অন্যরকম একটি ঈদ স্মৃতি
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০৩:৩০:৫৩ দুপুর
মা বাবার যুগলবন্দী পথচলার ধারাবাহিকতায় জীবনের নিয়মেই জীবন তরীর নাওটা ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে আসে। প্রায়শই ভাবি কোথায় ছিলাম? কোথায় এলাম? একসময় আম তেঁতুলের ভর্তা নিয়ে হাতাহাতি, কাড়াকাড়ি করে খাওয়া ভাইবোনরা সবাই আজ পরস্পর হতে কত দূরে.....জীবনের জোয়ার ভাটার টানে টালমাটাল সময়ে হাফ ডজন ভাই বোনের এক জোড়া ছিটকে গেছি স্বদেশ ছেড়ে। বাকীদের ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের দূরত্ব ডিঙ্গিয়ে সময় হয়ে উঠেনা প্রিয়জনদের সান্নিধ্যের।অথচ নীল চাঁদোয়া আকাশটা আর চিরচেনা চাঁদ, সূর্যটা তো প্রতিদিন তার বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখা অগুনতি স্মৃতির পসরা নিয়ে কাছের দূরের সবার কাছেই থাকে সমান ভাবে দৃশ্যমান।
প্রিয়জনদের কাছে না পাওয়ার বেদনা অনেক বেশী বুকে বাজে প্রিয় কোন দিনে। তাই ছোটভাইয়া এবার দেশে যাবার প্ল্যান করল ঠিক ঈদুল ফিতরের ঈদকে সামনে রেখে। পরিকল্পনামত আমার দেশে যাবার ঠিক দু'দিনের মাথায় ভাইয়া ও স্বস্ত্রীক দেশে পৌঁছে গেল।ইচ্ছে সব ভাইবোন ছোটবেলার মত একসাথে ঈদ করবো।।মেঝ আপুর মেয়ের বিয়ের যোগাড়যন্ত্রের ফলে ব্যস্ততা দেখিয়ে না আসার অজুহাত আমরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলাম। মুখে দক্ষ চালিয়াতের ভান ধরে আমি আর ছোট ভাইয়া বললাম, আমরা যেহেতু মুসাফির। তাই পেটে ভাতের নিশ্চয়তা দিলেই আমি আর ছোট ভাইয়া বিয়ে বাড়ির সমস্ত কাজে ফুলটাইম মজুরি খাটতে রাজি। এদিকে নতুন জামাই ছোট মামা আর ছোট খালামণির কাছে অতিরিক্ত ভালোমানুষী দেখাতে বউকে তিনদিন আগেই প্লেনে পাঠিয়ে দিল। মেয়েটিকে আলহামদুলিল্লাহ মহান প্রভু এই বয়সেই বিয়ে ছাড়া ও মাতৃত্বের গুরু দায়িত্বের ভার দিয়ে দিয়েছেন। কষ্ট লাগলেও হাস্যকর ব্যাপার হল, যে যানজট এড়াতে জার্নি বাই বাস না হয়ে জার্নি বাই প্লেন হল ব্যাপারটা কিন্তু হয়ে গেল যে কপাল সে মাথার মতই। অর্থাৎ কিনা সেই প্লেন ডিলে হয়ে সর্ব সাকুল্যে ৫/৬ ঘন্টার ধকল সেরে মেয়েটি যখন বাসায় ফিরলো তখন সে পুরো শয্যাশায়ী। হায়রে বাংলাদেশ...
চার জায়গা হতে ৬জন ভাই বোন সব জড়ো হলাম ঈদের দিন সকালে আম্মার বাসায়। ছোট ভাইয়ার শত কড়াকড়ি স্বত্তে কাকডাকা ভোরে হাজিরার খাতায় লেট তো হলই। ওমা সবার বাচ্চাকাচ্চা জড়ো হয়ে দেখি রীতিমত ভাম্যমান চাঁদাবাজ কমিটি গড়ে তুললো। উদ্দেশ্য ঈদ মানি খসানো। ভাগ্যিস ইতিমধ্যে সবাই ব্যাংকার ছোট দুলাভাইর কাছ হতে নতুন টাকা সংগ্রহ করে নিয়েছে। গ্রাহকের লিস্ট লম্বা হওয়াতে ছোট দুলাভাই যখন টাকা দিতে টালবাহানা করছিলো তখন সবাই বললাম- আমরা কিন্তু তোমাদের ব্যংকের আইনসম্মত গ্রাহক। সুতরাং ...
আমার, ভাইয়া ও আপুদের মিলিয়ে প্রায় ১৫ জনের এই চাঁদাবাজ দলকে আমিই প্রথম ঈদমানি দিয়ে চাঁদা চাওয়ার বৈধতা দিলাম। এর মধ্যে ছোট ভাইয়া দুষ্টটা ছোটদের একজনের হাতের ফাঁক দিয়ে নিচু হয়ে লাইনে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে বললাম- এই আমার হিসেবের বাইরে একজন গ্রহীতা সংখ্যা বাড়লো কি করে। বাচ্চারা এবার হেসে উঠলো এক সঙ্গে। বলল- আম্মু, এটা ছোট মামার হাত। এরপর টাকা বিতরণের পালা ছোট ভাইয়ার। বাচ্চারা আবার যেয়ে ওর কাছে লাইন ধরলো। ভাইয়া পাশের রুম হতে ঘোষণা করলো - টাকা গ্রহনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আমার লিস্ট অনুযায়ী এখনো একজন গ্রহীতা এসে পৌঁছায়নি। তাকে তাড়াতাড়ি আসতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। বাচ্চারা সবাই সবাইকে গুণে বললো - মামা, আমরা সবাই আছি। ছোট ভাইয়া তখন আমাকে টেনে লাইনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো- এটাতো আসল ফকির। আমি আমতা আমতা করে বললাম- এই না না। আমি তো বড় হয়ে গেছি। আমার ঈদ মানি লাগবেনা। ভাইয়া তখন হাসতে হাসতে বললো- কিন্তু আমার কাছে তো তুই ছোটই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন পাঠক এই সুযোগে নগদ কিছু টাকা আমার হস্তগত হল।
এবার বড় ভাইয়ার পালা। ওমা আলহামদুলিল্লাহ আজকের দিনটা আমার জন্য সত্যিই শুভ। এবারো গ্রাহকের তালিকায় আমার নাম। আর একবার অর্থ যোগ। এরপর দেখি মেঝআপু আমাকে খুঁজছে। বললেন- এই তোর টাকাটা এখনো নিলিনা। আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললাম- আপু, আমি তো বড় হয়ে গেছি। আপু কপট রাগ দেখিয়ে বলল- হু আমার জানা আছে তুই যে কত বড় হয়ে গেসিছ। ধর, ধর।এর পর আব্বু- আম্মুর পক্ষ হতে ভাইয়া ,ভাবী, আপু, দুলাভাই আমার উনি, বাচ্চারা সবার আর এক পশলা অর্থ যোগ হল। এভাবে একাধিক বার অর্থ প্রাপ্তি হল।
একটু পর বড় ভাইয়া দেখি বললেন- এই সবাই এসো। অর্থ বিতরণের পালা শেষ। এবার বস্ত্র বিতরণ। আমি ভাবলাম ভাইয়া বুঝি মজা করছেন। আমি আব্বার পাশে বসেই রইলাম। তখন ছোট আপু খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলল- এই আয় না। বড় ভাইয়া ডাকছে। ওমা এযে দেখি সত্যিই বস্ত্র বিতরণ। আমাদের সব বোন ও ছোট ভাবীকে থ্রীপিস তুলে দেয়া হল। সেই সাথে হোম টেক্সটাইলের বেড়শিট। ব্যগটা যে বয়ে আনাই মুশকিল হয়ে গেল। আমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য একাধিক কালার দেখাতে গিয়ে আমার ভাগে বেড়শিট বেশি পড়ে গেল। বড় ভাইয়া দুষ্টমি করে বলল- ওকি তুমি সব গুলোই বাগিয়ে নিচ্ছ যে? ছোট আপু আমার হয়ে ওকালতি করে বলল- বুঝলেন না? জিনিস যার হাতে যায় তার।
বড় আপুর বড় ছোলেটা ঈদ মানি দিতে সব বিশ টাকার নোট করে এনেছিল। ওর কাছে বাচ্চারা যে চায় তাকে একটি করে নোট দেয়। বাচ্চাদের তো সেই টাকার অংককে আমাদের বড়দের মানে আনতে গলধঘর্ম অবস্থা। আমার ছোট মেয়েটি এখনো টাকা ভালো চেনেনা। ও বার বার যেয়ে ভাইয়ের কাছ হতে একটি করে বিশ টাকার নোট নিয়ে আসে। এভাবে মনে হয় প্রায় ১২০ টাকা খসিয়েছে সর্ব সাকুল্যে। কিন্তু ওর এখনো ধারণা সবচেয়ে বেশী টাকা ওকে ভাইয়াই দিয়েছে। যেহেতু নোটের পরিমাণ ছিল বেশী। আর বাচ্চাদের মধ্যে বড়গুলো ওর ফাঁকিবাজি ধরতে পেরে রেগে বললো- ভাইয়া, তুমি এত কিপ্টে বলেই তোমার এখনো বিয়ে হচ্ছে না।
বিকেলে সবাই মিলে চলে গেলাম সমুদ্র সৈকতে।কতদিন পর আবার সেই চিরচেনা সাগরের কাছাকাছি! মনে হল কত অব্যক্ত কথা জমে আছে শুনবার ,শোনাবার। সবুজের পেলবতামাখা গাছপালা আর দিগন্তে সাগরের বুকে ঝুঁকে এসে আকাশের গোপন কানাকানি দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল। স্রষ্টার শুকরিয়ার নতজানু হয়ে মনে মনে বললাম- তোমরা আল্লাহর কোন কোন নিয়ামত করবে অস্বীকার।
সম্মানিত পাঠক, সেদিন আমি সর্বসাকুল্যে দশ হাজার টাকা ঈদ মানি পেয়েছিলাম। বাচ্চারা এক একজন প্রায় আট হাজার করে। আলহামদুলিল্লাহ একদিনের ইনকাম মন্দ নয়। কি বলেন?
আমি আল্লাহর পথে দানের উপর বইটি লিখতে গিয়ে বুঝেছি টাকা পয়সা এক পথে বান্দার কাছে আসবে। আর অন্যপথে তা বেরিয়ে যাবে সৃষ্টির কল্যাণে। তাই এবারের ঈদুল আযহার ঈদের আগে বাচ্চাদের বললাম- আমি আমার ঈদ মানি হতে একটি কুরবানি দেবার নিয়ত করেছি অসহায় দুস্থদের জন্য। তোমাদের তো বেশ কিছু ঈদ মানি জমা আছে। সেখান হতে যাদের কিছু নেই তাদের জন্য কি কিছু দেবে? আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চারা বলল- মা, সবগুলো টাকাই দিয়ে দাও। আমি তখন ভাগ করে ওদের তিনজনের টাকা হতে দুস্থদের জন্য একটি কুরবাণীর টাকা দিলাম। আর কিছু রাখলাম প্যলেস্টাইনের জন্য। রিয়া আল্লাহ পছন্দ করেন না। তবে আল্লাহ অন্তরযামী। শুধু প্রাপ্তি নয়। দেবার মাঝে ও যে সুখ রয়েছে সে অনুভূতিটি শেয়ার করার জন্যই শুধু লিখলাম। আর মা হিসেবে আমি একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমিহীন সময়ের কোন এক বাঁকে যখন ইনশাআল্লাহ আমার বাচ্চারা বড় হবে তখন আজকের দিনের এই স্মৃতি সেদিনও তাদেরকেও দানশীলতার পথ নির্দেশ করবে।
বিষয়: বিবিধ
১৯১১ বার পঠিত, ৬৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
িঈদ মানির খরছের যে হিসাব দিয়েছেন - তা রিয়া হবে কেন। এটা ছিল জরুরী।
আমাদের সবাই এই দায়িত্বটা পালন করতে পারলে সমাজের চেহারা ভিন্ন হত।
আপনাকে - আপনার উনাকে সহ সবাইকে ঈদ মোবারক।
আপনাদের ভাইবোনদের কড়চা পড়ছিলাম মজা করে। ভাই বোনেরা একসাথে হলে যে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয় , এই সুখানুভুতি অন্য কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা। আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে আপনাদের এই বন্ধনকে অটুট রাখুন....
একটানেই পড়েছি- হিংসা হচ্ছে খুউব..
আমরা দু-হালি ভাইবোন আম্মার ইন্তেকালের পরে আর একত্রিত হতে পারিনি
এমনই হোক বাংলাদেশের সকল পরিবার
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকিল্লাহ
যে স্থানটি বুঝতে বেশ মাথা ঘামাতে হয়, সেটাই কোট করে দিলাম। অনেক মাথা ঘামিয়ে বুঝলাম যে, মেয়েটার বিয়ে আগেই হয়েছে, এখন সবার উপস্থিতিতে, ফাংশান হবে, তাই না আপু? আর জামাইবাবু ঢাকা থেকে প্লেনে তুলে দিয়েছে তাই না?
আল্লাহ্ আপনার বর্তমানেই আপনার সন্তান্দের দ্বারা আপনার চক্ষু শীতল করুন সেই দোয়া করি।
অবশ্য আপনার চক্ষু শীতল হলে দুলাভাইর চক্ষুযে হিম শীতল হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এমন কথয় কেউ লজ্জা পায়কিনা তাই বললাম না।
আমরাও যেন আপনার ঈদের দিনে্র অংশিদার হলাম।
শেষের প্যারাটা পড়ে এক অন্যরকম অনুভুতি হলো। দোআ করি আপনার সন্তানদের জন্য যেন গরীব অসহায়দের পাশে থাকতে পারে সবসময়। আমার জন্যও দোআ করবেন আপু।
ঈদ মানি এবনহ বস্ত্র বিতরন প্রজেক্ট পড়ে খুব ভালো লাগলো, টারচাইতে ভালো লাগলো আপনাদের করা কোরাবানী! আল্লাহ এই আমালগুলোকে কবুল করে নিন! আমীন! [-
o<
স্টিকি পোস্টে অ ভি ন ন্দ ন
কি যে ভাল লাগল দারুন ঈদটি কাটানোর কথা শুনে। মনে হচ্চিল আমিও সেখানে থেকে উপভোগ করছিলাম। আল্লাহ আপনার ও পরিবারের ও সমস্ত স্বজনদের উপর সর্বদা রহম করুন
আলহামদুলিল্লাহ ।
আপনার এই উদ্দশ্যটি সফল হোক আর আমাদের এ পারিবারিক বন্ধনটি অটুট থাকুক এই কামনা করি৷
দির্ঘদিন পর ব্লগে আসলাম, এসেই আপনার এই চমৎকার লেখাটি পড়লাম। অনেক ভাল লেগেছে!
ধন্যবাদ আপনাকে চমৎকার লেখাটির জন্য ।
(দোয়ার দরখাস্ত রইল)
দেশে আমার চাকুরী জীবনের পুরো বোনাসের টাকাটাই, আত্মীয় অনাত্মীয়কে পোষা্ক ও নানাবিধ জিনিষ কিনে দেবার পিছনে ব্যয় করতাম। সবার আনন্দ দেখে খুবই উৎফুল্ল হতাম........ আপনার সুন্দর লেখাটির জন্য আবারো অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন