কাজের মেয়ে সমাচার
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৩:১৭:৪৮ দুপুর
ইদানিং প্রায়ই অভিযোগ শুনি,বাসায় কাজ করানোর জন্য কাজের ছেলে মেয়ে পাওয়া যাচ্ছেনা। এই বিষয়টি নিয়ে গত কিছু দিন ধরে আমার চিন্তার আলোকেই আজ লিখতে বসা।
একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। একবার আমার ছোট আপু একটি বাসা ভাড়া নিলো। উল্লেখ্য বাড়িওয়ালা ছিলো এক দারোগা। বাসাটি দেখতে বেশ সুন্দর ও প্রশস্ত। কিন্তু কেন যেন দীর্ঘদিন ফ্ল্যাটটি খালিই ছিলো। যদি ও ভাড়া নেয়ার আগে টুকিটাকি কিছু কথা কানে এসেছিলো বাড়িওয়ালাকে নিয়ে। কিন্তু ভাড়া নেবার পর দেখা গেল বাড়িওয়ালি ও তার পরিবার সবাই ভীষণ ভালো মানুষ। আপুর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। ভদ্রমহিলা ওকে ভীষন স্নেহ করতেন। তার বাচ্চারা ও নতুন আন্টির জন্য পাগল ছিলো। আর আমার আম্মু যখনই আপুকে দেখতে যেতেন বাড়িওয়ালি অভিযোগ করে বলতেন- খালাম্মা, শুধু এক মেয়েকে দেখে চলে গেলে হবে না। এখন হতে বড় মেয়ের ও খোঁজ নিতে হবে। মোটকথা বেশ ভালো ও ঝামেলামুক্ত ভাবেই প্রথম ৭/৮ মাস কেটে গেল।
এর মধ্যে একদিন আমি আপুর বাসায় বেড়াতে গেলাম। আপু বলল- এই জানিস আমি না একটি সমস্যায় পড়েছি। আমি জানতে চাইলাম - কি ব্যাপার? আপু তখন বলল- জানিস বাড়িওয়ালির কাজের মেয়েটিকে আমি বেশ আদর করি। যখনই আসে এটা ওটা খেতে দিই। মেয়েটি ও মনে হয় আমাকে খুব পছন্দ করে। গত বেশ কিছুদিন হতে বলছিলো আমাকে কি যেন বলতে চায়। এই করতে করতে গত কাল বিকেলে এসে বললো- খালাম্মা,আফনেরে একটা কতা বলতাম। আমার খালাম্মারে কইয়েন না। আমাগো দারোগা খালুর চরিত্র ভালো না। যহন তহন আমারে ডিস্টার্ব করে। আমি খালাম্মারে কইয়া দিমু কইয়া ডর দেহাই। অহন তো আমার খালাম্মা ডেলিভারীর লাইগা বাপের বাড়িতে যাইবো। কইছে বাচ্চা ৪টারে আর আমারে রাইখা যাইবো খালুর জন্য রান্ধনের লাইগা। আমার তো এহন ডর লাগতাচে। আফনে খালাম্মারে যদি একটু বুঝাইয়া কইতেন আমারে উনার সাথে নিয়া যাইতে। আমার নাম কইয়েন না। তাইলে আমারে মারবো।
আমি শুনলাম। এই সব ভদ্রতার মুখোশ পরা অভদ্রদের কথা ভাবলাম। এরপর আপুকে বললাম- এমন ভাবে কাজটি করতে হবে যাতে সাপ ও না মরে। আবার লাঠি ও না ভাঙ্গে। মহিলাকে তুমি যে করে হোক বুঝিয়ে বল সে যেন তার সেবার জন্য কাজের মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যায়।
এরপর একদিন সুযোগ বুঝে আপু ভদ্রমহিলার সাথে কথা তুললেন। মহিলা বললো- ভাবী, বুঝেনই তো এ বয়সে বাপের বাড়িতে চারটে বাচ্চা নিয়ে যাওয়া তো ঝামেলা। তাছাড়া ভাইয়ের বউই বা কি মনে করবে। তাই ভেবেছি কাজের মেয়েটিকে রেখে গেলে সেই সংসারটা দেখে রাখবে। আপু বিভিন্ন ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলো। এরপর বললো- না হয় আপনার মা'কে আপনার বাসায় নিয়ে আসুন। মহিলা জানালো - তা সম্ভব নয়। আপু তখন আমতা আমতা করে বললো- ভাবী কিছু মনে করবেন না। আপনার কাজের মেয়েটির বয়স ১৫/১৬ এর কম হবে না। আর দেখতে ও বেশ সুন্দরী। তাই বলছিলাম মেয়েটিকে এভাবে রেখে যাবেন। দিনের কোন সময় আপনার স্বামী শুধু একা ঘরে থাকবে। আবার কখনো আপনার ছেলেটি একা থাকবে। একটু কেমন না ব্যাপারটি। আর ইসলামে ঠিক এভাবে রেখে যাওয়াটা সাপোর্ট ও করে না। মহিলা একটু বিরক্ত হয়ে বললো - রাখুন ইসলাম। আমি জানি আমার ছেলে কেমন। আর আমার স্বামীর মত ফেরেশতা স্বভারের মানুষ হতেই পারে না।
সম্মানিত পাঠক, ইসলামকে অমান্য করে ঠিক এই ধরনের মনোভাবের কারণে আমাদের দেশে কাজের মেয়েকে নিয়ে অনেক ঘটনা শোনা যায়। আমি বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতা হতে ও অনেক ঘটনা শুনেছি। যার জন্য আমি মনে করি এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য কাজের মেয়ে নয়।বরং গৃহকর্তী মহিলারাই দায়ী।
যাই হোক আপু যখন কিছুতেই বোঝাতে পারলেন না তখন একটু দূর হতে মহিলার স্বামী সম্পর্কে আভাস দিতেই মহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল- আপনার কি করে সাহস হল আমার স্বামী সম্পর্কে এ সব কথা বলার। এ জন্যই তো বলি আমার মেয়েটি এত ঘন ঘন আপনার বাসায় কেন আসে? বেয়াদবটাকে আজ মজা দেখাবো। আর আপনিও ভুলে যাবেন না আমার স্বামী দারোগা। ওর ক্ষমতা কত জানেন?
রীতিমত থ্রেট। এরপর কয়েকদিন কাজের মেয়েটির আর দেখা নেই। ও বাসার কেউ আসে না আর। ৩/৪ দিনের মাথায় আপু বাইরে বের হতে নিয়ে কাজের মেয়েটির মুখোমুখি পড়লো। আপু শিউরে উঠলো মেয়েটির মুখ, হাত দেখে। সারা মুখ, হাতে মারের দাগ, কাটার দাগে ভরে আছে। মেয়েটি নির্বাক দু'টি চোখ তুলে ছলছল দৃষ্টিতে আপুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দ্রুত সরে গেল। আপু তো মেয়েটির অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেললো। ওর কাছে মনে হতে লাগলো মেয়েটির এ অবস্থার জন্য ও নিজেই দায়ী। এদিকে বাড়িওয়ালী ও বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলো। আশে পাশে নুতন বাসা খুঁজতে গিয়ে শত মুখে অনেক তথ্য জানা গেল। সবাই জানালো মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার আর কাজের মানুষকে নির্যাতন এই পরিবারের স্বাভাবিক ব্যাপার। একবার নাকি ৭/৮ বছরের একটি ছোট কাজের ছেলেকে নির্যাতনের এক পর্যায়ে সে মারাই যায়। তখন তারা ময়লার ট্যাঙ্কে লাশটি গুম করে ফেলে। ছেলেটির গরীব বাবা আশে পাশের লোকজন নিয়ে বাড়ির সামনে বিচারের দাবীতে বেশ হৈ চৈ ও করেছিলো। পরে দারোগার ক্ষমতার দাপট এবং পুলিশী ভয়ে আর আসতে সাহস পায়নি।
ঘটনা ২- আমার বিয়ের পর এক বেশ অত্যাধুনিকা এক মহিলা প্রায়ই আমার সাথে গল্প করতে আসতেন। তিনি আমাকে বেশ স্নেহ করতেন । আমার ও তাকে বেশ ভালো লাগতো। কিছু দিন পরে তার এক ক্লোজ আত্নীয়ের মুখে শুনলাম ভদ্র মহিলা নাকি বেশ শক্ত টাইপ মানুষ। একবার নির্যাতন করতে করতে কাজের মেয়েকে মেরে ফেলেছিলেন। আর পরে পুলিশকে টাকা খাইয়ে সব কিছু ঢাকা ও দিয়ে দিয়েছেন।
ঘটনা ৩ -আমার এক আত্নীয়ের বিয়ের পর তার এক বিশেষ আত্নীয় সম্পকে পারিবারিক সোর্স হতে জানলাম, ভদ্র মহিলা কাজের মেয়েকে প্রায়ই পিটাতেন। এক পর্যায়ে মেয়েটি মারা যায়। সমাজে একটি বিশেষ অবস্থানে থাকার কারণে খুব সহজে তিনি টাকা দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দেন।
এই তিনটি ঘটনার আলোকে বলবো ,আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রায় অনেক ঘরেই এ ধরনের কাজের মেয়ে নির্যাতন ও গত্যার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। গরীবের বিচারের বাণী নিভুতেই কাঁদে। তাই আজ যদি তারা নিজেদের রক্ষার দাবীতে মানুষের বাসায় কাজ করতে অনীহা দেখায় তবে নিজ অস্বিত্ব রক্সায় এ অধিকার তাদের অবশ্যই আছে। আমি তো মনে করি এ তাদের উপর বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অন্যায়েল এক নিরব প্রতিবাদ।আমি একে স্বাগত জানাইঘ
বদরী সাহাবী আবু মাসউদ(রাঃ) বলেন, একবার আমি কোন বিষয়ে রাগ করে আমার চাকরকে মারছিলাম। হঠাৎ পেছন হতে কারো আওয়াজ শুনতে পেলাম-''আবু মাসউদ জেনে রাখ! তুমি যতটুকু ক্ষমতা তোমার এই গোলামের উপর রাখ আল্লাহ এর চেয়ে অনেক বেশী ক্ষমতা তোমার উপর রাখেন।''
আমি পেছনে তাকিয়ে দিখি এই আওয়াজ রাসূল (সাঃ)। আমি তখন হাত হতে চাবুক ফেলে দিয়ে বললাম- হে আল্লাহর রাসুল! এই গোলাম আমার পক্ষ হতে আল্লাহর জন্য মুক্ত ও স্বাধীন। অন্য বর্ণনায় আছে তিনি রাসূল(সাঃ)এর কাছে ওয়াদা করলেন- আজ থেকে আর কোন গোলামকে মারবো না। রাসুল(সাঃ) তাকে বললেন-'' যদি তুমি তোমার গোলামকে মুক্ত করে না দিতে তবে জাহান্নামের আগুন তোমাকে ঝলসে দিত।''(সহীহ মুসলিমঃ১৬৫৯)
ভেবে দেখুন পাঠক একজন কেনা গোলামের ব্যাপারে একজন বদরী সাহাবীকে যদি রাসূল(সাঃ) এই উপদেশ দিয়ে থাকেন তবে আমাদের ঘরে যারা কাজ করে তারা তো আমাদের কেনা গোলাম নয়। তাদের ব্যাপারে আমাদেরকে কেমন ভয় করা উচিত।
আর একটি কথা ভেবে দেখেছেন কি? সামান্য কয়টি টাকা বেতন দিয়ে রাখা কাজের মানুষের কাছ হতে যদি আমরা এতটা আনুগত্য আশা করি। তবে যে মনিব এত অফুরন্ত ও অগণন নেয়ামত দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন আমাদের সব সময়, তাঁর প্রতি কত বেশী আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত দাস হিসেবে আমাদের।
বিষয়: বিবিধ
৭৭০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন