ছুটেছি যখন শিকড় পানে ( জার্নি টু নানা বাড়ি) শেষ পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৯ নভেম্বর, ২০১৪, ০৯:৪১:৫৯ রাত
সন্ধ্যায় ছাদে উঠে দেখি আকাশ জুড়ে তারাদের মিটিমিটি দুষ্টমিভরা হাসি যেন উপচে পড়ছে। সেই সাথে চাঁদের নীল জোৎস্না মাখা আলো এক অন্যরকম মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তাকিয়ে দেখি দলে দলে একাধিক ছক্কার বোর্ড নিয়ে বসে গেছে বাচ্চারা। বড় আপুর বড় ছেলেটি আমাকে দেখে বললো- খালামণি, এত গুলো বাচ্চাকাচ্চা এক সাথে হৈ চৈ করলে মুরুব্বিদের কানের বারোটা বেজে যাবে । তাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা নিলাম। মায়াবী নীল চাঁদোয়া আলো, মোমবাতির আলো আবার মোবাইলের আলো সব মিলিয়ে খেলোয়াড়দের সমস্যা হচ্ছিল না। আমি কোলাহল এড়িয়ে সেই নিকষ কালো রাতের অচেনা অবয়ব উপভোগ করছিলাম একাকী হেঁটে হেঁটে।সুবহানাল্লাহ! দিন রাতের পালা বদলে কত কি বৈচিত্র লুকিয়ে আছে। একসময় দুর্নীতির অভিযোগে খেলা আর বেশী দূরে এগুলো না। এরই মাঝে অবশ্য বাজার হতে নিয়ে আসা ডজন ডজন গাবের সুমিষ্টতা সবার মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো।
সবাই হৈ চৈ করে নিচে নেমে আসার পর দেখি বড় আপুর ছোট ছেলেটা সবাইকে নিয়ে ড্রইং রুমে আসর বসিয়ে দিল। ও সারাদিন কি কি দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করেছে তার সচিত্র প্রদর্শনী চলল। আমি ও যোগ দিলাম ওদের সাথে। হঠাৎ একটি ছবি দেখে আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম- চান্দু, চালাকি করার জায়গা পাওনা না? এত বড় গুঁই সাপের ছবি নির্ঘাৎ তুমি অন্য জায়গা হতে মেরে দিয়েছ। তখন আপুর ছোট ছেলেটি বললো- ছোট খালা এই মাথা ছুঁয়ে বলছি- এটা আসল। আমি ওকে দু’চার কথা শুনিয়ে উঠে গেলাম।
কিন্তু একজনগজীয়মান(উদীয়মান)প্রকৃতিপ্রেমীর উপর এই অভিযোগ উপর ওয়ালা বোধহয় পছন্দ করলেন না। পরদিন বিকেলে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছি হঠাৎ দেখি ভাইয়াদের পাশাপাশি পার্ক করে রাখা গাড়ি দুটোর একটির নীচ হতে মেটে রংয়ের কি যেন বেরিয়ে এলো। আমি তো দেখে দিলাম এক চিৎকার । সবাই চারদিক হতে ছুটে এলো। ইয়া বিরাট এক গুঁই সাপ লম্বায় প্রায় ছোটখাটো একটি কুমিরের মত। মনে পড়লো খুব ছোটবেলায় ও এ আকারের গুঁইসাপ আমি নানু বাড়িতে দেখেছিলাম। জনমানবহীন বাড়িতে আজো তাদের বংশধররা টিকে আছে! আমার ছোট ভাগিনা বললো- খালা, এই বার বিশ্বাস হল। আমি বিস্ময়েরর দরজায় দাঁড়িয়ে মাথা দুলিয়ে ওর ফটোগ্রাফিকে স্বীকৃতি দিতে দিতে বললাম- বাবা, রংয়ের দুনিয়ায় সব কিছুই রং মিশানো মনে হয়রে।
একটু পর আমার বড় মেয়েটি এসে বললো-মা, ছোট নানা ভাইয়া মাথায় পানি দিচ্ছে। আমি দৌড়ে গেলাম। দেখি ছোট মামার চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। আমি ছোট মামার গা ছুঁয়ে দেখি মামার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমি বললাম- মামা, আপনার এত জ্বর আর আপনি আমাদের কিছু বলেননি? মামা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন- নারে মা। একটু খারাপ লাগছিলো। কিন্তু তোদের দেখে জ্বরের কষ্ট একটুও অনুভব করছি না। আমার বাচ্চারা তো এখনো বলে- আম্মু, নানা ভাইয়াটা এত ভালো। গায়ে জ্বর নিয়েও কে খেল কে খেলনা সবার সবকিছু সারাক্ষণ খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। পরদিন আমার বড় মেয়েটি বললো- আচ্ছা আম্মু, উনি ফারুক নানা ভাই নাকি লাতু নানা ভাই? সব কাজিনরা বলছে উনি লাতু নানা ভাই । কিন্তু আম্মু তুমি তো বলেছো উনি ফারুক নানা ভাই। কোনটা সত্যি? আমি হাসতে হাসতে বললাম- ফারুক নানা ভাই আর লাতু নানা একই ব্যক্তির দুটি নাম। আমাদেরএখানে লোকালি ছোট বাচ্চাকে লাতু বলেতো। আমার মেয়েটি উনি লাতু নানা শুনে তো খুবই একসাইটেড। আমি কারন বুঝে মুচকি হাসলাম। আমাদের ছোটবেলার সমস্ত গল্পের হিরো ছিলো এই ছোট মামা। ভুতের সাথে মারামারি, পেত্নীকে ঠেঙ্গানো,দুষ্ট ছেলেদের শায়েস্তা করা, কারো বিপদে আত্নস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া সব কিছুতেই মামা হিরো। সেই গল্প গুলো তো অবসরে বাচ্চারা আমার কাছে শুনেছে।
রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছের জানালা গুলো ভয়ে বন্ধ করে দিলাম।কিন্তু বারান্দায় গ্রিল থাকায় দরজা খোলাই রেখে দিলাম। শেষ রাতে হঠাৎ আকাশ মেয়ের ঝুমঝুম কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধীরে ধীরে আঁধার কেটে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু এর মধ্যে দেখলাম একটি ব্যাঙ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বারান্দায় উঠে এলো। আমি তাকিয়ে আছি ব্যাঙটির দিকে। ওর চিন্তিত ভঙ্গিমায় বারান্দায় পায়চারি দেখে মনে হল এই ঝরঝর মুখর বাদল রাতে নির্ঘাৎ ওর মনে ভাবের উদয় হয়েছে। অনেকটা কবি কবি ভাব ছন্দের অভাব আর কি। হঠাৎ দেখি বেশ ব্যস্ত ভাব দেখিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকে গেল। ওর ঢোকার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হল বৃষ্টির কবিতা লিখতে গিয়ে ছন্দ বা শব্দের অভাব জনিত কারণে আমার মত অখাদ্য লেখকের সাহায্য চাওয়ার কথা মনে পড়েছে । কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে এতক্ষণ বৃষ্টির রিনিঝিনি সুর ঝংকারে বেশ ভাবের উদয় হওয়া মনটা হতে ভাব টাব আমার এক নিমিষে উবে গেল। আমি তো বেরসিকের মত ভয়ে দিলাম এক চিৎকার।বড় আপু ভাবলো কি না কি। দৌড়ে উঠতে যেয়ে দরজার সাথে খেল এক ধাক্কা। সে এক হুরুস্থুল কান্ড।
সবাই যখন জানলো এই ঘটনার মূল নায়ক এক ব্যাঙ তখন আপুরা দু’জনই আমাকে বকতে লাগলো। অবাক কান্ড পরের রাতে ব্যাঙের ভয়ে পাশের রুমে ঘুমিয়েছিলাম। ভোরে বাচ্চাদের নামাজের জন্য জাগাতে গিয়ে আবার ব্যাঙের দেখা। আমি ছোট আপুকে তাড়াতাড়ি উঠালাম। ও চারদিক তাকিয়ে কিছু না দেখে আমাকে বললো- সেই কাল থেকে খালি ব্যাঙ ব্যাঙ করছিস। কোথায় ব্যাঙ? আমি বাথরুমের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাতে ও হেসে বললো- যাক বাবা এটা তো এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। ব্যাঙরা ও ভদ্র হয়ে যাচ্ছে। তাই হাই কমোড ইউজ করতে ওই বাথরুমে এসে ঢুকেছে বোধহয়।। বলে আমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসলো। আমি বেচারা তীব্র অপমান বোধে চুপসে গেলাম।
সকালে দেখি বড় আপুর বড় ছেলেটি পুকুর ঘাটে বসে মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছে। আমি জানতে চাইলে বললো- খালা, এসেছি থেকেই মাছ গুলো তো হাইড এন্ড সিক খেলার চ্যলেঞ্জ করছে। কাহাতক আর লোভ সামলাই। এক লোককে খুঁজে এনে একটি বর্শি বানিয়ে নিলাম। দাম নিয়েছে কত জানো? ১০০ টাকা। আমি অবশ্য ওর বানানোর পদ্ধতিটি দেখে দেখে শিখে নিয়েছি। তাই আর একটি নিজেই বানিয়ে নিলাম। দুঃখ জনক ব্যাপার হল শেষ পর্যন্ত ও বেচারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি মাছ ও ধরা পড়েনি। সুতরাং ওর ১০০ টাকা পুরোই জলে গেল।
সকালের শান্ত পরিবেশে আমরা অনেকজন এক সাথে বাড়ির সামনের পুকুরের সিঁড়িতে যেয়ে বসলাম। এটা ওটা নিয়ে মজা করছি, গল্প করছি। ও বেচারার রেখে যাওয়া বর্শিটা প্রতি মিনিটে মিনিটে এক একজন করে নিজ দায়িত্বে তুলে চেক করে ফাঁকে ফাঁকে মুরুব্বিয়ানা দেখিয়ে। ও পরে এসে অভিযোগ করে বললো- তোমাদের এই অতিরিক্ত নজরদারীতেই মাছেরা সতর্ক হয়ে ফাঁদে পা দেয়নি। এরই মধ্যে হঠাৎ করে কি যেন একটি পুকুরের পাশের জঙ্গল হতে লাফিয়ে বের হল। সবাই এক সাথে বানর বানর করে চেঁচিয়ে উঠলো।
বাড়িতে গিয়ে বাকিদের বানর দর্শনের খবর দিতেই ওরা এমন ভাবে তাকাতে লাগলো যেন আমরা নিজেরাই সার্কাস হতে আগত ওই শ্রেণীর কিছু। আমি আর আমার ছোট ভাইয়ের বউ ছাড়া বাকী সবাই ছিলো পিচ্চির দল। তাই আমি অপারগ হয়ে ওকেই সাক্ষী মানলাম। ও বেচারী ও বললো- হাঁ সত্যি ছোট আপুর সাথে আমি ও দেখেছি। ওমা বড়দের তো সে কি হাসি। বললো- গ্রামের অতিরিক্ত সবুজের ছোঁয়ায় তোদের চোখের পাওয়ার একটু বেশিই বেড়ে গেছে। তাই বেশীই দেখে ফেলেছিস। অদ্ভুত ব্যাপার আমি নিজে আলহামদুলিল্লাহ তিন সন্তানের জননী। আর আমার ভাইয়ের বউ ও কম না। ও বেচারী ও রীতিমত লাইসেন্স ধারী ফার্মাসিস্ট। কিন্তু একেই বলে কপাল বড়দের কঞ্জুসপনার কারণে আমরা ছোটরা কখনই বড় হবার সুযোগ পাই না। সুতরাং আর এক বার হাসির পাত্র হলাম।
ছোট আপুর সাথে গ্রামের বৃষ্টি ভেজা পথে হাঁটতে বেরিয়েছি। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি একটি মা কাঠ বিড়ালির পেছনে দুটি ছোট ছোট কাঠবিড়ালি এগিয়ে যাচ্ছে। আমি তো খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম- এই দেখ দেখ কাঠ বিড়ালি পরিবার। ছোট আপু তাকাতে তাকাতেই ওরা হাওয়া। আপু এবার আমাকে ধমকে বললেন- তুই তো এখনো গাধা রয়ে গেছিস দেখছি। সেই কখন থেকে একবার ব্যাঙ, একবার বানর , একবার কাঠবিড়ালি বলে বকে যাচ্ছিস। লাগাবো ধরে একটা। তোদের লেখকদের নিয়ে সমস্যা। কল্পনার চোখে সব উল্টা পাল্টা দেখিস। আমি তো রীতিমত সমস্যায় পড়লাম। হচ্ছেটা কি এসব। মানলাম আমি সব সময় আমার চারপাশটাকে কল্পনার রং তুলি দিয়ে সাজাতে ভালোবাসি। শুষ্ক জনমানবহীন মরুভূমির এক সময়কার হারিয়ে যাওয়া প্রাণ স্পন্দনকে আমি কল্পনায় সাজিয়ে নিই। সেই হারিয়ে যাওয়া অতীতকে ভেবে বেদনায় বুকটা বোবা কান্নায় উথলে উঠে।এবারের বাংলাদেশ সফরে শাপলা চত্বরের নিরব প্রকৃতি আমায় ফিসফিসিয়ে এক আঁধার রাতের গোপন পৈচাশিকতার গল্প শুনিয়েছিলো। আলোকোজ্জ্বল দিনে বসেই আমি সেই বেদনাভারে অশ্রুসজল হয়েছিলাম। কিন্তু তাই বলে চোখটা এত ধূলো দেবে। আমি রীতিমত অপমানিত বোধ করলাম। মুখ গোঁজ করে আপুর সাথে হাঁটছি। হঠাৎ আমি যেখানে কাঠ বিড়ালি দেখেছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে আমার পিচ্চিটি চিৎকার করে বললো- আম্মু, দেখ কাঠ বিড়ালির ফুট স্টেপ। একটি বড় আর দুটো ছোট । ওমা কি কিউট! মা, কেন কিউটি গুলো আমার জন্য ওয়েট না করে চলে গেল? আমি ওকে সান্তনা দিয়ে বললাম- আমি এ বাড়িতে ঢুকেই ওদের নারকেল খাওয়া নিয়ে অভিযোগ করেছিলাম বলে ওরা মনে হয় অভিমান করেছে। ছোট আপু ভালো করে খুঁটিয়ে পায়ের ছাপ গুলো দেখে বললো- যাহ এবারের মত ভুল দেখার অপবাদ হতে তোকে অব্যাহতি দেয়া গেল।
বিকেলে ছাদে উঠে দেখি আমার বড় ভাগীনা একটি লম্বা বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললাম- এই লম্বা বাঁশ দিয়ে পেড়ে তো আমড়া গুলো সব ফাটিয়ে ফেলছিস। তোর হাতের নাগালের মধ্যে থাকলে ওখান হতেই পাড়না। ও বললো- খালা, তুমি তো দেখি আম্মুর মতই বললে। ওই বেটা কাঠ বিড়ালির দোষ তুমি ও আমার ঘাড়ে তুলো দিলে?
পরদিন অবশ্য নানা বাড়ির দূর্লভ প্রজাতির অর্কিড তুলে যখন শুকনো নারকেলের মাঝে কাঠবিড়ালির করা গর্তে আমি বেশ দক্ষতার সাথে সেট করে দিলাম। তখন সেটার ন্যাচারাল লুকিং দেখে মনে হল না বাবা ওটা শুধু সর্বভুক প্রাণীই নয়। বরং শিল্পঅনুভূতি ও আছে কিছুটা।
বৃষ্টি আর ভ্যপসা গরমে সবাই যখন হাঁকুপাঁকু করছিলো তখন সিদ্ধান্ত হল গোসল করার। ২/১ জন বাথরুমে ঢুকলো। কিন্তু বাকিরা বললো- বাড়ির সামনের দীঘির মত পুকুরটায় বিশাল জলস্রোতের আহবান ছেড়ে বাথরুমে ওই সীমিত পানিতে গোসল করলে কৃপণতা দেখানো হবে। পুকুরে নামলেই মজা হবে। ছোট ভাইয়া কতক্ষণ ওর বউকে ক্ষেপালো - এই বাংলাদেশের অবস্থা তো জান না। বর্ষায় চারপাশের সবার হাগু গুলো ধুয়ে এই পুকুরে এসে জমা হয়। হিঃ হিঃ। ওর বউ আড়চোখে তাকিয়ে বলল- ছোট আপু নামলে আমি ও নামবো। এই নিয়ে প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে ভোটাভোটি হল । মজার ব্যাপার হল পুকুরের জলটলমল হাতছানি কেউ উপেক্ষা করতে পারলনা । শেষ পর্যন্ত প্রায় সবাই নামলো। আমরা মেয়েরা ভেতরের ঘাটের সিড়িতে বসে দূরে ভাইয়াদের পুকুরে নামার দৃশ্য দেখছি। বড় ভাইয়া নামার প্রস্তুতি নিতেই ছোট আপু হাসতে হাসতে বললো – এই দেখ দেখ ভাইয়ার মাথার দিকে। আমি আর ছোট ভাবী তো হেসে সারা। কেন হেসেছি প্রিয় পাঠক সেটা কিন্তু সিক্রেট। বড় ভাইয়া জানলে ছোট বেলার মত শাস্তিও বরাদ্দ হয়ে যেতে পারে।
দুপুরে মজার ব্যাপার ছিলো ছোটভাইয়ার পক্ষ হতে সারপ্রাইজ পার্টি। রীতিমত আয়োজন করে আমাদের গ্রামের নিজ বাড়িতে পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রকমারি খাবারের বন্যা বয়ে গেল। এর মধ্যে আমার হ্যজব্যন্ড আমাকে এসে বললো আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার যখন খাবার, বাবুর্চি এটা সেটা সব কিছুর হিসেব দিচ্ছিল তখন এক পর্যায়ে বললো হ্যন্ডেল খরচ ..। আমার হ্যজব্যন্ড বুঝতে না পেরে বললো- আপনি এত টাকার কিসের হ্যন্ডেল কিনলেন। লোকটি তখন বসার জায়গার সামিয়ানার দিকে ইশারা করে বললো- গেরাম হইলেও হ্যন্ডেল খরচ তো কম অইতো নো। আমার হাজব্যন্ড বললো তখন আমি মনে মনে বুঝলাম তোমাদের এখানে ‘প’ কে তো ‘হ’ বলে। তাই ভদ্রলোক আসলে ‘প্যন্ডেল’ বুঝিয়েছেন। আমি ওর কথায় একটু অদৃশ্য খোঁচা অনুভব করে বললাম- থাক থাক তোমাকে প আর হ এর তরজমা করতে হবে না। পানিকে হানি বানিয়ে খেলে তার স্বাদ যে কতগুণ বেশী লাগে সেটা তো বুঝা তোমার কম্ম নয়। নানু বাড়ি হতে আমাদের বাড়ি ২০/২৫ মিনিটের মত লাগে। তাই আমরা বললাম- চল সবাই দল বেঁধে হেটে যাই। বড় ভাইয়া বললেন- না না মাথা খারাপ। যাওয়ার পথে বাজার পড়বে। লোকজন সব হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। সবাই গাড়িতে উঠো। আমি বললাম- ঠিক আছে আপনারা যদি ফ্রি সার্ভিস দিতেই চান নিতে তো সমস্যা নেই। সুতরাং প্রায় ৩০/৪০ জন মানুষকে ভাইয়ারা দু’জন দুই গাড়িতে টেনে টেনে পিকনিক স্পটে পৌঁছালো। ছোটবেলা হতে গ্রামের বাজার আমার খুব আকর্ষণের স্থান। লাল হলুদ রংয়ের কত কত জিনিস ঝুলিয়ে রাখে দোকান গুলোয়। আর মানুষ গুলো ও কত বিচিত্র। গাড়ির ভেতর হতে তাকিয়ে অবাক হলাম বাজারের অবস্থা আর সেই রকম নেই। রীতিমত কাঁচের গ্লাস দেয়া দোকান গুলোতে বেশ শহুরে অত্যাধুনিক ভাব। খাওয়ার পর সবাই দলবেঁধে সুপারি বাগানে যেয়ে বসলাম। এক সময় আমার মায়ের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে করা বাড়িটি এখন এক রকম পরিত্যক্তই। দেখা শোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার আছে। লোকটি প্রায় শ’খানেক ডাব পেড়ে আনলো। সুতরাং বিকেলে সবাই মিলে কচি ডাব খাওয়া হল ইচ্ছে মত। প্রায় শ’খানেকের উপরে সুপারি গাছের সারি একপাশে।তারই পাশে বয়ে যাওয়া খালে মাছের পোনাদের ছুটাছুটি। সেগুনের পাতার ফাঁকে বহমান ঝিরঝিরে হাওয়া। খাল পেরিয়ে দিগন্ত জুড়ে সবুজ ধানের মাঠ। সীমানায় অগুনতি বাবুই পাখির বাসা নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছ। ভালো লাগার এক সুতীব্র আবেশে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা যেন মনের অন্তস্থল হতে ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো। মনে হচ্ছিল ব্যস্ততাহীন সেই মনমাতানো উপভোগ্য অবসরে যদি বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যেত! বাচ্চারা কোথা হতে বাবুই পাখির বাচ্চা, মাছের ছানা ধরে নিয়ে এলো।
আমার ছোট মেয়েটির সাথে তো ছোট মামার খুব সখ্যতা হয়ে গেল। বার বার অঙ্গীকার করাতে লাগলো আমাদের সাথে আসার জন্য। মামা বললেন- দেখনা আমার ছোট কুইনটা কি করছে আমার জন্য। আমি বললাম- মামা আল্লাহর ঘর দর্শন আর তোমার কুইনের সাথে করা ওয়াদা ভুলে যেওনা যেন।এক সময় ফেরার সময় হয়ে গেল। ছুটির অবসর শেষে সবারই যার যার খোঁপে ব্যস্ততার জালে নিজকে জড়িয়ে নেবার ডাক আসতে শুরু হল। পরদিন সকালে ছলছল চোখে নানু, সেজমামী,কাজিনরা আর ছোট মামা আমাদের বিদায় জানালেন। আমি নিজের বেদনাবোধকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে বললাম-মামা, আপনি আর ক’দিন থাকবেন? মামা বললেন- না, না, থাকার প্রশ্নই আসেনা। তোরা চলে গেলে খুব খারাপ লাগবে। আমরাও একটু পর বাড়ি ছাড়বো। আমি বিশাল বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম টানা দুই দিন ভীষণ ব্যস্ততা আর হৈ চৈ এর পর বাড়িটির আবার সুদীর্ঘ নিরবতার ভাঁজে নিজকে জড়িয়ে নেবার সময় হয়ে এলো। ফিরতে শুধু করলাম সবাই অন্য রকম দু’টি দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজ নিজ ব্যস্ততার জোয়াল কাঁধে নেব বলে।
- সমস্ত কৃতজ্ঞতা সেই প্রভুর জন্য যিনি আমাদের সবাইকে সেদিন এক সাথে জড়ো হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
- যৌথ ভাবে ধন্যবাদ রইলো ছোট মামা আর ছোট ভাইয়াকে এত মজার একটি আয়োজনের জন্য।
- ধন্যবাদ বড় আপুকে আমাকে সময়মত বেরসিক ব্যাঙের কবল হতে রক্ষায় অপরিসীম সাহসিকতা দেখানোর জন্য।
- বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ রইলো ছোট ভাইয়ার জন্য পিকনিকে ওরকম মজার মজার খাবারের আয়োজনের জন্য। দোয়া করি আল্লাহ ওকে বাচ্চা কাচ্চায় ঘর ভরিয়ে দিন। আর ওদের বিয়ে উপলক্ষে সারা বছর যাতে ওরকম মজার খাবার খাওয়ার জন্য আল্লাহ আমার দাঁত গুলোকে মজবুত রাখেন।
- ছোট আপুর সাথে অলিখিত সময়ের জন্য আড়ি আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে বিদ্রুপবানে জর্জরিত করার জন্য।
- ধন্যবাদ পাঠকদের এই অখাদ্য লিখার সাথে থাকার জন্য।
বিষয়: বিবিধ
২০৪০ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগা রেখে গেলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সেই শান্ত-শিতল শ্যামল পরিবেশ যেন চোখের সামনে ভাসছে।আমি যদিও আশৈশব শহরের অধিবাসি তবে আমার শৈশবে পরিবেশ একই রকম ছিল। আমাদের বাড়িও ভর্তি ছিল বিভিন্ন গাছপালায়।
ভাগ্য ভাল যে ব্যাঙ এর সাথে তার খাদক তথা সর্প হাজির হননাই! যদি হতো তাহলে কি হইতে পারে সেটা চিন্তা করার চেষ্টাও করলাম না। প আর হ শুনেই বুঝেনিয়েছি আপনার বাড়ি কোথায়!!! কাঠ বিড়ালি ও গুইসাপ বেশি রেয়ার না হলেও বান্দর দেখা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। দিঘির টলটলে পানি এখন যেন সপ্ন। সবকিছুর মধ্যেও আপনি ভুলেননি শাপলা চত্বর কে।
এমন লিখাই যেন আমাদের সবার মনের সব দুঃখ ভুলিয়ে নতুন সপ্ন দেখায়।
প্রাণ ছোঁয়া আর হৃদয় নিংড়ানো লেখা।
তবে লেখাটা কিন্তু সুন্দর হয়েছে।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন