এক নজরে কুরবানীর গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা ও ঈদের নামাজের পদ্ধতি
লিখেছেন লিখেছেন ইসমাইল একেবি ১৫ অক্টোবর, ২০১৩, ১২:০০:৪৬ দুপুর
মুসলমানদের অন্যতম দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। এ দু'টোতে তারা সুখ দুঃখ পরস্পরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। তন্মধ্যে একটি দিন ঈদুল আযহা। এদিনে আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশে সক্ষম মুসলমানগণ পশু কুরবানী করে থাকেন। এদিনে কুরবানি করাই আল্লাহ্ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ। মোটকথা আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই কুরবানি করতে হয়।
এদিনে কুরবানীর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন মাসয়ালা মানুষের জানার প্রয়োজন হয়। তাই, এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু মাসয়ালা তুলে ধরলাম।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا
অর্থাৎ, যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে। (মুসনাদে আহমাদ-৮২৭৩, একই অর্থে- মুসতাদরাকে হাকেম-৩৪৬৮,৭৬৬৫,৭৫৬৬, বায়হাকী; সুনানে সাগীর-১৮০৯; বায়হাকীঃ সুনানে কাবীর-১৯০১২, বায়হাকীঃ শুয়াবুল ঈমান-৬৯৫২; হাদিসটি সহীহ; দেখুন- সাহীহুল জামে'- আলবানী, নং-৬৪৯০)
কুরবাণীর বিধান নাযিল হয় কখন?
দ্বিতীয় হিজরীতে যাকাত ও দুই ঈদের নামাজের মতই কুরবানির বিধানও নাযিল হয়েছে।
কুরবাণী বৈধ হওয়ার দলীলঃ
পবিত্র কুরআন থেকেঃ
১। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন:
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (2)
অর্থাৎ, অতএব আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবাণী করুন। (সুরা কাউসারঃ ২)
২। আল্লাহ্ তায়ালার বাণী-
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذَلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (36)
অর্থাৎ,আর আমি উটকে তোমাদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে একটা নিদর্শন হিসেবে তৈরী করেছি।তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ।অতএব,তোমরা দন্ডায়মান অবস্থায় তার উপর [জবেহ করার সময়]আল্লাহ্ তায়ালার নাম উচ্চারণ কর।অতঃপর যখন সে মাটিতে পড়ে যাবে তখন তোমরা তা খাও এবং যারা [প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও]চায় না কিংবা যারা চায় তাদেরকে খাওয়াও।এভাবেই আমি তাকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারো। (সুরা হজ্জঃ ৩৬)
হাদীস শরিফ থেকেঃ
কুরবানি সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে মাত্র দু'টি হাদীস এখানে উল্লেখ করলাম।
১। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«ضَحَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ، ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ، وَسَمَّى وَكَبَّرَ، وَوَضَعَ رِجْلَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا»
অর্থাৎ,রাসুল (সাঃ)সাদাকালো রঙয়ের দু'টি শিং ওয়ালা বকরী দিয়ে কুরবাণী দিয়েছিলেন।তিনি নিজের পা তাদের ঘাড়ের পাশে রেখে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে নিজ হাতে জবেহ করেছিলেন।(বুখারী-৫৫৬৫,৫৫৬৪,৫৫৫৮ মুসলিম-১৯৬৬,তিরমীজি-১৪৯৪,নাসায়ী-৪৩৮৭,৪৪১৫, ইবনে মাজাহ-৩১২০, দারেমী-১৯৮৮, ইবনে হিব্বান-৫৯০০,একই অর্থে- মুসনাদে আহমাদ-১২৭৩৬, ১৩২০২,১৩৩২৩, ১৩৬৮১, ১৩৭১৪, বায়হাকীঃ সুনানুস সাগীর-১৮০২, বায়হাকীঃ সুনানে কুবরা-১০২২১,১৯০০৮)
২।বারা ইবনে আযেব (রাঃ)হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا نُصَلِّي، ثُمَّ نَرْجِعُ فَنَنْحَرُ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ، فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا،
অর্থাৎ,আমরা এই দিনটিকে যে কাজ দিয়ে শুরু করব তাহল-প্রথমে নামাজ আদায় করব এরপর ফিরে গিয়ে কুরবানি করব।আর যে এমন করবে সে যেন আমাদের সুন্নাত পালন করল।(বুখারী-৯৫১,৯৬৫,৯৬৮,৯৭৬,৫৫৪৫,মুসলিম-১৯৬১,মুসনাদে ইবনে হিব্বান-৫৯০৭; বায়হাকীঃ সুনানে সাগির-১৮২৮, বায়হাকীঃ সুনানুল কুবরা-১৯০২৭,১৯০৫৮,১৯১০৯, বায়হাকীঃ শুয়াবুল ঈমান-৬৯৪৫)
ইজমা থেকেঃ
সমস্ত মুসলিম একমত যে,কুরবাণী ইসলামি শরীয়ত কর্তৃক স্বীকৃত।
কুরবানি কেন করতে হবে?
কুরবানি করতে হয় পূর্ণ একটি বছর মানুষের বেচে থাকা এবং আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত অগণিত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা, গুনাহর প্রায়শ্চিত্য করার জন্য। অনুরুপভাবে কুরবাণী দাতা ও অন্যান্য পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কুরবাণী করা হয়; তবে, সাদাকাতুল ফিতরের মত এতে [কুরবাণী না করে] মুল্য পরিশোধ করে দিলে চলবে না। কেননা, সাদাকায়ে ফিতরে শুধুমাত্র গরীবদের প্রয়োজন মেটানো উদ্দেশ্য থাকে। ইমাম আহমদ (রহঃ) বলেছেন: কুরবাণী করা কুরবাণীর সমপরিমাণ মুল্য সাদকা করার চেয়েও উত্তম।
কুরবানির হুকুমঃ
১। হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ স্কলারের মতে-কুরবাণী দেয়া ওয়াজিব। কেননা, রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا
অর্থাৎ, যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে। (মুসনাদে আহমাদ-৮২৭৩, একই অর্থে- মুসতাদরাকে হাকেম-৩৪৬৮,৭৬৬৫,৭৫৬৬, বায়হাকী; সুনানে সাগীর-১৮০৯; বায়হাকীঃ সুনানে কাবীর-১৯০১২, বায়হাকীঃ শুয়াবুল ঈমান-৬৯৫২; হাদিসটি সহীহ; দেখুন- সাহীহুল জামে'- আলবানী, নং-৬৪৯০)
তাদের যুক্তি হল-কুরবানি ওয়াজিব বা বাধ্যতামুলক না হলে এটা বাদ দিলে রাসুল (সাঃ) এর পক্ষ থেকে এমন ধমক দেয়া হত না।
২। অন্যান্য মাজহাবের স্কলারদের মতে, কুরবাণী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। তাদের দলিল হচ্ছে- রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ»
অর্থাৎ, যখন তোমরা জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখ এবং তোমাদের কেউ যদি কুরবাণী করতে চায় তাহলে সে যেন তার চুল ও নখ কর্তন না করে। (মুসলিম শরীফ-১৯৭৭)
তাদের যুক্তি হল-উপরের হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন: [أَرَادَ] অর্থাৎ, "ইচ্ছাপোষণ করে" এর দ্বারা বুঝা যায় কুরবানী ওয়াজিব নয়।
কাদের উপর ওয়াজিব?
ঈদের দিন সকালে বাসস্থান, পোশাক, প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের বাইরে সাড়ে ৫২ তোলা বা ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য কিংবা তার সমপরিমাণ মুল্যের সম্পদ যার মালিকানায় আছে তার উপর কুরবাণী ওয়াজিব।
কোন কোন পশু দিয়ে কুরবাণী বৈধ?
সকল ইসলামিক স্কলার একমত যে,কুরবাণী হতে হবে চতুষ্পদ জন্তুর মধ্য থেকে। চতুষ্পদ জন্তু ছাড়া অন্যগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।যেগুলো দিয়ে কুরবাণি দেয়া যায় সেগুলো হল-
১।গরু
২।মহিষ
৩।উট
৪।ছাগল (ভেড়া দুম্বাও এর অন্তর্ভুক্ত)
এগুলোর উভয় লিঙ্গের পশুকেই কুরবাণী করা যায়।
পশুর বয়স কত হতে হবে?
দুম্বাঃ
১। দুম্বাঃ হানাফী ও হাম্বলী স্কলারদের মতে- মোটাতাজা হলে ৬ ষ্ট মাস পেরিয়ে সপ্তম মাসে উপনীত হলেই যথেষ্ঠ। এটা মালেকী মাযহাবের স্কলারদেরও একটি মত। হানাফী স্কলারগণ মোটাতাজা চেনার সিস্টেম বলতে গিয়ে বলেছেন-৭ম মাসে উপনীত দুম্বাকে এক বছর বয়সী দুম্বার মাঝে ছেড়ে দিলে যদি পার্থক্য করা না যায় যে, কোনটা এক বছর বয়সের এবং কোনটার বয়স ৭ম মাসে উপনীত হয়েছে। তাহলে তাকে কুরবাণী দেয়া যাবে।
শাফেয়ী স্কলার ও মালেকীদের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতে- দুম্বার বয়স ১ বছর পূর্ণ হতে হবে।
অন্যান্য পশুগুলোর বয়সঃ
* হানাফী মাজহাবের স্কলারদের মতে—
১।ছাগলের বয়স ১ বছরপূর্ণ হতে হবে।
২।গরু ও মহিষ ২ বছর পূর্ণ হতে হবে।
৩।উট ৫ বছর পূর্ণ হতে হবে।
* মালেকী স্কলারদের মতে-
১।ছাগল ১ আরবী বছর [৩৫৪ দিন]হওয়া লাগবে।এরপর স্পষ্টভাবে নতুন বছরে পদার্পন করা লাগবে।যেমন-১ বছরের চেয়ে ১ মাস বেশী বয়স হবে।
২। গরু ও মহিষের বয়স ৩ বছর পূর্ণ হতে হবে।
৩। উট ৫ বছর পূর্ণ হতে হবে।
* শাফেয়ী স্কলারদের মতে-
১। দুম্বা দ্বিতীয় বছরে পদার্পন করতে হবে।
২। গরু-মহিষ ও ছাগল তৃতীয় বর্ষে পদার্পন করতে হবে।
৩। উটের ক্ষেত্রে ৬ষ্ট বর্ষে পদার্পন করতে হবে।
* হাম্বলী স্কলারদের মতে-----
১। ছাগল পূর্ণ ১ বছর।
২। গরু [মহিষও একই]পূর্ণ দুই বছর।
৩। উট পূর্ণ ৫ বছর।
কোন পশু কয়জনে কুরবাণী দিতে পারবে?
১।গরু,মহিষ ও উটকে ১ থেকে ৭ জন পর্যন্ত যে কোন সংখ্যক লোক কুরবানি করতে পারবে।
হাদীস শরীফে জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ
অর্থাৎ, আমরা হুদায়বিয়াতে উট ও গরুকে ৭ জনের পক্ষ থেকে কুরবাণী করেছিলাম। (মুসলিম শরীফ-১৩১৮)
২। অন্যান্য পশুকে শুধুমাত্র একজন কুরবানি করতে পারবে।
গোশত বন্টন করাঃ
অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে, কুরবাণীর গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিকটাত্মীয়, বন্ধু বান্ধবকে দিয়ে দেবে যদিও তারা ধনী হয়। আর অপর এক তৃতীয়াংশ গরীব মিসকীনদেরকে দিয়ে দেবে। আর বাকী অংশ নিজেরা রাখবে। এটা করা মুস্তাহাব বা উত্তম। কেউ যদি বন্টনে কমবেশী করে তাতেও কোন সমস্যা নেই।
মালেকী মাজহাবের স্কলারগণ বলেন, তিনভাগ করার প্রয়োজন নেই; বরং, সাধারণভাবে নিজেরা খাবে এবং অন্যদেরকেও দেবে।
মৃতের পক্ষ থেকে কুরবাণী দেয়াঃ
* শাফেয়ী স্কলারগণের মতে-
মৃত ব্যক্তি অসিয়ত না করে গেলে তার নামে কুরবানি দেয়া হবে না। তবে, অসিয়ত করে গেলে অসিয়তের কারণে এটা বৈধ হবে। কোন ধনী ব্যক্তি কিংবা যিনি কুরবানি দিলেন তারা এ কুরবাণী থেকে খেতে পারবে না।কেননা,মৃতের পক্ষ থেকে খাওয়ার কোন অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না।
* মালেকী স্কলারদের মতে-
মৃত্যুর আগে পশু নির্ধারণ করে না গেলে তার নামে কুরবানি দেয়া মাকরুহ।যদি মান্নত ছাড়া নির্ধারণ করে দিয়ে যায় তাহলে তার ওয়ারিশদের জন্য তা বাস্তবায়ন করা মুস্তাহাব।
* হানাফী ও হাম্বলী স্কলারদের মতে-
জিবীতদের মতই মৃতের নামেও কুরবাণী করা যাবে এবং তা অন্যান্য কুরবাণির মতই খাওয়া যাবে এবং সাদকাহ করা যাবে; এতে মৃত ব্যক্তি সাওয়াবও পাবে। হানাফী স্কলারদের মতে, মৃত ব্যক্তি নির্দেশ দিয়ে যাওয়ার পর তার নামে কুরবানি করলে তা যিনি কুরবাণী করলেন তিনি খেতে পারবেন না।
একই গরুতে কুরবানি ও আকীকা দেয়া যাবে কিনা?
১। শাফেয়ী ও হানাফী স্কলারদের মতে একই গরু কিংবা উটে আকীকা ও কুরবানি করা যাবে।
২। হাম্বলী ও মালেকী স্কলারগণ একই গরু কিংবা উটে আকীকা ও কুরবানি করতে নিষেধ করে থাকেন।
গোশত রিজার্ভ রাখা যায় কতদিন?
কুরবানীর গোশত আপনি যতদিন খুশি জমা করে রেখে দিতে পারেন। এ গোশত আপনি সারা বছর কিংবা সারাজীবন ধরে যখন খুশি ইচ্ছামত খেতে পারেন অন্যকে খাওয়াতে পারেন এবং ফ্রিজ ভর্তি করে বছরের বছর ধরে জমা করে রাখতে পারেন। এগুলোতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এ গোশতগুলো আপনি কি করবেন সে ব্যাপারে আপনি পূর্ণ স্বাধীন।
বুখারী শরিফ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ খুজলে দেখা যায় রাসুল (সাঃ) একবার বলেছিলেন,তোমাদের কেউ যেন কুরবাণীর গোশত তিনদিনের বেশী জমা করে না রাখে। পরবর্তী বছর একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)!! আমরা কি গত বছর যেমন করেছিলাম এবারও তেমনি করব? তিনি জবাবে বললেন:
«كُلُوا وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا، فَإِنَّ ذَلِكَ العَامَ كَانَ بِالنَّاسِ جَهْدٌ، فَأَرَدْتُ أَنْ تُعِينُوا فِيهَا»
অর্থাৎ, তোমরা [এখন] কুরবানীর গোশত খাও,অপরকে খাওয়াও এবং রিজার্ভ করে রাখো!! কারণ,ঐ বছর মানুষের মাঝে অভাব অনটন ছিল। আমি চেয়েছিলাম তোমরা যেন তাদেরকে সাহায্য করতে পারো। (আধুনিক যুগে অর্থ করা যেতে পারে এভাবে-খাও,খাওয়াও এবং ফ্রিজে ভর্তি করে রাখো!)। (বুখারী-৫৫৬৯,মুসলিম-১৯৭৩,মুসনাদে আহমাদ-১১৫৪৩)
উল্লেখ্য যে,এখানে জমা করে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়নি। বরং জমা করে রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে মাত্র।
কিভাবে পশু জবেহ করবেন?
যারা কুরবাণী করবেন তারা নিজেরাই নিজেদের কুরবাণীর পশু জবেহ করতে পারেন। রাসুল (সাঃ) নিজেই নিজের কুরবানীর পশু জবেহ করেছিলেন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবেহ করতে হয় এটা সবারই জানা। সামনের চারটি রগ [দু'টি রক্তনালী,খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী] কাটলেই যথেষ্ঠ। আপনি আপনার নামে কুরবাণী করছেন এ নিয়ত মুখে উচ্চারণের কোন প্রয়োজন নেই। আলাদা কোন দুয়া পড়াও জরুরী নয়। আপনার মনে সংকল্প আছে যে,আমি এই কুরবাণী আমার নামে দিচ্ছি। সেই সংকল্পের নামই নিয়্যাত। এটাই কুরবাণীর জন্য যথেষ্ঠ।
সতর্কতা
রাসুল (সাঃ) জবেহের আগে ছুরিকে ভাল করে ধার দিয়ে নিতে বলেছেন যেন,পশুর কষ্ট না হয়। আর একটি পশুর সামনে অপর পশুকে জবেহ করবেন না। পশুকে দেখিয়ে ছুরিতে ধার দেবেন না।
ঈদের নামাজের নিয়ম
হানাফী স্কলারদের মতে-ঈদের নামাজ অতিরিক্ত ৬ তাকবীরের সাথে আদায় করতে হয়।শাফেয়ী স্কলারদের মতে ১২ এবং হাম্বলী ও মালেকী স্কলারদের মতে ১১ তাকবীর দিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে হয়।
অতএব,আমি সবাইকে বলব-আপনি কয় তাকবীরের সাথে ঈদের নামাজ পড়বেন ছয় তাকবীর নাকি বারো তাকবীরে সেটা আপনার নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সব স্কলারদেরই তাদের মতের স্বপক্ষে দলিল প্রমাণ আছে।তাই,এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ির চিন্তা আমাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা দরকার। ইসলামিক স্কলারদের যার মতামত আপনার পছন্দ হয় সেটাই আপনি নির্দ্বিধায় মানতে পারবেন।
যদি ছয় তাকবীর দিয়ে হানাফী স্টাইলে পড়েন তাহলে--
ইমাম প্রথম রাকাতে তাকবীর দিয়ে হাত বাধবেন। এরপরে সানা পড়ে তিনটা তাকবীর দেবেন। সেই তিনবারের মধ্যে দুইবারে হাত উঠাবেন কিন্তু হাত বাধবেন না;হাত ছেড়ে দেবেন। তৃতীয়বার তাকবীর দিয়ে হাত উঠিয়ে হাত বেঁধে ফেলবেন। এর পর ইমাম কেরাত পড়া শুরু করবেন। যথারীতি অন্যান্য নামাজের মতই কেরাত,রুকু, সিজদাহ ইত্যাদি আদায় করে রাকাত শেষ করবেন।
দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম প্রথমেই কেরাত পড়বেন এরপর কেরাত শেষে তিনটি তাকবীর দেবেন। সেখানে প্রতিবারই হাত উঠাবেন কিন্তু না বেঁধে ছেড়ে দেবেন। চতুর্থবার হাত না উঠিয়েই তাকবীর দিয়ে রুকুতে চলে যাবেন।
বাকীগুলো সব অন্যান্য নামাজের মতই। এটাই হানাফী স্কলারদের মত।
আর যারা ১২ তাকবীরে পড়বেন-
প্রথম রাকাতে তাকবীরে তাহরীমার পরে এবং কেরাতের আগে ৭ বার তাকবীর দেবেন। প্রতিবার হাত তুলবেন এবং বেঁধে ফেলবেন।
দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের আগেই ৫ বার তাকবীর দিয়ে কেরাত শুরু করবেন। বাকীগুলো অন্যান্য তাকবীরের মতই। এটা শাফেয়ী স্কলার ও সমমনাদের অভিমত।
মালেকী ও হাম্বলীদের মতামত হল-
প্রথম রাকাতে তাকবীরে তাহরিমার পর ৬ তাকবীর দেবেন। এরপর কেরাত পড়ে যথারীতি প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় রাকাতের জন্য উঠবেন। দ্বিতীয় রাকাতের কেরাত শুরু করার আগে ৫ টা তাকবীর দিয়ে কেরাত শুরু করবেন। এরপর যথারীতি অন্যান্য নামাজের মতই নামাজ শেষ করবেন।
কুরবাণীর গোশত বিক্রি করাঃ
কুরবাণীর পশুর গোশতসহ কোন অংশই বিক্রি করা যাবে না।তবে,চামড়া বিক্রি করলে তার মুল্যটাও গরীব মিসকীনদের মাঝে দান করে দিতে হবে।যদি কেউ অন্য কাউকে দিয়ে কুরবানীর পশু জবেহ করিয়ে নেন তবুও জবেহ কারীকে মজুরী হিসেবে কুরবানির গোশত দেয়া যাবে না।
আজকে আপাততঃ এ পর্যন্তই। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা!!! ঈদ মোবারক। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
[তথ্যসুত্রঃ আল ফিহহু আলাল মাজাহিবিল আরবা'আ ,আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, ফাতাওয়া আশ শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ]
বিষয়: বিবিধ
২৭৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন