একটি আক্কেল দন্ত বিসর্জন
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৪:০১:৩৫ বিকাল
গত সপ্তাহে হঠাৎ দেখি দাঁতে ব্যথা। সে কি ব্যথারে বাবা। সে কি খানিক পর দেখি নেই। এই আছে এই নেই ব্যথা। ভাবলাম রহস্যটা কি? তৎক্ষনাৎ নিজকে দিয়ে ১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করলাম। অনেক অনুসন্ধানের পর আবিস্কার করলাম বাম পাশের উপরের মাড়ির একদম শেষ মাথার একটি দাঁতই এই ব্যথার কারণ। আমি তো অবাক। কেননা এত ভেতরে যে দাঁত থাকে সেটাই আমার জানা নেই। আর সম্ভবত আমার এই অজ্ঞতার কারণে দাঁত বেচারা লম্বালম্বি ভাবে ক্ষয়ে গেছে।
ছুটলাম দাঁতের ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার হচ্ছেন আমার এক পরিচিত ভাবীর মেয়ে। পূর্ব হতে খবর দিয়ে ওর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। রিসেপশনের ওরা তো ডাক্তার আপার গেস্ট শুনে বেশ তাজিমের সাথেই নিয়ে গেল। আমরা বলার পর ও ফি'র টাকা রিসিভ করলনা। বলল- ম্যাডাম বললে নেবো।
যাই হোক ডাক্তার হুমায়রা আমাকে বেশ হাসিমুখে স্বাগত জানালো। আমি বললাম- তোমার আাম্মুর কাছে ইনফরমেশন পেয়েছো নিশ্চয়। আমি দাঁতের ডাক্তারদের খুব ভয় পাই। তুমি ব্যথা দেবেনা। এই আশাতেই তোমার কাছে আসা।
মেয়েটি চেহারায় প্রশান্তির আভা ফুটিয়ে মিষ্টি করে হাসল। বলল- জ্বি আন্টি, আমি জানি। ইনশাআল্লাহ আমি আপনাকে ব্যথা দেবনা। বেচারী অনেক কষ্টে আমার দাঁতের অবস্থান স্থল পরীক্ষা করলো। বলল- আন্টি, এটা আপনার উপরের পাটির আক্কেল দাঁত। বাঁকা হয়ে এমন জায়গায় উঠেছে যে স্বাভাবিক ভাবে সেখানে আঙ্গুল বা ব্রাশ পৌঁছানোর কথা নয়। তাই প্রাথমিক অবস্থায়ই দাঁতটি বেশ ক্ষয়ে গেছে। ওটা ফেলেই দিতে হবে। আমি বললাম- তাঁর মানে আক্কেল বুদ্ধি কিছু এখন হতে মাইনাস হয়ে যাবে। ওর হাজব্যন্ড এসবি ব্লগার ছিরো। সেখানে ও আমার লিখা 'আমার উনি কেমুন জানি' পড়ে বেশ মজা পেয়েছিলো। তাই আজ ও আমার কথায় হাসলো।
যাই হোক বেশ যত্নের সঙ্গে ও এমন ভাবে দাঁতটি ফেললো যে আমি খুব একটা টেরই পেলাম না। বার বার ও আমাকে ব্যাখা করছিলো ওর পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে। আসলে ডাক্তারের আন্তরিক ব্যবহার, কর্ম দক্ষতা, রোগীর সাথে সুন্দর কমিনিকেশন এগুলো রোগীর মনে আস্থা বাড়ায়। সে দিক দিয়ে ডাক্তার হুমায়রা'র সার্ভিস আমাকে বেশ মুগ্ধ করলো। দাঁত তোলার পর ও বলল- আন্টি, অ্যানিসথিশিয়া দিয়েছি তো। তাই আপনি ৫ মিনিট রেস্ট করে তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠুন। না হয় মাথা ঘুরাতে পারে।
কি আর করা আমি বাধ্য বালিকার মত শুয়ে থাকলাম। দেখি ঠিক আমার সামনে ট্রলির উপর আমার বিসর্জন দেয়া রক্ত মাখা দাঁতটি। মনে পড়ল ছোট বেলা দাঁত পড়ে গেলে সেটাকে কাঁচের বোতলে সংরক্ষণ করে রাখতাম। ইচ্ছে হল সেই ছোট বেলার মত একই দুরন্তপনায় দাঁতটি টিস্যুতে মুড়ে ব্যগে ঢুকিয়ে ফেলি।
কিন্তু মনের ভেতর হতে কেউ যেন বলে উঠলো- ওটা তো আর তোমার নয়। বুকের মাঝে সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন শূণ্যতার শিরশিরে এক অনুভূতি হল। সত্যিই তো। গত এতগুলো দিন যে দাঁত আমার শরীরের একটি অংশ ছিলো এখন আর সেটা আমার নয়।
মনের ভাবনার ফিতাটা দ্রুত ঘুরতে শুরু করলো। মনে হলো, জীবনের সোনাঝরা দিনগুলো ওতো আর এখন আমার নেই। একজন মানুষের গড় আয়ু যা তার অর্ধেক তো জীবন হতে নাই হয়ে গেছে। ঠিক এমনি করেই। আর কত দিন থাকা হবে এই পৃথিবীতে? শরীরের এই ক্ষুদ্র অংশটির মত আমার পুরো শরীর ও একদিন ঠাঁই নেবে নির্জনতার গহ্বরে। তবে এই যে সময় গুলো বরফের মত ফুরিয়ে গেলো- এর কি সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি? স্রষ্টার আনুগত্যে, সৃষ্টির কল্যাণের পথে আমার বিচরণ কতখানি ছিলো? কি হিসেব দেবো এই হারিয়ে যাওয়া সময়ের?
ফিলিপিনো নার্সটি ট্রে টি ঠেলে ঠেলে সরিয়ে নিলো আমার সামনে হতে। হয়তো এখুনি দাঁতটি ফেলে দেবে ময়লার বিনে। এরপর তা হয়তো এক সময় মাটির সাথে মিশে যাবে।
মনে হলো, প্রচুর ফোন কল থাকে বলে এক কাঁধে কর্ডলেসটা কানে চেপে ধরে অন্য হাতে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই অসতর্কতায় আঙ্গুল কেটে যায়। এ পর্যণ্ত কতবার যে কেটে, ছিঁড়ে কত রকম করে শরীরের কিছু কিছু অংশ হারিয়েছি। আমাদের সৌন্দর্য উপকরণ চুল যা না থাকলে নাড়ু বেল মাথার কথা ভাবতে ও হাসি পায়। সে চুল কতবার কাটি, প্রতিদিন কত কত চুল ঝরে যায়। এরপর এগুলো আর আমাদের থাকেনা। ঠাঁই হয় মাটির গহ্বরে। আমি কি ভেবেছি প্রায়ই যে একটু একটু করে শরীরের কিছু না কিছু অংশ আমরা হারাই। একদিন এই পুরো শরীর ও ঠাঁই নেবে মাটির হিম শীতল গহ্বরে। শুরু হবে বর্তমান জাগতিক জীবনের জবাবদিহিতা নিয়ে নতুন একটি জীবন। সেই অন্য রকম একটি জীবনের প্রস্তুতি কি নিয়েছি? যখন বেলা শেষের ভেলায় ভেসে এই আমি চলে যাবো আমার এই দাঁতটির মতই।
শুনেছি দাঁত তুললে অনেক সময় চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। এটা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার আগে আমার নিজের মাঝে ও একটু দ্বিধাদ্বন্ধ কাজ করছিলো। পরে মনে পড়লো প্রভুর বাণী- অন্ধ আর চক্ষুষ্মান,অন্ধকার আর আলো কখনো সমান নয়। নিজকেই আমি প্রশ্ন করেছিলাম তখন- প্রভু যে অপূর্ব দৃষ্টি শক্তি আমাকে দিয়েছেন তার কতটুকু সদ্বব্যবহার করতে পেরেছি। এই পোড়া চোখ এত জীবনে প্রতিনিয়ত কত অনিয়ম দেখে সয়ে চলেছে নিরবে। কত মজলুমের অশু সিক্ত কাতরতা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছে অহরহ। কখনো কি এর প্রতিবিধান করতে পেরেছি সামান্যতম ও? তবে তো আমি চোখ থেকে ও অন্ধের মত পথ চলেছি।নিজেকেই নিজে বললাম- এর শাস্তি হিসেবে বিধাতা যদি এই দাঁতের জন্য আমার দৃষ্টি শক্তি খানিকটা কেড়েও নেন তবে সেটাই আমার পাওনা ভেবে নিতে হবে আমাকে।
ঘরে ফিরতেই লাকি ভাবীর ফোন জরুরী কথা আছে। উনি বললেন- এই এমন চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিস কেন? আমি বললাম- একটি আক্কেল দাঁত উঠেছিলো বেআক্কেলের মত। ওটাকে বিসর্জন দিয়ে এলাম তো তাই মুখে ব্যন্ডেজ চেপে কথা বলছি। ভাবী স্নেহের স্বরে বললেন- আহারে তাহলে তো তোর অনেক কষ্ট হচ্ছে।
আমি বললাম- না, কোন অসুবিধা নেই। কথা বলেন। অ্যানিসথিশিয়ার জন্য এখনো ওখানে কোন চেতনা হচ্ছে না। ভাবী জরুরী কথা সারলেন। ফোন রাখতে রাখতে মুখের ব্যথাহীণ অনুভুতি দেখে মনে মনে ভাবলাম- আচ্ছা, চারপাশে যারা চক্ষুষ্মান হয়ে ও দেখে না। যারা জ্ঞান থেকে ও বোঝেনা। তাদের চেতনার উপরও কি এমনি অ্যানিসথিশিয়া দিয়ে দিয়েছে কেউ?
বিষয়: বিবিধ
১৭১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন