সেদিন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম লাশঘরে
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ৩১ মার্চ, ২০১৪, ০৮:৫৪:০৩ রাত
কতইনা ক্ষুদ্র আর ক্ষণস্থায়ী আমাদের জীবন। এই জীবনের ক্ষণিকের পথ চলাকে ঘিরে কতইনা স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ি আমরা জীবনের সারাবেলা। অথচ সাগর সৈকতে শিশুর বালু দিয়ে খেলাঘর নির্মাণের মতই অবেলায় সব ছেড়ে আমরা ফিরে যাবো যে কোন সময় অনন্তের ডাকে। সূরা হাদীদ এ আল্লাহ তায়ালা এভাবেই বলেছেন-‘’ ভালোভাবে জেনে নাও, দুনিয়ার এই জীবন শুধু একটি খেলা- তামাসা ও মন ভুলানোর উপায় এবং বাহ্যিক চাকচিক্য ও তোমাদের পরস্পরে গৌরব – অহংকার করা আর ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততির দিক দিয়ে একজনের অপরজন হতে অগ্রসর হয়ে যাওয়ার চেষ্টা মাত্র। এটি ঠিক এই রকমই যেমন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তখন এ হতে উৎপন্ন সবুজ শ্যমল গাছ- পালা ও উদ্ভিদ রাজি দেখে কৃষক সন্তুষ্ট হয়ে গেল। তারপর সেই ক্ষেতের ফসল পাকে আর তোমরা দেখ যে তা লালচে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভূষি হয়ে যায়। এর বিপরীতে রয়েছে পরকাল। এটি এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আযাব আর আল্লাহর ক্ষমা – মার্জনা এবং তাঁর সন্তোষ। দুনিয়ার জীবনটা প্রতারণা ও ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।‘’
গত কয়েকদিন ধরে মনের ঘরে অনির্ধারিত কথপোকথন চলছে নিজের সাথে নিজেরই। মনের ভেতরে বেদনাহত একটা ডাহুক যেন অনবরত কেঁদেই চলেছে বিরামহীম ভাবে।
আমার খুব কাছে নতুন প্রতিবেশী হয়ে এলেন জাপান হতে একটি পরিবার। বাচ্চাদের স্কুল হতে আনতে গিয়ে প্রায় কথা হয় ভদ্রমহিলার সাথে। গত ২ সপ্তাহ আগে ভদ্রমহিলা জানালেন তার শাশুড়ি আসছেন বাংলাদেশ হতে। আমি আমার হাজব্যন্ডের সাথে কথা বললাম উনাদেরকে সহ আর কিছু পরিবারকে দাওয়াত করবো ১৪ মার্চ শুক্রবার। আমার হাজব্যন্ডকে আলাদা করে বলে দিলাম- খালাম্মার জন্য খেয়াল করে কয়েক রকম মাছ নিয়ে আসবে। কেননা অনেক সময় বৃদ্ধ মানুষরা ঠিক গোশত পছন্দ করেন না। এরই মধ্যে আমার হ্যাজব্যন্ড এত ব্যস্ত হয়ে গেল যে আমি আর সেই নির্ধারিত দিন দাওয়াতটা আর করতে পারলাম না। ওকে বারবার মনে করিয়ে দিলাম- আসছে ২১ মার্চ শুক্রবার কিন্তু তুমি হাতে কাজ রেখনা। আমি উনাদেরকে দাওয়াত দেব। অবাক কান্ড ১৬ মার্চ দুপুরে আমার হাজব্যন্ড অফিস হতে ফোন করে বললো- এই জানো, গত কাল সকালে খালাম্মা মারা গেছেন। আমি ফোনটা ধরে নির্বাক হয়ে গেলাম। আহারে আমি খালাম্মাকে খাওয়াতে চেয়েছিলাম।
মনের ঘরে তখন ভাবনার স্রোত বইতে শুরু করেছে। খালাম্মার ছেলের বউয়ের কাছে শুনেছি এর আগে উনি বড় ছেলের কাছে অমেরিকায় ছিলেন। ওখান হতে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরই আবার সাথে সাথে জেদ্দায় এলেন। তবে কি উনার মৃত্যুই উনাকে এখানে টেনে নিয়ে এলো? ব্যাথাভরা মন নিয়ে স্কুলে গেলাম বাচ্চাদের আনতে।
আমার বড় মেয়ে আমাকে দেখে ছুটে এসে বললো- মা, আমার এ্যরাবিক ম্যাডাম মিস বুশরা শুক্রবার মারা গেছেন। স্টমাক ক্যন্সার হয়েছিল। আমার ব্যাথাতুর মন নতুন করে ব্যাথায় আন্দোলিত হল। গত ৩/৪ দিন আগে ও মহিলার সাথে আমার দেখা হয়েছে। আমার বাচ্চাদের এ্যরাবিকের ব্যাপারে আমাকে এত সহযোগিতা করতেন যা কখনো ভুলার নয়। আমার সাথে দেখা হলেই কথা হত। বার বার মনে পড়তে লাগলো শেষ যেদিন দেখেছি উনি দূর হতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি ব্যস্ত ছিলাম বলে কথা বলা হয়নি। আহারে তখন কি জানতাম সেই হবে মহিলার সাথে আমার শেষ দেখা। বার বার মনে হচ্ছে কত ক্ষণিকের এই জীবন। তবে কেন বালির বুকে মিছে স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ি আমরা? কেন ভুলে যাই সেই অনন্তের জীবনকে। সন্ধ্যায় আমার হাজব্যন্ড জানালো খালাম্মার শেষ অসিয়ত অনুযায়ী উনাকে এখানে কবর দেয়া হবে। আমি খবর পেয়ে ছুটলাম যেখানে মুর্দার গোসল দেয়া হয় সেই স্থানে। খালাম্মাকে গোসল কাফন পরালো এক মহিলা অনেক যত্নের সাথে। আমি খালাম্মার কপালে হাত রেখে আমাকেই মনে মনে বললাম- হে গাফেল নফস! সব কিছু জানার পর ও দুনিয়ার মোহে তুমি এই ফিরে যাওয়াকে কি করে ভুলে থাক? একদিন তুমিও পৃথিবীর সব মায়ামোহ ছেড়ে এই রকম অবস্থায় পৌঁছাবে। কখন তোমার চেতনা জাগবে? পরকালের প্রস্তুতি নেবার সময় হবে।
আমার বাচ্চারা ও লাশঘরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ইচ্ছে করেই ওদের সাথে রেখেছিলাম যাতে এই যে অবশ্যম্ভাবী ফিরে যাবার ডাক তারা কখনো যেন ভুলে না যায়। এক সময় কাফন পরানো পুরোপুরি শেষ হয়ে গেলে যিনি গোসল করাচ্ছিলেন সেই মহিলা পাশে আর একটি রুমের দিকে ঢুকে যেতে যেতে বললেন- এখন তোমরা চলে যাও। এশার নামাজ শেষে জানাযা হবে। আমরা খালাম্মার লাশ একটি বন্ধ রুমে রেখে মসজিদে গিয়ে বসলাম। কিন্তু বার বার মনে হল খালাম্মার ছেলের বউ আমার সাথে দেখা হলেই বলতেন- ভাবী আমার শ্বাশুড়ি একা কিছু করতে পারেন নাতো তাই আমি সার্বক্ষনিক উনাকে সঙ্গ দিই । আমার বাচ্চাটিকে ও বলে রেখেছি দাদু ডাকলেই দৌড়ে যাবে। আমার মনে হল আপন জনদের সেই ব্যস্ততার আজ ছুটি হয়ে গেছে। এই যে বদ্ধ ঘরে রেখে এলাম উনি আর কখনো কাউকে ডেকে বলবেন না- আমার চশমাটা একটু এনে দাও তো।
ব্যস এই তো জীবন।
রাতে লাশ দাফনের পর আমার স্বামী যখন ঘরে ফিরলো আমি বললাম- একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছো আম্মা( আমার শ্বাশুড়ি) আমরা বাংলাদেশ হতে আসার ৫ দিন পর মারা যান। তুমি অনটাইমে টিকেট পাওনি বলে উনার জানাজায় অংশ নিতে না পেরে কেঁদেছিলে। আর আজ দেখ এই ভাইয়ের মা কত দূর হতে এসে এখানেই মারা গেলেন। তোমার ও নসীব হল আর এক মায়ের জানাজায় অংশ নেয়ার। যা আমরা কখনো চিন্তাই করিনি। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলবো- আমি ও ঠিক এই ব্যাপারটিই ভাবছিলাম।
প্রতিটি মৃত্যুর খবর শোনার পর আমি ওই আয়াতটি তেলাওয়াৎ করি- ‘’হে প্রশান্ত আত্না! চল তোমার রবের দিকে, এমন অবস্থায় যে তুমি (নিজের শুভ পরিণতিতে ) সন্তুষ্ট (এবং তোমার রবের) প্রিয়পাত্র। শামিল হয়ে যাও আমার (নেক) বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।‘’
হৃদয়ের সব আকুতি জড়ো করে রহমানু রহিমের কাছে প্রার্থনা- মাওলা! আমার বিদায় বেলা যেন আমি ও যেন সেই প্রশান্ত আত্নাদের একজন হতে পারি। তোমার কিতাব ও রাসূলের মাধ্যমে যে নেয়ামতে ভরা জান্নাতের বর্ণনায় তুমি লোভাতুর করে তুলেছ এই অবুঝ হৃদয়টাকে, সেই জান্নাতের অবারিত নিয়ামত হতে তুমি মাহরুম করোনা আমায়।
বিষয়: বিবিধ
২০১১ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হে আল্লাহ তাহাদের আমলনামা ডান হাতে দিন ।
যাজ্জাকাল্ললাহ খায়ের
আল্লাহ মারহুমাদের জান্নাতের মেহমান হিসাবে কবুল করুন।
পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়।
মরন একদিন মুছে দেবে সব।
রাস্তার অপর পার্শ্বে ব্যাংক কর্মকতা কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, তিনি রাস্তার অপর পাশ্বের্র ঘটনা দেখে তড়িৎ গতিতে আহত ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্য সেদিকে ধাবিত হন। ফলে দ্রুত ধাবমান ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।
তৃতীয় বৃদ্ধ ব্যক্তি নাতি নিয়ে হাওয়া খেতে বের হয়েছিলেন, তিনি এই দুটো মর্মান্তিক ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। স্নায়ুচাপে সহ্য করতে না পেরে তিনি ঘটনাস্থলেই হার্ট এটার্ক করে মারা যান।
মৃত্যু এমন এক নির্ধারিত সহ্য, সোলায়মান (আঃ) এর মত মহান নবীকেও এক মুহূর্তের জন্য ছাড় দেয়নি। কোথায় মরবেন, কখন তা সংগঠিত হবে কেউ জানেনা, তাই প্রতিটি ব্যক্তির উচিত সর্বদা মৃত্যুর জন অগ্রিম প্রস্তুত থাকা। আপনার লেখাটি তারই প্রতিবিম্ব, কোন সন্দেহ নাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন