অনিরুদ্ধ আলাপনে ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল-২০১৮
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০১ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:৫৩:২২ রাত
সময়টা যদি ও মোটেই বিকেলের কনে দেখা আলোর সময় ছিল না। রীতিমত মধ্যাহ্নে সূর্য মামার খটমটে চাহনির চৌহদ্দির মধ্যেই বেরুলাম সবাই। গাড়িতে আমরা ৫ সদস্যের কমিটি। উদ্দেশ্য সুন্দরীদের ফ্যশনশো দেখা। ওই যে কথায় আছেনা- আগে দর্শনদারি পরে গুণ বিচারি। তাই যদি ভালো লেগে যায় তবে মনের মত সুন্দরী কনে নির্বাচন করা। গত বছর হতেই কারো কারো মুখে শুনছিলাম সুন্দরীদের ওই মেলার কথা। যেহেতু অচেনা পথ তাই জিপিএস ছাতি মাথা ঘটকের ভূমিকা নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।
পথে যাত্রা বিরতি দিয়ে জুমার নামাজ সারলাম। আমার হ্যজব্যন্ড দেখি বয়স্ক এক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছেন। গাড়িতে এসে আমাদের বলল- জানো, আমাদের বাসার কাছের মসজিদের পাশের বিল্ডিং এ তিনি থাকেন। আমাদের মত উনারা ও একই গন্তব্যে রওনা হয়েছেন। আমরা চাইলে উনাদের ও ফলো করে যেতে পারি।
কিছুদূর চলেই আমরা গাড়ি দু’টো ফলো করা বন্ধ করলাম। কেনন গাড়ি দুটো এমন ভাবে ছুটছিল ঠিক যেন ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়। এর সাথে সমতা রেখে অতিরিক্ত স্পীড়ে চলতে গিয়ে পথে পথে লুকিয়ে থাকা ক্যামেরার সাথে ঘন ঘন মোলাকাতের খেসারত হিসেবে পকেট ফতুর হয়ে যেত। যাক বাবা- এই নির্জন মরুপথে আল্লাহই ভরসা। আমি গত কয়েকদিন ধরে গোগ্রাসে গিলতে থাকা সঞ্জীব চট্রোপাধ্যায় এর ছোটদের হাসি সমগ্র বইটি সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চাদের গত কয়েক দিনের আবদার মেটাতে চলার পথে অনেকক্ষন পর্যন্ত গল্প পড়ে শুনালাম। প্রচন্ড বইয়ের পোকা আমি দেখি প্লেনে কিংবা গাড়িতে বই পড়লে কেমন যেন মাথা ধরে। তাই এক সময় আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। এবার আমাদের রীতিমত চমকে দিয়ে আমার মেঝ মেয়ে সিডি প্লেয়ার অন করলো। দেখি বাবা মায়ের পছন্দের বেশ কিছু ইসলামী গান। সে নাকি সকালে বসে ডাউন লোড করেছে। আমরা দু’জন তো মুগ্ধতার পরশ মেখে তন্ময় হয়ে গান শুনলাম।
বাইরে মরুভূমিতে গনগনে বালির তরঙ্গ ভেঙ্গে রুক্ষ লুহাওয়ায় একের পর এক এগিয়ে চলেছে উটের বহর। চারিদিকে ঠা ঠা রোদ আর ধূসর ধু ধু বালির মাঝে একটু খানি স্নিগ্ধ শ্যমলতার আমেজ মাঝে মাঝে আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছিলো সহজেই। খানিক পর দেখি মরুভুমির হালকা সবুজের মাঝে ন্যাড়া মাথার আকৃতিতে তরমুজের ক্ষেত। মায়ের বকুনি খেয়ে উঠোনের কাদা জলে হাত পা ছড়িয়ে চিৎপটান হয়ে শুয়ে থাকা অভিমানী শিশুর মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরই মাঝে সাদা জুব্বাপরা কাকতাড়ুয়া দেখে দিনদুপুরে ভুত দেখার মত পিলে চমকে গেল। লক্ষ্য করলাম পুরো যাত্রা পথে প্রায় ৩৫০ কি মি পথে গাড়ির ক্ষিধে পেলে খাবার খাওয়ার অর্থাৎ পেট্রোল পাম্পের কোন ব্যবস্থা নেই। অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম কনের বাড়ি। অবাক কান্ড পুরো শহরে ভুতুড়ে এক নিরবতা। যেন রুপকথার গল্পের রাক্ষসের পেটে সমস্ত জন মানুষ গিলে খাওয়ার মতই নির্জনতা। শুধু হাতের বামপাশে ইন্ড্রাষ্টির লম্বা চিমনী দিয়ে জ্বলজ্বলে আগুনের লেলিহান শিখা জাহান্নামের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো। জিপিএস ঘটক কনের বাড়ির দোর গোড়ায় নেবার আগে যে পথে ঘোরালেন তাতে সারি সারি ঝরা পাতার আর্তনাদ মাখা গাছগুলোকে কনে বাড়ির পাশে আইবুডো মেয়েদের করুণ অস্তিস্তের মতই মনে হচ্ছিলো।
সম্মানিত পাঠক, এবার ঝেড়ে কাশি। আসলে আমরা পুরো পরিবার ইয়ান্বোবু গিয়েছিলাম- ১২তম ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল উপভোগ করতে। যা ইতিমধ্যে ২০১৪ এবং ২০১৭ তে পর পর দু’বার গ্রীনিচ বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডে স্থান করে নিয়েছে। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার খানিক আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। তাই গাড়িতে বসেই সেই আয়াতটি মনে পড়লো- মহা দয়াময়ের সৃষ্টিকর্মে কোনরুপ অসঙ্গতি পাবেনা। দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে দেখ,কোথাও কোন দোষ-ত্রটি দৃষ্টিগোচর হয় কি? বার বার দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তোমাদের দৃষ্টি ক্লান্ত, শ্রান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে। আমি পুস্প প্রদর্শনীর বিশাল সৌন্দর্যের বহর দেখে মনে মনে বললাম- প্রভু, তোমার এত সৃষ্টি সুষমায় আমি মুগ্ধ এক দর্শক। ঢুকতে হাতের পাশে বিশাল ফুলের দেয়াল আমাদের দু’হাতে স্বাগত জানালো।
পাহাড়াকৃতিতে সারি সারি ফুলের বিছানা। সবই পুস্পিত মৌসুমী ফুল-ফ্লামিংগো,স্টার,ইকসিয়া, জন কুইল,লুনারিয়া,স্টক এমনি নানা ফুলের কেয়ারী। কত রং বেরংএর ফুল। এই অবারিত সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দু’চোখে সম্মোহনের ভাব এসে ভর করে। তারপর ও যে সত্য কথাটি না বললেই নয়। এত এত ফুলের বন্যার মাঝে দাঁড়িয়ে ও অনুভুতিটা কেমন যেন নিষ্প্রভ লাগছিলো। ভালোলেগে ও না লাগার মত মিশ্র এক অনুভূতি। আসলে এই পরিপাটি পুস্প আয়োজনের সব ফুলই ছিলো মৌসুমী ফুল। ইতিমধ্যে এত সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে ও আমি কিছু কিছু ফুলেদের গায়ে বেলা শেষের বির্বনতা দেখেছি। বেশ বুঝতে পারছিলাম সামান্য সময়ের ব্যবধানে বাকিদের গায়ে ও ছড়িয়ে পড়বে এই মৃত্যুর মড়ক। বিবাগী হাওয়ায় শুকনো মরা-খুসকির মত ঝরে পড়বে বর্ণালী পাপড়ি গুলো। এত অবারিত সৌন্দর্যের এই ক্ষনস্থায়িত্ব আসলে আমাকে আসলে দুনিয়ার জীবনের ক্ষনস্থায়িত্বকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিলো বার বার।
টিভিতে রান্নার শোতে দেখা প্রসাধন চর্চিত রাঁধুনীর পোষাকী চেহারার চাইতে আমার শ্যামলাবরণ মায়ের রান্না ঘরে ঘর্মাক্ত মুখ, কপাল ছুঁয়ে নেমে আসা বিচুর্ণ চুলের অস্তিত্ব আর হাতের আঙ্গুলে লেগে থাকা তেল- হলুদের দাগই আমার বেশী প্রিয়। সেই সাথে অকৃত্রিম বলেই মনে হয়। আজকের এই পুস্প প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে ও তাই। প্রকৃতিকে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে ছেড়ে না দিয়ে বেশ কড়া শাসনে রাখা হয়েছে। তাই আর্মিদের কদম ছাট চুলের মত একই পরিধির লম্বা, পরিকল্পিত পরিবার পরিকল্পনার মত মেপে মেপে প্রতিটি গাছে একই সংখ্যক ফুল,সব মিলে মিশে বড় বেশী কৃত্রিম মনে হয়েছে। তার চাইতে প্রকৃতিকে তার দুরস্ত চপলতায় নিজস্ব গতিতে চলতে দিলে বোধকরি আরো বেশী দৃষ্টি নন্দন মনে হত। কখনো দুরন্ত শিশুর হেসে গড়িয়ে পড়ার ভঙ্গি, কখনো নিজের সৃষ্টি সৌন্দর্যের কৃতজ্ঞতার প্রভুর প্রতি সিজদার নতজানু ভঙ্গি …………………………….।
তারপর ও এত বিশাল একটি আয়োজন পুরোপুরি বানিজ্যিক ভাবে না নিয়ে জনসাধারণের জন্য অবাধে উন্মুক্ত রাখার বিষয়টিতে আয়োজকরা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখেন। ফুলের পাহাড়ের মাথার উপর উডন্ত ড্রোনটিকে কালো ফড়িং এর মত লাগছিলো।হঠাৎ দেখলাম তার্কিশ এয়ার লাইনস হতে বিশাল বড় একটি রং বেরংএর পাখি সেই ড্রোনের চারপাশে চক্কর লাগালো। আমি তো পাখি বেচারার নিরাপত্তার আশংকায় আঁতকে উঠলাম। রিসাইকেলিং প্রজেক্ট, প্রজাপতি প্রদর্শনী, বীজ প্রদর্শনী ছাড়া ও ছিলো শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইডের ব্যবস্থা । ওয়েস্ট জিনিস দিয়ে বানানো মাছ, ময়ুর বিভিন্ন ধরণের প্রদর্শনী গুলো পেরিয়ে যেতেই দেখলাম মাথার উপর প্যারাসুটে কিছু মানুষ স্কাই ডাইভিং করছেন। এভাবে জীবনকে বিপন্ন করে আনন্দ খুঁজার মাঝে মানুষ কি মজা পায় তা আমার মোটা মাথায় অনেক ভেবে ও বের করতে পারলাম না।
মজার ব্যাপার হল, সেখানে দুটি নার্সারী পুস্প প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিল। তার মধ্যে একটির মালিক ছিলেন বাংলাদেশী । আমরা বেগুন, বিভিন্ন রকমের মরিচ, বেলী, গোলাপ, পুদিনা সহ অনেকগুলো গাছ কিনলাম। নার্সারীর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ভাইগুলো যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তা ভুলার মত নয়।
সমস্ত আয়োজন ঘুরে দেখা শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা। রাত জেগে উঠেছে। থকথক করছে চারপাশের দূর্বিষহ অন্ধকার।পাহাড়গুলো অন্ধকারের বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।ফিরছি জেদ্দা অভিমুখে। এরমধ্যে আমার হ্যজব্যন্ড জানালো ক্রমাগত দু’চোখের পাতা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছে। তাতে চা’য়ের সাহায্য ছাড়া ঘুমদের গুম করা অসম্ভব হয়ে দাাঁড়িয়েছেন। তাই ক্ষণিক যাত্রা বিরতি দিতেই হল। পুস্প প্রদর্শনী হতে কেনা সব গাছদেরকেই যদি ও গাড়ির পেছনে রেখেছি। কিন্তু একটি এক বিগত আকৃতির গোলাপ গাছের অবস্থা ছিলো বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরী মেয়েটির মত। কোলে কাঁখে এত এত বাচ্চা। এতগুলো ফুল আর কলি নিয়ে বেচারীর অবস্থা ও তাই নাজুক। বেচারীর যত্ন নিতে আমি গাছটিকে কোলে নিয়ে ফুল শিশুদের নানীর ভূমিকায় বসে আছি। আমার হ্যাজব্যন্ড গাড়ি থামিয়ে চা ’য়ের দোকানে ঢুকতেই দেখি বেশ কয়েকজন লোক হাত বাড়িয়ে হ্যন্ডশেক করলো। একটু পরই দেখি এক ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে আমাদের গাড়ির জানালায় নক করলেন। আমি গাড়ির দরজা খুললাম। ভদ্রলোক সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলেন- ভাবী,ভালো আছেন?বাসায় বেড়াতে আসেন না’তো। আমি একটু অপ্রস্তত ভাব নিয়ে সালামের জবাব দিলাম। এরই মধ্যে আমার হ্যাজব্যন্ড এসে উনার পাশে দাঁড়িয়ে বলল- চিনতে পেরেছে উনাকে। পান্নু ভাই….। ওই যে বাংলা স্কুলের চেয়ারম্যন। আমি চিনতে পারলাম। পান্নু ভাই তখন মনে করিয়ে দিলেন উনার স্কুলের ইলেকশনের সময় জরুরী কাগজ পত্র আমিই এনে দিয়েছিলাম বাংলাদেশ হতে। আর আসলে সেই সূত্রেই উনার সাথে পরিচয় হয়। পরে জানতে পারি উনি আমার শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়। জানলাম জেদ্দার বাংলা স্কুল ও ইংলিশ স্কুল হতে একাধিক বাসে করে অনেকে এসেছেন।ভালো লাগলো, এই দিনের পুস্প মেলায় কাছের দূরের জেদ্দার অনেক বাংলাদেশী পরিবারের সাথে দেখা হয়ে গেল।
আবার যাত্রা হল শুরু।আমার হ্যজব্যণ্ড ড্রাইভ করতে করতে সারাটি পথ একের পর এক সুরেলা গলায় গেয়ে আমাদের যাত্রাকে আরো উপভোগ্য করে তুলল।মাঝে মাঝে আমি ও বেসুরো গলায় তাল মিলালাম। হাতের ডান পাশটায় চাঁদ মামাকে দেখলাম মিটিমিট হাসির জোসনা নিয়ে আমাদের সঙ্গী হতে
বিষয়: বিবিধ
১১৫৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাগ্নিদের ছবিটা আজই পেলাম, ফুলের সমারোহ থাকাতে এখানেও শেয়ার করে দিলাম।
আপনার একই লেখা দুইবার পেষ্ট হয়ে গেছে, একটা মুছে দিতে হবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন