একই দৃষ্টি অথচ দৃষ্টিভঙ্গি কত ভিন্ন
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৩ মে, ২০১৮, ১০:৫৭:০৮ রাত
গত কয়েক মাস আগের কথা। আমার হাজব্যণ্ডের এক নতুন অফিস কলিগ । উনার বাসায় দাওয়াত ছিল আমাদের। ভাবীটি সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট ছিলেন। বাসায় গিয়ে দেখি টেবিলে সাজানো বিভিন্ন মুখরোচক খাবার। পোলাও, কোরমা, মাছের কাটলেট হতে নিয়ে ভর্তা, শুটকি কিছুই বাদ রাখেননি। বুঝলাম যিনি রাঁধেন তিনি চুল ও বাঁধতে পারেন।
খাবার পর্ব সারতেই আমার মেঝো মেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো একটি শেলফের দিকে । দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওমা…… থরে থরে বই। আমি তো রীতিমত বইয়ের শেলফের উপর হামলে পড়লাম। কোন ভদ্রতা ছাড়াই ফ্লোরে বসে গেলাম। নীচ হতে বইয়ের নাম পরিচয় জানার সুবিধার্থে। ভাবী আমার অবস্থা দেখে হেসে দিলেন। বললেন- একি .. আমি বললাম- আহারে এতক্ষণ কি খাওয়ালেন? আমি তো বইয়ের পোকা। কিন্তু সেই বইই চোখে পড়লো এত পরে। ভাইকে বলে কিছু বই এই অধমকে যদি ধার নেবার ব্যবস্থা করে দেন। ভাবী মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। বললেন- বইর প্রতি আপনার অনুরাগ আপনার দিকে তাকিয়েই অনুমান করতে পারছি। তবে আপনার ভাই তো আপনাকে বই দিতে পারবেনা।..
উনার কথায় আমি চোখ মুখ করুণ করে বললাম- কেন? আমি বই সময় মত ফিরিয়ে দেব। উনি মুখটা একটু গম্ভীর করে বললেন- সরি, তারপরও ও আপনাকে কোন বই দিতে পারবেনা? আমি বাচ্চাদের মত অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম- কেন? উনি এবার হাসিতে ফেটে পড়লেন।বললেন- কারণ বইয়ের মালকিন তো আমি। ও কি করে দেবে? আর আমি ও দিতে পারি এক শর্তে আপনি যে সময় মত ফেরত দেবেন তার জন্য ২/১ জন সাক্ষী প্রমাণ লাগবে। আমি তো মুশকিলে পড়লাম। হঠাৎ নিমন্ত্রিতদের মধ্য হতে লাবনী ভাবীর দিকে চোখ পড়লো। বললাম- এই ভাবী, বলেন না আমি বইয়ের কত উত্তম হেফাজতকারী। তখন লাবণী ভাবী বললেন- ভাবী, আপনি উনাকে চোখ বন্ধ করে বই দিতে পারেন। আমার হ্যজব্যন্ডের লাইব্রেরীর সমস্ত বই উনি পড়েছেন। আর খুব আমানতদারীতার সাথে ফেরত ও দিয়েছেন। মেজবান ভাবী হাসতে হাসতে বললেন- তাহলে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ যখন পাওয়া গেল। মামলা ডিশমিশ। আপনি যখন ইচ্ছা যত ইচ্ছা আমার লাইব্রেরী থেকে বই নিতে পারেন।
রামাদানের আগে যাতে শেষ হয়ে যায় তাই প্রায় মাঝ রাত পর্যন্ত পড়ে পড়ে বইগুলো শেষ করলাম। মন খারাপ ছিলো বলে হালকা বই ছোটদের হাসি সমগ্র দিয়েই শুরু করলাম। লেখক সঞ্জীব চট্রপাধ্যায়। বইয়ের ৬৬০-৬৬১ পৃষ্ঠায় পাওয়া একটি বিষয় আপনাদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। এক গল্পে বড়ভাই ছোটভাইকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলছেন-‘’জীবন কেমন জানিস? তোকে বাঘে তাড়া করছে। তুই ছুটছিস। উঠে গেছিস পাহাড়ে। বাঘ তখনো তোর পেছনে। পাহাড় চুড়া থেকে তুই পড়ে যাচ্ছিস খাদে। পড়ে যেতে যেতে কোনরকমে একটা লতা ধরে ঝুলছিস। বাঘটা উঁকি মারছে। এই সময় হঠাৎ বেরিয়ে এল এক পাহাড়ি ইঁদুর,ইয়া এত বড়। ইঁদুরটা ধারালো দাঁত দিয়ে, তুই যে লতাটা ধরে ঝুলছিস সেইটা কাটতে লাগলো। তুই ঝুলছিস। নীচে গভীর খাদ। পড়ে গেলেই মৃত্যু। এমন সময় তুই দেখলি পাশেই তোর হাতের নাগালের মধ্যে ঝুলছে, এক থোকা পাকা আঙ্গুর। বাঁ হাতে লতাটা ধরে ঝুলছিস।ইঁদুর কাটছে, মাথার উপর বাঘ ঝুঁকে আছে। তুই ডান হাতে একটা করে আঙ্গুর ছিঁড়ছিস আর মুখে দিচ্ছিস। নিচে গভীর খাদ হা করে আছে। তোকে যেভাবেই হোক ঝুলে থাকতে হবে। মৃত্যুর পরোয়া করিনা। জীবনকে উপভোগ করি।‘’
এই একই বিষয়টি একজন আস্তিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে হলে হত এরকম। (আমি সম্ভবত অনেক আগে কোন বইতে পড়েছি। মনেই করতে পারছিনা। তাই মূল থিমটি ঠিক রেখে নিজের ভাষায় উল্লেখ করছি।)
একবার এক ব্যক্তি স্বপ্ন দেখলো- তাকে একটি বাঘ তাড়া করেছে। সে বাঘের হাত হতে বাঁচতে দৌড়াতে দৌড়াতে একটি গাছে উঠে গেল। এরপর গাছের উপর হতে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল একটি বড় সাপ গাছের নীচে হাঁ করে বসে আছে। তখন সে ভয় পেয়ে গাছের গোড়ার দিকে তাকালো । দেখতে পেল একটি কালো ইঁদুর ও একটি সাদা ইঁদুর গাছের গোড়াটি পালা করে কেটে দিচ্ছে।চারদিকে এত সব ভয়ের মধ্যে যখন সে উপরে তাকালো তখন দেখতে পেল উপরের ডালে একটি মৌচাক। সে উপরে তাকাতেই এক ফোঁটা মধু মৌচাক হতে তার ঠোঁটে এসে পড়লো। আর ক্ষণিকের জন্য সে সব কিছু ভুলে গেল।
লোকটি এক ইমামের কাছে গেলেন স্বপ্নের অর্থ জানতে।ইমাম সব শুনে বললেন- তুমি যে বললে স্বপ্নে দেখেছো বাঘ তোমাকে তাড়া করেছে তার মানে মৃত্যু। প্রতিনিয়ত মৃত্যু মানুষকে এমনি করে তাড়া করছে। এরপর তুমি দেখলে ভয়ে তুমি একটি গাছে উঠে গেছ। গাছটি মানে জীবনকাল।এরপর তুমি গাছ হতে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলে একটি সাপ বসে আছে হা করে তোমাকে গিলে খেতে। সেই সাপ মানে কবরের গহ্বর। প্রতিটি মানুষকে নিজের ভেতর পাওয়ার জন্য কবর এমনি করে অপেক্ষা করে আছে। এরপর তুমি গাছের গোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখলে একটি সাদা ইঁদুর ও একটি কালো ইঁদুর গাছটির গোড়া কেটে দিচ্ছে।সেই সাদা ইঁদুর মানে দিন। আর কালো ইঁদুর মানে রাত। দিনের শেষে রাত। আর রাতের শেষে দিন।এমনি করে আমাদের জীবনবৃক্ষের সময় গুলোকে কেটে শেষ করে দিচ্ছে।একদিকে বাঘের ভয়। একদিকে গাছের নীচে সাপের অপেক্ষ। একদিকে গাছের গোড়ায় ইঁদুর কাটতে থাকা এতসব ভয়ের মধ্যে যখন তুমি উপরের দিকে তাকালে তখন দেখতে পেলে একটি মৌচাক । তুমি তাকাতেই এক ফোঁটা মধু এসে তোমার মুখে পড়লো। আর তুমি ক্ষণিকের জন্য মধুর মিষ্টতায় চারপাশের সমস্ত বিপদ গুলো ভুলে গেলে। সেই মধু মানে হচ্ছে দুনিয়ার প্রতি লোভ বা মায়া।
মানে আমরা জানি, প্রতিনিয়ত বাঘরুপী মৃত্যু আমাদের তাড়া করছে। আমাদের গাছরুপী জীবনকাল বা হায়াত ইঁদুররুপী রাত ও দিনের আবর্তনে শেষ হয় যাচ্ছে। সাপরুপী কবরের গহ্বর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। তারপর ও মধুর মত প্রিয়জন,প্রিয়বস্তু সবকিছুর মোহে আমরা এই চিরন্তন সত্য গুলোকে ভুলে থাকি। সুতরাং তোমাকে মৃত্যুর আবশ্যকতা জেনে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে হবে। তৈরী হতে হবে মহান প্রভুর কাছে জবাবদিহিতার জন্য।
দেখুন দু’টি ঘটনার বর্ননা অনেকটা একই ভাবে দেখা। কিন্তু বুঝবার কত পার্থক্য? তাই তো মহান প্রভুর প্রশ্ন’’যারা জানে এবং যারা জানেনা তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।‘’ সূরা যুমার-৯
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আবারো একাধিকবার প্রশ্ন করেছেন,’’বল ,অন্ধ ও চক্ষুষ্মান লোক কি কখনো এক হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি কখনো এক ও অভিন্ন হয়?’’ সূরা আর রা’দ-১৬/ সূরা ফাতির-১৯-২০)
মহান প্রভু আমাদেরকে বিবেকের সমস্ত বদ্ধ দ্বার খুলে তার সত্যকে মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারা তৌফিক দিন।
নূর আয়েশা সিদ্দিকা(বিউটি)
জেদ্দা, সৌদি আরব।
বিষয়: বিবিধ
১১৭১ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বইয়ের প্রতি আপনার ভালবাসা দেখে সত্যিই ভাল লাগলো আমি নিজেও একজন বই প্রেমিক,
.
আর যে গল্প বললেন সেটা শুনেছি মনে বয় মনে নেই তবুও খুবই ভাল লিখেছেন গল্পের মধ্যে একজন মুসলিমের চরিত্র উটে উঠেছে, আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের সঠিক পথে তলার তৌফিক দান করুণ আমাদের মতো গুনাগাড় বান্দাদের মাফ করুণ, আমিন
রামাদানের শুভেচ্ছা ভাল কাটুক এই রামদান আপনার দোয়া রইলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন