নাটকের পেছনে নাটক( একটি ঈদ আয়োজনের স্মৃতি কথা)
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৩ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৫০:৪৪ রাত
সময়টি ছিল গত বছরের শেষের দিকে। আমার হাজব্যণ্ড দেখি মাত্রাতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়লো গান, কৌতুকের রিহার্সসেল নিয়ে। ওকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম ঈদুল আযহার কিছু দিন পরেই ওরা বেশ জমকালো একটি ঈদ পুনর্মিলনীর উদ্যেগ নিয়েছে। আমি বললাম- ইস তোমারা ছেলেরা কত মজা কর। আর আমরা মেয়েরা সব কিছু হতেই বঞ্চিত । ও বললো- চাইলে তোমরা ও কিছু করতে পার আলাদা করে। আমরা সাপোর্ট দেব। শুনে তো আমি খুশীতে লাফিয়ে উঠলাম। ঘনিষ্ঠ ২/১ জনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বললাম। প্রথমজন এতবড় কাজের ঝক্কি ঝামেলার কথা চিন্তা করে সরাসরি ভেটো দিল। আর দ্বিতীয়জন বেশ উৎসাহ দেখালো। আমি হলাম স্বপ্নচারিণী। এত সহজে কি হাল ছাড়ি। ততক্ষণে যে মনের জমিতে স্বপ্নের বীজ অংকুরিত হতে শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে মনের ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটি কাহিনীর টুকরোগুলোকে জড়ো করে চট করে একটি নাটক লিখে ফেললাম। এরপর শুরু হল পাত্রী নির্বাচনের পালা। নাহ পাঠক কারো বিয়ের জন্য নয়। নাটকের পাত্র পাত্রী নির্বাচনের কথাই বলছি। প্রথমেই হোঁচট খেলাম চেয়ারম্যান চরিত্রে যে ছাত্রীকে সিলেক্ট করেছি সে চলে গেছে মালেশিয়ায় উচ্চ শিক্ষার্থে। কি আর করা। এর মাঝে ও ভালো লাগলো আমি আমার প্রবাস জীবনের শুরুতে দীর্ঘ সময় ধরে যে ছাত্রীকে দিয়ে একক ও দলীয় অভিনয় করিয়েছি অনেকবার। আমার সেই স্কুল ছাত্রী আজ মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারে। শুধু তাই নয় সৌভাগ্যক্রমে সে তখন হজ্জ করতে জেদ্দায় এসেছে। ওকে নক করতেই ও তো খুশীতে এক পায়ে খাড়া। নিজের ব্যস্ততার মাঝে ও মেয়েটি এত সুন্দর প্রিপারেশন নিল। ‘সাব্বির’ চরিত্রে শাহাদাতের দৃশ্যে ফাইনাল অনুষ্ঠানের দিন ওর অভিনয় সবাইকে অশ্রুসজল করে তুলেছিলো।
নাটকের প্লটটি ছিল একটি গ্রামীন আবহে। একদিকে দূর্নীতিবাজ চেয়ারম্যন,তার সাথে ভন্ড মাজারের দরবেশ,শহরের বড় ভাই অন্যদিকে গ্রামের সাধারণ জনগন ও নৈতিক চেতনা সম্পন্ন একটি গোষ্ঠী। এবার গ্রামীন মহিলা চরিত্রে জরিনা চাচীকে নির্বাচনের পালা। যার পরপর ২টি মেয়ের পর ১ টি ছেলে। মাজারের তাবিজ কবচের প্রতি যার অন্ধ বিশ্বাস। এই চরিত্রে শেলী ভাবী এত সুন্দর অভিনয় করলেন কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায়, দশর্করা তো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা । কেউ কেউ তো আমাদের গ্রীন রুমে এসে উনার জন্য স্পেশাল পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে গেলেন। ফাইনাল নাটকের দিন এক কান্ড হল। উনি এসে আমাকে মুখ মলিন করে বললেন- বইন বকিস না। আমি না ঝাড়ু আনতে ভুলে গেছি। আমি মনে মনে বিমর্ষ বোধ করলেও উনাকে বুঝতে না দিয়ে বললাম- কি আর করা। যান যেভাবে পারেন স্টেজে উঠে ডায়ালক একটু বদলে সামাল দিয়ে দেন। দৃশ্যটি ছিলো ভন্ড দরবেশের বুজরুকি ধরা পড়ে যাবার পর জরিনা বিবি ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে আসবে। উনি তখন স্টেজে উঠে বললেন- ওমা হেতেরে আই এত বিশ্বাস করি তাবিজ আইনতাম। হতেনে কইচে আয়না হড়া দি দেকচে আর জামাই বলে শহরে আর ইগ্যা বিয়া কইরচে। আর বিটা বাড়ির উচে বলে বদ জ্বিনের নজর হইচে। অন তো দেখি বেক মিচা কতা। অনুফা ও কইতরী যা মা দুম্বী যা। বাইত তুন আর পিছাগাইছ লই আন। আইজা আই এই ভন্ড দরবেশরে ঝাড়া পিডা কইরুম। মাশাআল্লাহ একেই বলে প্রতিভা। ঝাড়ু না আনার ক্ষতিপূরণ ডায়ালগ দিয়ে রিকভার হয়ে গেল।
এরপর চেয়ারম্যন চরিত্রে পাত্রী নির্বাচনের পালা। সবাই বললো- এই মোর্শেদা আপাকে রাজি করাও। উনি পারবেন। আপা তো শুনে চোখ কপালে তুলে ফেললেন- ছি ছি মানুষ কি বলবে। আমরা বাকিরা অনবরত পটাতে থাকলাম- আপা রাজি হয়ে যান। আপনি ভালো পারবেন। মহিলাদের অঙ্গনে একটি অনুষ্ঠান। কোন অসুবিধা নেই। আর আপনার মধ্যে একটু মোড়ল মোড়ল ভাব আছে তো বেশ মানাবে। উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে সন্দেহের চোখে বললেন- সত্যি! আমরা তো তাকে ঠেলেঠুলে এই চরিত্রে কাস্ট করে দিলাম। ফাইনালের দিন আপা এত এক্সিলেন্ট অভিনয় করলেন যা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। উনার কথার উচ্চারণ,অঙ্গ ভঙ্গি সব এত পারফেক্ট ছিল। এই চরিত্রটি ও জরিনা বিবির মতই দর্শকের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা পেল। আমার তখন একটি কথাই বার বার মনে হল মানুষ অনেক সময় নিজেই বুঝতে পারেনা তার মাঝে কি প্রতিভা লুকিয়ে আছে।
দরগার বাবা চরিত্রে নির্বাচন করেছিলাম নাজিহাকে। ও এবার এস এস সি পরীক্ষা দিল। ফাইনাল রিহার্সসেলের দিন পর্যন্ত মেয়েটির স্কুল পরীক্ষা ছিলো। কিন্তু প্রবাসের এই নিরানন্দ পরিবেশে এক চিলতে আনন্দের এই আয়োজন ও ছাড়তে রাজি হলনা। পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে ও প্রস্তুতি নিল। আর দরগার বাবার চরিত্রে আয়না পড়া, তাবিজ পড়া দিতে গিয়ে এত সাবলীর উচ্চারণ ও অভিনয় করলো কে বলবে এই সব কিশোরী কখনো গ্রামীন পরিবেশ দেখেনি। বিদায়াতের চিহ্ন এই তাবিজের ঘাটতি পূরণ করলাম আমরা এ্যালমুনিয়াম ফোয়েল দিয়ে তাবিজ বানিয়ে। আর আগর বাতি যে আমার উনি কোন দুনিয়া হতে এনে দিয়েছিল আল্লাহ মালুম। রাখালের বদনা, মাস্তানের চুল ওয়ালা ক্যাপ এইসব কস্টিউম গুলো জোগাড় করার সময় দোকানি বড় বড় চোখ করে বলছিল- তোমরা কাজটা কি করছো?
জরিনা চাচীর মেয়ে অনুফার চরিত্রে মাহাদিয়া ও কইতরী চরিত্রে ছিলো আমার ছোট মেয়ে জুয়াইরিয়া। মাশাআল্লাহ সম্পূর্ণ আঞ্চলিকতা দিয়ে ডায়ালগ গুলো ওরা এত সুন্দর মুখস্ত করেছিল যে দর্শকদের মাঝে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। আমার জুয়াইরিয়ার জন্য অভিনয় এই প্রথম। ও ২/১ দৃশ্যের পর আমাকে কাঁদো কাঁদো হয়ে জড়িয়ে ধরে বললো- আম্মু, আমি আর নাটক করতে চাইনা। আমি স্টেজে উঠলে সবাই শুধু হাসে। ওরা কেন আমাকে শুধু শুধু টিজ করে হাসছে? আমি শুনে তো অবাক। পরে বুঝিয়ে বললাম- মা, তোমার অভিনয় ভালো হচ্ছে দেখেই সবাই খুশী হয়ে হাসছে। ও তখন অবাক হয়ে বললো- সত্যিই তাই? আমি বললাম- সত্যি। দর্শক না হাসলে তো বুঝতে হবে তোমার অভিনয় ভালো হচ্ছেনা। নাটকের একটি দৃশ্যে দাওয়ায় বসে অনুফা কবিতা পড়ছিল- আ.. আমি হবো সকাল বেলার পাখি।.... তখন কইতরী প্রশ্ন করে- বুবু ও বুবু তুমি কেন পক্ষী হইবা? পক্ষীরা তো হাইগ্যা আমগো ঘর বাড়ি বেবাক নাশ কইরা ফালায়। মায় হেইডি আবার কষ্ট কইরা সাফ করন লাগে। আর মায় হেইদিন যে মুরগিডা রানছিল হেইডা কত মজা আছিল। তুমি পক্ষী হইলে কি এত মজা কইরা খাইতে পারতা? জুয়াইরিয়া রিহার্সসেলের সময় মাশাআল্লাহ টেনে টেনে পুরো ডায়ালগটিই বলে যেত। কিন্ত ‘বেবাগ’ শব্দটিকে ও সবসময় বলতো ‘বেগাক’ শত চেষ্টা করে ও কিছুতেই বেবাক বলতে পারছিলো না। তাই ফাইনালের দিন ও ‘বেগাক’ই বলেছিলো।
দরগার বাবার মাজারের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য লালসালু কাপড়ে মোড়া মাজারাকৃতির কিছু, হরেক রকম সুতায় বাঁধা তাবিজ সব তৈরী করলাম। এরপর দৃশ্যটি আরো
প্রাণবন্ত করতে লাউ, মুরগি, কবুতর সব কিছুই খুঁজে পেতে সংগ্রহ করেছিলাম। এক মজার ব্যাপার হল অনুষ্ঠান শেষে যাওয়ার সময় দেলোয়ার ভাবী ডেকে বললেন- এই শোন, মুরগীটি তুমি নিয়ে যাও। বাসায় যেয়ে জবাই করে খেয়ে নিও। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম- ভাবী, আপনার মুরগী তো আর মুরগী নেই। ওটা এখন শিল্পী হয়ে গেছে। এই মুরগীরে জবাই করলে আমার খবর আছে। দেখছেননা কবুতর দু’টো নিয়ে আমার ছোট মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে কম করে হলে ও ১০/১৫ বার ওয়াদা করেছি নাটকের পরই কবুতর দুটো ছেড়ে দেব। জবাই করা যাবেনা। এখন আপনার মুরগী দিয়ে আমারে বিপদে ফেইলেন না। উনি তো হাসতে হাসতে শেষ।
নাটকের শেষ দৃশ্যে মাষ্টার সাব্বিরের শাহাদাতের পর কিছু কথা বলতে হয় আবেগ জড়ানো গলায়। কিন্তু মাষ্টার চরিত্রে অভিনয়কারী ছাত্রীটি এতক্ষণ ঝরঝরে অভিনয় করলেও লাস্ট মোমেন্টে বললো সে লাস্ট ডায়ালগ গুলো বলতে নার্ভাস ফিল করছে। আমার সহকারী আব্দুল কাদের ভাবী তাৎক্ষণিক ভাবে একটি মাইক্রোফোন স্টেজের পর্দার নিচ দিয়ে আমাকে ছুড়ে দিয়ে বললেন- ভাবী সামাল দেন। ব্যাপারটা একে বারেই আকস্মিক। নাটকের স্কিপতো বরাবরই হাতে ছিলো। আমি ভেতর হতে আঞ্চলিক গলায় কথাগুলো বলতে শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ কি করে যে কান্নারত গলার সেই আবেগটা আমার মধ্যে এসে ভর করলো আমি ভেতর হতে পুরো ডায়ালগ বলে গেলাম । দশর্কদের কেউ বুঝতে পারেনি যে ডায়ালগ গুলো সেদিন আমি বলেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ দর্শকদের এত উচ্চসিত প্রংশসা পেয়েছিল নাটক আর নাটকের পাত্রপাত্রীরা এর পর তো কয়েক তরফ হতে পুরস্কারই গ্রহণ করতে হয়েছে সবাইকে । তাই যারা বাদ পড়েছিলো অভিনয় হতে তারা মজা করে বলছিলো – এই সামনে তোমার নাটকে ঝাড়ুদারের চরিত্র হলেও দিতে হবে। এত পুরস্কার চোখের সামনে আসা যাওয়া করছে। দেখে তো হিংসেই লাগছে।
শেষ হইয়া ও হইলনা শেষ। নাটকের একটি দৃশ্য ছিলো জরিনার অভাবের সংসারে ক্ষুধার্ত কইতরী( জুয়াইরিয়া) মা’কে গলা জড়িয়ে ধরে বলে- মায়ু, ক্ষিধা লাগচে খাওন দেও। নাটকের বেশ মাস খানেক পরে আমার জুয়াইরিয়া একদিন বললো- আম্মু, আমি যখন স্টেজে শেলী চাচীর কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলাম উনি বলেছিলেন আলু মাছ দিয়ে ভাত দেবেন। আলু মাছটা কি জিনিস। কি আর করা। মেয়ের উপর্যুপরি একই প্রশ্নের জবাব জানতে আমি ভাবীকে ফোন দিলাম। উনি তো হাসতে হাসতে শেষ। বললেন- জানো তোমার মেয়ে না স্টেজ থেকে নেমেই আমাকে ও একই প্রশ্ন করেছিলো। ব্যস্ততার জন্য আমি জবাব দিতে পারিনি। আমি আসলে ডয়ালগটি বানিয়ে বলেছিলাম টেংরা মাছের ভর্তা দিয়ে ভাত দেব। শব্দটি তো ও নতুন শুনেছে তাই বারবার জানতে চাচ্ছে। এরপর তে ওকে আমার রীতিমত ব্যাখা করতে হল টেংরা মাছ দেখতে কি রকম? কোথায় থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটকের বিভিন্ন দৃশ্যে মাস্তানদের গ্রুপ,সাব্বিরের বন্ধুরা , দরগার বাবার সাগরেদরা, সাব্বিরের মা , রাখাল, চেয়ারম্যনের চেলা প্রভৃতি দৃশ্যে সবার প্রাণবন্ত অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলো। মহিলা ও ছাত্রীদের একক গান , কৌতুক, ও নাটকের সমাহারে দিনটি সত্যিই ছিলো অন্যরকম। পরিচিতির স্বাতন্ত্র ধরে রাখতে মহিলাদের স্কাই ব্লু কালার স্কার্ফ ও ছাত্রীদের পিং কালার ওড়না শিল্পীদের আরো পরিপাটি করে তুলেছিলো দর্শকদের কাছে। অনুষ্ঠানের বাড়তি খরচ কমাতে স্টেজ সাজানো, ব্যানার তৈরী, পুরুষ ও মহিলাদের সব ব্যজ গুলো ও আমরা নিজ হাতেই বানিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে যিনি যেভাবেই সহযোগিতা করেছেন মহান আল্লাহ তাদের সবার প্রতি রহম করুন। আর আমার সহযোগী হিসেবে যে সমস্ত বোনরা সহযোগীতা করেছিলেন বিশেষ করে আব্দুল কাদের ভাবীর যে নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার তার উত্তম প্রতিদান আল্লাহ যেন তাদেরকে দান করেন।
বিষয়: বিবিধ
১৯০৭ বার পঠিত, ৩১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দ
খ
ল
> > >
আঁর বিটা বাড়ির উচে বলে বদ জ্বিনের নজর হইচে।
অন তো দেখি বেক মিচা কতা। "
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
বেশ মজা করে উপভোগ কর্লাম আপনাদের নাটক। আমিও ডায়ালগগুলো টেনে টেনে পড়লাম ঠিক যেভাবে কইতারিরা ছাড়লো স্টেজে উঠে কইতারির কথা মনে পড়লেই আর নাম দেখলেই আমারও হাসি আসতেছে এখন.... হা হাহ হাহাা
জুয়াইরিয়া - তুমি আর কইতারি'র চরিত্রে অভিনয় করিওনা, আমার কেমন জানি হাসি পাচ্ছে ভীষণ
আমাদেরকে ইসলামে দিকে ফিরে নিয়ে যাবে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন