সম্পর্ক কি ছেঁড়া স্লিপারের চেয়ে ও মূল্যহীন……?

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২২ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:৪৫:০১ রাত



আলম ভাবীকে দেখলেই মা-খালাদের বয়সীই মনে হয়। ভদ্র মহিলার আচরণেও তেমনি স্নেহের ছোঁয়া লেপ্টে থাকে সব সময়। একদিন আমার বাসায় এলেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। সাথে একটি তিন সাড়ে তিন বছরের ফুটফুটে শিশু। আমি লিভিং রুমে নিয়ে বসালাম। বাচ্চাটির সাথে ভাব জমাতে ওকে ফিশ এ্যকুরিয়ামের মাছগুলো দেখাতে নিয়ে গেলাম হাত ধরে। দেয়ালের ঝর্ণাটা দেখালাম। আমার বাচ্চাদের বাতিল কিছু খেলনা দিলাম।নাক চেপে ধরে ভুতের মত গলায় কথা বলার চেষ্টা করলাম। আমার সাথে শিশু কিশোরদের খুব তাড়াতাড়ি ভাব হয়ে যায়। কিন্তু এই বাচ্চা যেন ব্যতিক্রম। সে যেন কিছুতেই তার আড়ষ্ট ভাব কাটাবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে। আমি এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবীকে বললাম- আমার সব চেষ্টাই দেখি ফেল করলো। ভাবী, আপনার নাতিতো দেখি একদম চুপচাপ। কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই। ভাবী নোয়াখালী আঞ্চলিক টানেই কথা বলেন। আর আমি তো ফেনীর মানুষ।উনার দেশাতো বোন। ভাবী আমাকে বললেন- ইগা তো আর নাতি ন।

আমি বললাম- কয়দিন আগে না শুনলাম আপনার মেয়ে বেড়াতে এসেছে ভিজিট ভিসায়। ওর ছেলে না? ভাবী মুখের পান চিবাতে চিবাতে বললেন- না। হেতের মা বাইরে কাম করে। হেতে আর কাছে থাকে। হেতের বাপে তো হেতেরে হালাই চলি গেচে।

আমি তখন ভাবীর মুখে বিস্তারিত শুনে যা বুঝলাম।

বাচ্চাটির নাম আবদুল্লাহ।ওর নানা- নানী জেদ্দায় থাকতেন। উনারা দু’জন কোন কোম্পানিতে ক্লিনিং এর কাজ করতেন। আর আবদুল্লাহর মা দেশেই থাকতো। একসময় আবদুল্লাহর মা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর জেদ্দায় বাবা- মায়ের কাছে চলে আসে। সারাদিন বাবা- মা কাজের প্রয়োজনে বাইরে থাকতো। এই সুযোগে বাসার পাশের এক বাংলাদেশী দোকানদার যুবকের সাথে আবদুল্লাহর মায়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিষযটি বছর খানেক গড়ানোর পর যখন আবদুল্লাহর নানা- নানী জানতে পারেন তখন তারা মেয়েকে বাঁধা দেন।এক পর্যায়ে সেই যুবক এসে আবদুল্লাহর নানা- নানীর পায়ের উপর পড়েন। সেই যুবক তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে চান। না হয় সে আত্নঘাতী হয়ে যাবে। আবদুল্লাহর মায়েরা সম্ভবত ঢাকার দিকের মানুষ। তাই অচেনা চট্রগ্রামের ছেলের কাছে কিছুতেই নিজেদের একমাত্র মেয়েকে তুলে দেবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়ের কান্না আর সেই যুবকের অসম্ভব ভালোমানুষি চেহারায় উনারা সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হন। একপর্যায়ে মেয়েকে সেই যুবকের সাথে বিয়ে দেন। এর পর বিয়ের বছর গড়ালে এক সময় আবদুল্লাহর জন্ম হয়।

সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। একদিন হঠাৎ আবদুল্লাহর বাবা স্ত্রী’কে বলল- আমি তো অনেক বছর বাংলাদেশে যাই না। দেশ হতে ফোন এসেছে।আমার একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে। আমাকে যেতেই হবে। আর বাবা- মাকে ও তো অনেক দিন দেখিনা। তাই কিছুদিনের জন্য দেশে যাবো। আবদুল্লাহর মা সরল বিশ্বাসে তাকে যেতে সম্মতি দিল। যাওয়ার ২/১ দিন আগে আবদুল্লাহর বাবা আবার স্ত্রী’কে বলল- শোন.এতটা বছর তেমন কোন টাকা পয়সা জমানো হল না। দেশে খালি হাতে কি করে যাই। বোনটার বিয়ে। যদি কোন গহনাপত্র নিতে পারি তাহলে মনটা ও ভালো লাগতো। বোনটার বিয়েতে অন্তত একসেট গহনা দিলে আমার বাবা- মা ও খুশী হবে। এরপর কৌশল করে তোমার প্রসঙ্গটি বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলবো। যাতে তারা বউ হিসেবে তোমাকে মেনে নেয়।এক কাজ করনা। তোমার বিয়ের সময় তোমার বাবা-মা যে গহনার সেটটি দিয়েছে সেটা যদি তুমি আমাকে বোনের বিয়ের জন্য দাও তাহলে আমি দেশ হতে ফিরে তোমাকে নতুন একসেট গহনা আবার কিনে দেব। বিয়ের আগে এতদিনের সম্পর্ক।আবার নিজের এক সন্তানের বাবা। তাকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই উঠেনা। তাই আবদুল্লাহর মা সরল বিশ্বাসে স্বামীকে নিজের বাবা-মায়ের দেয়া গহনার সেটটি দিয়ে দিল।

এদিকে আবদুল্লাহর বাবা দেশে যাওয়ার পর একদিন দু’দিন করে সময় গড়াতে থাকে। কিন্তু কোন যোগাযোগ করছেনা দেখে মহিলা অস্থির হয়ে যোগাযোগের সকল ধরণের চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু কোন খোঁজ করতে পারেননি। কয়েক মাস পর আবদুল্লাহ বাবার এক পরিচিত লোকের খোঁজ পান। সে লোক ও আবদুল্লাহর বাবার সঠিক ঠিকানা জানেন না। তবে সেই লোকের কাছে সব শুনে তো মহিলার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আবদুল্লাহর বাবা নাকি দেশে যাওয়ার সময় ভিসা ক্যনসেল করে দিয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে আবার চাকরির জন্য দুবাই চলে গেছে। আর আবদুল্লাহর বাবারা শুধু দু’ভাই। কোন বোনই নেই। তার মানে বিয়ের ঘটনা, গহনা চাওয়া ও ছিলো এক ধরণের নাটক। আবদুল্লাহর নানা- নানী চট্রগ্রামের ঠিকানায় যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই ঠিকানা গুলো ও সঠিক ছিলনা। ….তার মানে আবেগের দিন ফুরিয়ে গেলে আবদুল্লাহর বাবা নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে চিরদিনের মত ছেড়ে চলে গেছেন।

আবদুল্লাহ মা সন্তানের খরচ যোগাতে একসময় নিজে ও একটি ছোট কাজে যোগ দেয়। আর তাই গত বছর খানেক ধরে তিনি চাকরিতে যাওয়ার সময় আলম ভাবীর কাছে বাচ্চাটিকে রেখে যান।

আলম ভাবী আমার বাসা হতে আবদুল্লাহকে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি বাচ্চাটির হাতে জুস আর চকলেট দিতে গেলাম। কিন্তু বাচ্চাটি হাত বাড়িয়ে নিলনা। আমি অবাক হয়ে দেখলাম বাচ্চাটির অসম্ভব মায়াভরা মুখখানিতে যেন নিরাপত্তাহীন জীবনের আভা ফুটে রয়েছে। স্বাভাবিক শিশুসুলভ কোন চপলতাই আমি প্রায় ৩ঘন্টা সময়ে একবার ও দেখিনি। আমার বাসায় প্রচুর হাতের বানানো শোপিস। যে কোন বাচ্চা এলেই রীতিমত একটা তোলপাড় করে যায়। বাচ্চারা চলে গেলে আমি আবার গুছাতে থাকি। আর পান্তা বুড়ির মত আমার স্বামীর কাছে অনুযোগ করি। কিন্তু জীবনেএই প্রথম একটি শিশু এলো যে আমাকে সেই গজগজ করার কোন সুযোগই দিলনা। আমার সামনের ব্যলকনিতে শাইখ সিরাজের শিষ্যত্ব নিয়ে কিছু বৃক্ষ রোপনের ব্যর্থ চেষ্টা আমি রেগুলার করি। বারান্দায় রাখা ব্যবহারের চপ্পলজোড়া প্রায় অনেক দিন হল ছিঁড়ে গেছে। মরুভুমির ধুলো ঝড়ের প্রভাবে তার উপর দফায় দফায় ধুলোর পরত পড়েছে। আমি তাই ব্যবহারের জন্য নতুন চপ্পল রেখেছি। কিন্তু দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত ছেঁড়া প্রয়োজনহীন চপ্পলগুলো ফেলি ফেলি করে আজো ফেলা হয়নি। কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে।মনে হয় যেন –আহারে কতদিন ধরে আছে।থাক না হয় এক পাশে পড়ে।

