পুলিশের এলোমেলো গুলি ও আমার জীবনের একটি করুণ অভিজ্ঞতা

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৯ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৩৬:৫২ রাত

আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার শেষ দিন। হঠাৎ বাসায় কিছু মেহমান এসে উপস্থিত। আমাদের সাথে তাদের আগে হালকা পরিচয় ছিলো। যাই হোক উনাদের আগমনের হেতু জানা গেল। ভদ্রমহিলার ছোট ভাইয়ের জন্য আমাকে পছন্দ করে গেলেন। অনেক আগেই নাকি ওরা আমাকে মনে মনে পছন্দ করে রেখেছিলো। আমার অভিভাবকরা ও প্রস্তাবটি পছন্দ করলেন। ছেলের ভাই ভাবী দেশে এসেছেন। ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে। তাই উনারা থাকা অবস্থাই এনগেজম্যন্ট করে ফেলতে চান তাড়াতাড়ি। যদি আমার আব্বা আম্মা রাজি থাকেন তবে ফোনে বিয়েটা ও সেরে নিতে চান। সব কিছুই বেশ তাড়াহুড়ো।

যেদিন পাত্র পক্ষ এনগেজম্যন্ট এর জন্য এলেন সেদিন প্রায় ৭০/৮০ জন গেস্ট খাবেন আমাদের বাসায়। আম্মা ব্যস্ত হয়ে কিচেন সামলাচ্ছেন। দেখা গেল ওদের গেস্টদের ২/৪জন কি করে যেন আমার বড় আপুর ও পরিচিত। আর ও মজার ব্যাপার ওর ঠিক ক্লোজ একজন কাজিনের জন্য ও আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো আগে। এরই মাঝে ওদের এক রিলেটিভ যিনি আমাদেরকে ও চিনতেন তিনি কিচেনে গিয়ে আমার আম্মুকে ফিসফিসিয়ে বললেন- আগে এত দাম দেখাচ্ছিলেন মেয়েকে এখানে বিয়ে দেবেন না। ওখানে দেবেন না। আর এখন বিদেশে থাকা খোঁড়া ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। আম্মু তো শুনে থ।

- কি বলছেন এসব? মহিলা বললো- আমার কথা মিথ্যে হলে খোঁজ নিয়ে দেখেন। বুঝেন না এত তাড়াহুড়ো করছে কেন ওরা?

ভয়ে আম্মুর গলা শুকিয়ে গেল। আব্বাকে ডেকে সব খুলে বললেন। আব্বা বললেন- দেখ ওরা আমাদের পূর্ব পরিচিত হলেও ছেলেটিকে তো আমরা দেখিনি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি কোন পাকা কথা ওদের দেব না। তবে যেহেতু ওরা আমাদের মেহমান আপ্যায়নে যেন কোন ক্রটি না হয়। আম্মু চোখের পানি মুছে বুকের মাঝে অজানা আশঙ্কা লুকিয়ে রেখে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে ওদের আপ্যায়ন করলেন। মোটামুটি বিয়ের গহনা হতে শুরু করে যা যা লাগে সব ওরা নিয়ে এসেছে। খাওয়ার পর ওদের একজন ফোনে বিয়ের কথা তুললো। আমার আব্বা বললেন- দেখুন, বিয়ে শাদি আল্লাহর হাতে। ছেলে দেশে আসুক তারপর বিয়ে হবে। আমার ছোট মেয়ে। আমাদের ও তো শখ আছে। যাই হোক ওদের অনেক আবদারের মুখে ও আব্বা কোন পাকা কথা বা কমিটমেন্ট দেয়া এড়িয়ে গেলেন।

সময় যেতে লাগলো। আমি এক সময় অনার্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। ওরা রেগুলার আমাদের বাসায় আসে। এরই মাঝে আরো দু'একজনের কাছ হতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল-সত্যিই ছেলের পায়ে কখনো গুলি লেগেছিলো। আব্বা আম্মা ওদেরকে সরাসরি কিছু বলেন না। কিন্তু মনটা খারাপ থাকে এই নিয়ে। কেন ওরা সরাসরি এ বিষয়ে কিছু বলছেন না নিজ হতেই? এক সময় পাত্র দেশে এলো। বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো শুরু হলো। আমার বড় আপা ওর বোনকে এবার কথাটি বলেই ফেললেন। উনারা এত আপসেট হলেন এতে। আপনারা এই কথা এতদিন বলেননি কেন? আজই আমাদের বাসায় এসে ছেলেকে দেখে যান। শেষ পর্যন্ত আমার অভিভাবকরা ওদের বাসায় গেল। ছেলেকে শুনিয়ে ওর বোন বলল-এই তুমি হাঁটতে পারো কিনা সেটা ওদেরকে দেখিয়ে যাও। আমার অভিভাবকরা তো রীতিমত লজ্জা পেয়ে গেলেন। ছেলে বেড় রুম হতে ওদের সামনে এসে বসলো। খুব শর্ট ডিসটেন্সে হাঁটা। কেউ কিছুই বুঝতে পারলনা। আব্বা আম্মা ইনডিসিশনে ভুগতে লাগলেন -কি করবেন। এদিকে বিয়ের ডেট ও এগিয়ে গেল। কার্ড ছাপানো দাওয়াত দেয়া সমস্ত কিছুই হয়ে গেল। আব্বা এই বলেন- বিয়ে দেবেন। আবার বলেন দেবনা। কি যে বিব্রতকর পরিস্থিতি। এতদিনের পরিচিত মানুষ। তাই সরাসরি মুখের উপর না ও বলতে পারছেন না। এদিকে আমার পড়াশোনার কথা ভেবে আমি ও খুব কান্নাকাটি করছিলাম। সব মিলিয়ে এক অন্য রকম পরিস্থিতি। আমার অভিভাবকদের ধারণা ছেলের পায়ে সমস্যা আছে। আবার ওদের ও আমাদের দোটানা ভাব দেখে মনে হল মেয়ের বোধহয় অন্য কোথাও পছন্দ আছে। এক পর্যায়ে বিয়ে হয়েই গেল।

বিয়ের ২/১ দিনের মাথায় দেখলাম ওর পায়ের ঠিক টাকনুর কাছে হালকা দু'টি দাগ। আমি জানতে চাইলাম ওটা কিসের দাগ। দুষ্টটা শোয়া হতে বেশ গুরুত্বের সাথে উঠে বসে বলল- ওহ যার জন্য এত কিছু। সেটাই এখনো বলিনি তোমাকে।এরশাদের সময় স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল তখন একদিন প্রাইভেট পড়তে যেতে বেরিয়েছি হঠাৎ মনে হল কোথাও যেন গুলির শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক গরম কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলাম পায়ে। সেই সঙ্গে কেমন একটা অবশ ভাব। আর কিছু বলতে পারবনা। পরে শুনেছি আমার এক সহপাঠী আমাকে কোলে করে দ্রুত হসপিটালে নেবার ব্যবস্থা করেছিলো। দীর্ঘ একমাস মেডিকেলের সেই বদ্ধ রুমটায় এক রকম বন্দী অনিশ্চয়তার জীবন কেটেছিলো। জানতাম না তখনো আর কখনো আমার দু'পায়ে ভর করে সবুজ ঘাসের শিশির ছুঁয়ে হেঁটে বেড়ানো হবে কিনা।পুকুরের নীল জলে ইচ্ছে মত হাত পা ছুঁড়ে দুরন্তপনায় সাঁতার কাটা হবে কিনা। আলহামদুলিল্লাহ আমার মায়ের মায়ের দোয়াই হয়তো ডাক্তার একদিন বললেন- গুলি পায়ের একদিক দিয়ে ঢুকে যেহেতু আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তাই ভয়ের কিছু নেই। ইনশাআল্লাহ ও হাঁটতে পারবে। তখন কি আর জানতাম এই দুর্ভোগ আমার নতুন জীবন গড়তে ও ছুঁয়ে যাবে। অনেক কষ্টের পথ পেরিয়ে এই পর্যন্ত এলাম। দেখলেনা তোমাকে ও কেমন করে বউ করে নিয়ে এলাম। ও ওর সারল্যভরা মুখটি নিয়ে আবারো দুষ্টমির হাসি হাসলো। আমার চোখটা অশ্রুতে ভরে গেল।

আমার বিয়ের পর ওকে খুব কমই পেয়েছে আমার অভিভাবকরা। তাই ঠিক ৪ বছরের মাথায় একদিন দেখি আম্মু অশ্রু সজল চোখে বললেন- কাল রাতে তাহাজ্জুত নামাজে আমি বিশেষ ভাবে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করেছি। সবার কথা শুনে শুনে আমার নিজের মাঝে একটি শংকা ছিলো এতদিন। আহারে আমার ছোট মেয়েটা। বেচারী পড়ার জন্য বিয়েতে রাজি ছিলোনা। আমরা জোর করে ওকে বিয়ে দিলাম। আমার মনে হত, যে ছেলের পায়ে গুলি লেগেছে। সে যতই যাই হোক ঠিক করে কি হাঁটতে পারে? আমি মনে মনে বিবেকের কাছে খুব অপরাধী ছিলাম। কিন্তু সেদিন জামাইকে নিয়ে যখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম ও দীর্ঘ পথ আমাদের সাথে সুন্দর হেঁটে গেল তখন আমার ভেতর হতে দীর্ঘদিন ধরে করে আসা আশঙ্কাটা মুছে গেল।

আমার বাচ্চাদের জন্মের পর ওরা ওর বাবার সেই গুলির দাগটির উপর হাত বুলিয়ে অনেক মমতা নিয়ে জানতে চায়- বাবা, সেদিন তোমার অনেক কষ্ট হয়ে ছিলো?

এতবড় ঘটনা পুনরাবৃত্তির কষ্ট পাঠকদের এই জন্যই দিলাম ,সেদিন পুলিশের উপরের দিকে ছুঁড়ে মারা গুলিতে তন্ময় নামের এক কিশোরকে আহত হতে দেখে। নিজের জীবনের এই ঘটনাটি নতুন করে আবারো মনে পড়লো। একটি এলোমেলো গুলি খরচ পুলিশের জন্য হয়তো কিছুই নয়। কিন্তু যার গায়ে লাগলো এর বদৌলতে তার গোটা জীবনটাই বদলে যেতে পারে। আল্লাহ না করুক সেদিন গুলি যদি তন্ময়ের চোখে লেগে যেত তবে ওর আঁধারের গহীনে ঢাকা পড়ে যাওয়া জীবনটার সঙ্গী কে হত? আলহামদুলিল্লাহ আমার হাজব্যন্ড আজ হাঁটতে পারছেন বলেই ওর জীবনে আমি এলাম। ওর সেদিনের করুণ স্মৃতিটা আমি অনেক ভালোবাসায় আমার লেখনির ডগায় তুলে নিতে পারলাম। কিন্তু যাদের জীবনে এই এলোমেলো গুলির সুবাদে বেঁচে থেকে ও আরো বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের এই কষ্টকর স্মৃতি গুলো লিখার জন্য কোন ভালোবাসাভরা দু'টি হাত সাথী হয়ে কখনো আসবে কি? মৃত্যু এক ধরণের কষ্ট। কিন্তু বেঁচে থেকেও যার জীবন গতি হারায় সে আরো অনেক বেশি হতভাগ্য। এই অপূরনীয় ক্ষতির দায় ভার কে নেবে?

বিষয়: বিবিধ

১৯৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File