আনমনে ভাবি বসে
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:২৭:০৩ রাত
সময়ের স্রোতে ভেসে জীবন তরীটা কতটা পথ পেরিয়ে এলো। এই সুদীর্ঘ পথ চলায় ছেড়ে এলাম কত শহর, বন্দর, জনপদ। চেনা পরিচিতের হাজারো মুখের মিছিল। বেশ কিছু দিন আগে আমার এক প্রিয় জন আমার খুব ছোট বেলার একটি ছবি খুঁজে পেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে। আমার বড় মেয়েটি সেটি আবার আমার কম্পিউটারে স্ক্রীন সেভারে সেট করে দিয়েছে। ছবি সংরক্ষণের বাড়তি আহলাদ আমার কখনো নেই। কিন্তু সেই খানিকটা ঝাপসা সাদাকালো ছবিটি নিয়ে আমার বাচ্চাদের হাজারো প্রশ্ন। মা তখন তোমার বয়স কত ছিলো? তোমার জামার রংটা কি রকম ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই হঠাৎ পাওয়া শৈশবের সেই আমি কে আজকের এই আমি কোন আলাদা আবেদন না জাগালেও ভাবনাহত করে ঠিকই। প্রতিদিন কম্পিউটার খুলতে গিয়ে সেই ছোট বেলার আমিকে দেখি নতুন করে। অবাক হয়ে ভাবি সেদিনের সেই আমি আর আজকের এই আমিতে কত ফারাক। শারীরিক মানসিক সব দিক হতেই। সেদিনের সেই আমার হাতটি আজকের এই আমার হাতের মুঠোয় পুরোপুরি লুকিয়ে রাখা যায় । নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবি কোথায় ছিলাম? জীবনের ভেলায় ভেসে ভেসে কোথায় আজ দাঁড়িয়ে?
আমার প্রথম যেদিন প্রথম কাবা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেই হতে আজ পর্যন্ত যতবারই আল্লাহর ঘর দর্শনের সুযোগ হয় আমি ইচ্ছে করেই চেষ্টা করি কাবা ঘরটা একবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার। এরপর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই মনে মনে বলি- মাওলা, অগুনতি পাপের বোঝা নিয়ে নুয়ে পড়া এই জীবনে কখনো তো ভাবিনি এমন করে তোমার ঘর স্পর্শের, দর্শনের সুযোগ আমার জীবনে বারংবার আসবে। কত পিয়াসী হৃদয় অধীর হয়ে প্রহর গুণে জীবনে অন্তত একবার হলে ও তোমার ঘরের দর্শন পেতে। অথচ সেই সৌভাগ্য তুমি না চাইতেই দিয়েছো। মাওলা, এমন যেন না হয়। শুধু তোমার ঘরের দর্শনই পেলাম বারংবার। কিন্তু কাল কেয়ামতে তোমায় দর্শনের সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়ে যাই। তুমি আমাকে তোমার রংয়ে রঙিন করে নাও। এর চেয়ে উত্তম রং তো আর হতে পারেনা।
আমি বাহ্যিক ভাবে ভীষণ চঞ্চল এক মানুষ। চারপাশে জন কোলাহলে ডুবে থাকি প্রায়শ। কিন্তু খুব অনুভব করি আমারই স্বত্তার অন্য দিকটা ঠিক ততটাই নিরব। যেখানে ভাবনার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ভেবে যাই নিরবে। তখন চারপাশের শব্দময় পৃথিবীর কোন কিছুই আমার সেই নিরবতার দেয়ালে আঘাত করতে পারেনা। কত কি ভাবি। সেই দূর শৈশব হতে আজকের এই পর্যন্ত নিজের কাজের আত্নপর্যালোচনা চলে। মনের ঘরে চলমান আদালতে নিজেই নিজের কৃতকর্মের আত্নপক্ষ সমর্থন করে কথা বলি। আবার বাদী হয়ে নিজের বিরুদ্ধে নিজেই আভিযোগের দেয়াল তুলি। আবার বিচারক হয়ে নিজেই নিজকে শাস্তি দিই। জাগতিক আদালতের পক্ষপাতিত্ব সেই বিচারের রায়কে কুলষিত করেনা কখনো। তাই মনে হয় আমার নিজের কোন ভুলের শাস্তি যতটা না অন্যের কাছ হতে পাই তার চেয়ে অনেক বেশী পাই নিজের কাছে নিজেই। আলহামদুলিল্লাহ! মনের সেই জাগ্রত স্বত্তা সদা সতর্ক থাকে আমাকে ভুলের পথ হতে ফেরাতে।
ছোট্র জীবনের উন্মুক্ত শিক্ষাঙ্গনে আমি এক ক্ষুদ্র শিক্ষানবীস। কত কি শিখি জীবনের পথ পরিক্রমায়। দূরারোগ্য ব্যধি ক্যন্সারে আক্রান্ত প্রিয় মুন্নিভাবীকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম- ভাবী, এতবড় একটি রোগ হয়েছে জানার পর আপনার কেমন লেগেছিল? তিনি প্রশান্ত মুখে জবাবে বলেছিলেন- এই রোগটির জন্য ও আমি আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করছি। কেননা এ রোগের ওসিলায় ইংল্যন্ডে অনেক বড় বড় ডাক্তারের কাছে আমার যাবার সৌভাগ্য হয়েছে। আর আমি তাদের সবার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে পেরেছি। আমি তখন আমার মনকে ফিসফিসিয়ে বললাম – শিখে নাও একেই বলে তাওয়াক্কুল। ( আল্লাহ মরহুমা বোনটিকে জান্নাতুল ফিরদৌসের স্হায়ী বাসিন্দা হিসেবে কবুল করে নিন।)
হঠাৎ ব্যবসায় বড় ধরণের লস খেয়ে থমকে গেছে জীবনের চাকা নীলা ভাবীর। থাকার বাসাটি আধাআধি করে ভাড়া দিতে হয়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে না পেরে নিরবে চোখের পানি মোছেন এই বোনটি। কিন্তু এই বিপর্যয়কর অবস্থার মাঝে ও নিজের হাত খরচের টাকা হতে যখন কিছু টাকা লুকিয়ে বের করে দেন আল্লাহর পথে দানের জন্য তখন আমি নিজকেই নিজে মনে মনে বলি- জেনে নাও একেই বলে দান। যখন দেখি বৃদ্ধ বাবাকে পরম আদরে কাঁধে বসিয়ে মধ্যবয়সী সন্তান হাঁটতে থাকে আল্লাহর ঘরের দিকে তখন আমি চোখকে বলি – বুঝে নাও একেই বলে প্রকৃত ভালোবাসা। যখন দেখি সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ মানুষটি গড়িয়ে গড়িয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করছেন তখন আমি বিবেককে বলি- বুঝে নাও একেই বলে মনিবের ডাকে সাড়া দেয়া।
এ ভাবে কত অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে পাই পথ চলতে গিয়ে। এগুলো সবকিছুই পাথেয় হয় আমার নিরব মনের ভাবনার ক্ষণে।
বিষয়: বিবিধ
২২৩৩ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভীষণ ভালো লাগলো লেখাটি। জাযাকিল্লাহ।
কিন্তু আমার অবস্থা খুবই বেগতিক !! চিন্তা ভাবনা আর আমার আমলের মধ্যে হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান। আপু আমার জন্য দোয়া করবেন !!!
আপনার লেখার গভীরতা কাছে নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নগণ্য মনে হল-- নিয়মিত লিখবেন আশা করছি--
মন্তব্য করতে লগইন করুন