ভদ্রমহিলা স্বামীর দোষ নিজের ঘাড়ে নিলেন

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৮ মার্চ, ২০১৮, ১০:২৯:৫০ রাত



ঘটনাটি ক্যলেন্ডারের পাতায় কয়েক বছর পেছনের। একদিন অনেকজন বসে আছি একটি আড্ডায়। কথা হচ্ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। আড্ডা শেষ হলে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো আপ্যায়ন নিয়ে। সহসা আমার চোখ পড়লো এক ভদ্রমহিলার দিকে। প্রশ্ন করলাম- ভাবী,আপনাকে তো এর আগে কখনো দেখিনি।মহিলা লাজুক গলায় বললেন- আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। এরপর একটু একটু করে পরিচিতির পর্বটা এগুলো। আমি এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার ছেলে মেয়ে ক’জন। দেখলাম মহিলার মুখে মলিনতার ছাপ পড়লো- ভাবী,আমি নিঃসন্তান। আমি জানতে চাইলাম- বিয়ে হয়েছে কত বছর?- জ্বি ১৪ বছর হল। টুকিটাকি আরো কিছু কথা এগুলো। হঠাৎ আমাকে বেশ অপ্রস্তত করে দিয়ে ভদ্র মহিলা লাজুক গলায় বললেন- ভাবী, আমার হ্যাজব্যন্ডের ……………….। আমি মহিলার কথায় একটু অপ্রস্তুত হয় গেলাম। এরপর বললাম-ডাক্তার দেখিয়েছেন? এধরণের সমস্যায় আপনি টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে চেষ্টা করতে পারেন। ভদ্রমহিলা বললেন- আসলে ভাবী, মাঝে মাঝে কিছু ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু আমি তো দেশে থাকি।আর ও থাকে এখানে। তাই ডাক্তাররা অনেক সময় ট্রিটমেন্ট ও করতে চায়না ঠিকমত । আমি বললাম- এখানে কতদিন থাকবেন?- ভিজিট ভিসা তো। যতদিন পারা যায়। আমি বললাম- আমি একজন গাইনী ডাক্তারকে চিনি। বেশ ভালো। আর যেহেতু উনি বাংলাদেশী তাই আপনার কথা বলতে কোন সমস্যা হবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হতে নেই। এরপর ও বেশ কিছুক্ষণ ওখানে ছিলাম। দেখলাম চারপাশের ছোট ছোট বাচ্চাগুলেকে কি অপার মমতায় আদর করছেন ভদ্রমহিলা। টিস্যু দিয়ে এঁটো মুখ মুছে দিচ্ছেন। আমার দিকে চোখে চোখ পড়তে লাজুক ভাবে হাসলেন। আমি ও হাসির আড়ালে যেন অব্যক্ত মাতৃত্বের হাহাকারই খুঁজে পেলাম। ভদ্রমহিলা আমার ফোন নম্বর চেয়ে নিলেন।

আমি পরদিনই সেই গাইনী ডাক্তার আপাকে ফোন দিলাম। সেই ভদ্রমহিলার সমস্যাটি নিয়ে আলাপ করলাম। বললাম-আপা, কেন যেন মহিলাটিকে আমি ভুলতে পারছিনা।কি যে করুন মুখাবয়ব। আমার একটি অনুরোধ আপনি যদি মহিলার সমস্যাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন।তাহলে আল্লাহর রহমতে ইনশাআল্লাহ কোন সমাধান ও হতে পারে। তিনি বললেন- ও.কে আপা আমি আল্লাহর রহমতে সাধ্যমতে চেষ্টা করবো। উনাকে পাঠিয়ে দিন। আর আমার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটি ও দিয়ে দেবেন। নিঃসন্তান ভদ্রমহিলা যেন অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমাকে ফোন করলেন। আমি সেই ডাক্তার আপার নম্বর দিয়ে দিলাম।

কিছুদিন পর ভদ্রমহিলা ফোন করলেন। বললেন- সেই ডাক্তার আপার কাছে গিয়েছিলাম। বেশ কিছু টেস্ট উনি করলেন। উনি ও টেস্ট টিউব পদ্ধতির কথাই বললেন মোট…….. রিয়াল লাগবে।

আমি বললাম- জ্বি ভাবী, খরচটা একটু বেশী কিন্তু সন্তানের জন্য…….

উনি আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন- না, না ভাবী একটি সন্তানের মুখ দেখার জন্য তো গায়ের রক্ত বিক্রি করে হলে ও ট্রিটমেন্ট করবো কিন্তু……

মহিলার কথায় আমার মনে হলা আহারে এইতো বাবা মায়ার শ্বাশত ভালোবাসা। সন্তানের জন্য জীবন দিতে ও প্রস্তুত। আর সেই সন্তানই আজ ভালোবাসার বিনিময় দেয় বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে।

আমি বললাম- তাহলে সমস্যা কোথায়? তিনি বললেন- ভাবী, টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে গুনাহ হবেনা? আমি বললাম- ভাবী, এখানে যেহেতু আপনাদের নিজেদেরই…… তাহলে সমস্যা কেনো হবে। যদি স্পার্ম অন্যের কাছ হতে নেয়া হয় তাহলে হয়তো আপনি অন্য ভাবে ভাবতে পারতেন। আপনার স্বামীকে বলুন এ বিষয়ে আপনাকে সঠিক তথ্যগুলো ইন্টারনেট হতে জানাতে। আর সেই ডাক্তার আপার কাছে আপনার প্রশ্ন গুলো মন খুলে করুন। উনি বেশ ইসলামী জ্ঞান রাখেন। আপনাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবেন। আমি নিজে ও আমার সামান্য জ্ঞান হতে টেস্ট টিউব পদ্ধতির বিষয়টি যতটুকু জানি বুঝিয়ে বললাম।

কয়েকদিন পর তিনি জানালেন তিনি টেস্ট টিউব পদ্ধতির জন্য রাজি।

আলহামদুলিল্লাহ! এক সময় তিনি জানালেন আল্লাহর রহমতে তিনি কনসিভ করেছেন। আমি দোয়া জানালাম। সেই সাথে সতর্ক করলাম সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ মত চলতে। উনি আমাকে বললেন- ভাবী, একটি অনুরোধ করবো। আমি যে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলাম কেউ যাতে না জানে।আপনি বিষয়টি গোপন রাখবেন। আমি কথা দিলাম। এর মাঝে উনার পরিচিত এক ভদ্রমহিলা জানালেন –ভাবী, ওই যে ভাবীটি এসেছিলো। উনার তো অনেক সমস্যা ছিলো। তাই বাচ্চা হত না। এখন নাকি সুখবর আছে। আমি যে বিষয়টি জানি তাকে বুঝতেই দিলাম না। কিন্তু একটু অবাক হলাম ভদ্রমহিলার অনেক সমস্যার বিষয়টি শুনে।

হঠাৎ একদিন সে ভদ্রমহিলা ফোন দিলেন। ভাবী, খুব জরুরী দরকারে আমাকে কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে যেতে হবে। আমি বললাম- এই অবস্থায় আপনার জার্নি করা কি নিরাপদ? তখন তিনি বললেন – ডাক্তার আপা ও তাই বলছিলেন। কিন্তু যেতেই হবে। ইনশাআল্লাহ দেশে গিয়ে সাবধানে চলাফেরা করবো। তখন আমি উনাকে প্রশ্ন করলাম – আচ্ছা ভাবী, আপনার সন্তান না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আপনি পরিচিত জনদের কি বলেছেন? ভদ্র মহিলা আমার প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেলেন। এরপর আমতা আমতা গলায় বললেন- ভাবী, আমি সবাইকে বলেছি আমারই সমস্যা। আমি বললাম- কিন্তু আমি তো জানি…..উনি বললেন- আসলে ভাবী, আমি তো এখানে থাকিনা। তাই আমাকে কেউ বাঁজা ভাবলে বা খারাপ চোখে দেখলে আমার কি বা এমন ক্ষতি হবে। কিন্তু আমার স্বামী তো এখানে থাকেন। আমি চাইনা ওর সমস্যার কথাটি সবার সামনে বলে ওকে ছোট করতে। তাই আমি সবাইকে ওরকম বলেছি। আমি বললাম- কিন্তু আপনি তো বলেছেন- আপনার এত দীর্ঘ বছর সন্তান না হওয়ার কারনে আপনার শ্বশুর বাড়ির লোকজন আপনার স্বামীকে আবার বিয়ে করাতে চাইছিলেন। এখন গেলে কি ওদের কে ও বলবেন না যে সমস্যা আপনার স্বামীর। মহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন- নাহ আপা বলবো না। ওকে আমি কারো কাছে ছোট করতে চাইনা। ওর পরিবারের কাছে ও না। ও এমনিতেই মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। আর এ সমস্যার জন্য তো ও নিজে দায়ী নয়।

সম্মানিত পাঠক ,ভদ্রমহিলার এই আচরণে আমি পুরোপুরি বিস্মিত। কেননা আমি দেখেছি কেউ কেউ তার সন্তান হয়না বলে তাকে কেমন অবহেলার চোখে দেখেন। অপয়া মনে করে নিজেদের ভালো কিছু তার সাথে শেয়ার পর্যন্ত করেন না। হতে পারে অনেক বেশী শিক্ষিত তিনি নয়। কিন্তু কি বিশাল মনের অধিকারী! সম্পর্কের বিশ্বস্ততা,উদারতা আর ভালোবাসায় ভরপুর বিশালহৃদয়ের অধিকারী এক মহামানবী মনে হল তাকে। আমি জানি না আজ সমস্যা উনার হলে উনার স্বামীর আচরণ কেমন হত।

মাঝে মাঝে উনি আমাকে দেশ হতে নক করতেন। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য আমার ফোন রিসিভ করা হত না। এরপর তাকে আমি আসলে এক রকম ভুলেই গেলাম। প্রায় ৫ মাসের মাথায় একদিন আবারো ফোন। আমি ফোন ধরতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এর মাত্র কয়েকদিন আগে তার একটি মৃত অপরিণত বাচ্চা জন্মানোর খবর দিলেন। আসলে টেস্ট টিউব বেরির ক্ষেত্রে নানা জটিলতা থাকে। তার ক্ষেত্রে ও তাই হয়েছিলো। কান্নার জন্য কথাই বলতে পরাছিলেন না। আমি বললাম- ভাবী, আল্লাহ কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করেন, কাউকে না দিয়ে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। যে আল্লাহ এত দীর্ঘ সময় পর আপনাকে কিছুদিনের জন্য হলে ও মাতৃত্বের অনুভব দিলেন সেই আল্লাহ চাইলে আবারো দিতে পারেন। বরং আপনি তো আপনার এই মৃত সন্তানের বিনিময়ে জান্নাতে নিজের জন্য জায়গা করে নিলেন ইনশাআল্লাহ। বান্দাহর দুঃখের সময় আল্লাহ তার সবচেয়ে কাছে থাকেন। আপনি এই অবস্থায় আল্লাহকে বলুন আল্লাহ নিশ্চয় আপনার ডাক শুনবেন।

ফোন রেখে মনে মনে বললাম-হে আল্লাহ! স্বামীর সম্মান রক্ষার জন্য এ মহিলা যে সর্বোচ্চ ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন তার উসিলায় এই মহিলাকে সন্তানের মা ডাক হতে মাহরুম করোনা।

নূর আয়েশা সিদ্দিকা। বিউটি

বিষয়: বিবিধ

৯৫২ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384927
১৮ মার্চ ২০১৮ রাত ১১:৩১
মোহাম্মদ আবদুর রহমান সিরাজী লিখেছেন : এমন স্ত্রী সত্যিই বিরল। আল্লাহ উনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
১৯ মার্চ ২০১৮ রাত ১২:০৬
317444
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনার নেক দোয়ার জন্য।
384929
১৯ মার্চ ২০১৮ রাত ১২:৩৭
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam... we can learn from this experience.
১৯ মার্চ ২০১৮ রাত ১০:৩৯
317449
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
384933
১৯ মার্চ ২০১৮ সকাল ১০:১০
আবু নাইম লিখেছেন : আসসালাম..
আপনার লেখার হাত চমৎকার..
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর একটা শিক্ষনীয় লেখা দেয়ার জন্য....
এমন সুন্দর ও ভাল মেয়ে আছে বলেই জগত সংসার আজও টিকে আছে....
আপনার সাথে আমিও বলি..-হে আল্লাহ! স্বামীর সম্মান রক্ষার জন্য এ মহিলা যে সর্বোচ্চ ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন তার উসিলায় এই মহিলাকে সন্তানের মা ডাক হতে মাহরুম করোনা।
১৯ মার্চ ২০১৮ রাত ১০:৪৪
317450
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ। কারো জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা হতে পারে অন্যের জন্য ও শিক্ষনীয়। তাই আমি সব সময় চেষ্টা করি তাকে কলমের ডগায় তুলে নিতে।
384934
১৯ মার্চ ২০১৮ দুপুর ১২:২৭
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! কেমন আছেন আপুনি? আপনার লেখা দুইটি বই আমার বরের পক্ষ থেকে উপহার পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্। মহান আল্লাহ্ আপনার লেখার মেধাকে আরো বৃদ্ধি করে দিন। আর লেখার ঐ আপুনির জন্যেও আপনার দোয়ার সাথে আমিন।
১৯ মার্চ ২০১৮ রাত ১০:৪৮
317451
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। জ্বি আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি বোন। ভাইকে ও আমার সালাম জানাবেন।আপনাদের নেক দোয়া আর ভালোবাসাই আমার সবচয়ে বড় পাওয়া। আল্লাহ এর উত্তম প্রতিদান আপনাদের দান করুন।
384960
২২ মার্চ ২০১৮ দুপুর ০২:১১
কুয়েত থেকে লিখেছেন : মাশা আল্লাহ খুবই সুন্দর হয়েছে শিক্ষানিয় পোস্ট আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটির জন্য আল্লাহ্ সকলকে উত্তম প্রতিদান দিন
২২ মার্চ ২০১৮ রাত ১১:৫৮
317457
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালোলাগার জন্য।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File