চলুন ঘুরে আসি 'নাখিল ভিলেজ' (১ম পর্ব) সাথে চলুক আগোছালো কিছু আলাপন
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৭ মার্চ, ২০১৩, ০৫:১০:০৪ বিকাল
লোহিত সাগরের পূর্ব ধার ছুঁয়ে 'নাখিল ভিলেজ' এর অবস্থান। সাগরের এই পাশটিতে এ ধরণের আরো অনেক অনেক রিসর্ট চোখে পড়ে। ছবির মত সাজানো গোছানো পরিপাটি এই রিসর্টটিতে ঢুকতেই প্রবেশ পথের পরে রিসিপশন ও মূল ডাইনিং ভবনটি। এরপর ভেতরে ঢুকলেই হাতের ডান পাশে সুইমিং পুল, সুরম্য উদ্যান, পানির ফোয়ারা, ডানে বামে অনেক গুলো ডুপেক্স ভিলা। এছাড়া ও রয়েছে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র সুইমিং পুল। যেতে যেতে সাগরের তীর ঘেঁষে আরো একটি সুইমিং পুল, মূল লোহিত সাগরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা নিয়ে বোট স্কেটিং এরিয়া সব মিলিয়ে বেশ দৃষ্টি নন্দন পরিবেশ।
গত বেশ কয়েক বছর আগে একবার গিয়েছিলাম 'নাখিল ভিলেজ। 'এবার আমার হ্যজব্যন্ডের অফিসের পিকনিকে আবার যাওয়া হল। যেহেতু অফিস হতে পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিলো সীমিত, মাত্র ৪০০ ফ্যামিলি। তাই দেখা গেল অন্য ন্যশানালিটির মানুষের ভিড়ে আমরা বাংলাদেশী মাত্র ৫টি পরিবার যাবার সুযোগ পেলাম। যেহেতু অফারটি ছিলো 'আগে আসলে আগে পাবে'র মত। তাই বাকীরা অলসতার আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে 'নো ভেকেনসি' সাইন পড়ে গেল। থাক, ভাবলাম বাকীদের জন্য মন খারাপ করে লাভ নেই। বাঙ্গালী একাই একশ।
নাখিল ভিলেজে ঢোকার রাস্তাটি ভিলেজের বুক চিরে ঠিক মাথার সিথির মত মাঝ বরাবর করে এগিয়ে গিয়ে যেন একবুক তৃষ্ণা নিয়ে আছড়ে পড়েছে সাগর সৈকতে। আর পথের দু'পাশ জুড়ে সবুজ ঘাসের কার্পেট ফুঁড়ে কোথাও বাগান বিলাস, কোথাও কাঠ গোলাপ এধরণের রকমারি ফুলের গাছ। মরু ভূমির রুক্ষ বুকে সবুজের এই মেলা কেবলি মনে করিয়ে দিচ্ছিল সবুজ বাংলার স্নিগ্ধ শ্যমল মায়াময় রুপটিকেই। স্রষ্টার অকরুণ দানে আমাদের দেশে ঘাস যেখানে বিনা যত্নে, বড় অবহেলাতেই বেড়ে উঠে। সেখানে এই দেশে এই ঘাস শিশুকে পরিচর্যা করার জন্য রীতিমত আমাদের মত গরীব দেশগুলো হতে দল বেঁধে কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। এই ঘাস শিশুদের পরিচর্যায় এই সব শ্রমিকরা কর্তব্যের খাতিরে পরম মমতায় যেভাবে নিজকে নিঃশেষ করে শ্রম ঢেলে দেন। তার অর্ধেক মমতাও এই পরবাসী মানুষ গুলো গোটা জীবন মিলিয়ে ও নিজের সন্তানকে দেবার মত সুযোগ পান বলে আমার মনে হয়না।
মাঝে মাঝে এখানে ওখানে তৈরী করা কৃত্রিম পানির ফোয়ারা গুলো দুষ্ট ছেলের মত বিরামহীম ভাবে পানি ছিটিয়ে চলছে। সুশৃংখল ভাবে সারি করে লাগানো গাছ গুলো কোনটি করিম ঘটকের ছাতার আকৃতি,আবার কোনটি সর্পিল ভঙ্গিতে এঁকে বেঁকে গেছে।
এখানে একটি কথা বলি পাঠক। তরুণী বধুর পার্লারের কল্যাণে খুঁত ঢাকা নিপূণ প্রসাধন চর্চিত মুখটি আমার চোখে যেমন অতি মাত্রায় কৃত্রিমতার সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে রাখে। তার তুলনায় তরুনী বধুর সদ্য ঘুম ভাঙ্গা ফোলা মুখ আর কপাল জুড়ে কিছু বিচুর্ণ চুলের অস্তিস্ব কিংবা স্নান শেষে সারা চোখে মুখে পানির আদ্রতা ভরা প্রলেপ অনেক বেশী মনলোভা আর প্রাকৃতিক মনে হয়। তাই নাখিল ভিলেজের প্রকৃতি জুড়ে সবুজের এই সমারোহের মাঝে ও মনটা খুঁত খুঁত করছিলো। মনে হচ্ছে যেন বড় বেশী কৃত্রিমতার ছড়াছড়ি সর্বত্র। প্রকৃতির নিজস্ব ভঙ্গিতে চলার গতিকে যেন এক করুণ নিষ্ঠুরতায় মানুষের রুচি আর মর্জির কাছে হার মানতে হয়েছে। তাই কি প্রকৃতি সুযোগ পেলে তার বন্য আক্রোশে মাঝে মাঝে প্রতিশোধ নেয় জনারণ্যে? কখনো মাতাল ঝড় আর কখনো দু'কুল প্লাবিত ধ্বংসাত্নক বন্যা হয়ে।
আমার ছোট মেয়েটি ছুটে এসে বললো- আম্মু, দেখ গাছটিতে কি সুন্দর সাদা ফুল ফুটেছে। আমিও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম অনেকটা বেলী ফুলের মত দেখতে। এরই মাঝে আমার মেয়েটি হঠাৎ আর্তনাদ করে বলল-আম্মু, গাছটি খুবই পচা। দেখ আমাকে কাঁটা ফুটিয়ে দিলো। আল্লাহ কাঁটা গাছ বানানোর কি দরকার ছিলো? আমার ক্লাস ওয়ানে পড়ুয়া এই মেয়েটির হাজারো প্রশ্ন থাকে প্রতিদিন। আর যেটাই তার অপছন্দ সেটা র ব্যাপারে প্রশ্ন থাকে- কেন আল্লাহ এটি বানালেন? আমি ওকে সান্তনা দিয়ে বললাম- কেন তুমিই তো সেদিন বললে তোমার সাইন্স টিচার বলেছেন কাঁটা গাছের আত্নরক্ষার কাজে লাগে। তাছাড়া গাছ বেচারা তো নিজ হতে তোমাকে গিয়ে ব্যথা দেয়নি। তু্মিই ওকে ধরতে গিয়ে ব্যথা পেলে। আর দেখ গাছেরা কত ভালো। কত রকম গাছ মিলেমিশে এক জায়গায় আছে। কেউ কাউকে মারছেনা, চিমটি কাটছেনা কিংবা গালাগালি দিচ্ছেনা। অথচ দেখ আমরা সৃষ্টি সেরা জীব হয়ে ও আমরা মানুষরা কিন্তু তাই করি।
আমার মেয়েটা মাশাআল্লাহ বেশ মন দিয়ে শুনে। ও বিজ্ঞের মত মুখ ভঙ্গি করে গাছের উপর আলতো করে হাত রেখে বললো- গাছ বন্ধু, সরি।
আমার বড় মেয়েটির জন্য আজকের দিনটি বেশ আনন্দের। ভাগ্যক্রমে ওর একজন সাউথ আফ্রিকান আর একজন মালেশিয়ান ক্লাস মেটকে পেয়ে গেল পিকনিকে। এদিকে ছোটটাকে নিয়ে আমি গেলাম মেয়েদের সুইমিং এরিয়ায়। সেখানে বাহুল্য কাপড়ের অপচয় রোধের আন্দোলনে নামা প্রায় নগ্ন পোষাকের মুসলিম নারীদের দেখে কষ্টে মনটা ভরে গেল। কত অভাগা আজ মুসলিম জাতি! পোষাকি নামটাই শুধু মুসলিম পরিচিতি প্রকাশের একমাত্র প্রতীক। কিন্তু চিন্তা- চেতনায়, মন-মননে আজ ও পূর্ণ ভাবে আমরা ইসলামে দাখিল হতে পারছিনা। বিজাতীয় সংস্কৃতিই আজ আমাদের একমাত্র অনুকরণরীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার পিচ্চিটা তো চোখ বড় বড় করে বার বার প্রশ্ন করল- আম্মু, ওরা সবাই এমন শেমলেস কেন? শিক্ষা আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যখন আমাদের মানব সভ্যতার অবস্থান ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী। সেখানে পোষাক আর আচরণগত দিক দিয়ে কেন যে এখনো আমাদের মনের দৌড় সেই গুহা মানবদের পর্যায়েই কেবলি ধেয়ে যেতে চায় তা আমার বোধগম্য হয় না। মাশাআল্লাহ আমার ছোট মেয়েটির জানার আগ্রহ খুব বেশী। তাই ওকে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম- সেদিন তুমি বলেছিলে রাস্তার বিল্লি(বিড়াল) গুলো খুব শেম লেস। যেখানে সেখানে টয়লেট করে। আল্লাহ ওদের কেন বানিয়েছেন? এখন তুমিই বল আমরা এত বড় মানুষরা বেশী সেমলেস? নাকি লিখাপড়া না শেখা বিল্লি গুলো? আমার মেয়েটি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল- আমরা মানুষরা।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
২১০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন