নাইবা দিলাম শিরোনাম
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৯:৩২:৪৮ রাত
ফোনের রিসিভারটা হাতে নিয়ে বসে আছি বজ্রাহতের মত।ওপাশে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দটা মিলিয়ে গেছে বেশ আগেই। কিন্তু আমার জীবন হতে হঠাৎ যেন সময়টা থমকে গেল। বেদনাহত মনের গভীরে চলছে স্মৃতিদের স্বশব্দ আনাগোনা। কষ্টের নিধুয়া পাথারে দাঁড়িয়ে কেবলই জানতে ইচ্ছে করছে- কেন এমন হয়? কোথায় যেন পড়েছিলাম জীবনের যুগলবন্দী পথচলায় কখনো কখনো প্রিয় সম্পর্কের অয়বয়টা বাথরুমের ছেড়া স্লিপারের মত কিংবা ছেঁড়া ন্যকড়াটার মত এসে ঠেকে। দিন মাস বছরের খুনসুটি গুলো মিলিয়ে বিবর্ণ হতে শুরু করে প্রিয়ত্বের রং। কেন এমন হয়? জানিনা ঠিক কতটা সময় এমনি করে ভাবালুতায় ডুবে ছিলাম। সম্বিত ফিরে পেলাম দরজা খোলার আওয়াজ শুনে। ও ঘরে ঢুকে আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো – এই কি হয়েছে? আমি ভাবনার ঘোর হতে চমকে উঠলাম। রিসিভারটা ধীরে ধীরে জায়গামত নামিয়ে রাখলাম। আলগোছে গালে হাত দিয়ে টের পেলাম গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রুগুলো চোখের রোদ্দুরেই শুকিয়ে গেছে। কষ্টের আবিলতায় ভরা দীর্ঘশ্বাসটাকে বুক হতে ধীরে ধীরে বের করে নিজকে হালকা করার চেষ্টা করলাম।
ইদানিং কেমন যেন বদলে যাচ্ছি বোধহয়। হৈ হুল্লোড়ে সেই আমি যেন ধীরে ধীরে নিজের মাঝে শামুকের মত গুটিয়ে যাচ্ছি। আগের মত হৈচৈ করে বেড়ানোয় ইচ্ছাটায় আলস্য এসে গেছে। মাঝে মাঝে আজকাল দুরালাপনীর করুণ স্বরে ডেকে ডেকে যাওয়াটায় বিরক্তির মাত্রা মনে হয় বিরাশি সিক্কায় পৌঁছে যায়। তারপর ও অনেক দিন পর ইচ্ছে করেই কয়েকজন মিলে একটি পিকনিকে যোগ দিলাম। হল ঘরে ঢুকতেই মনে হল আনন্দের বন্যায় যেন সবাই ভাসছে। সালাম বিনিময় করতে করতে ভেতরে ঢুকছি। বেরা ভাবি ডেকে উঠলেন- এই ভালো আছিস? যাহ বাবা যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয় কথাটি তাহলে মিথ্যে নয়। মুখে দেঁতো হাসি ঝুলিয়ে বললাম- জ্বি ভালো। ভাবীর এর পরের প্রশ্নের জন্য তৈরী না হলেও বিষয়টি আজানা ছিলনা। তাই -আমার মেয়ের খবর পেয়েছিস তো। প্রশ্নটা না অপ্রত্যাশিত আর না অজানা আমার জন্য। তারপর ও ভেতরে ভেতরে খুব দমে গেলাম। কি দেব এই প্রশ্নর জবাব? সেদিন বিকেলে দুরালাপনীতে ভেসে আসা এই একটি খবরই তো আমার বিশ্বাসের দেয়ালে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর হতেই মনের ভেতরে চলছে বেদনার খরস্রোতা এক প্রস্রবন। ভাবী আমার গায়ে আলতো করে হাত রাখলেন। ইদানিং জীবন চলার পথে মনে হচ্ছে যেন বড় বেশি অভিনয় নির্ভর হয়ে পড়ছি। তাই আমি চমকে উঠে কথা গুরিয়ে নিপূন অভিনেত্রীর মত বললাম- ভাবী, কেমন আছে মেয়েটি এখন? ভাবীর দু’চোখে শ্রাবণের ঢল জমতে শুরু করলো। একটু ফুঁপিয়ে উঠে বললেন- একে কি বেঁচে থাকা বলে? বলতে পারিস ও কি এমন পাপ করেছিল?
আমি কি বলবো এই বেদনাহত মা’কে? রেবা ভাবী নিজেই আবার মুখ মুখলেন- বলতে পারিস বোন মানুষ কি করে এত পাষাণ হয়? আমার সোনার টুকরো মেয়েটিকে ওরা দিনের পর দিন এত কষ্ট দিয়েছে। অথচ অতটুকু মেয়েটি মাশাআল্লাহ ধৈর্যের বাঁধে নিজকে এতটা জড়িয়ে রেখেছিল আমাদের ও কিছু বুঝতে দেয়নি। প্রাণপণে চেয়েছিলো সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। আমি এবার মুখ খুললাম- ভাবী, কি করে বুঝলেন ব্যাপারটা যে এতটা গড়িয়েছে? ভাবী চোখের পানি আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন- জানিস এত তাড়াতাড়ি আবার এতদূরের শহরে মেয়েকে বিয়ে দিতে আমি ঠিক রাজি ছিলাম না। তাই কখনো কোন সমস্যার কথা মেয়ে আমাকে জানাতো না। সব কথা হত ওর বাবার সাথে। মাস খানেক আগের কথা। আমার হ্যাজব্যন্ড গাড়ি ড্রাইভ করছে ওরই মধ্যে ফোনটা এলো। ও কেবল হু হা করেই জবাব দিচ্ছে। শেষ কথাটি আমার কানে গেল। -না, না। চিন্তা করোনা। তোমাকে আমি খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো। ফোন কাটতেই আমি চমকে উঠে বললাম- এই কাকে নিয়ে আসার কথা বললে? ও আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো- তুমিতো বেশী টেনশন কর। তাই রিমি তোমাকে বলতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু এখন না বললেই নয়। ওর শ্বশুর বাড়িতে বেশ প্রবলেম হচ্ছে। ওরা মনে হয় ওকে টর্চার করে। জানিস বোন কথাটি শুনে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। এরপর খুব দ্রুতই আমি দেশে গেলাম। কোন খবর না দিয়েই মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। ভাগ্যিস কোন খবর দিইনি। না হয় ওরা হয়তো আমার রিমিকে সরিয়ে ফেলতো। আমাকে হঠাৎ দেখে ওর স্বামী ,শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তো ভুত দেখার মত চমকে গেল।বার বার অভিযোগ করতে লাগলো কেন আসার খবর জানাইনি। আমি হেসে বললাম- আপনাদের সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি। আসলে আমি ভেবেছিলাম হঠাৎ করে কোন খবর না দিয়ে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবে বুঝতে আমার সুবিধা হবে । বোন, তোর তো মনে আছে আমার মেয়েটিকে আমি কি রকম ফুলের মত সাজিয়ে রাখতাম। জানিস আমার মেয়ের পরনে যে রং উঠা পুরনো জামা আমি দেখলাম তা আমার বাড়ির কাজের মেয়েকে পরানোর কথা ও আমি চিন্তা করতে পারিনা। ভাবী আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন।
আমার বিষন্ন মনটা স্মৃতির ভেলায় ভেসে গেল দূর অতীতে। তখন আমি জেদ্দায় নতুন। রেবা ভাবীর বাসায় দুপুরের দাওয়াত খেয়ে গল্প করছি। ভাবী বললেন- এই রিমিকে একটু ভালো করে পড়তে বলে দেনা। আমি তাকাতেই রিমি মুচকি হাসলো। আমি বললাম -বাহ রিমি এত সুন্দর সুন্দর জামাগুলো কোথায় পাও তুমি? ভাবী হেসে বললেন-আসলে ওর ওয়েটটা তো একটু বেশীই । তাই সব সময় পছন্দসই জামা পাওয়া যায়না। সেজন্য ওর বাবা বা আমি মার্কেটে বের হলে পছন্দসই ও মাপমত জামা পেলে একাধিক ও কিনে ফেলি। আমি হেসে বললাম- সে কি রিমি বাবাকে যে ফতুর করে ফেলবে। মৌনভাষী মেয়েটি শুধু মায়ামায়া মুখ করে হাসলো আমার কথায়। ভাবী বললেন- আর বলিস না। ওর বাবা খুব বেশী দিন ওর দাদীকে পায়নি তো। তাই রিমির জন্মের পর হতেই বলে- রিমিই আমার মা। বাপের আহলাদী মেয়েকে দেখিসনা খাইয়ে খাইয়ে কি করেছে। রিমি হেসে বললো- আম্মু, তুমি ওতো আমাকে চেপে চেপে খাওয়াও। ভাবী ধরা পড়ে মাত্বেত্বের মমতা লেপ্টে থাকা মুখে লাজুক হাসলেন। সেই রিমি...
ভাবী আমাকে আনমনা হতে দেখে আবার বললেন- এই কি ভাবছিস? আমি চমকে উঠে বাস্তবে নোঙ্গর করতে করতে বললাম – না, কিছু না। রেবা ভাবী বললেন- জানিস, আমি রিমির শ্বশুর বাড়ির লোকদের বললাম-ওর কাজিনের বিয়ে মেয়েকে আমার সাথেই নিয়ে যাবো। কিন্তু ওর স্বামী, শ্বাশুড়ি কিছুতেই মেয়েকে ছাড়বেনা। রিমি তো ওর খালোতো বোনের বিয়ের কথা শুনে এক পায়ে খাড়া আমার সাথে আসতে। একটু পর ওর স্বামী ওকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল। বেশ অনেকক্ষণ পর মেয়ে যখন ফিরলো তখন মলিন মুখে বললো- মা, তুমি এখন যাও। আমি না হয় পরে যাবো। আমি মেয়ের হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ বুঝতে না পেরে ওকে কাছে ডাকলাম।ওমা তাকিয়ে দেখি ওর ওড়নায় ঢাকা বাম গালটা টকটকে লাল হয়ে আছে। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম- রিমি কি হয়েছে আমাকে বল? ও ভয়ার্ত চোখে ভীত হরিণীর মত চারদিকে তাকিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো – মা, তুমি আমাকে যে করে হোক নিয়ে যাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। সব দেখে শুনে আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম। রিমির শ্বশুরকে গিয়ে বললাম- বেয়াই, আমি একটি বিয়ে উপলক্ষে এসেছি। রিমিকে ছাড়া আমার ভালো লাগবেনা। কিন্তু ওর স্বামী শ্বাশুড়ির এক কথা- রিমি এখন যাবেনা। তখন আমি রাগ করে বললাম- এখন যদি ও না যায় তবে যেন আমার মরা মুখ দেখতেও না যায়। এবার শ্বশুর বেশ সদয় হলেন। শ্বাশুড়িকে বললেন- আহা তোমরা এমন করছো কেন? উনি তো দেশে মাত্র ক’দিন থাকবেন। বউমা যাক না মায়ের সাথে থেকে আসুক কিছু দিন। ওর জামা কাপড় গুছিয়ে দাও। ভাবী বললেন- অনেক যুদ্ধ করে মেয়েকে নিয়ে যখন ও বাড়ি হতে বের হলাম তখন দেখি মাত্র দুটি সুতির থ্রীপিচ দিয়েছে মেয়েকে। একটা ভালো শাড়ি বা একটা গহনা ও নয়। অথচ আমি আমার মেয়েকে শাড়ি, গহনা, ঘরের যাবতীয় আসবাব পত্র কি দিইনি বল। ওর বাবাকে ফোনে জানাতে ও বললো- থাক রেবা। দুঃখ করোনা। আমার মেয়েকে জীবিত ফেরত পেয়েছি এটাই যথেষ্ট। ধরে নাও ওগুলো ওর জানের সাদাকা হিসেবে গেছে।
মেয়েকে বাসায় আনার পর দেখি ও ঘুমে মুষড়ে পড়েছে। আমি যখন খাওয়াতে বসালাম তখন এত খেল যে আমিই অবাক। আমি ওর দিকে তাকাতে লাজুক হেসে বললো- জানো মা, ও বাড়িতে আমাকে ঠিক মত খেতে দিত না। সারাদিনই আমার কাজ করতে হত। ঠিকমত ঘুমাতে ও পারতাম না। আমি কত করে বললাম- লিখাপড়াটা শেষ করে নিই। তখন তোমাদের জামাই বলে- আমার নাকি অত পড়ার দরকার নেই। বেরা ভাবী বললেন- আমি হঠাৎ মুখ ফসকে বললাম- রিমি ওরা কি তোর গায়ে হাত.....। রিমি করুণ গলায় বললো- মা, সম্পর্কের সুতোটা যখন এত করে ওধরে রাখতে পারলাম না তখন আর লুকিয়ে কি লাভ? ভাবী এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন- জানিস আমার মেয়েটার জামার হাতা তুলে দেখি মারের দাগ কালসিটে হয়ে আছে........। শুধু হাতে নয়। সারা গায়ে দাগ।
প্রিয় পাঠক, আমি নির্বাক। অক্ষম এক রোবটের মত শুধু শুনেই গেলাম। মনটা আবার সুদূরে হারালো। রিমির বিয়ের আগে শেষবার ও যখন জেদ্দায় এসেছিল তখন এক ভাবীর বাসায় দাওয়াত খেতে গেছি। ওখানে উপস্থিত ভাবীরা সবাই আমার পরিচিত। কিন্তু একটি অপরিচিত মেয়েকে দেখলাম লাজুক মুখে বসে আছে। আমি অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে বললাম – ভাবী, এটা কোন ভাবীর মেয়ে। আর সারা ঘরে তো হিহি হাসির শব্দ। এক ভাবী বললেন- আচ্ছা বোকা হয়েছিস না? রেবা ভাবী বললেন- তুই রিমিকে চিনলি না। আমি তো বিস্ময়ের স্বপ্ত ডিঙ্গায়! শুনেছি রিমি অনেক স্মিম হয়ে গেছে। তাই বলে স্মিম হলে মানুষ এতটা বদলে যায়। আমি রিমির দিকে এগুতে ও এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম – আমি শুনেছি ইন্ডিয়ান নায়িকারা নাকি অনেক সুন্দর। আমাদের বাংলাদেশী মেয়েরা দেখছি ওদেরকে ও হার মানায় আহারে সেই সোনার টুকরো মেয়েটার গায়ে যারা হাত তুলে তারা কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে!
আমি ক্ষুব্ধ গলায় জানতে চাইলাম- ভাবী, রিমির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কিছু বলতো না? ভাবী বললেন- আর বলবে..রিমিকে যখন মারতো তখন ওর কান্নার আওয়াজ যাতে আশেপাশের লোকেরা শুনতে না পায় তাই ওর শ্বাশুড়ি ছেলেকে বাধা না দিয়ে আরো দৌড়ে গিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিতো। জানিস ওরা এত আমানুষ ছিলো রোজার রাতে সেহরীতে গরম খাবার খেতে অনেক রাতে রিমিকে রান্না করতে হত। আবার যাতে সময়মত ওরা সেহরীতে জাগতে পারে তাই রিমিকে জেগে বসে থাকতে হত। ঘড়িতে এলার্ম দেয়া যাবে না। এতে নাকি তাদের ঘুমের ডিস্টার্ব হয়। রিমির স্বামী রেগুলার ওর মোবাইলের ব্যালান্স চেক করেতা। আমাদেরকে যাতে লুকিয়ে ফোন করতে না পারে। আর আমরাও ফোন করলে ওরা সামনে বসে সব কথা শুনতো। আল্লাহ রহম করুন সেই বৃদ্ধাকে। ওর শ্বশুর বাড়ির সেই আত্নীয়া মহিলা এই বিপদে রিমিকে সাহায্য করেছেন। তিনি লুকিয়ে তার মাোবাইল হতে আমাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। না হয় তো আমি আমার রিমিকে জীবিত পেতাম না। ভাবী আবার ফুঁপিয়ে চোখ মুছলেন। এই নিয়ে কথা বলতে বলতে কতবার যে তিনি অনিরুদ্ধ অশ্রুগুলোকে বাঁধ দেবার চেষ্টা করলেন। এমনি করে সেদিন অক্ষম আমি কান পেতে শুনে গেলাম রিমির জীবনের দুঃখের কথা গুলো।। মনে প্রশ্ন জাগলো, যে ব্যবহার রিমির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা রিমির সাথে করলো সেই ব্যবহার যদি ওদের মেয়ের সাথে কেউ করতো তবে ওদের কাছে কেমন লাগত?। কেন আমরা সব কিছু নিজকে দিয়ে বিচার করতে পারিনা। সময়ের আবর্তনে আমরা প্রতিটি নারী কি পর্যায়ক্রমে কখনো মেয়ে , কখনো ননদ, কখনো স্ত্রী,কখনো শাশুড়ি নই। আবার প্রতিটি পুরুষই কখনো ভাই , কখনো স্বামী বা কখনো বাবা নই?এমনি করেই কাঁচের টুকরোর মত ভেঙ্গে গেল শেষ পর্যন্ত রিমির ২/ ৩ বছরের সাজানো সংসার। মুখ থুবড়ে গেল একটি মেয়ের সারাজীবন ধরে তিল তিল করে গেঁথে নেয়া স্বপ্ন গুলো।
মনে পড়লো হঠাৎ করে, আমার বিয়ের সময় আব্বা দোয়া করতে যেয়ে বলেছিলেন- হে আল্লাহ ,রাসূল (সাঃ) ও আয়েশা(রাঃ) যে মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক ছিলো সেটাই তুমি আমার মেয়ের ভাগ্যে নসীব কর। সত্যিই তো। যে রাসূলকে এত ভালবাসি আমরা(???) আর যা কিছু ভুলি না কেন খাওয়ার পর মিষ্টি খেয়ে সুন্নত পালন করতে ভুল হয়না আমাদের। মৃত্যুর পর কবরে লাশ রাখার সময় খুব জোরে জোরে শব্দ করে বলি- রাসূলের মিল্লাতের উপর রেখে যাচ্ছি। আমরা কি একবার ও ভাবি যার সারাটি জীবনের পথ চলাই ছিলো রাসূলের মতাদর্শের বিপরীত। আজ তার নিথর লাশ দিয়ে রাসূলের কি যায় আসবে। আমরা কি পারিবারিক জীবন কিংবা ব্যক্তি জীবনে একবার ও ভাবি একজন স্বামী হিসেবে রাসূল(সাঃ) কেমন ছিলেন? একজন সুদর্শন যুবক হয়েও নিজের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ বয়সের এক বৃদ্ধাকে বিয়ে করে ও কোন আক্ষেপ বা স্ত্রী’কে কটাক্ষ কিংবা অপমান কখনো করেননি। বরং আজীবন তাকে প্রিয়ত্বের মাপকাঠিতেই স্মরণ করে গেছেন। তাঁর একাধিক স্ত্রী’র ঘরে কোন সন্তান ছিলন। কিন্তু এই নিয়ে কোন কটু কথার হুল ফুটিয়ে তো মনে কষ্ট দেননি স্ত্রী’দের। আয়েশা (রাঃ) আনাড়ি গৃহস্থালির কাজে বন্ধুর মত সাহায্য করতেন এই মহান মানুষটি। ভালোবাসা, হাসি কৌতুক, মমতার বন্ধনে জড়িয়ে রাখতেন স্ত্রী’দের। এতবড় একজন ইবাদকারী কিন্তু কখনো তো রমযানের রাতে সেহরীতে গরম খাবার খাওয়ার জন্য স্ত্রী’র রাতের ঘুমকে নষ্ট করেন নি। আয়েশা রাঃ সাথে দৌড় প্রতিযোগিতাসহ কত কত মধুর স্মৃতি। শুধু কি তাই। ব্যক্তিকে পরিমাপের জন্য রাসূল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন-‘’ তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম যিনি তার স্ত্রী’র কাছে সর্বোৎকৃষ্ট এবং নিজ পরিবারের সঙ্গে স্নেহশীল আচরণ করেন।‘’।সেই রাসূলের উম্মত বলে নিজকে দাবী করি আমরা। অথচ আমাদের কথা কাজে কত ফারাক।
আমার তো মনে হয় আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মুসলমানের ঘরে পাঠকের চাইতে কোরআনের সংখ্যা বেশি। এই যে এত দুলে দুলে সুরে সুরে আমরা কোরআন পড়ি সেই আমরাই যখন একজন নিঃসন্তান স্ত্রী বা ছেলের বউকে,বা শুধুমাত্র একাধিক কন্যার জন্মদানকারী নারীকে মানসিক নির্যাতন করি তারা কখন জানবো এই কোরআনের পাতায়ই আল্লাহ তায়ালা লিখে দিয়েছেন- ‘’তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। কাউকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা কিছুই দেন না।‘’ সূরা শূরা-৪৯ তাহলে এখানে একজন নারীর দায়বদ্ধতা কোথায়। সারা বছর অর্থ না বুঝে তোতা পাখির মত যারা কোরআন খতমের উপর খতম করে বেড়ান তারা যদি বুঝতেন এই আল কোরআনেই, স্ত্রী’সাথে সদাচরনের কথা, পরিবার পরিজনের সাথে উত্তম ব্যবহারে কথা, ইহসানের কথা সবচেয়ে বেশী লিখা আছে। মাঝে মাঝে দুঃখ হয়। মনে হয় সেই আয়াতটি-‘’ যদি আমি এই কোরআনকে পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে যে পাহাড় আল্লাহর ভয়ে বিনীত হতো ও ফেটে চৌচির হয়ে যেত । ‘’সূরা হাশর
আমাদের গাফেল হৃদয়ের দিকেই তাকিয়ে বুঝি মহান প্রভু বলেছেন-‘’ এর পর ও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে যায়। পাথর কিংবা তার চাইতে কঠিন। এমন কতক পাথর আছে , যা হতে নহর প্রবাহিত হয়। এমন কতক পাথর আছে যা বিদীর্ণ হয়ে যাবার পর পানি নির্গত হয়। আবার এমন কতক পাথর আছে যা আল্লাহর ভয়ে খসে পড়ে। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফেল নন।‘’ সূরা বাকারাহ-৭৪
আফসোস সে ভয় কেন আমাদের হৃদয়ে জাগেনা!
এমনি অনেক কিছু ভাবনা চলছিলো যখন মনের ঘরে তখন শিলা ভাবী এসে বললেন- কিরে এসেই ছাগলের খুঁটি গেড়ে বসে পড়লি। এই নিয়ে কতজন তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। আমি ইশারায় রেবা ভাবীকে দেখালাম ।বললাম- ভাবীর কাছে রিমির কথা শুনছিলাম। । তখন শিলা ভাবী আমার গায়ে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আহারে রিমিটার জন্য দুঃখ লাগে। দোয়া করি আমাদের ঘরে ঘরে যে রিমিরা রয়েছে তাদের জীবনটা যেন অমন না হয়। আমারা দু’জন পরস্পরের দিকে যে চাহনিতে তাকালাম তাতে মনে হল এক আলোকিত দিনে দাঁড়িয়েও সন্তানের অনাগত ভবিয্যতের কথা ভেবে এক অনিশ্চয়তার অন্ধকার মেঘই যেন ভেসে উঠলো মনের কোণে সব ছাড়িয়ে।
বিষয়: বিবিধ
১৭২৫ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মর্মস্পর্শি লিখাটির প্রসঙ্গে এতটুক বলতে পারি। আমরা আমাদের ঘর ও পরিবারের মধ্যে যে ইসলাম এর বিরোধি চর্চা করছি আল্লাহতায়লা সামাজিক,অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারই শাস্তি দিচ্ছেন মনে হয়।
অসনে বসেন খৃষ্ট তোমরা, হিন্দু তোমরা সভ্যতায়
তুমি মুসলিম! যাহারে দেখিয়া ইহুদিও লাজে মরিয়া যায়।
নির্যাতিত সব নারীদের আল্লাহ হেফাজত ও সুখি করুক।
একটা সুন্দর সমাজের প্রত্যাশায় আমরা যারা স্বপ্ন দেখি, বিশ্বাস করি, কাজ করি কবে আসবে সেই সমাজ? আমাদের ঘরে ঘরে কোরআন থাকলেও তার সঠিক আদর্শ আমাদের চরিত্রে, সমাজে নেই! আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন!
শুকরিয়া আপু
পাশাপাশি আল্লাহর বানী দিয়ে মুড়িয়ে যে শিক্ষা রেখে গেলেন লেখার প্রান্তে তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
পাশাপাশি আল্লাহর বানী দিয়ে মুড়িয়ে যে শিক্ষা রেখে গেলেন লেখার প্রান্তে তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। একমত জ্ঞাপন করলাম।
আপুকে ধন্যবাদ, কাহিনীটা শেয়ার করার জন্য, যাতে অনেক মা বাবাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আল্লাহ আপনার লিখনীকে সব সময় এমন শিক্ষণীয় করে প্রকাশের তৌফিক দিন, আমিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন