কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্যাম্পাস লাইফ

লিখেছেন লিখেছেন ইসমাইল একেবি ০৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৭:১৮:০২ সন্ধ্যা



ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট

২০০৫ সাল। সবেমাত্র কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। প্রতিবেশী জেলা হওয়া সত্ত্বেও এর আগে কখনও ওখানে যাওয়া হয়নি। ভর্তি পরীক্ষার ফরম তোলার সময়ই প্রথমবারের মত ক্যাম্পাসটাকে দেখলাম। সবুজ শ্যামল গাছগাছালিতে ভরা সবুজাভ মনোরম ক্যাম্পাস। এক কথায় অপুর্ব লাগে দেখতে। বিকাল কিংবা সকালে জনমানবশূন্য ক্যাম্পাসে পায়চারী করতেও অনেক ভালো লাগে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপ্রান্তে মেইন গেট থেকে প্রবেশ করলে ডানদিকে রয়েছে প্রশাসনিক ভবন এবং বামদিকে শহীদ মিনার। সামনে রয়েছে একটা চত্ত্বর; এটার নাম সম্ভবতঃ ডায়না চত্ত্বর। এখান থেকেই সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আরও বামদিকে গেটের প্রায় এক কিলোমিটারের কাছাকাছি দুরত্বে রয়েছে ছাত্রদের সাদ্দাম হল। এর পাশেই আছে জিয়া হল। জিয়া হলের পুর্বদিকে গা ঘেষে মাত্র ৪/৫ বছর আগে নতুন আরেকটি হল তৈরী করা হয়েছে তার নাম লালন শাহ হল। এগুলোর দক্ষিণে কিছুটা সামনেই রয়েছে বংগবন্ধু শেখ মুজিব হল। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদেরও দুটি হল রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে। সেগুলো হল- ফজিলাতুন নেসা মুজিব হল ও বেগম খালেদা জিয়া হল। ছেলেদের হলগুলো সেদিনই দেখে আসলাম। ঘুরে ফিরে দেখলাম অপুর্ব সুন্দরভাবে সাজানো ক্যাম্পাসটাকে।

ক্যাম্পাসে আবার গেলাম ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন। পরিচিত একজন বড় ভাইয়ের রুমে রাত্রি কাটালাম সেদিন। শিবিরের পক্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষার্থীদেরকে হলের মধ্যে রাত্রিযাপনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে, হলগুলো সেসময় ছিল ভর্তি পরীক্ষার্থী ও হলের আবাসিক ছাত্র সব মিলিয়ে কানায় কানায় ভর্তি। এদিনই বিকেল বেলা ক্যাম্পাসের খোলা মাঠে শিবিরের পক্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য একটা ছোটখাটো সমাবেশের আয়োজন করা হল। সেখানে শিবিরের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষার্থী ছাত্রদেরকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এখানে সাধারণ জ্ঞানের যেসব প্রশ্ন ভর্তি পরীক্ষায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলো নিয়েও উন্মুক্ত আলোচনা হয়েছিল। প্রশ্ন করে ছাত্রদের পক্ষ থেকে উত্তর আদায় করে নেয়া এবং অন্যদেরকে সেগুলো শেখানোর সুযোগ করে দেয়ার মত চমৎকার এ আয়োজনের কথা ভুলা যায় না। কয়েকশত ছাত্র সেখানে একত্রিত হয়েছিল। যারা প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে না তারাও সেগুলো জেনে নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল সেদিন। এগুলোর ভিতরে কয়েকটি প্রশ্ন সম্ভবতঃ ভর্তি পরীক্ষায়ও এসেছিল।

ভর্তি পরীক্ষার কয়েকদিন পরে জানলাম আমি এবং আমার ভাই দুইজনই চান্স পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। ভর্তি হলাম। ক্লাস করছি,অবসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে দেখছি। সবমিলিয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে ভালভাবেই।এছাড়া আমার ক্লাসমেটদের মধ্যেও অনেকে চান্স পেয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারাও আমাদের সাথে আছে; পড়ছে একই ইয়ারে। কেউ কেউ আবার আমার সাবজেক্টেও আছে।তাদের সাথে এবং নতুন নতুন ক্লাসমেটদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালোভাবেই চলছিল ক্যাম্পাস লাইফ। তবে,একটা সত্য কথা হল,ওখানকার পড়ালেখা এবং সিলেবাস আমার হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিতে পারেনি।মনে হয়েছিল কোথাও যেন একটা শুণ্যতা রয়ে গেছে।শুণ্যতাটা পুরণ করার জন্য বিভিন্ন উপায় খুজছিলাম। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে শূন্যতা পুরণের ব্যবস্থা করে দেয়ায় ওখানে কিছুদুর এগিয়ে যাওয়ার পরেও সেগুলো বাদ দিয়ে অন্যত্র স্টাডির জন্য চলে গিয়েছিলাম।আলহামদুলিল্লাহ!!

আমি ওখানে যে শুন্যতা অনুভব করেছিলাম তা ছিল-ওখানকার স্টাডি সিস্টেম।বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস মানানসই থাকলেও সিলেবাসের বইগুলো কিনতে পাওয়া যায় না।ছাত্রদেরকে লাইব্রেরীতে গিয়ে সেগুলো পড়তে হত।সব সময় কি আর লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ থাকে?রাত্রিবেলায় বাড়ীতে পড়াশুনাও তো করা দরকার।সেজন্য দেখা যায়,বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে যাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য অনেক ছাত্র শুধুমাত্র নোটের উপর নির্ভর করা শুরু করে দেয়।এক সময় দেখা যায় ছাত্রদের পড়ালেখা হয়ে যায় হ্যান্ডনোট কেন্দ্রিক।যার কারণে তারা নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

অপরদিকে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং জর্ডানের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি প্রতিটি সাবজেক্টের জন্য আলাদা আলাদা বই নির্ধারণ করে দেয়া হয়।শিক্ষার্থীরা বইগুলো কিনে বাড়ীতেও পড়াশুনা করার সুযোগ পায়।আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে প্রচুর সময় ব্যয় করেন ছাত্রদের জন্য একাডেমিক বই এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য উপযোগী বিভিন্ন বইপত্র লেখাতে।কিন্তু,দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য,আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেম বইপত্র লিখতে অনেক ভয় পান। অথচ,একজন আলেমের উচিত বইপত্র লেখা। কেননা,একজন হয়ত অনেক বড় আলেম।তিনি যদি বইপত্র না লেখেন তাহলে দেখা যাবে তিনি মারা গেলে তার সাথে সাথে তার ইলমও মারা যাবে।কারণ,তিনি সেগুলো মানুষকে মুখে মুখে বললেও লিখে যাননি।লিখে রেখে গেলে সেগুলো থেকে পরবর্তী প্রজন্মও উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেত।পক্ষান্তরে না লিখলে নিজের জ্ঞানটাকে মানুষের কাছে বংশ পরম্পরায় পৌঁছানোর কোন সুযোগ থাকে না।তাই,আমি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে অনুরোধ করব প্রতিটি বিষয়ের জন্য রেফারেন্স বইয়ের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি প্রতিটা সাবজেক্টের সিলেবাসের পুর্ণ অংশ ছাত্রদের সামনে আলাদাভাবে বই হিসেবে উপস্থাপণ করার ব্যাপারটাকে ভেবে দেখবেন।ছাত্ররা যেন নোটসর্বস্ব শিক্ষার্থী হয়ে গড়ে না ওঠে।বরং,তারা নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়।

যাহোক,আবার ক্যাম্পাসের কথায় ফিরে আসি।ক্যাম্পাসের বড়ভাইদের অনেকের সাথেই পরিচয় হল। ছাত্রদের মাঝে ইসলামী চিন্তাধারা ও ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার সাথে যুক্ত ইসলামী আন্দোলনের অনেক ভাইয়ের সাথেও পরিচিত ও ঘনিষ্ট হলাম। তাদের অনেকের সাথে একান্ত পরিবেশে আলাপ আলোচনা করারও সুযোগ হল।অনেকের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম অমায়িক ব্যবহার;কিন্তু,তাদের অনেকের মোবাইল নম্বর আমি রেখে দিতে পারিনি।ফলে,তাদের সাথে এখন ইচ্ছা করলেও যোগাযোগ করতে পারিনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রথম এসেছি তখনও জানা ছিল,আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্ত্রবাজির কারখানা।এখানে প্রায়ই মারামারি, সংঘর্ষ হয়;সেশন জট বাধে।ফলে,৪ বছরের অনার্স করতে অনেক সময় ৭ বছর সময় লেগে যায়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের ব্যাপারে অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানলাম।অনেককে বলতে শুনেছি,ক্যাম্পাসে কোন গন্ডগোল হলে হলের ভিতর চলে আসবেন। বাইরে যতকিছুই হোক হলগুলো সবসময় শান্ত থাকবে।হলের ভিতরে সাধারণত কোন সমস্যা থাকে না।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বছর খানিক ছিলাম।এসময় দুইবার সরাসরি সংঘর্ষ দেখেছি।একবার ছাত্রদল-ছাত্রলীগ এবং একবার ছাত্রদলের দুইগ্রুপ।তবে, সংঘর্ষগুলো ছিল অনেকটা সাধারণ।সেখানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়নি।

যেদিন ছাত্রদল-ছাত্রলীগ সংঘর্ষ হল সেদিন ক্লাস শেষ করে অনুষদ ভবণ থেকে বের হয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছিলাম। অনুষদ ভবনের উত্তর গেটের সামনে একটা রাস্তা রয়েছে পুর্বপশ্চিম বরাবর। এর উত্তর দিকে রয়েছে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী ও অন্যান্য কয়েকটি ভবণ। আমি ক্লাস শেষ করে রাস্তা ক্রস করে উত্তর দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তা ক্রস করার সময় বামদিকে দেখতে পেলাম একদল যুবক গেটের বাম সাইডে রাস্তার উত্তর দিকের একটা ছোট সাইজের গাছের নিচে জটলা করছে। ভাবলাম ছাত্ররা জটলা করতেই পারে।বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা অস্বাভাবিক কিছু না।আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম। রাস্তা পুরোপুরি পার হতে পারিনি বামদিক থেকে তারা তেড়ে আসল "এই ধর ধর ধর"করতে করতে। আমার পাশ দিয়েই তারা দৌড় দিল পুর্বদিকে শহীদ মিনারের দিকে থাকা ছাত্রলীগের পিছনে।তাকিয়ে দেখলাম কেউ কেউ সামনে পাওয়া ছোট ছোট চটকা গাছের ডাল টান দিয়ে ভেঙ্গে নিয়ে ওদের দিকে দৌড়াচ্ছে।আরও তাকিয়ে দেখলাম শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে কেউ কেউ রাস্তার দিকে দৌড়াচ্ছে।ইতিমধ্যে দুই এক রাউন্ড গুলিও ফুটল।তখন সর্বপ্রথম বুঝতে পারলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি?এগুলো ছাড়া মনে হয় আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল।যারা জটলা করছিল ওরা ছিল ছাত্রদল এবং যাদের দিকে ছুটে গেল তারা ছিল ছাত্রলীগ। সেদিন তারা ধাওয়া করে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছিল।

এদিকে অনেক ছাত্র জড়ো হয়ে গেছে অনুষদ ভবনের সামনে।সবার আগ্রহ সংঘর্ষ কেমন হয় দেখবে।এসময় শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দায়িত্বশীলরা এসে সবাইকে ওখান থেকে সরিয়ে অনুষদ ভবনের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল।কারণ,ওখানে সাধারণ ছাত্ররা অপ্রীতিকর ঘটনার শিকারও হতে পারে।অধিকাংশ ছাত্রদেরকে শিবিরের দায়িত্বশীলরা সাদ্দাম হলে নিয়ে গিয়েছিল বলে একটু একটু মনে পড়ছে।

এভাবেই শেষ হল ঐদিনের সংঘর্ষ।এতে অবশ্য কারও হতাহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়নি।তবে,ছাত্রলীগকে ছাত্রদল ক্যাম্পাস ছাড়া করেছিল।

দ্বিতীয় দিনের ঘটনা হল-একদিন সাদ্দাম হলের ভিতর ছিলাম।একসময় খবর পেলাম,বাইরে ছাত্রদলের দুই গ্রুপ মুখোমুখী অবস্থানে রয়েছে।তারা যেকোন মুহুর্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে।ইউনিভার্সিটির গন্ডগোল বলে কথা।গন্ডগোলটা ওরা কিভাবে করে তা দেখার দারুন আগ্রহ সবার মনে।অনেক ছাত্র সাদ্দাম হলের সামনের গেটে ভিড় জমিয়েছে।আমরাই বা আবার কেন পিছিয়ে থাকব? সাদ্দাম হলের গেটে এসে দেখলাম ছাত্রদলের এক গ্রুপের কিছু ছাত্র সাদ্দাম হলের সামনের দিকের মাঠে বসে জটলা করছে।অন্যদিকে আছে ছাত্রদলের আরেকটি গ্রুপ।শিবিরের নেতাকর্মীরা সাদ্দাম হলের সামনে উপস্থিত।শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতিও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।শিবিরের নেতাকর্মীরা কাউকে বাইরের দিকে যেতে দিচ্ছে না অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে এই অজুহাতে। যাহোক,শেষ পর্যন্ত সেদিন ওদের সংঘর্ষ সামনে অগ্রসর হয়নি।

মিশর থেকে দেশে গিয়েও দুইবার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি মিশর থেকে অনার্স শেষ করে গিয়ে দেখলাম আমাদের সহপাঠিরা আমার আগে অনার্স শেষ করতে পারেনি। আমি তাদের সাথে কিছুদুর শেষ করে আবার নতুন করে শুরু করা সত্ত্বেও আমরা এবং তারা একই সময়ে অনার্স শেষ করেছি। এর পিছনে একমাত্র কারণ হল- বাংলাদেশের সেশন জট।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে আদর্শ জাতি গড়ার লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যাক এ কামনা করি।

বিষয়: বিবিধ

৩৯৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File