ফাটল (জীবন হতে চুরি করা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৫ এপ্রিল, ২০১৮, ০৯:৪৪:১৯ রাত
নীলা ছেলের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইংল্যন্ড গিয়েছিলো। ফিরেছে বেশ কয়েকদিন হল।এসে একাধিকবার চেষ্টা করেছে রীমির সাথে যোগাযোগের। কিন্তু বার বার ম্যসেজ আসছে নাম্বারটি বন্ধ। ওর বাসায় গিয়ে জানতে পারলো ওরা নেই।মাস খানেক আগে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। কেউ ওর কোন ঠিকানা জানেনা। নীলা ভেবে কুল কিনারা পায়না জলজ্যন্ত মেয়েটি কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? ভাবনার কুয়াশা ঠেলে নীলার মনে পড়ে রীমির সাথে প্রায় ২মাস আগে শেষ বারের কথপোকথন গুলো।
সেদিন নীলার ফোন পেতেই রীমি গলায় অনুযোগের সুর তুলেছিলো
-এত দিন পর মনে পড়লো আপা? নীলা লজ্জিত গলায় কৈফিয়ত দেয়- আসলে জানো গত ৬/৭ মাস এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে তোমাকে ফোন করতে সময়ই বের করতে পারিনি। তুমি,বাচ্চারা সবাই ভালো আছো তো?
রীমি একটি বড় শ্বাস ছেড়ে বলে- আপা,ভালো আর মন্দ যাই থাকিনা কেন সময় তো আর বসে থাকেনা। ঠিকই হারিয়ে যায়। শুধু অসময়ের কিছু ছাপ রেখে যায় আজীবনের জন্য। নীলা চমকে ওঠে ওর কথার ভঙ্গিতে- কেন রীমি? সব ঠিক আছে তো?
এরপর এটা ওটা টুকি টাকি কথার এক পর্যায়ে হঠাৎ রীমি বলে- আচ্ছা আপা,আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করি। আমার পরিচিত এক ভাবী আছেন । উনাকে প্রায়ই উনার স্বামী কথায় কথায় বলেন ডিভোর্স দিয়ে দেবেন। এ অবস্থায় উনার করণীয় কি?
নীলা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন- কেন ? ভদ্রমহিলার কি নতুন বিয়ে হয়েছে? রীমি বলল- না না, আপা উনাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর। ২টি বাচ্চা ও আছে। নীলা বললেন-তাহলে সমস্যা কোথায়? ভদ্রলোকের হয়তো ইসলামী জ্ঞান নেই। উনি হয়তো জানেন না আল্লাহর কাছে তালাক পছন্দনীয় নয়।এটি সেজন্য নিকৃষ্টতম হালাল বলা হয়েছে। রীমি বললো – না আপা, তাও নয়। ভদ্রলোকের বাবা আলেম ছিলেন। আর উনি নিজে ও ইসলাম সম্পর্কে ভালোই জানেন। তারপর ও তিনি প্রায়ই আজকাল অল্পতেই রেগে যান। স্ত্রী’র সাথে কথায় কথায় ঝগড়া করেন। আর রাগ করলেই স্ত্রীকে তালাকের কথা বলেন।
নীলার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তাই সে বলে- কিছু মনে করোনা রীমি। আমার সাথে তো অনেকেই ব্যক্তিগত কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করে। পরামর্শ চায়। তাই সেই অভিজ্ঞতা হতে বলছি- আল্লাহ না করুন। আমার মনে হয় ভদ্রলোকের এই অসংলগ্ন আচরণের পেছনে অন্য কিছু নেই তো.... আই মিন পরকীয়ার কোন ব্যাপার...। রীমি রীতিমত অবাক গলায় বলে- আপা, আপনি এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটি ধরে ফেললেন? আসলেও তাই ভদ্রলোক পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেছেন। নীলা বলেন-তুমি সেই মহিলাকে ভালো করে বুঝাও। যাতে তিনি ধৈর্যহারা না হন। ধীরে সুস্থে স্বামীকে যেন বুঝানোর চেষ্টা করেন। বিশেষ করে এই সব ঝগড়া ,বাজে বিষয়গুলো তাদের বাচ্চাদের মনে ও বিরাট প্রভাব ফেলবে। রীমি অভিমানী গলায় বলে- আপা, আমার আর ধৈর্য নেই ওকে বুঝানোর। ওকে বুঝানোর কম চেষ্টা করিনি .....নীলা অবাক হয়ে বলে- আমার মানে রীমি তুমি কি বুঝাতে চাইছো? রীমি এবার পুরোই ভেঙ্গে পড়ে – আপা সেই মহিলা আর কেউ নয়। আমিই..... রীমি ওপাশ হতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। নীলা ওকে কয়েক সেকেন্ড নিজকে সামলে নিতে সময় দেয়। এরপর বলে- দেখ রীমি,তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়োনা। হতে পারে এটা তোমার নিছক সন্দেহ। তোমার হ্যজব্যন্ডের খিটমিটে মেজাজের কারণ অন্য কিছু ও হতে পারে। অফিসের কোন ঝামেলা...
রীমি বলে- না আপা, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। আজ হতে প্রায় বছর খানেকের ও বেশী আগে ও একটু একটু করে কেমন যেন বদলে যাচ্ছিলো।ফোনে অনেক সময় কাটায়। ফোন আসলেই বারান্দা বা অন্য কোথাও চলে যায়। আমাকে কেমন যেন আড়াল করে।বাচ্চারা একজন সিক্সে পড়ে। আর একজন এইটে পড়ে। আমার ওতো ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই প্রথমে আমি ব্যাপারটি বুঝতেই পারিনি। কিন্তু একদিন দেখলাম ভুলে ফোন বাসায় রেখে বেরিয়ে গেছে। ওপাশ হতে বার বার একটি নাম্বার হতে কল আসাতে আমি ভাবলাম জরুরি কোন ফোন হবে। অন করতেই দেখি এক মহিলার কন্ঠস্বর। আমি আর কথা বললাম না। মহিলা ওপাশ হতে ওর নাম ধরে বার বার ডাকছিলো। আমার সন্দেহ হওয়াতে নাম্বারটি নোট করে নিই।তারপর সব খবর নিয়ে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা।।ভদ্রমহিলা নিজে ও বিবাহিতা। একটি ছোট মেয়ে আছে। তার হ্যজব্যন্ড এর কিছুই জানেন না। আমি অনেক চেষ্টা করে ও আমার স্বামীকে ফেরাতে পারলাম না। ও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে প্রয়োজনে আমাকে ছাড়তে তৈরী আছে। কিন্তু সেই মহিলাকে কিছুতেই নয়।তখন একজনের মাধ্যমে মহিলার স্বামীকে জানালাম। ভদ্রলোকতো প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করছিলেন না। কেননা তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নাকি খুবই ভালো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন একাধিক প্রমাণ পেলেন তখন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন। তিনি বার বার বলছেন- আমার স্ত্রী আমার সাথে দিনের পর দিন এত নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে! আমি ভাবতেই পারছিনা। যাই হোক আপা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি এ সংসার ছেড়ে চলে যাবো। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে আর যাই হোক জীবন চলতে পারেনা।
নীলা বুঝতে পারেন ওদের দুজনের মাঝে সম্পর্কের দুরত্বটা এখন অবিশ্বাস আর তিক্ততা হতে ধীরে ধীরে ভাঙ্গনে রুপ নিচ্ছে। তাই ও বাঁধা দিয়ে বলে- না না রীমি, ওরকম করেনা। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওর সাথে খোলাখুলি কথা বল। রীমি কান্না জড়ানো গলায় বলল- আপা জানেন, আমরা অনেক গুলো ভাইবোন ছিলাম । এর মাঝেই আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। আমার এখনো বেশ মনে পড়ে। একদিন আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাবা একটি লাল শাড়ি পড়া মহিলাকে বাসায় নিয়ে আসলেন । বললেন- তোমাদের নতুন মা। এখন হতে এ বাসায়ই থাকবে। কারো কাছে উনার এ সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে সে সানন্দে বাড়ি হতে বেরিয়ে যেতে পারে। এ কথা যার উদ্দেশ্যে বলা তিনি শুধু অশ্রুসজল চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন স্বামীর দিকে। না আমাদের এতগুলো ভাইবোনদের ফেলে তিনি সংসার ছেড়ে যাননি। বরং ধীরে ধীরে কেমন যেন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। মেশিনের মত সারাদিন সংসারের সমস্ত কাজ করে যেতেন। আমার নতুন মা ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে আসার পর আমি আমার মা’কে আর কখনো হাসতে দেখিনি।। ক্রমাগত মানসিক চাপ হতে আমার মা এক সময় পাগল হয়ে গেলেন। আপা, আমি আমার মায়ের মত পাগল হয়ে বাঁচতে চাইনা।আমি সহ্য করতে পারছিনা এই মানসিক চাপ। অন্যের সাথে ওর এই কাঙ্গালপনায় আমার আসলে নিজকে খুব ছোট লাগছে ।আমি তো জানতেই পারলাম না কোন অযাচিত সময়ের জঠরে আমার এত সুখের সংসার ভাঙ্গার বীজ রচিত হয়েছিলো ধীরে ধীরে।সংসার ,সন্তান সব কিছুকে নিয়ে আমি এমন ভাবে ব্যস্ত ছিলাম কখন যে আমার সংসারে আমিই বাতিলের খাতায় লিখা হয়ে গেলাম সেটা নিজে ও টের পেলাম না। আমি চলে যাবো।ওর পথের কাঁটা হয়ে আর থাকবো না।র্দীর্ঘ ১৫টি বছর একই ছাদের নিচে থেকে ও মানুষ চিনতে বড় দেরী হয়ে গেল।....
সেদিনের সেই স্মৃতিচারণ শেষে নীলা এক সময় বাস্তবে ফিরে। নীলার মনে হল অনেক সময় যুগল বন্ধী সময়ে দুটি জীবন সমান্তরাল ভাবে এগোলে ও অসময়ের আতাতায়ী কখনো কখনো জ্যমিতিক নিয়মে তাদেরকে একই গন্তব্য পৌঁছুতে দেয়না। ওর হয়তো আর কখনই জানা হবেনা প্রত্যাশা নষ্ট জীবনের গ্লানি নিয়ে অভিমানী রীমি একরাশ জিজ্ঞাসার মাঝে কোথায় হারিয়ে গেল।
নূর আয়েশা সিদ্দিকা।(বিউটি)
জেদ্দা
বিষয়: বিবিধ
১০৮২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শরিয়তে এই বিধান থাকলেও নারীরা সেটা মানতে চায় না । সেজন্য তারা মনুষ্য আইনকে আঁকড়ে ধরে যেখানে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেবার বিধান আনা হয়েছে। অথচ ৪ টি পর্যন্ত বিয়ে করার যে অনুমতি আল্লাহ তায়ালা পুরুষদেরকে দিয়েছেন সেখানে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া লাগবে সেটা বলেন নি।
বর্তমান সমাজে স্ত্রীরাই বরং ডিভোর্স দিয়ে থাকে বেশী এবং সেগুলো খুবই সামান্য কারণে।
পুরুষের একান্তই দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রয়জন হলে লুকচুরির কি দরকার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ্ব করেই সেটার সমাধান করা সম্ভব।
আমার প্রথম নানিই আমার নানাকে দ্বিতীয় বিবাহ করিয়েছিলেন। সেই ঘরে আমার মা, দুই খালা এবং দুই মামার জন্ম।।
মন্তব্য করতে লগইন করুন