্যালঘু ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকেরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তাই তারা জোর দাবি জানায় ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে।

উপরের অনুচ্ছেদে প্রথিতযশা বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের আলোচনা থেকে সম্ভাব্য যে প্রশ্নগুলি মনে সৃষ্টি হতে পারে সেগুলি হচ্ছে – ১) ধর্মীয় বিধান কি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তগত জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? ২) রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারেনা, এটা কি কোনো বুদ্ধিদীপ্ত কথা? ৩) ধর্ম কি প্রগতির অন্তরায়? ৪) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কোনো ধর্মীয় দল রাজনীতি করে এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় তারপরও কি তা অগ্রহণযোগ্য? ৫) এক ধর্ম কি অন্য ধর্মের লোকদের উপর অত্যাচার করতে বলে?

উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর কি হতে পারে তা নিয়ে এখন আলোচনা করবো। আমরা প্রথমেই ধারণা দিয়েছি বিষয়টি রাজনৈতিক এবং প্রেক্ষিত বাংলাদেশ। তাই প্রশ্নগুলির উত্তর ধর্ম ও রাজনীতি উভয় দিক থেকেই খোঁজার চেষ্টা করবো। আমাদের দেশে কয়েকটি ধর্মের অনুসারী থাকলেও শুধুমাত্র ইসলামী দলেরই পদচারণা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তাই ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গিটাই এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হবে।

উপরে উত্থাপিত সম্ভাব্য প্রথম প্রশ্নের উত্তর এক কথায় হতে পারে ধর্মীয় বিধান শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তগত জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ সামাজিক জীব, তাই ব্যক্তিগত কাজের বাইরে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু কাজের সাথে তাকে সম্পৃক্ত হতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাজগুলি কোনো না কোনো নীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। কুরআন সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নানান দিক নির্দেশনা দেয়। একজন বিশ্বাসীকে ব্যক্তিগত জীবনের বাইরের কাজগুলিকেও কুরআনের নীতির আলোকেই করতে হবে এবং তিনি তা করতে বাধ্য। তাছাড়া কুরআনের বিধান অনুযায়ী কিছু কাজ সম্মিলিতভাবে সম্পন্ন করা অপরিহার্য বা ফরজ। কাজেই ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে প্রচার করে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করার জন্য কুরআন ও সুন্নাহ্‌র আইনকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকতে পারে কিনা? আগেই উল্লেখ করেছি প্রশ্নটি উত্থাপন করে থাকেন আমাদের দেশেরই কিছু প্রথিতযশা বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা বলেন ধর্ম হলো মানুষের জন্য। কাজেই রাষ্ট্রের জন্য কোন ধর্মকে সাব্যস্ত করা ঠিকনা। তাঁদের বক্তব্য একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের বাস। তাই একটি রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি ধর্মকে সাব্যস্ত করার অর্থ হচ্ছে অন্যান্য ধর্মের লোকদের প্রতি অবিচার করা। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম তাঁরা সঠিক কথা বলছেন। তাহলে কেউ যদি প্রশ্ন করেন প্রতিটি মতাদর্শের জন্য কি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে? কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এক মতাদর্শের অনুসারীরা অন্য মতাদর্শের লোকদের দ্বারা নিগৃহীত হয়। মোটামুটিভাবে এটা সারা বিশ্বের স্বাভাবিক চিত্র। নির্দিষ্ট একটি আদর্শ দ্বারা পরিচালিত কোনো রাষ্ট্রে অন্য আদর্শের অনুসারীদের সমস্যা না থাকলে ধর্মের ব্যাপারেও তা থাকার কথা না। আরো প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে, আদর্শ হচ্ছে মানুষের জন্য, তাহলে একটি রাষ্ট্রের কি কোনো আদর্শ থাকতে পারে? বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ প্রচার করে থাকেন তাঁদের মনোনীত আদর্শের আলোকে স্বপ্নের রাষ্ট্রের কথা। যেমন, সমাজতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রগুলি কোনো না কোনো আদর্শের আলোকে পরিচালিত হয়। ধর্মও মতাদর্শ বৈ অন্য কিছু না। পার্থক্য হলো ধর্মীয় মতাদর্শ এসেছে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আর অন্যান্য মতাদর্শগুলি মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেরাই তৈরি করে থাকে। যে কোনো বিচারে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আসা মতাদর্শ মানব রচিত মতাদর্শের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাহলে মানব রচিত মতাদর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে সৃষ্টিকর্তার মতাদর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারবেনা কেন? কাজেই উত্থাপিত প্রশ্নটি বুদ্ধিদীপ্ত নয়।

পরের প্রশ্নটি ধর্ম কি প্রগতির অন্তরায়? উত্থাপিত প্রশ্নটি যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে ধর্ম একটা অচল জিনিসের মতো। প্রগতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, অভ্যুদয় ইত্যাদি। ধর্ম তথা ইসলাম কি কখনো উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় ছিল নাকি বর্তমানে তা সৃষ্টি করছে? নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন ইসলাম প্রগতির পথে অন্তরায় নয়। ইসলামের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অন্ততঃ সেটাই বলে। মুসলিমগণ ইসলামের বিধান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করার কারণে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্নভাবে চিত্রিত হলেও মুসলিমদের এটিই আসল চিত্র নয়। তথাকথিত প্রগতিবাদীরা যুক্তির উপর নির্ভর করে সবকিছু জয় করতে চান। ইসলাম যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং বিশ্বাসই ধর্মের মূলমন্ত্র। যুক্তির মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানানোর অনেক ঘটনা আমাদের সামনে রয়েছে। যুক্তিবাদীগণ বুঝানোর চেষ্টা করেন হাজার হাজার বছর আগে আসা ধর্ম তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোকে চাহিদা পূরণ করতে পারলেও বর্তমানে তার কার্যকারীতা আর নেই। এটি তাদের একটা ভ্রান্ত চিন্তা ছাড়া আর কিছুই না। মূলতঃ ধর্ম মানুষকে নীতিবোধ শিক্ষা দেয় যা কিনা উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সকল যুগেই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রগতির অর্থ যদি বেলেল্লাপনা ও বেহায়াপনা হয় তবে ধর্ম অবশ্যই প্রগতির অন্তরায়। যুগের পরিবর্তনে উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য উপায়-উপকরণে পরিবর্তন আসতে পারে কিন্তু নীতি-নৈতিকতার পরিবর্তন আসতে পারেনা। ফলে ধর্ম প্রগতির অন্তরায় তো নয়ই বরং সহায়ক।

চতুর্থ প্রশ্নটি হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তা গ্রহণীয় কিনা। এব্রাহাম লিংকনের দেয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার।১ অন্যভাবে বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র হলো কোন জাতিরাষ্ট্রের (অথবা কোন সংগঠনের) এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান ভোট বা অধিকার আছে।২ স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে। কারো নিকট সেটা পশ্চাৎপদ কোনো ব্যাপার মনে হলেও গণতন্ত্রের আলোকেই এর বিরুদ্ধে কোনো কিছু করার নেই। কিন্তু সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পতাকাধারীগণ তা মানতে নারাজ। ধর্ম যেন রাজনীতির ত্রিসীমানার মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে তাঁরা বাধা প্রদান করে থাকেন। যা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

শেষ প্রশ্নের উত্তর হলো কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের নিরাপরাধ লোককে অত্যচার করতে বলেনা। সকল ধর্মের মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে বলে। তবে ইসলামের ব্যাপারে একদেশদৰ্শী ও পক্ষপাত-দুষ্ট হয়ে কথা বলার লোকের অভাব হয়না। অনেকে বলে থাকে ইসলাম নাকি এসেছেই তরবারিরর উপর ভর করে। তারা প্রসঙ্গ ছাড়াই কুরআন থেকে কিছু উদ্ধৃত করে তা প্রমাণ করার চেষ্টাও করে। কোনো কোনো আয়াতের মাধ্যমে অবিশ্বাসীদেরকে শাস্তি দানের কথা বলা হয়েছে সত্য, তবে তা অবিশ্বাসী হওয়ার জন্য নয়। বরং কোনো অপরাধ মূলক কাজের সাথে জড়িত থাকার কারণে। অপরাধীকে শাস্তি দানের বিধান সকল ধর্মেই রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও ধর্মগুলির মৌলিক নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায়না।

জীবনের বিরাট একটা অংশ থেকে ধর্মকে দূরে রাখার তথাকথিত প্রগতিবাদীদের প্রবণতাকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি, “য়ুরোপে রিলিজন বলিয়া যে শব্দ আছে ভারতবর্ষীয় ভাষায় তাহার অনুবাদ অসম্ভব; কারণ, ভারতবর্ষ ধর্মের মধ্যে মানসিক বিচ্ছেদ ঘটিতে বাধা দিয়াছে–আমাদের বুদ্ধি-বিশ্বাস-আচরণ, আমাদের ইহকাল-পরকাল, সমস্ত জড়াইয়াই ধর্ম। ভারতবর্ষ তাহাকে খন্ডিত করিয়া কোনোটাকে পোশাকি এবং কোনোটাকে আটপৌরে করিয়া রাখে নাই। হাতের জীবন, পায়ের জীবন, মাথার জীবন, উদরের জীবন যেমন আলাদা নয়–বিশ্বাসের ধর্ম, আচরণের ধর্ম, রবিবারের ধর্ম, অপর ছয়দিনের ধর্ম, গির্জার ধর্ম, এবং গৃহের ধর্মে ভারতবর্ষ ভেদ ঘটাইয়া দেয় নাই। ভারতবর্ষের ধর্ম সমস্ত সমাজেরই ধর্ম, তাহার মূল মাটির ভিতরে এবং মাথা আকাশের মধ্যে; তাহার মূলকে স্বতন্ত্র ও মাথাকে স্বতন্ত্র করিয়া ভারতবর্ষ দেখে নাই–ধর্মকে ভারতবর্ষ দ্যুলোকভূলোকব্যাপী মানবের-সমস্তজীবন-ব্যাপী একটি বৃহৎ বনস্পতিরূপে দেখিয়াছে।” ৩

তথ্যসূত্রঃ

১. ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ শহরে এব্রাহাম লিংকনের ভাষণ

২. বাংলা উইকিপিডিয়া

৩. http://bn.wikisource.org/wiki/

বিষয়: রাজনীতি

১৬২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File