সমস্ত অনুষ্ঠানে লাজনম্র কনেটিকে খুঁজেই পেলাম না
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৬ মে, ২০১৮, ১০:৫৭:০৬ রাত
২০১৬ সালের কথা। সেবার ছুটিতে বাংলাদেশে গিয়ে একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাবার সুযোগ পেলাম। বেশ নামকরা বিশাল এক কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন। ঢুকতেই লাল,হলুদ রং বেরংএর মিটিমিটি লাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। চারদিকে রকমারী ফুলের সাজ। মন ছুঁয়ে গেল। মনে হল প্রবাসী জীবনে স্বজনদের এই ধরণের আনন্দ আয়োজন হতে আমরা সত্যিই বঞ্চিত হই।
স্টেজের ডেকোরেশন ও তাকিয়ে থাকার মতই। দীর্ঘ অনেক বছর পর এ ধরণের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া। তাই আমি শিশুসুলভ কৌতুহল নিয়ে চারদিক অবাক হয়ে দেখছি। যেহেতু একটু দূরের কারো বিয়ে । তাই সেই অনুষ্ঠানে কেউই আমার পরিচিত নন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কনের মিষ্টি মুখটি দেখবো বলে। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেল। সেই চাঁদ মুখটির দেখা মিললো না। আমি পরে অধৈর্য হয়ে আমার এক আত্নীয়াকে জিজ্ঞেস করলাম। এত দেরী হয়ে গেল। কনে এখনো এলোনা।? সে আমাকে অবাক হয়ে বলল- সেকি? আপনি এখনো কনে দেখেননি। এই যে এতক্ষণ ধরে ফটোশ্যুট করছিলো বিভিন্ন ভঙ্গিতে সেই তো কনে। আমি তো পুরো হা হয়ে গেলাম। বলে কি-কখনো বউরানী শাড়ির বিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে ওড়নার আঁচল ধরে । কখনো ষ্ট্যান্ডার্ড লুঙ্গির বিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে ঘাঘরার নীচের স্কাট ধরে । কখনো হাঁস মার্কা নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে চুল ধরে । কখনো বেদের মেয়ে জোসনা ছবির জোসনার মত করে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে বেড়ালো সে কিনা কনে?নয়নে নেই সেই স্নিগ্ধনত দৃষ্টি। ঠোঁটে নেই লাজুক হাসির রেশ। আমি তো ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে আশা করে বসে ছিলাম- মিষ্টি মুখের লাজুক চেহারার কনে বধূর মুখখানি দেখবো বলে। এখন তো ফটোশ্যুটের সেই উৎকট অঙ্গ ভঙ্গির কথা ভাবতে রীতিমত লজ্জাবোধ করলাম।কেননা আবহমান কাল ধরে লাজুকতা আর শালীনতা শব্দ দুটোর সাথে যে আমাদের অলিখিত এক নাড়ির যোগ রয়েছে বলেই জানি।
স্টেজে আরো বিভিন্ন জন এসে ছবি তুলছিলো। প্রায় সবার সাজ পোষাকই পাল্লা দিয়ে এতটা আকর্ষণীয় যে আমি আলাদা করে কনে কে তা বুঝতেই পারিনি। ফর্সা ধবধবে মুখ, নাক চোখ সব যেন বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার প্রস্তুতি পূর্ব মহড়ার আদলে ছাঁটা। তবে মজার ব্যাপার হল এগুলো স্রষ্টা প্রদত্ত নয়। পার্লারের আটা, ময়দার কারিশমা। আরো একটি ব্যাপার। (কেউ আমাকে ক্ষ্যত বলে ক্ষ্যাপাবেন না প্লিজ) আমি গত ২/১ দিন আগে কনেকে তার বাড়ির সামনে দেখেছিলাম। কিন্তু সেই মেয়ে আর এই কনে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। আজকাল আসলে বিউটি পার্লারের বদৌলতে শুধু মুখ পালিশ নয়। বোঁচা নাক খাড়া। ছোট চোখ বড়। বেঢপ ঠোঁটের শেপ বদলানো সহ কত কি করা যায়। তাই আমি পরে আরো দীর্ঘক্ষণ থেকে ও সেকেলে বুড়ি দাদীর মত মিটমিটে চোখে তাকিয়ে কেবল ভেবেছি- এই কি সেই মেয়ে ? তাই কনেকে দেখার উত্তেজনা অনুভব করলে ও উপভোগ করা আর হলনা।
ইদানিং শুনি ৬ ঘন্টা প্লেন জার্নি করে ইন্ডিয়ায় যেয়ে কনে পার্লার হতে সেজে আসার ঘটনা ও আমাদের দেশে হচ্ছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও সাজার বিপরীতে নই। নিজকে সুন্দর করে সাজাতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু যে সাজ আমাকে আয়নায় দেখতে গিয়ে আমি বীহিন দেখাবে সেই সাজ আমার কিছুতেই কাম্য নয়। আমার স্পেশালিটি আমিই। ঠিক যে রকম করে শিল্পীর তুলির ছোাঁয়ায় আমার স্রষ্টা আমাকে বানিয়েছেন। সেই আমাকে মুছে যাত্রা দলের সং সাজার মত অন্য কারো আদল দিয়ে দেয়া আমার পছন্দ নয়। আর যে সাজ সামান্য একটু পানির ছোঁয়াতেই বিলীন হয়ে যাবে তার পেছনে এত কাড়ি কাড়ি টাকা খরচের কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনা। বরং ইদানিং এ ধরণের ঘটনা ও খবরের শিরোনাম হয় নববধুর পার্লারে প্রসাধন চর্চিত মুখের আটা- ময়দার প্রলেপ ধুয়ে ফেলার পর স্বামী আঁতকে উঠে বলেন- এই তুমি কে? আমার বউতো এরকম ছিলনা।
খানিক পর কনে দেখি স্টেজ হতে হাওয়া। কিছুক্ষণ পর এলেন ৪ বেয়ারার পাল্কি চেপে। সাথে ধুমধারাক্কা হিন্দি গান। অনেকটা পদ্ম ফুলের আকৃতিতে তৈরী পাল্কির দুলুনিতে- আহারে কনেটি পড়ে যেতে পারে বলে আশংকায় আমার বুক ধুক ধুক করছিল। তখন আমাকে রীতিমত ক্ষ্যত উপাধির চরম হকদার প্রমাণ করে কনে আধুনিকার চরম পরিচয় দিয়ে সেই পাল্কির উপর বসে হিন্দি গানের সাথে নাচ। সেই সাথে চারপাশের সখা- সখীদের ও সে নাচে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পরে শুনলাম কনে নৃত্য শিল্পী। গতবার নাকি তার বোনের বিয়েতে একাই নেচে স্টেজ মাতিয়ে ছিলো।মনে হল আজকের এই আয়োজনের অনেক কিছুই প্রয়োজনের নয় প্রদর্শনের।
ক্রমাগত শব্দ দূষণ এড়াতে আমি এক সময় হলের ডান পাশে গিয়ে বসলাম। কিন্তু বিধি বাম। কিছুক্ষণ পর এপাশে দেখি শুরু হল ওপেন গানের কনসার্ট। শুধু তাই নয় যিনি ড্রামের তালে তালে গান করছিলেন সে ভদ্রমহিলা রীতিমত শ্রোতাদের বাধ্য করছিলেন তার সাথে নাচে গানে অংশ নিতে।কখনো হিন্দী কখনো বাংলা দোআঁশলা সংস্কৃতির ককটেল চলছিল। সংস্কৃতির এই‘ধার’আমার কাছে নিজস্ব সংস্কৃতির ঔজ্বল্য নয় বরং অন্যের কাছে হাত পাতার মতই হ্যংলামো বলেই মনে হয়েছে।পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই দেখলাম সাদা লম্বা সফেদ দাাঁড়ি আর টুপী পরা হাজী সাহেব ঘুরে ঘুরে অতিথিদের বরণ করছেন। অমুক হাজী সাহেব হিসেবে কনের বাবার এলাকায় যথেষ্ট সুনাম কিনা। সেই সাথে কনের মাকে ও দেখলাম মাথায় হিজাব পরেই ঘুরছেন। যে বয়সে একজন নারীর প্রতি পর্দার বিধান শিথিল হয়ে যায় সেই বয়সে কেন ভদ্রমহিলা এত কষ্ট করে গরমের মাঝে হিজাব পরেছেন আমি কিছুতেই বুঝে পেলাম না। তবে এটা ঠিক বুঝলাম বয়সে প্রবীণ হলে ও উনাদের আধ্যাতিকতার এখনো শৈশব কাল চলছে।
পুরো অনুষ্ঠানএর বাহুল্য ব্যয় দেখে মনে হল, যে ব্যয় করা হয়েছে একটি অনুষ্ঠানে তা দিয়ে আরো ৫/৭টি বিয়ের অনুষ্ঠান করা যেত। আমার মনে পড়লো, আজ হতে অনেক বছর আগের কথা। আমাদের পরিচিত দু’টি আপুর হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হল। বর দু’জন সহোদর ভাই। তারা স্বপরিবারে আমেরিকা হতে এসেছেন দেশে বিয়ে করতে। সে বছর দেশে খুব বন্যা হয়েছিলো। তাই শুনেছিলাম বর কনে প্ল্যান করে বিয়ের অনুষ্ঠান না করে সমস্ত টাকা বন্যার্তদের জন্য দান করে দিয়েছিলেন। আসলে সহজ হওয়ার মধ্যেই আছে কালচারের পরিচয়। আর মাত্রাতিরিক্ত আড়ম্বরের মধ্যে অহংকারের পরিচয়ই ফুটে উঠে।
বিয়ে মানে মানব মানবীর জীবনে সবচেয়ে কাঙ্খিত একটি দিন। তাই সব কিছু সুন্দরের মাধ্যমেই হবে সেটাই প্রত্যাশ্যা। কিন্ত বিয়ের এই আয়োজন নিয়ে বেশী বেশী বাড়াবাড়িটা ঠিক কাম্য মনে হলনা। বিয়ের আনন্দের এই মাত্রাতিরিক্ত আয়োজন- আমাদের দিচ্ছে বেগ কেড়ে নিচ্ছে আবেগ। কথাটি এজন্যই বললাম- লাখ লাখ টাকা খরচ করে এত এত ফটোশ্যুট আর ভিডিও করে যতটা সময় নিয়ে স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করা হয় এ দিনটি ঘিরে। আমার মনে হয় ঠিক তার চাইতে কম সময় লাগে এই প্রিয় স্মৃতি মাড়িয়ে বিচ্ছেদের সুর বাজতে। তাই বলবো বিয়ের দিনটিকে কেবল স্মরণীয় করে রাখা নয়। বরং এই বন্ধন কি করে চিরদিনের চিরতরের করে রাখা যায় তার চর্চাটা আরো বেশী হওয়া উচিত।
বিয়ের সাজের জন্য দিল্লী আর মধুচন্দ্রিমায় যারা সিঙ্গাপুর, ব্যঙ্কক ঘুরেন তাদের ও এক সময় সংসারের চার দেয়ালের মাঝেই ফিরতে হয়। তাই এর চাইতে আরো বেশী গুরুত্ব দিয়ে যদি বর কনেকে তাদের নতুন জীবনের চলার পথে কি করণীয় ,কি বর্জনীয়, পারস্পরিক আচরণের কোনটি কতটা সহনীয়, কোন আচরণ দূষনীয় এই সব জ্ঞান দানের জন্য পরিবারের পক্ষ হতে ফ্যমিলি কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা হত তবে তা আরো ফলপ্রসু হত। কেননা স্বামী –স্ত্রী’র একজন রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করেন। আর একজন ঘুমানোর সময় আলো সহ্য হয়না। এই সব মামুলি মতববিরোধকে কেন্দ্র করে ডিভোর্স হওয়ার মত ঘটনা ও আজকাল ঘটছে।
আবার বিয়ে কিংবা হলুদে এত বেশী খাবারের আইটেমের ভিন্নতা ভোজের ব্যয়বহুল আয়োজন আমাদের রসনাকে পরিতৃপ্তি দিলে ও ঠিক কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে ডাস্টবিনের পাশে অতিথিদের আধা খাওয়া এঁটো খাবার নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষদের কাড়াকাড়ি দেখে মনে প্রশ্ন জাগে- এ কোন সভ্যতার মেকাপে আমরা নিজকে সাজালাম। এখানে যে শোভার চাইতে লোক দেখানোর সম্ভারই বেশী। আজকের এই দিনে দুই পক্ষের মাঝে পরস্পরকে নতুন আত্নীয়তার বন্ধনে বাধার চাইতে খরচের দায়ে বাধানোর চেষ্টাটাই বেশী মনে হল।
পরিশেষে বলবো- বিয়ের মত মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ন অথচ স্বাভাবিক একটি প্রয়োজনকে যদি এত বেশী বাহুল্য ব্যয়ের দেয়াল তুলে দেয়া হয়। তবে যারা সময়মত এই ব্যয় মেটাতে সামর্থ রাখেন না তারা অনৈতিকতার পথে এই প্রয়োজনকে মেটাতে বাধ্য হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
জীবনের একটি বিশেষ দিনকে ঘিরে আমাদের মাত্রতিরিক্ত দামী পোষাক,গহনা, বিয়ের খরচ,মোহর সব কিছুর অতিরিক্ত প্রদর্শনী হতে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আসুন সীমিত ব্যয়ে, আন্তরিক আয়োজনে,বাহুল্য লৌকিকতা এড়িয়ে নরনারীর যুগলবন্দী জীবনের মেলবন্ধনের জন্য সহজতার পথে নুতন কালচারের জন্ম দিই। অনেক বেশী আনন্দঘন আর দায়বদ্ধ করে তুলি জীবনের এই দিনটিকে।
নূর আয়েশা সিদ্দিকা( বিউটি)
জেদ্দা,সৌদি আরব
বিষয়: বিবিধ
১১৩২ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কবি আল্লামা ইকবাল (রহ)।একটি কবিতা----চাল চলনে খ্রিষ্টান তুমি, হিন্দু তুমি সভ্যতায় এইতো সেই মুসলিম, যাকে ইহুদী দেখে লজ্জা পায়!! -------- এই কবিতাটি কেন বলে ছিলেন আপনার পোস্টা পড়ার পড় বুঝতে পারলাম,
.
দোয়া করবেন আপু এখন অনেক ছোট আমি মাত্র ২০ বছর বয়স আমি বিয়ে করবো এমন একজন মেয়েকে যার ইসলামের প্রতিটি বিধান মেনে নিতে রাজি হবে, এই সমাজের আধুনিকতার মেয়েদের মতো জেন না হয়, দোয়ার দরখাস্ত রইলো
আল্লাহর কাছে মাফ চাই, কেয়ামতের দিন এদের জন্য যেন আমাদের অপারগতার জন্য কৈফিয়ত না দিতে হয়। আল্লাহ এদের হেদায়েত কর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন