ধর্ষক ফাঁকি দিচ্ছেন নিজের বিবেককে এমনকি দু’কাঁধের দু’জন প্রহরীকেও?
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৫ মার্চ, ২০১৮, ০৯:৪৩:৪৬ সকাল
জীবনের কিছু কিছু ঘটনা দৃশ্যপট হতে হয়তোবা হারায়। কিন্তু মনের গহীনে সময়ের পাষাণ শরীরে স্থায়ী আঁচড় কেটে যায় নিরবে। একবার এক খালাম্মার বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। মোটামুটি বিশাল এক খাদ্য ভান্ডার তিনি নাস্তার জন্য পরিবেশন করলেন।পরিচিত হলাম অনেক নতুন মুখের সাথে। চলল কিছু কথা কিছু আলাপন। এরই মাঝে খেয়াল করলাম এক ভদ্রমহিলা একটু দূরে দঁড়িয়ে আছেন বেশ অনেকক্ষণ হতে। আমি ডাকলাম- এই যে আপা এদিকে এসে বসুন। মহিলা আমার কথায় লজ্জা মেশানো গলায় বললেন- না, না আমি এখানে দাঁড়িয়েই আপনার কথা শুনছি। আমি বেশ কয়েকবার ডাকলাম। কিন্তু উনি কাজের অজুহাতে বসলেন না। পরে ওই বাসার খালাম্মা বললেন- উনাদের বাসায় মহিলাটি নতুন এসেছেন কাজ করতে। মহিলার আগ্রহ দেখে আমি পর্দার উপর লিখা আমার একটি বই তাকে গিফট করলাম। এমনি করেই সেদিন পরিচয় তার সাথে।
এরপর ওই বাসায় যতবার গিয়েছি সেই মহিলা শত ব্যস্ততার মধ্যে ও খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নিজ দায়িত্বে যে কাজটি করতেন তা হল- আমার জন্য আলাদা করে একটি প্লেটে সব ধরনের নাস্তা সাজিয়ে এনে হাতে ধরিয়ে দেয়া। বলতেন- আপা, আপনি এত কম খান। সব সময় খাবারের টাইমে ফাঁকি দিয়ে চলে যান। অনেক সময় তো মহিলা এতটা করতেন যে, খাবার বক্সে ঢুকিয়ে আমার পেছনে ছুটতে ছুটতে এসে জোর করে গাড়িতে এনে দিয়ে যেতেন।
একদিন সেই খালাম্মা ফোন দিলেন- এই তুমি কোন ভালো গাইনী ডাক্তার চিন। আমি বলালাম- হ্যাঁ। কেন? তিনি বললেন- আমার পরিচিত একজন তার বাচ্চাটা জন্মাক সেটা চাচ্ছেন না। তাই যদি বাচ্চাটা…….করিয়ে ফেলা যায়। আমি রীতিমত উনার কথায় অবাক হলাম। সেই সাথে প্রচন্ড রাগ ও হল। এত বছর আমার সাথে পরিচয়। আর উনি আমাকে এ প্রশ্ন করার সাহস কি করে পেলেন। আমি গলায় যথাসম্ভব বিরক্তি ফুটিয়ে বললাম- খালাম্মা, আপনি আমাকে এধরণের প্রশ্ন করছেন? আপনি জানেন না এই ভাবে সন্তান হত্যা করা কতটা গুনাহ।… আমি বেশ বিরক্তি নিয়েই উনার সাথে ফোনে কথা শেষ করলাম সেদিন।
এর কিছুদিন পর আবারো ফোন সেই খালাম্মার।বললেন বেশ ব্যস্ত ছিলেন তার পরিচিত সেই মহিলাকে নিয়ে। যেহেতু ভ্রণ হত্যা সৌদি আরবে বেঅইনী তাই বেশ কয়েকজন ডাক্তার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেজন্য এখন কেউ কি বাচ্চা দত্তক নেবে কিনা খোঁজ নিতে আমাকে ফোন করেছেন। আমি এবার আর রাগ চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম- আপনার কি মাথা নষ্ট হয় গেছে। করছেনটা কি? সেদিন আপনাকে আমি পই পই করে বললাম এসব গুনাহের কাজে না জড়াতে। আপনি তারপর ও এর পেছনে পড়ে আছেন।উনি আমাকে খুবই ভালোবাসেন । তাই বেশ থতমত খেয়ে গেলেন। এরপর বললেন- আমি জানি, তুমি ব্যাপারটি নিয়ে রাগ করেছো। সেজন্য তোমাকে আসল ব্যাপারটি জানাতেই ফোন করলাম। আমি বললাম – মানে… তিনি বলতে শুরু করলেন- জানো, এক গরীব মহিলা বাংলাদেশ হতে এখানে খাদদামা( গৃহপরিচালিকা) ভিসায় কাজ করতে এসেছে। যে বাসায় ছিলো তারা তাকে দিয়ে অনেক পরিশ্রম করাতো। কিন্তু ঠিকমত খাবার দিতনা। আবার মারধর ও করতো। এক পর্যায়ে মহিলা রাতের বেলায় সেই বাসা হতে পালিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর একটি টেক্সিতে করে জেদ্দার পথে রওনা হয়।একে তো একা মহিলা। সাথে ও কেউ নেই। মহিলাকে একা পেয়ে ড্রাইভার গাড়ি অন্ধকার মরুভুমির এক পাশে থামায়। এরপর তো বুঝতেই পারছো।………………….. মহিলার সকালে যখন হুশ আসে তখন নিজকে মরুভূমির পাশে বালির মাঝে পড়ে থাকতে দেখে। এরপর অনেক কষ্টে সে জেদ্দায় এসে পৌঁছায়। আমার এক পরিচিতজন মহিলাকে আমার বাসায় কাজে এনে দেয়। পরে মহিলা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে সব খুলে বলেন। সে রীতিমত কসসিভ করে ফেলেছ।তোমার সাথে তো মহিলার পরিচয় হয়েছে আমার বাসায়। এখন তুমিই বল মহিলার নিজেরই নিজের দায়িত্ব নেয়ার মত অবস্থা নেই। তাকে দশ বাড়ি কাজ করে খেতে হবে। সেখানে এই বাচ্চার দায়িত্ব কে নেবে? স্বামী ছাড়া এই বাচ্চাকে সে কি পরিচয়ে বড় করবে? বাংলাদেশে তার আত্নীয় স্বজন জানলে তার কি অবস্থা হবে? এসব জানলে এখানে ও তো কেউ তাকে কাজে নেবে না।…
খালাম্মার কথায় আমি যেন ক্ষণিকের জন্য আমার কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম।নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- এখন কি করবেন ভাবছেন? তিনি বললেন – এজন পুরুষ তো নষ্টামি করেই খালাস। কিন্ত একটি মেয়েকে তো পুরোই বইতে হয়। অপরাধ না করে ওতো দায়িত্ব এড়াতে পারেনা। তাই ডাক্তাররা যখন না করে দিলেন সেজন্য বিকল্প হিসেবে ভাবছি বাচ্চাটিকে যদি কারো কাছে পালক দিয়ে দেয়া যায়। আমি বললাম- মহিলার এসব ঘটনা জানার পর কেউ বাচ্চাটি কি নেবে? খালাম্মা বললেন- কি করবো? মেয়েটির কান্না দেখে তাকে আশ্রয়হীন অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারছিনা। আর ইতিমধ্যে তো তাকে দেখে বুঝা ও যাচ্ছে সে যে সন্তান সম্ভবা। আমি সবার কাছে মিথ্যে করে বলেছি এখানে এসে তার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্ত স্বামী ছেড়ে দিয়েছে এখন।তাই বাচ্চাটি কাউকে দিয়ে দিতে চায়।………………..
এমনি করে সেদিন শুধু নিরব শ্রোতা হয়ে রইলাম এক নৃশংসতার। কোন সাহায্যই আমি তাদেরকে করতে পারিনি। এর বেশ কয়েক মাস পর সেই খালাম্মা জানালেন কোন এক মহিলা বাচ্চাটিকে দত্তক নিতে রাজি হয়েছেন। তবে তিনি তার পরিচিতি লুকাতে সরাসরি নিজে যোগাযোগ না করে একজনের মাধ্যমে আর একজনকে এভাবে একাধিক লিংক ব্যবহার করেছেন। সেই খালাম্মা শুধু এটুকু জেনেছেন,যিনি দত্তক নেবেন তিনি কোন এক বার্মিজ মহিলা। আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। কিন্তু বাচ্চা নেই।
এই অনাকাঙ্খিত মাতৃত্বের কষ্ট নিয়ে সারাটি সময় বিভিন্ন বাসায় বাসায় সেই মহিলা কাজ করলো। আমি একদিন তার ক্লান্ত মুখ দেখে বলেছিলাম- শরীরটা এত খারাপ আপনার। রেস্ট কখন করেন? আমার কথায় সমবেদনার ছোঁয়া পেয়ে মহিলার চোখটা জলে ভরে উঠেছিলো। বলেছিলো- একে তো মাইয়া মানুষ। তার উপরে জন্ম নিচি গরীবের ঘরে। আমগো আবার শরীর। এক সময় বাচ্চাটির জন্ম হল। সেই ধনী মহিলা আর একজনের মাধ্যমে বাচ্চাটি দত্তক নিয়ে গেলেন। আর বিনিময়ে মহিলাকে ২০০০ রিয়াল দিলেন।
আমাকে সে খালাম্মা ফোন দিয়ে বললেন- জানো ,পৃথিবী কত অদ্ভত। এই অনাকাঙ্খিত সন্তানের জন্য এই মহিলা কত দূর্ভোগের শিকার হল। ওর জন্য আমাদের ও কত মিথ্যে বলতে হল।কিন্তু জানো, সন্তান জন্মের পর মহিলাটি একটি বার বাচ্চার মুখ দেখার জন্য জেদ ধরলো। আর যখন বাচ্চাটি দেখানো হল তখন সে কি কান্না- আপা, আমি আমার সোনা মানিকরে কাউরে দিমুনা। ......সে এক কান্ড। কিছুতেই বাচ্চাকে ছাড়তে চায়না। পাগলি একটা…. একটু থেমে খালাম্মা আমাকে আবার বললেন- অবাক ব্যাপার কি জানো, বাচ্চাটা কি যে সুন্দর। দেখলে মন ভরে যায়। যতই বকা দিইনা কেন মহিলাকে। আসলে মায়ের মন তো। এতটা মাসতো সেই সব বইলো শরীর দিয়ে।..............
সম্মানিত পাঠক,একটি নির্মম ঘটনার নিরব দর্শকের ভূমিকা নেয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলনা। নিজকে সেই বিপন্ন মহিলার জায়গায় দাঁড় করিয়ে আমি সেদিন কেঁদেছি । কি যে এক গভীর বেদনাভার অনুভব করেছি তা বোধহয় কাউকে কখনো বুঝিয়ে বলতে পারবো না। সেই সাথে অবাক মনে ভেবেছি, যে নোংরা লোকটি এ কাজ করলো সেকি কখনো জানবে- তার ক্ষণিকের সুখের জন্য একটি নিরপরাধ মহিলা কত ভুগলো? একজন পুরুষ কি অনুভব করেন একজন নারীর জন্য এধরের ঘটনা কত বড় ক্ষতি আর ক্ষতের চিহ্ন হয়ে সারাটি জীবন রক্ষক্ষরণ করে নিরবে? আদৌ কি সে মহিলা এধরণের মর্মান্তিক ঘটনা নিজের স্মৃতি হতে কখনো মুছতে পারবে? সেই লোকটি কখনো জানবে কি স্নেহ ,ভালোবাসা কিংবা অভিভাবকত্বের আবেশে নয় শুধুমাত্র তার নষ্টামীর দায় মেটাতে যে শিশুটি পৃথিবীতে এসেছিলো- কত গোপনীয়তা, কত মিথ্যে দিয়ে তাকে এই পৃথিবীর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হয়েছিলো। ধর্ষক তো অন্য গ্রহ হতে আসা ভিনগ্রহবাসী নন। অচেনা কেউ নয়। আমার আপনার মত কারো বাবা, কারো ভাই,কারো সন্তান। আমরা কি কখনো ভাবি আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধের অপূর্ণতাই এসব ধর্ষক তৈরী করছে? একজন ধর্ষক হয়তো ফাঁকির ধুলো দিয়ে নিজের জীবনের এসব ঘটনা লুকিয়ে রাখেন নিজের স্ত্রী, সন্তান ,স্বজন হতে। কিংবা হয়তো ফাঁকি দেন নিজের বিবেককে ও । কিন্তু মহান প্রভুর নিয়োজিত দু’কাঁধের দু’জন অতন্ত্র প্রহরী তাদেরকে ও কি ফাঁকি দিতে পারেন বলে মনে করেন?এমনি হাজারো প্রশ্নে নিজকে নিজে ক্ষত বিক্ষত করেছি সেদিন। সম্মানিত পাঠক,আমার এই লিখা যদি সচেতন বিবেকের স্পন্দনে ক্ষীণতর করে হলে ও গতিসঞ্চার করতে পারে তবে নিজকে স্বার্থক ভাববো। তাই আসুন,নফসের প্ররোচনায় সৃষ্টিকর্তার বেঁধে দেয়া নির্দেশের সীমালংঘনমূলক কাজ হতে নিজকে সংযত রাখার চেষ্টা করি।চারিত্রিক পবিত্রতা নিয়ে পরিশুদ্ধ জীবন যাপন করি।
নূর আয়েশা সিদ্দিকা বিউটি।
জেদ্দা।
বিষয়: বিবিধ
৯২১ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আহ! আমিও কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
হায়রে অমানুুষের কান্ড।
মানুষের চরিত্র দিনকে দিন পশুর চরিত্রকেও হার মানাচ্ছে। কিচ্ছু বলার ভাষা নেই।
president, senators , বাবা কে জানে না
মন্তব্য করতে লগইন করুন