নিজের যাপিত জীবনের যাতনার গল্প অনেকে আমাকে শোনান। তাই মাঝে মাঝে ভাবি –এক সময়ের প্রিয় সম্পর্কগুলো কেন আচানক এত মূল্যহীন হয়ে পড়ে? যেন বাথরুমের ছেঁড়া স্লিপারের চেয়ে ও মূল্যহীন, স্থায়িত্বহীন? মাত্রাতিরিক্ত আবেগের দিন ফুরিয়ে গেলে দুম করে সম্পর্কটা একটানে ছিঁড়ে ফেলে ঠিক ঘুড়ির সুঁতো কাটার মতই। ছোটবেলা দেখেছি রাস্তায় কুকুর বেড়ালের ফুটফুটে বাচ্চাগুলো ধরতে গেলে বাবা- মা কেমন করে তেড়ে আসতো। আজ যেন সৃষ্টির সেরা জীব মানব সন্তান তার চাইতে ও বেশী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ইচ্ছে হল তো বাবা ফেলে গেলেন অন্ধকার মাতৃজঠরে। আর ইচ্ছে হল তো মা ফেলে দিলেন ডাস্টবিনের আবর্জনায়। তাই নারী- পুরুষ দু’জনকেই বলবো- মাত্রাতিরিক্ত আবেগ নয়। বরং আবেগের স্বাভাবিকতার পথ ধরে নিজের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন। ভুলে যাওয়া চলবে না সময়ের পথ ধরে সুন্দর সভ্যতা বির্নিমাণের মহান দায়িত্ব দিয়েই স্রষ্টা আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

নূর আয়েশা সিদ্দিকা( বিউটি)

জেদ্দা

বিষয়: বিবিধ

১০০৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385146
২৩ এপ্রিল ২০১৮ রাত ১২:০৫
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : চমৎকার লেখা।আপু
২৩ এপ্রিল ২০১৮ রাত ১২:০৬
317586
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
385150
২৩ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১০:২৬
মোহাম্মদ নূর উদ্দীন লিখেছেন : ঘটনাবহুল সমাজের অনাচারের জায়গাগুলো মেরামতের জন্য ধর্মীয় অনূশাসন কার্যকরী হলেও শয়তানি আবেগের বশে ধর্ম-কর্ম পালনকারী মানুষগুলোও প্রায়ঃশয়ই ভুল করে বসে !! আল্লাহর দেয়া সীমার কিছু মাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই ইবলিস সাহেব সূযোগ পেয়ে যান !
আঁর বড় হোলার নামও কিন্তু আবদুল্লাহ ! তাই লেখাটা মন দিয়ে বুঝার চেষ্টা হয়েছে ! ধন্যবাদ ।
২৩ এপ্রিল ২০১৮ রাত ১১:১৭
317590
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী মন্তব্য। আপনার মন্তব্যের প্রতিটি পয়েন্টই সত্যতার দাবী রাখে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে নিজের নাফসের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার তৌফিক দিন। আর একটি কথা সৌদি আরবে 'আবদুল্লাহ'' মুহাম্মদ' এ দুটি নাম খুব বেশী রাখা হয়। দোয়া ও অনেক ধন্যবাদ রইলো আপনার ও পরিবারের সবার জন্য।
385151
২৩ এপ্রিল ২০১৮ সকাল ১১:৫৪
আবু নাইম লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
২৩ এপ্রিল ২০১৮ রাত ১১:১৮
317591
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : ভালো লাগার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
385157
২৩ এপ্রিল ২০১৮ রাত ০৮:৫৩
শেখের পোলা লিখেছেন : আখেরাতের ভয়ই একমাত্র এ সবের সমাধান দিতে পারে। ধন্যবাদ আপা।
২৩ এপ্রিল ২০১৮ রাত ১১:২০
317592
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : একদম ঠিক কথা। আসলে কাল কিয়ামতে মহান প্রভুর সামনে জবাবদিহিতার অনুভূতিই আমাদের চলার পথকে সুন্দর ও পরিমার্জিত করে। অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File