সময়ের রাসূল (সাঃ)
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৭ জানুয়ারি, ২০১৫, ১২:৫৭:১২ রাত
মযলুমের আর্তচিৎকারে যখন ভারী হয়ে উঠেছিল সময়ের বাতাস, বিপন্ন মানবতার আহাজারিতে যখন প্রকম্পিত হচ্ছিলো পৃথিবী, নারীত্বের মর্যাদা যখন ভূলুন্ঠিত হয়ে গুমরে কাঁদছিলো তৃষ্ণিত মরুবিয়াবানের ধূ ধূ প্রান্তরে , পাপাসিক্ত হয়ে ব্যক্তি, পরিবার , সমাজ যখন ঢাকা পড়েছিলো অনৈতিকতার সয়লাবে ঠিক তখনই এই তৃষিত ধরায় হেদায়াতের রোশনাই নিয়ে আবির্ভূত হলেন মুহাম্মাদ(সাঃ) । যাকে পাঠিয়ে মহান প্রভু নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন- ‘’হে নবী আপনাকে সমস্ত পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরুপ পাঠিয়েছি।‘’ সূরা কালাম-১০৭
ঐতিহাসিক Ameer Ali এ ক থাটি এভাবে বলেছেন-
‘’Never in the history of the world was need so great the time so ripe for the appearance of a deliverer.’’
যাকে পাঠিয়ে মহান প্রভু পথহারা মানব জাতিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বা সর্বোত্তম আদর্শের সাথে। জাহেলিয়াতের অন্ধকার গলি পথে হাতড়ে বেড়ানো মানুষ গুলোকে জানিয়ে দিলেন ‘সিরাজুম মুনীরা’ বা উজ্জ্বল বাতির দিক নির্দেশনা। তাইতো ঐতিহাসিক P.K.Hitti মন্তব্য করেছিলেন-
‘’The stage was set. The moment was phycological for the rise of a great religious and national leader’’.
এক অনৈতিক পাপবিদগ্ধ সমাজের বুকে বেড়ে উঠেও অভিভাবকত্বের বারংবার পালাবদলেও অগণন মিথ্যার সয়লাবে দাঁড়িয়েও মুহাম্মদ (সাঃ) খুব কম বয়সেই অর্জন করেছিলেন ’আল- সাদিক’ বা সত্যবাদী উপাধি।
যে সমাজে আমানতহীনতা সম্পর্কের বুনিয়াদকে এক নাজুক পরিস্থিতির সীমানায় ঠেলে দিয়েছিলো সেই আদর্শহীন সমাজে বেড়ে উঠেও এই মহান ব্যক্তি জীবনের শুরুতেই অর্জন করেছিলেন ‘ আল আমীন’ বা বিশ্বস্ত উপাধি। যার স্বাক্ষর দেখেছিলাম আমরা মক্কা ছেড়ে হিজরতের সময়ে। যাদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বেদনাহত হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেড়ে যাচ্ছিলেন প্রিয় জন্মভূমি। তখনো তিনি আমানতদারীতার সর্বোত্তম পরিচয় দেখিয়েছিলেন নিজের শত্রুদের সাথেই। তাঁর অবর্তমানে তারই নিযুক্ত আলী (রাঃ) তিল তিল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কাফেরদের গচ্ছিত সম্পত্তি। জাহেলিয়াতে ঢাকা কাফেরদের হৃদয়গুলোকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাদের মাঝে বেড়ে উঠেও তিনি জাগতিক লোভ লালসার অনেক উর্ধ্বে এক স্বতন্ত্র্য ব্যক্তি।
শান্তি,স্বস্তি ও মানবতার মর্যাদা ভূলুন্ঠিত সমাজে কিশোরোত্তীর্ণ বয়সেই মুহাম্মাদ (সাঃ) বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে গড়ে তুলেছিলেন ‘হিলফুল-ফুজুল’ এর মত ব্যতিক্রমী এক সংগঠন।শান্তি, শৃংখলা ,নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, অত্যাচারিত, দূর্বল, ইয়াতিম, নিঃস্ব,অসহায়ের সাহায্য, বিভিন্ন গোত্রের মাঝে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখার চেষ্টা, মুসাফিরের জান মালের নিরাপত্তা এমনি বিষয় গুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেন তিনি এই সংস্থা।
আজকের দিকভ্রান্ত, ড্রাগের মরণ নেশায় ধুঁকতে থাকা, অপসংস্কৃতির স্বপ্নীল ছোঁয়ায় মাতাল, অনৈতিকতার বিষাক্ত ছোবলে কাতর,আদর্শহীন কিশোর, তরুণদের একটি কাঙ্খিত প্রশান্তিময় নৈতিকতাসমৃদ্ধ জীবনের সৈকতে নোঙ্গর করতে হলে তরুণ মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সময়কেই ফিরিয়ে আনতে হবে।
মরু আরবের বছরের পর বছর চিরাচরিত ভাবে চলে আসা দীর্ঘ দিনের ভ্রাতৃঘাতী রক্ত তৃষ্ণাকে ঢেকে দিয়েছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সুশীতল পরশ বুলিয়ে। মহান প্রভুর ঘোষণা ‘’ তোমরা আল্লাহর রং ধারণ কর? তাঁর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে।‘’ সূরা বাকারা’র এই আহবানকে স্বাগত জানিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেই প্রথমে হয়েছেন এক জীবন্ত কোরআন। আর তাঁকে অনুসরণ করে সেই জাহেল আরবের অজ্ঞতার তিমিরে ঢাকা মানুষগুলো জাহেলিয়াতের তমসা কাটিয়ে কেউ হয়ে গেলেন ’সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তলোয়ার, কেউবা হয়ে গেলেন ‘সিদ্দীক’ আর কেউবা সময়ের সেরা মানুষদের একজন। জানিয়ে দিলেন পৃথিবীকে ঘৃণা ও ভালবাসার মূল উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তোষকে ঘিরে। তাইতো ঐতিহাসিক রায়মন্ড লার্জ বলতে বাধ্য হয়ে ছিলেন-‘’ প্রকৃতপক্ষে সামাজিক ও আন্তর্জাতিক বিপ্লবের অগ্রণী ব্যক্তি হিসেবে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতার নাম ইতিহাসে প্রথমে উল্লেখ করা যায়।‘’
‘’নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত’’- সূরা কালাম এর ৪ নং আয়াতে মহান প্রভুর এই ঘোষণার আঁধার মুহাম্মদ (সাঃ) ক্ষমা, ভালোবাসা, বিনয়, করুণা আর সদাচারের যে দীপশিখা জ্বালিয়ে ছিলেন মানুষের হৃদয়ে তার ফলে ‘’মুমিনরা পরস্পর ভাই’’ হয়ে গেল। আনসার ও মুহাজিরদের ত্যাগ ও ভালোবাসা তাই আজো ইতিহাসের এক নজীরবিহীন অধ্যায়। সেই শিক্ষার রোশনাইতে আলোকিত হয়ে রক্তপিপাসু ইকরামা বিন আবু জেহেল এর মত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন মানবিকতার জীবন্ত এক প্রতিচ্ছবি। সেজন্যই দেখা যায়, জেহাদের ময়দানে শাহাদাতের পূর্ব মুহৃর্তে নিজের মুখের তীব্র তৃষ্ণার পানি অন্য দ্বীনি ভাইকে এগিয়ে দিতে এতটুকু কুন্ঠিত হননি।আল কোরআন প্রদর্শিত নৈতিকতার কাঙ্খিত মান অজর্ন করে রাসূল (সাঃ) এর সাথীরা তারই আদর্শে পরিপূর্ণ ভাবেই প্রভাবিত হয়েছিলো। তাইতো তারা সেরা গুণ ও বৈশিষ্টের অধিকারী হয়ে দয়া, ভালবাসা, ত্যাগ ও কুরবনির নজরানা, মানবতা, ন্যায় ও ইনসাফ, দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকে।
আজকের ভালবাসা, বিশ্বাসহীন সমাজে সম্পর্কের বুনন যখন ঠুনকো সুতায় বাঁধা পড়ে দোদুল্যমান অবস্থায় দুলছে তখন বিশ্বকে আবারো সর্বোচ্চ মানবিকতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইলে রাসূল (সাঃ) সময়কে ফিরিয়ে আনতে হবে।
ব্যক্তিকে নির্বাচনের মিথ্যে লৌকিক মানদন্ডকে ভেঙ্গে দিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) ঘোষণা দিয়েছিলেন –‘’ অনারবের উপর আরবের, আরবের উপর অনারবের এবং সাদার উপর কালো এবং কালোর উপর সাদার কোন বিশেষত্ব নেই। শুধুমাত্র আল্লাহ ভীরুতাই হবে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।‘’ (যাদুল মা’য়াদ)
হাবশী ক্রীতদাস বেলার (রাঃ) কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন করে পৃথিবীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এতটুকু ইতস্তত করেননি রাসূল (সাঃ)। ক্রীতদাস যায়েদ (রাঃ) কে ইয়ারমুকের যুদ্ধ সেনা প্রধানের দায়িত্ব দিতে তাইতো তিনি বিন্দুবিসর্গ ভাবিত হননি। আবার সেই ক্রীতদাস যায়েদের সন্তান উসামা বিন যায়েদকে যে যুদ্ধে তিনি সেনা প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধে আবু বকর , উমর (রাঃ) মত সাহাবীরা ও একজন সাধারণ সৈন্য হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাইতো আল্লামা ইকবাল বলেন,’’ তোমরা জাতি , বর্ণের উর্ধ্বে এবং গোত্রের উর্ধ্বে। তার মধ্যে এক যোগ্য কৃষ্ণকায়ের মূল্য শত শ্বেতকায়ের মূল্যের চেয়ে বেশী। কামবরের(একজন কৃষ্ণকায় ঈমানদার মুসলিমের নাম ছিলো কামবর) এক বিন্দু ওযুর পানির মূল্য এক রোম সম্রাটের রক্তের চেয়ে বেশী। তুমি বংশ ও গোত্রের উর্ধ্বে ওঠো, সালমান ফারসীর মতো তুমি ও বলো ‘ আমি ইসলামের সন্তান’।‘‘
এরই ধারাবাহিকতায় সেই পরশ পাথরের আলোয় আলোকিত জীবনের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল মানুষ আবুবকর (রাঃ) পরবর্তীতে একজন খলিফা হয়ে ও এক অসহায় বৃদ্ধার গৃহের কাজকর্ম করে দিতেন নিজ হাতে। তারই পরবর্তী দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাঃ) অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হয়ে ও জেরুজালেম যাত্রা পথে নিজের ভৃত্যের সাথে বাহন পালাবদল করতে এতটুকু লজ্জিত বোধ করেননি। উপরন্ত হুজাইফা (রাঃ) এর ক্রীতদাস সালেম (রাঃ) সম্পর্কে শাসক ওমর অকপটে বলেছিলেন- ‘’এখন যদি সালেম জীবিত থাকতো তবে আমার পরবর্তী খলিফা পদের জন্য আমি তার নাম প্রস্তাব করতাম।‘’
স্বজন প্রীতি , ঠুনকো গুণাবলীর ভিত্তিতে অযোগ্য ব্যক্তিকে নির্বচনের ফলে সামাজের রন্দ্রে রন্দ্রে যে বেইনসাফের দাবদাহ জ্বলছে তাকে নির্বাপিত করতে হলে মুহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শের দিকেই আমাদের ফিরতে হবে।
তাইতো রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে কবি বলেছেন-‘’যাঁর পরশে সংকীর্ণতা উদার হল, আগলবদ্ধ অন্ধকার হৃদয় আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো, শুভ ও কল্যাণ দৃষ্টি উন্মোচিত হলো, পথহারা ভ্রান্তরা হলো পথ প্রদর্শক আর মৃতরা হয়ে গেল অন্যদের এাণকর্তা।‘’
সামাজিক সম্পর্কের দায়বদ্ধতাহীন পারিবারিক অঙ্গনের নিকষ কালো আঁধারের ঘন তমসাবৃত্ত রজনীর ঘোর কাটিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা জাগাতে মানুষকে জানিয়ে দিলেন- ‘’তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রী’র কাছে উত্তম ও পরিবারের কাছে সর্বোকৃষ্ট।‘’ একাধিক স্ত্রী’র স্বামী হয়ে ও সবার প্রতি সুবিচার আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ইসলামী পরিবার গঠন পদ্ধতি। শেখালেন মা, বাবা, ভাই, বোন ও আত্নীয়তার সম্পর্ক উত্তম রক্ষাকারী কি করে হতে হয়। মা- বাবার প্রতি সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়ে পাশাপাশি সন্তানকে শিখিয়ে দিলেন তাদের কল্যাণ কামনায় প্রভুর নির্দেশ’ রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সগীরা।‘’ আবার সবাইকে সতর্ক করে দিলেন- ‘’তোমরা নিজেরা দোযখের আগুন হতে বাঁচ। তোমাদের নিজেদের পরিবার পরিজনকে ও বাঁচাও।‘’ সূরা তাহরীম-৬
সেই সাথে দোয়া করতে ও শিখিয়ে দিলেন- ‘’রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ,ওয়া যুররিয়াতিনা, কুররাতান আইয়ুনিন ওয়া জায়ালনা লিল মুত্তাকিনা ইমানা।‘’ স্রষ্টার আনুগত্য, দ্বীনদারিতা, উত্তম চরিত্রের সমন্বয়ে সন্তানদের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার পথ ও ও তিনি বাতলে দিলেন। ( আগামী পর্বে সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
১৮৭১ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 10348
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
এজন্যই নবী মোহাম্মদ অসহায় অবলা ক্রীতদাসী ধর্ষনকে বৈধতা দিয়েছেন আল কোরাণে।
আমরা এখন দুনিয়ার চিন্তাই এতই অন্ধ যে এই সরল পথ চোখেই পড়েনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন