চলুন ঘুরে আসে ''নাখিল ভিলেজ'' সাথে চলুক আগোছালো কিছু আলাপন(শেষ পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০১ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫৩:০০ দুপুর





দুপুরে লাঞ্চ করতে গিয়ে দেখলাম রীতিমত খাবারের পাহাড় চারদিকে। প্রতিটি ডিশ হতে এক টেবিল চামুচ করে খাবার নিলে ও মোটামুটি ২/৪ দিন না খেয়ে থাকা যাবে। শুধু মাত্র চোখের ক্ষুধা মেটাতে বাহুল্য খাবারের এই ধরণের আয়োজনে আমার কেবলি সোমালিয়াসহ বিশ্বের অনাহারী মানুষ গুলোর অভুক্ত মুখটা ভেসে উঠে।

ভোজন পর্ব সেরে অনেকেই দেখলাম দুই পাশে রক্ষিত ভিলা গুলোয় আশ্রয় নিয়েছে খানিকটা অলস আবেশে বিশ্রামের আশায়। আমি কথা বলার জন্য সঙ্গী হিসেবে যদিও বেশ নিরস। কিন্তু আমার সঙ্গীনিকে মনে হল বেশ উপভোগ করছেন আমার সঙ্গ। অথচ ভর দুপুরে পাতার ঝিরঝিরে হাওয়ার ভেতর হতে কোথাও যেন হারিয়ে যাবার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম।

মনের যাযাবরী অংশটা লুফে নিলো সেই ডাক। নয় ছয় বুঝিয়ে ভাবীটিকে খসিয়ে ফেলে আমি বেরিয়ে এলাম প্রকৃতির আহবানে। চারপাশে বেশ সুনসান নিরবতা। আমি একটি চেয়ার টেনে বড় একটি পাম গাছের নীচে এসে বসলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম পাম গাছের বিঘত খানেক কাটা শুকনো পাতার গোড়ায় ছানা পোনা নিয়ে রীতিমত সংসার পেতেছে অসংখ্য পাখি। আমি তো বিস্ময়ে হা। আসলেই জীবন অপ্রতিরোধ্য। আমি খুঁতখুঁতে পান্তা বুড়ির মত মনে মনে বললাম- দেহ কারবার। এই বেকুব পক্ষীগুলানের কামডা দেখছো? কোন হানে থাকতাচে। আমরার দেশে বাবুই পাখি কত সুন্দর কইরা গর বান্ধে। দেখলে তোমরা টাসকি খাইতা। হ।

হঠাৎ দেখি গাছের মাথায় বেশ কিচির মিচির প্রতিবাদ। বুঝলাম আমরা মানুষরাই যেখানে নিজের সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত নই সেখানে এই পাখি বেচারাদের তো দোষ দিয়ে লাভ নেই। আর তাছাড়া অসময়ের অনধিকার অবস্থানকারীর এই উপস্থিতি বোধহয় তারা মেনে নিতে পারছেনা। আমি দ্রুত চেয়ার সরিয়ে নিলাম। সাবধানের মার নেই। যদি প্রতিশোধ হিসেবে ওরা আমার মাথায় ইয়ে ..করে দেয়। আমার হাতের কাছেই ঝোপের ভেতর একটি পাখির ডিম পড়ে আছে দেখলাম।



মধ্যাহ্নের সূর্যটা তখনো দু'হাতে তার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। মাথার উপর নির্মেঘ আকাশটা যেন সাদা বকের পালকে ছেয়ে আছে। পায়ের নীচে সবুজের কার্পেট। আমি ভাবনার পাহাড়ে হেলান দিয়ে ডুবে গেলাম অন্যলোকে। শব্দহীন মনটা যে তখন হাজারো আলাপনে সবর হয়ে উঠেছে নিজেরই সাথে।

বেশ অনেকক্ষণ পর বুকের ভেতর সাগরের আহবান শুনতে পেলাম। আমি জুতো জোড়া হাতে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত হেঁটে চললাম সবুজ ঘাসের বুক চিরে ঝরা পাতার গা মাড়িয়ে সৈকতের পানে। ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি মনে করিয়ে দিল সেই গানটি- জীবনের সোনা ঝরা দিন গুলো আজ শীতের পাতার মত ঝরে যায়।....



বিগত কয়েক ঘন্টায় দেখেছি ঘাস গুলোর সজীবতা ধরে রাখতে একাধিক বার পানি দেয়া হয়েছে। তাই এর সবুজ চাদরে হাঁটার লোভ সামলাতে পারলাম না। নিজ দেশের নীল আকাশের সামিয়ানা আর সবুজ ঘাসের গালিচাটা ছেড়ে আসার কষ্টটা যে লেপ্টে থাকে আমার প্রবাসী মনে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।

কিন্তু হাঁটতে গিয়ে ঘাসের কদম চাঁট চুলগুলো পায়ের তলায় হালকা সুঁইয়ের মত বিঁধছিলো। আগে ও বলেছি এখানে ও মানুষ প্রকৃতির গায়ে হাত দিয়েছে। কোথায় নরম ঘাসের ডগা গুলোকে নিজস্ব স্বকীয়তায় মাটির কাছে ঝুঁকে নিরিবিলি একটু আলাপ সারতে দেবে তাই নয়। বরং সেগুলোকে যেন রুলার দিয়ে মেপে কাচি চালানো হয়েছে সমানে। মনে মনে ভাবলাম- কেন অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারে আমাদের এই আগ্রাসী মনোভাব? নিজের মতে নিজের পথেই অন্যকে চলতে বাধ্য করা। না হয় অত্যাচারের এমনি খড়গ তুলে অন্যের জীবন বিপন্ন করা।

এক সময় পৌঁছে গেলাম সৈকতের বালুকা বেলায়। তাকিয়ে দেখলাম দিগন্তে, যেখানে নীল আকাশটা যেন মিশে গেছে সাগরের নীল জলে। দু'চোখে এক অদ্ভুত তন্ময়তা নিয়ে কেবল তাকিয়েই রইলাম। আমি সাগর পাড়ের মানুষ। সাগর আমার চেতনায়, আমার আত্নবিশ্লেষনে আমার ভাবনায় সব সময় এক অন্যরকম ছায়া ফেলে। কতটা দীর্ঘ সময় আমি তন্ময় হয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ দু'পায়ে নোনা জলের সিক্ততায় ঘোর কাটলো। সেই সাথে দু'চোখের আদ্রতায় ও চমকালাম নুতন করে। -একি আমি কাঁদছি!

পাঠক, আজ সত্যিই আমার খুব খুব মন খারাপ। চারপাশে এত উপচে পড়া সৌন্দর্যের মাঝে ও তা উপভোগের অনুভূতি যে লুঠ হয়ে গেছে। এই নিয়ে আজ কতবার যে চোখের পানি চোখের রোদ্দুরেই শুকিয়েছি। শুধু মাত্র একটি সুন্দর পরিবেশের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতেই বেদনাহত মনটাকে আড়াল করে শব্দের পর শব্দের জাল বুনে গেলাম।

১৯৭১ আমি দেখিনি। কিন্তু সেদিন আমি সাগরের নীল জলের তীরে দাঁড়িয়ে আমার হাজারো স্বজাতির কান্নার নোনা জলের স্বাদ পেয়েছিলাম।

গাছে পানি দিতে থাকা স্বল্প আয়ের আমার দেশের মানুষ গুলোর এই ছন্ন ছাড়া জীবন আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করে প্রতিনিয়ত। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার মনে মনে বললাম- থাক, নিজ দেশে পাখির মত গুলি খেয়ে স্বজনদের চোখের সামনে মরে পড়ে থাকার চেয়ে পর দেশে কুকুর বিড়ালের কোনমতে দু'মুঠো জঠর জ্বালা মিটিয়ে তবু বেঁচে থাক মানুষ গুলো। বুঝলাম বদলে যাওয়া সময়ের সোপানে এসে বদলে যাচ্ছে আমার অনুভবের পথচলাও।





বিষয়: বিবিধ

২৬৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File