পরিবারগুলো ভরে উঠুক অনাবিল সুখের মূর্চ্ছনায়
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৩:১৪:৪৭ দুপুর
আমরা সবাই কোন না ও কোন পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ। তাই পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক নির্ভরতা সম্পর্কের বন্ধনকে সুদৃঢ় খুঁটির মত স্থায়িত্ব দেয়। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা এখানে অনাবিল সুখের সুবাতাস ছড়ায় অহর্নিশ। সুন্দর ব্যবহার একের প্রতি অন্যের আন্তরিকতা আর শ্রদ্ধাবোধকে বাড়িয়ে তুলে। সেই সাথে একের কাছে অন্যকে আরো গ্রহণযোগ্য ও প্রিয়তর করে তুলে। কেন লিখলাম কথা গুলো তা সরজমিনে জানার জন্য চলুন পাঠক আমরা মিসেস জেসমিন ও মিসেস রীমা ভাবীর সংসারের চৌহদ্দিতে একটু ঢুঁ মেরে আসি। যেহেতু পারমিশন নেবার উপায় ছিলনা তাই কাজটি সারবো চুপি চুপি।( আমার আগের লিখাগুলোর মতই এই চরিত্রগুলো এবং ঘটনা বাস্তব হলে ও গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে ব্যক্তির নাম এবং পরিচয় গোপন রাখছি।)
১. আমার খুব পরিচিত ও প্রিয় জেসমিন ভাবী। একদিন ভাবীকে ফোন করে আমি অভিযোগের গলায় বললাম- ভাইয়ের বউদের মায়া ভালোবাসা কি কম থাকে নাকি? আপনি দেখি আমার একটু খোঁজ খবর ও নেন না। ভাবী পাল্টা অনুযোগের গলায় বললেন- প্রায়ই মনে করি আপনাকে ফোন করবো। কিন্তু বুঝেন না এত ব্যস্ত থাকি। আপনার ভাইর সংসারে কাজ করতে করতে হাড়মাংস খসে যাবার উপক্রম। আমি তখন কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললাম- কি আমার ভাই নিশ্চয় বাসায় নেই? তাই সুযোগ পেয়ে ভাইয়ের গীবত করা হচ্ছে। দাঁড়ান না আমি তো ভাইকে ঠিকই বলে দেব। ভাবী তখন স্বশব্দে হেসে উঠে বললেন- না, সেই সুযোগ বোধহয় আপনার কপালে নেই। কেননা আমি তো গীবত করিনি। এরপর গলাটা একটু পাশে সরিয়ে বললেন-এই শোনতো ভাবী বলছে আমি নাকি তোমার গীবত করছি? কারো উপস্থিতিতে যদি তার ব্যাপারে কথা বলা হয় সেটা কি গীবত হবে? ভাই তখন পাশ হতে জোর গলায় বললেন- আমার বোনকে বল উনার পেরেশানীর কোন কারণ নেই। উনি আর একদিন ফোন দিলে আমি ফোনটি আগে রিসিভ করে তোমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তোমার ব্যাপারে কিছু অভিযোগ করে দেব। ব্যস কাটাকাটি হয়ে যাবে। ভাবী এবার আমাকে শুনিয়ে বললেন- শুনেছেন তো? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম- ওমা ভাইয়া বাসায় আপনি আমাকে আগে বলবেন না। আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন- না না অসুবিধা নেই আমরা কথা বলি। আজ কত জীবন ধরে সংসার করছি। কথা তো কম বলা হলনা ওর সাথে। এখন না হয় একটু ননদদেরকেই সময় দেই। আর ও একটু পরেই মসজিদে চলে যাবে নামাজ পড়তে। সম্মানিত পাঠক, বিনা ব্যাখ্যাতেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এই পরিবারে স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক কত সুন্দর ও মধুময়। আর একটি তথ্য দিচ্ছি এই সুখময় ঘরের জান্নাতী আবহে বেড়ে উঠা সবকটা ছেলেমেয়েই সৎ চরিত্রবান ও মেধার সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রেখে প্রতিষ্ঠার উচ্চাসনে নিজদের স্থান করে নিয়েছে।
২. এবার আসুন রীতা ভাবীর সংসারে চোখ রাখি। ইনি ও আমার খুব প্রিয়জনদের তালিকায় আছেন। বেশ সুন্দর মনের খুব ভালো একজন মহিলা। উনার সাথে ও প্রায়ই ফোনে কথা হয়। পরিচয়ের প্রথম দিকের ঘটনা। আমরা দু’জন ফোনে কথা বলছি হঠাৎ খেয়াল করলাম উনার কন্ঠস্বর যেন খাদে নেমে গেল। আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম- কি ব্যাপার ভাবী কোন সমস্যা? উনি নীচু স্বরেই বললেন- না, না। কিন্তু আমি একটু হতবাক হয়ে গেলাম। কেননা কন্ঠস্বরে একটা তারতম্য আঁচ করতে পারছি। অথচ উনি খোলাসা করছেন না। আমি আবারো বললাম- ভাবী, শরীর খারাপ লাগছে আপনার? উনি আবারো বললেন- না।
আমি মানুষটা একটু চঞ্চল স্বভাবের। খুব দুষ্টমি ও করি। কিন্তু কখনো এমন হয়না যে সীমা লংঘন করে ফেলি। রীতা ভাবী ও বেশ মজার মানুষ। তাই উনার সাথে দুষ্টমি করি। কিন্তু মাত্রা ভেঙ্গেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। এক রকম অস্বস্তি নিয়েই আমি প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফোন রাখলাম। মনের খচখচানি ভাবটি থেকেই গেল। পরদিন দেখি ভাবী নিজেই ফোন করেছেন। উনি নিজ হতেই আগের দিনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বললেন- আমার হ্যজব্যন্ড বেড রুমে এসেছিল তো তখন । আমি তো আবাক। পরে দিনের পর দিন মিশতে গিয়ে বুঝলাম বেচারি স্বামীকে যমের মত ভয় করেন। সন্তানরা ও তাই। ভদ্রলোক পরিবারের সাথে খুব কঠোর মেজাজ করেন। তাই বাচ্চারা কখনো স্বাভাবিক ভাবে প্রয়োজন না হলে তার সাথে কথা বলে না। স্ত্রী ও তাই। মন খুলে স্বামীর কাছে দুটো কথা শেয়ার করতে পারেন না। ভদ্রলোক ঘরে থাকাকালীন সময়ে ঘরে সবাই আতংকিত অবস্থায়ই থাকে।
দু’ধরনের পরিবার হতে দুটি চিত্র তুলে ধরলাম। এই চিত্র সার্বিক ভাবে আমাদের গোটা সমাজের। কেন এমন হয়? রীতা ভাবীর স্বামীর মত ব্যক্তিরা কি কখনো ভেবে দেখেন, একই ছাদের নিচে বাস করার পর ও এই যে খারাপ আচরণের মাধ্যমে সবার সাথে নিজের যোজন যোজন দুরত্ব তৈরী করে নিয়েছেন এর ফলে অর্জনটা কি হল? সারাদিন প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে যে প্রিয়জনদের জন্য উপার্জন করেন। যাদের কল্যাণকামনায় সারাক্ষণ তিনি পেরেশান থাকেন সেই তাদের সাথেই সামান্য মুখের ব্যবহারের অসংযতার জন্য নিজের অজান্তেই এক অলিখিত দুরত্ব নির্মাণ করে চলেছেন দিনের পর দিন। একটু ভেবে দেখেন কি এই ধরণের রুক্ষ মেজাজের ব্যক্তিরা, উনি অসুস্থ হলে সবসময় পাশে থাকেন কে ? এই প্রিয়জনরাই। উনার কষ্টকর সময়ে সবচেয়ে কাছে কাদের পান? এই প্রিয়জনদেরকেই। তবে কেন এই ভুলের ঘোরে জীবন পার করা? ভেবে দেখেছেন কি আপনার বার্ধক্যে কর্মহীন অবসরে কারা আপনার চারপাশে থাকবে? এই প্রিয়জনরাই। আজ সচেতন ভাবেই হোক বা অসচেতন ভাবেই হোক এই যে দুরত্বের পাহাড় গেঁথে চলছেন হয়তো এ মুহৃর্তে কর্মব্যস্ততায় সেটি আপনি অনুভবই করতে পারছেন না। কিন্তু বেলা শেষে যখন অনুভবের সময় আসবে তখন প্রিয়জনদের কাউকেই দুটো সুখ দুঃখের কথা বলার জন্য পাশে পাবেন না। আর আপনার এই অসংযত আচরণ দেখে বড় হওয়া বাচ্চাদের জীবন ও আপনার মতই অসুখী হবে। তাইতো রাসূল (সাঃ) বলেছেন’’ তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রী’র কাছে সর্বোকৃষ্ট এবং যে নিজ পরিবারের সঙ্গে স্নেহশীল আচরণ করে।‘’ মিসেস ড্যমরস বলেন-‘’ ভালোবাসাকে শেষ করতে কড়া কথা অথবা ব্যবহার হল ক্যান্সারের মতো। আশ্চর্য ব্যাপার , লোকেরা এটা জানে বলেই – আমরা আপন আত্নীয়স্বজনের চেয়ে অচেনাদের কাছেই ভদ্রতা দেখাই। নিজের লোকদেরই আমরা অসম্মান করি বেশী।‘’ আসলে ও তাই। নিজের প্রিয়জনদের কাছে রুক্ষতার প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে বাইরে সবার কাছে নিজকে চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে জাহির করেন যারা তারা কি কখনো ভেবে দেখেন যে নিজের ভালোসাবার মূল উৎসমূলটি নিজ হাতেই উপড়ে ফেলছেন। তাই চলুন নিজের সুন্দর ব্যবহারের পরশ দিয়ে মজবুত করি পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের বুননকে। যেন পরিবারই হতে পারে আমার সর্বোত্তম মানসিক প্রশান্তির এক অমিয় ভুবন।
বিষয়: বিবিধ
১৫০২ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ভালো লাগলো লেখাটা। আত্মসমালোচনার খোরাক পেলাম। বাসায় কাছের মানুষদের সাথে কত খারাপ ব্যবহারই না করে ফেলি!
অনেকদিন কথা হয় না আপনার সাথে...
আপনার অনবদ্য সুণ্দর লেখার জন্য... ।
আপনার এ লেখায় কাউকে দায়ী করা হয়নি । উগ্র নারীবাদী বা পুরুষ বিদ্বেষীও নয়, ভারসাম্যপূর্ণ একটি লেখা ।
আপনার এবং অন্যান্য সম্মানিত ব্লগারদের এই ধরণের লেখা--যা নিঃসন্দেহে সদকায়ে জারিয়াহ--নিয়ে বই বের হওয়া খুবই প্রয়োজন ।
আমার কি মনে হয় জানেন আপু এক একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব এক একরকম,স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে একজনের চাহিদামত আর একজনের স্বভাব না হলেই ঘোল পেকে যায়!
তবে আপু এমন মানুষ কম দেখিনি যারা পরিবারের মানুষকে নিজের কাজ-কর্ম দিয়ে পর করে দেয় আর পরের সাথে এমন আচরন করে যেন কলিজা কেটে দিয়ে দিতে পারবে!আশ্চর্য!শুনতে অন্যরকম শোনালেও এদেরকে আমার কেমন যেন পলিটিশিয়ান পলিটিশিয়ান মনে হয়
আফা ভালা আছইন নি? খুব দরকারী একটা পোষ্ট করেছেন। খুব ভালা লাগছে পড়িয়া।আমি এক্জন শায়খ এর লেক্চার নিয়মিত শুনি।MUFTI ISMAIL MENK. শায়খ ও এই কথা গুলো সব সময় বলে থাকেন। আফনার সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ। আর একখান কথা আমিও কিন্তু সিলেটি।ভালো থাকবেন।
বাইরের অপরিচিত কারো চেয়ে পরিবারে আমরা নিজের লোকদেরই অসম্মান করি বেশী। সংসার যেহেতু স্বামি-স্ত্রী দুজনের তাই দুজনেরই উচিত মানিয়ে চলা। ভাল লাগলো লেখাটা। ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন