বিয়ের মোহরানা ছিলো ১ কোটি
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ৩০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:২৩:০৩ রাত
গত কয়েক দিন আগে একজন আমাকে বললেন উনার এক আত্নীয়ের বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। পাত্রী পক্ষ ১ কোটি টাকা মোহর দাবী করেছেন। ছেলে পক্ষ ৫০ লাখ এর উপরে রাজি হয়নি। তাই বিয়েটা ভেঙ্গে গেল।
আমার তখন মনে পড়লো,বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার এক পরিচিতা আমাকে বলেছিলেন,উনার পরিচিত এক মহিলার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মোহর ১ কোটি টাকা। সবাই এটা নিয়ে কানাঘুষা করছে। সেই মেয়ের মা নাকি খুব ক্লোজ একজনকে বলেছেন এটা তার প্রেস্টিজের ব্যাপার। তাই কাবিনে ১ কোটি লিখিয়েছেন। তিনি নিজে ও জানেন এই টাকা আদায় হবেনা। আমি শুনে অবাক হলাম। মনে পড়লো ‘আল কোরআনের জবানবন্দী’ নাটকটির কথা। সেখানে একটি দৃশ্যে ছিলো –একটি বিয়েতে মোহর ধার্য করার পর পাত্র যখন প্রশ্ন করলো –আমি এত টাকা মোহর কিভাবে আদায় করবো? তখন ঘটক বলল- মোহর আদায় করতে হয়না। বাসর রাতে বউমার কাছ হতে মাফ চেয়ে নিলে হয়।
আবার এ রকম ঘটনা ও শুনেছি, ছেলে মেয়ের মাঝে দীর্ঘ দিনের জানা শোনার পর ও বিয়ের আসরে মাত্রাতিরিক্ত মোহর দাবীকে কেন্দ্র করে বিয়ের আসর ভেঙ্গে যেতে।
আমার মনে আছে। আমার বিয়ের পর আমার হ্যজব্যন্ড আমাকে বলল- দেখ, ইসলামের নিয়ম মোহর আদায় করে দিতে হয়। আমি তো তোমাকে পুরোটা আদায় করে দিইনি। তাই যেটা বাকী আছে সেটার জন্য আমি কিছুদিন সময় চাই । মানে আমি সেটা লোন হিসেবে নিচ্ছি। তোমার মতামত কি? একবার…দুবার..তিনবার….. ও আমাকে একই কথা বলেই যাচ্ছে। আমার বিয়ে হয়েছিলো ইন্টার মিডিয়েটের পর। আমাকে মা কিংবা বড়রা কেউ বলে দেননি মোহরের ব্যাপারটি। তাই আমি কি উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না।
আমার হ্যাজব্যন্ড পরে এটা নিয়ে আমাকে ক্ষ্যপাতো। বলতো- বাব্বাহ কি মেয়ে? এত হিসেবী? প্রথম দিন একটু লোন চাইলাম। রাজিই হচ্ছিলো না। আমি তখন বললাম-আসলে এ কথার জবাবে কি বলতে হয় সেটাই তো বুঝতে পারছিলাম না। আমি শুধু আকাশ পাতাল চিন্তা করে কুল পাচ্ছিলাম না এই লোকটা নতুন পরিচয়ে আমার কাছ হতে লোন চাইছে কেন? আমি বেচারা টাকা কোথায় পাবো?
আসলে এ জন্য পরিবার হতে এসব বিষয়গুলোর সুস্পষ্ট জ্ঞান দেয়া প্রয়োজন।
আমার পরিচিত একজন দুঃখ করে বলেছিলেন, উনার এক পুরুষ আত্নীয়ের বিয়ের সময় বিশাল বড় অংকের মোহর ধার্য করা হয়। কিন্তু বিয়ের পর ধীরে ধীরে জানতে পারেন মেয়ের অন্য কোথাও সম্পর্ক ছিলো। আর সেই সুত্র ধরে সে সংসারে ভীষণ ঝগড়া অশান্তি এমনকি মেয়ে হ্যাজব্যন্ডকে ছুরি ও মেরে ছিলো। কিন্তু সেই ভদ্রলোক এতটা অসহায় ছিলেন মোহরের টাকা জোগাড় করতে পারছিলেন না বলে ডিভোর্স ও নিতে পারছিলেন না। তখন বুঝতে পেরেছিলেন মেয়ে পক্ষ এটা জানতো বলেই এত বিপুল টাকা মোহর হিসেবে ধার্য করেছিলো। অনেক পরে অবশ্য তিনি টাকাটা জমিয়ে সেই সম্পর্কের ইতি টেনেছিলেন। এ ধরণের ঘটনা আমি আরো একাধিক জনের কাছ হতে শুনেছি। উল্লেখ্য যে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ সালের আইনের সেকশন ১০ মতে- দেনমোহর স্ত্রী চাহিবামাত্র পরিশোধ যোগ্য।
আবার মোটা অংকের টাকা মোহর ধার্য করে সামান্য কারণে বিয়ে ভেঙ্গে সেই মোহর আদায় করা ।এভাবে আগের বিয়ের খবর গোপন রেখে একের পর এক বিয়ের নামে প্রতারণার ঘটনা ও আজকাল খুব শুনছি। মেয়ের পূর্বের দোষের কারণ প্রকাশিত হয়ে বিয়ে যাতে না ভাঙ্গে সেজন্য রক্ষা কবচ বা এর মাধ্যমে নারী নির্যাতনের মিথ্যে মামলা করে স্বামীর কাছ হতে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যবসায়িক মানসিকতা অনেকের মাঝে আজকাল দেখা যায়।
প্রাক্তন সংসদ সদস্যা হাফেজা আসমা খালাম্মা শেষবার যখন জেদ্দায় বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের গাড়িতে বসে গল্প করতে গিয়ে বলেছিলেন- জানো, এবার আমেরিকাতে একটি অন্য রকম বিয়ে খেলাম। পাত্রী সম্পর্কে আমার নাতনী হয়। তার বিয়ে হয়েছে এক মিশরী যুবকের সাথে। ওদের মসজিদের ইমামই ঘটকালি করেছিলেন। মেয়েকে যখন দেখতে এসে জিজ্ঞেস করা হল – তুমি বিয়েতে মোহর কত চাও? তখন মেয়ে বলেছিলো- এক সেট ফি জিলালিল কোরাআন হবে আমার বিয়ের মোহর। ( কারো কুৎসা বর্ণনা করা নয় পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে বলছি) খালাম্মা বলছিলেন, আমার নাতনিটি বেশ কালো। কিন্তু তার স্বামী অসম্ভব সুদর্শন এক যুবক। তারপর ও বিয়ের পর সেই যুবক ও তার পরিবার বলছিলো- আমরা পৃথিবীর সেরা মেয়েটিকে আমাদের পরিবারে পেয়েছি। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস হতে জানা যায়- রাসূল (সাঃ)পবিত্র কোরআন শিক্ষা দেয়াকে একজন মহিলার মোহর ধার্য করে এক সাহাবীর বিয়ে দিয়েছিলেন।
আবার এমন ঘটনাও আমি জানি স্বামী সামর্থ রাখেন তাই বেশ বড় অংকের মোহর ঠিক করে বিয়ে করেছেন। আর বাসর রাতেই স্ত্রী’কে চেকের মাধ্যমে সমস্তই আদায় করে দিয়েছেন। আমার মেঝ আপু যখন গতবার হজ্জে এলো তখন দুলাভাই মজা করে বলছিলেন- তোমার আপুর বিয়ের সময় মোহর তো ছিলো কম। আমি তার পরিবর্তে ওকে আমার বাড়ির অর্ধেক লিখে দিয়েছি। যা মোহরের চাইতে অনেক গুন বেশী।
মোহরের ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি :-পুরুষের আর্থিক সামর্থ আর নারীর জীবন যাপনের বর্তমান অবস্থা সেই সাথে সামাজিক( শিক্ষা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদি) অর্থনৈতিক,ভৌগলিক এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে মোহর নির্ধারিত হওয়া উচিত।
১. মোহর স্ত্রী’র প্রতি স্বামীর দান নয়। বরং এটি স্ত্রী’র জন্য আল্লাহর দেয়া অধিকার।
২. আল কোরআন মোহরকে অপরিহার্য ফরয বলে উল্লেখ করেছে।( সূরা নিসা-৪)
৩. আবার যে ব্যক্তি মোহর আদায়ের নিয়ত রাখেনা তাকে যিনাকারী বলে রাসূল (সাঃ) উল্লেখ করেছেন।( কানযুল উম্মাল)
৪. বাসর ঘরে কিছু না কিছু স্ত্রী’কে দেয়া উচিত। মোহর নগদে পরিশোধ করা সুন্নত। তবে স্ত্রী চাইলে মোহরের কিছু অংশ বা পুরোটা মাফ করে দিতে পারেন। অথবা চাইলে পরিশোধের জন্য স্বামীকে সময় দিতে পারেন। আবার যদি মোহরের দাবী একবার তুলে নিয়ে স্ত্রী সেটা পুনরায় দাবী করেন তবে স্বামী তা দিতে বাধ্য।
সতর্কীকরণ
১.মনে রাখতে হবে মোহর সামাজিক প্রদর্শনী মুলক কোন বিষয় নয় আর না তালাকের প্রতিবন্ধক কিছু। রাসূল সাঃ বলেছেন- ‘’তোমরা নারীদের পুরুষদের সাথে বাঁধতে চেষ্টা কর। এবং দেনমোহর নির্ধারণে সীমালংঘন করবেনা।‘’
২.রাসূল (সাঃ) আরো বলেন,’’ সর্বোত্তম মোহর হচ্ছে যা পরিশোধ করা সহজ।‘’( নায়লুল আওতার/ হাদীসের আলোকে মানব জীবন হাদীস নং-১৩৭)
৩. উমর (রা) বলেন,’’ নারীদের দেনমোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সীমালংঘন করবেনা। এটা যদি পার্থিব জীবনের সম্মানের বস্তু হত এবং আখেরাতের জন্য তাকওয়ার ব্যাপার হত তাহলে রাসূল (সাঃ) এটাকে তোমাদের চেয়ে বেশী পছন্দ করতেন। কিন্ত তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের কারো মোহর ১২উকিয়ার(৪০ দিরহামে ১ উকিয়া/ অর্থাৎ ৪৮০ দিরহাম) বেশী ছিলনা।‘’( তিরমিযী / হাদীস শরীফ- মোহরানা অধ্যায়) ব্যাখায় বলা হয়েছে- বেশী পরিমাণের মোহর অনেক সময় অহংকারের কারণ ও ঘটায়।
৪. ‘’ এবং তোমরা যা দিয়েছ তোমাদের কোন এক স্ত্রীকে বিপুল পরিমাণ ধন- সম্পদ মোহরানা স্বরুপ. তা হতে এক বিন্দু ফিরিয়ে নিও না।‘’ সূরা নিসা-২০
উমর (রাঃ) মোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতে চাইলে এক নারী আল কোরআনের এই আয়াতটিকে দলিল হিসেবে পেশ করেন। পুরুষের সামর্থ থাকার পর ও মোহর কম ধার্য করা মোহরে ফাতেমী নামে এটা যেমনি ঠিক নয়। তেমনি যারা সামর্থ রাখেন তারা মোহরের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু শর্ত হচ্ছে অবশ্যই আদায়ের নিয়ত থাকতে হবে।
পরিশেষে যেটা মনে রাখতে হবে,আবার এই মোহরকে কেন্দ্র করে পুরুষকে প্রতারণামূলক কাজ গুলো হতে ও নারীকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে ইসলাম নারীকে যে সম্মান দিয়েছে এই মোহরের অধিকারের মাধ্যমে তার অন্যায় প্রয়োগ করা আল্লাহর বিধানকে অপমানিত করারই নামান্তর। আল্লাহ আমাদেরকে তার বিধানের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের তৌফিক দিন।
নূর আয়েশা সিদ্দিকা (বিউটি)
জেদ্দা,সৌদি আরব
বিষয়: বিবিধ
১১৯৭ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অন্যান্য আপুরা এখন আর আসে না।
।
আর আপু খুবই ভাল লাগলো ইনশাল্লাহ আমি আমার বউয়ের মোহর বিয়ের দিন রাতে দিয়ে দেবো, দোয়া করবেন খুবই তারাতারি জেন বিয়ে করতে পারি দিন দিন বিয়ের বয়স হচ্ছে আব্বু আম্মু বুঝতেছেন না
দেনমোহর ধার্য্য করা উচিত ছেলের সামর্থ্যের উপর - সে কি পরিমাণ দিতে পারবে সেটা।
আমাদের দেশে এখন বাল্যবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বা অপছন্দ করা হচ্ছে , অন্যদিকে বাল্যপ্রেমকে লাই দেওয়া হচ্ছে , বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কোনটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর - বাল্যবিবাহ নাকি বাল্যপ্রেম ?
আমর মতে বাল্যপ্রেমের ক্ষতি সাধন ক্ষমতা ব্যাপক । তার চেয়ে বরং বাল্যবিবাহ অনেক কুকর্ম থেকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই - এবং শরিয়ত মতে এটা সর্ব্বৈব বৈধ।
এখন কথা হল অল্প বয়সে (২২/২৩ বছর বয়সে- যখন সে অনার্সের স্টুডেন্ট)যদি বিয়ে দেওয়া হয় একটা ছেলেকে (মেয়েদের হাত পা বড় হয়ে গেলে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায় বয়স ৯ হোক বা ২০) তাহলে সে কিভাবে দেনমোহর শোধ করবে? একজন স্টুডেন্ট তথা নন-স্টাবলিশ ছেলের হাতে কি কোন বাবা তার মেয়েকে শপে দেবে ?
২. এধরণরে পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বাল্যপ্রেমের অনৈতিকতা হতে বাঁচতে বাল্য বিবাহকেই কল্যাণের মনে করতে হবে।
৩. অনার্স পড়ুয়া বর যদি মোহরের টাকাই শোধ দিতে না পারেন তবে পরে তো বউকে ও খাওয়াতে পারবেন না। তাই এধরণরে ক্ষেত্রে পরিবার যদি সহযোগিতা করেন তবে বিষয়টি সহজ হয়ে যায়।অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার সুচিন্তিত এতগুলো বিষয় শেয়ার করার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন