গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী কি আসলেই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন??
লিখেছেন লিখেছেন ইসমাইল একেবি ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:০০:৪৮ বিকাল
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ফেসবুকে কিংবা সরাসরি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল সম্বন্ধে আমার মতামত জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। তাদের সবারই একটা কমন প্রশ্ন থাকে যে, ভাই!! প্লিজ!! একটু বলবেন কি গোলাম আযম,নিজামী,সাঈদী এরা রাজাকার কিনা? তারা আসলেই মানবতাবিরোধী কোন অপরাধ করেছেন কিনা?
গত পরশুদিনও ফেসবুক মেসেজে এক ভাই এ প্রশ্নটি করে বসলেন। তাদের কথার সারাংশ হল-আমরা সাঈদী,নিজামী,গোলাম আযমকে কোন অপরাধ করতে দেখিনি। কিন্তু,১৯৭১ সালে তারা আসলেই কোন অপরাধ করেছে কিনা? বাংলাদেশে তারা তো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার হিসেবে পরিচিত!!
এটা এমন একটা প্রশ্ন যার সঠিক উত্তর দিলে পাঠক হয়ত আমাকে একপক্ষের লোক ভেবে বসতে পারেন। কেননা,উত্তরটা কারও না কারও বিপক্ষে যাবে।হয় উত্তর আসতে পারে যে তারা যুদ্ধাপরাধী অথবা যুদ্ধাপরাধী নয়।ফলে,এক পক্ষের কাছ থেকে আমি হয়ত পক্ষপাতদোষে দুষ্ট হিসেবেও খেতাব পেতে পারি।
যাহোক,বিষয়টি যেহেতু অনেক গুরুত্বপুর্ণ তাই কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কেন্দ্রিক উত্তর না দিয়ে সাধারণভাবে এটা নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।
প্রথমেই আমার আলোচনার বিষয় হল-
তারা আসলে রাজাকার ছিলেন কিনা বা মানবতাবিরোধী কোন অপরাধ তারা করেছেন কিনা?
এর উত্তরে আমি বলব,কেউ যদি শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধ করে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে,তার অপরাধের শাস্তি আমি অবশ্যই সাপোর্ট করব। হোক সে অত্যধিক জনপ্রিয় কোন ব্যক্তিত্ব। এটাই ইসলামের নির্দেশ।আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
অর্থাৎ,হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্য ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাও। যদিও সাক্ষ্যটি হয় তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা নিজেদের পিতামাতা অথবা নিকটাত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে। যদি তারা (যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া হচ্ছে) ধনী কিংবা গরীব হয় তাহলে জেনে রাখো,আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশী বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু। অতএব,তোমরা ন্যায়বিচারের পথে নিজেদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না। যদি তোমরা (সত্য সাক্ষ্য না দিয়ে) সাক্ষ্যকে পরিবর্তন কর কিংবা সত্য সাক্ষ্য না দাও তাহলে,জেনে রেখো!!! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কর্মকান্ড সম্বন্ধে খোজখবর রাখেন!!!(সুরা নিসাঃ ১৩৫)
এ আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী আমি যদি মুসলমান হই তাহলে,আমাকে অবশ্যই অভিযুক্তের ব্যাপারে কোর্টে সত্য সাক্ষ্য দিতে হবে। যদিও সাক্ষ্যটা চলে যায় আমার কিংবা আমার পিতামাতা অথবা আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে।
সেদিক থেকে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন কেউ যদি অভিযুক্ত হয়ে যান এবং তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে আমাকে অবশ্যই তাকে শাস্তি দেয়ার পক্ষে থাকতে হবে। কেননা,অপরাধীর সাথে কোন আপোষ হতে পারে না। রাসুল (সাঃ)নিজেও ঘোষণা করেছিলেন যে, আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত আমি মুহাম্মাদ (সাঃ) তার হাত কেটে দিতাম।আর তাদের উপর শাস্তি বাস্তবায়নের সময় তাদের প্রতি যেন কোন মুসলিম দয়াপরবশ না হয়ে যায় এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে দিয়েছেন।আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
অর্থাৎ,যদি তোমরা আসলেই আল্লাহ তায়ালা ও শেষ দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের ব্যাপারে (আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি বাস্তবায়নের সময়) অপরাধীদ্বয়ের প্রতি দয়ার উদ্রেক না হয়। (সুরা নূরঃ ২)
এবার আসি আসলেই তারা অপরাধী কিনা সেই আলোচনায়।
পৃথিবীর সমস্ত আইন অনুসারে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ প্রমাণিত হতে হবে।প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন ব্যক্তিকে বড়জোর অভিযুক্ত বলা যেতে পারে;অপরাধী বলা যাবে না।তাই,অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন ব্যক্তিকে আমি অপরাধী বলতে পারি না।অভিযুক্তকে অপরাধী বলা বৈধ হলে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে পৃথিবীর যে কাউকে অপরাধী হিসেবে দাড় করানো যেত।অথচ,ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অনেক সময় বিভিন্ন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং ব্যক্তি নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
এ কথার জবাবে সে ভাই রিপ্লাই করলেন-
বিশাল জনগোষ্টী তাদেরকে ফাসি দিতে চায় এবং সবাই বলে,তারা অপরাধী। তাহলে আমরা কি বলব?
আমি জবাব দিলাম-পৃথিবীর সমস্ত মানুষও যদি একজোট হয়ে কারও সম্বন্ধে বলে অমুক অপরাধী,অমুক এ অপরাধটা করেছে,তাদের সে দাবির পক্ষে যদি কোন প্রমাণ না থাকে এবং সেগুলো কোর্টে প্রমাণিত না হয় তবে,ব্যক্তি শুধুমাত্র পৃথিবীবাসীর কথায় অপরাধী হয়ে যায় না।অভিযোগের পক্ষে এভিডেন্স থাকতে হয়।
এ ধরণের একটা ঘটনা এসেছে পবিত্র কুরআন মাজীদে।রাসুল (সাঃ)এর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ)এর বিরুদ্ধে যখন কিছু লোক মিথ্যা অপবাদ আরোপ করল যে,আয়েশা (রাঃ)সাফওয়ান (রাঃ)এর সাথে অপকর্ম করেছেন তখন আল্লাহ তায়ালা আয়েশা (রাঃ)কে নির্দোষ ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত নাযিল করলেন।(বিস্তারিত ঘটনা জানতে সুরা নুরের ১১-২৫ নং আয়াত দেখুন)আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ مَا اكْتَسَبَ مِنَ الْإِثْمِ وَالَّذِي تَوَلَّى كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ (11) لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْرًا وَقَالُوا هَذَا إِفْكٌ مُبِينٌ (12) لَوْلَا جَاءُوا عَلَيْهِ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَإِذْ لَمْ يَأْتُوا بِالشُّهَدَاءِ فَأُولَئِكَ عِنْدَ اللَّهِ هُمُ الْكَاذِبُونَ (13) وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِي مَا أَفَضْتُمْ فِيهِ عَذَابٌ عَظِيمٌ (14) إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (15) وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ قُلْتُمْ مَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهَذَا سُبْحَانَكَ هَذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ (16) يَعِظُكُمُ اللَّهُ أَنْ تَعُودُوا لِمِثْلِهِ أَبَدًا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (17)
অর্থাৎ,যারা ইফক তথা অপবাদ আরোপ করেছে তারা তোমাদেরই একটা গ্রুপ;(হে আবু বকর রা.এর পরিবার)তোমরা এটাকে অকল্যাণ বলে মনে করো না।বরং,এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্ম পরিমাণে সাজা।আর যে এর নেতৃত্বে আছে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।যখন তোমরা এটা শুনলে তখন মুসলমান নর-নারীরা কেন তাদের নিজেদের লোকদের সম্বন্ধে সুধারণা করে এ কথা বলল না যে,এটা স্পষ্ট অপবাদ??? যদি তারা চারজন সাক্ষী না নিয়ে আসে……;যদি তারা (চারজন)সাক্ষী না নিয়ে আসে তাহলে তারা আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে মিথ্যাবাদী হিসেবে গণ্য হবে।যদি তোমাদের উপর আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত তাহলে তোমাদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তি নিপতিত হত!!যখন তারা তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কিছু কথাবার্তা বলাতে চেয়েছিল এবং তোমরা তা বলেছিলে যে ব্যাপারে তোমাদের কাছে কোন জ্ঞান ছিল না।তোমরা মনে করেছিলে ব্যাপারটা খুবই সাধারণ অথচ,আল্লাহ তায়ালার কাছে এটা অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার।যখন তোমরা এটা শুনেছিলে কেন তোমরা বললেনা যে,আমাদের এসব কথাবার্তা বলা উচিত হবে না;এটা জঘন্য অপবাদ???? আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন,খবরদার!!যদি তোমরা বাস্তবেই মুসলিম হয়ে থাকো তাহলে এমন কাজের যেন পুণরাবৃত্তি না হয়।(সূরা নুরঃ ১১-১৭)
আমরা মুসলমানদের ব্যাপারে অবশ্যই সুধারনা করব যে,এমনটা হতে পারে না। যতক্ষণ না তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইসলামী আইনের একটা সুত্র হচ্ছে-
الْأَصْلَ بَرَاءَةُ الذِّمَّةِ
অর্থাৎ, [কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে] "মুলকথা হল সে নিরপরাধ।" (আল কাওয়ায়েদঃ ১/৩৬১ ও উসুলের অন্যান্য গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য)
ব্যক্তিকে প্রথমেই নিরপরাধ মনে করতে হবে। কেননা,আমাদের কাছে তার অপরাধের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।তদন্তে হয়ত ব্যক্তি নিরপরাধ প্রমাণিত হতে পারে।বিচারকের ক্ষেত্রেও এটা নির্দেশ রয়েছে যে,উভয় পক্ষকেই তিনি সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা দেবেন।এরপর দলীল প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই বিচার করতে হবে।
রাসুল (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে বলেছেন:
فَإِذَا جَلَسَ بَيْنَ يَدَيْكَ الْخَصْمَانِ، فَلَا تَقْضِيَنَّ حَتَّى تَسْمَعَ مِنَ الْآخَرِ، كَمَا سَمِعْتَ مِنَ الْأَوَّلِ، فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يَتَبَيَّنَ لَكَ الْقَضَاءُ
অর্থাৎ, যখন তোমার সামনে বাদী বিবাদী আসবে তখন তাদের মাঝে বিচার করবে না যতক্ষণ না প্রথম জনের কাছ থেকে যেমন শুনেছ অপরজনের কাছ থেকেও শুনবে। কেননা, তাতে তোমার কাছে বিচারের ধরণটা স্পষ্ঠ হয়ে যাওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে। (আবু দাউদ: ৩৫৮২)
ইবনে কুদামাহ (রহঃ) বলেন, বিচারের জন্য অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে বাদী বিবাদীর মাঝে সবকিছুতে সমতা নিয়ে আসা।বসা,সম্বোধন করা,খেয়াল রাখা,শব্দ ব্যবহার,কোর্টে প্রবেশ করা,তাদের দিকে তাকানো,তাদের কথা শোনা ইত্যাদিতে সমতা আনতে হবে। আর এটাই বিচারক শুরাইহ,ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)এর মত। এ ব্যাপারে কোন স্কলার দ্বিমত করেছেন বলে আমার জানা নেই। (আন নিযামুল ক্বাদায়ি ফিল ফিক্বহীল ইসলামী:১/৫২৯)
অতএব, আমাদেরকে প্রমাণ ব্যতিত যে কারও বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। প্রমাণ পাওয়ার পরই কাউকে আমরা অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারি তার পূর্বে নয়।
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন