এক আরব পরিবারের আতিথেয়তার গল্প

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৫:০৩:৩২ বিকাল



ব্যস্ততার হাত হতে সময় বের করা যেন ছোট শিশুর হাত হতে তার প্রিয় ললিপপটি কেড়ে নেয়ার মতই ভোগান্তিকর। অনেকটা সেই রকম ঝক্কি সামলেই আল বাহায় এই ঝটিকা সফরে আসা। তাই দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতি যাত্রার জন্য গোছগাছ শেষ করলাম। গাছের ডগার লোভনীয় ফলের লোভে দুরন্ত বালক দক্ষ গাছির মত তরতর করে মগডালে চড়ে বসলেও গাছের উপর হতে নীচে তাকালে যে রকম বুক ধড়াস করা অবস্থা হয় আমাদের ও আবস্থা এখন খানিকটা হলে ও সেরকমই। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যত তাড়াতাড়ি দিনের আলোয় এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে যাওয়া যায় ততই শান্তি।



আমরা হোটেল হতে বেশ তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেলাম। ফিরে আসার আগে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আবারো বাগান এরিয়াগুলোয় ঢুঁ মারবো। কেননা আগের বার তো ওখানে কোন মালিক কিংবা পাহারাদারের দেখা পাইনি। ওখানে পৌঁছে দেখলাম প্রায় আমাদের সাথে সাথেই একটি গাড়ি এসে ঢুকলো বাগানে। আমরা প্রথমে ভাবলাম আমাদেরই মত কোন দর্শনার্থী হবে হয়তো। কিন্তু একটু পরেই দেখলাম ওরা গাড়ি নিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। এরপর আমরা ও গাড়ি হতে নামলাম। আমাদের দেখে গাড়ি হতে নেমে আসা বয়স্ক ভদ্রলোকটি পাশের গেটটি দিয়ে বাগানে ঢুকতে ইশারা করলো। আমরা একটু অবাকই হলাম। চেনা নেই জানা নেই অচেনা এতগুলো মানুষকে এভাবে নির্দ্বিধায় লোকটি ঢোকার অনুমতি দিলো। বাগানে ঢুকে তো আমরা আগের মতই বিস্মিত, অভিভূত, সুবহানাল্লাহ! এত সুন্দর বাগান।

ফলভারে নুয়ে পড়া আনার, আঙ্গুর, আপেলে ভর্তি আমি তো মন্ত্র মুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি। আমার বান্ধবী আমাকে খোঁচা মেরে বলল- কি লেখিকাতো প্রকৃতির মাঝে এসে হারিয়ে গেলেন। প্রকৃতির মাঝে আসায় লেখিকার লাভ আমাদের চাইতে একগুণ বেশী। আমি বললাম- কেন কেন। ও বলল – বারে আমরা তো শুধু দু’চোখ ভরে দেখবো। আর তুমি তো কলমের ডগায় গেঁথে ও রাখবে। ইস এখন যদি হাতের কাছে কাগজ কলম হত না। আমি নিরবে হাসলাম ওর দুষ্টমিতে। মনে মনে বললাম- আমি আমার বুকের মাঝে এক অদৃশ্য কলমের গতিময়তা অনুভব করি সব সময়। এরই মাঝে আমার হাজব্যণ্ড বেশ উঁচু গলায় সবাইকে সতর্ক করলো- এই ওরা কিন্তু আমাদেরকে বাগান দেখার পারমিশন দিয়েছে। ফল ছেঁড়ার নয়।কেউ একটি ফল ও ছিড়বেনা। আমরা দুই বান্ধবী একে অন্যকে ফিসফিসিয়ে বললাম- ব্যস দর্শন পর্যন্তই সন্তুষ্ট? কিন্তু না একটু পরই দেখলাম লোকটি আমাদের বাচ্চাদের কাছে ডাকলো। ওরা যেতেই দু’জনের হাতে দু’টো বেশ বড় বড় শপিং ব্যগ ধরিয়ে দিল। আমরা তো একটু অবাকই হলাম। বাচ্চারা কাছে এসে বলল- আম্মু ,উনি বলেছেন আমাদের যত ইচ্ছে ফল পেড়ে নিতে। আমার হাজব্যন্ড আবার সতর্ক করলো- এই অল্প কয়েকটি নাও। বেশী নিও না। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ভেতর হতে দু’জন হিজাব পরা মহিলা এসে আমাদের ডাকলো। জমিতে লাগানো ধনে পাতা, বরবটি এ জাতীয় সবজি গুলো পেড়ে নিতে বললো। আমরা ইতস্তত করছি দেখে কাজের মহিলাকে দিয়ে ছুরি আনিয়ে নিজেরাই কেটে কেটে দিল। এরপর গাছ হতে কালো আর সবুজ আঙ্গুর পেড়ে দিলো। এত অন্তরিকতা দেখাচ্ছিলো যে আমরাতো পুরোপুরি বিস্মিত। বার বার আরো বেশী করে আনার পেড়ে নিতে ইশারা করলো। আমরা প্রায় ১৫০টির মত আনার পাড়লাম। সবুজ আপেল ও নিলাম প্রায় শ খানেকের বেশী । ওদের কাছ হতে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো তখন দু’টি মেয়ে আমাদের জন্য গাহোয়া (চা জাতীয় পানীয়) নিয়ে এলো। এরপর আমাদের হাজব্যণ্ডরা বয়স্ক লোকটির কাছ হতে বিদায় নিতে গেলে লোকটি জোর করে ওদেরকে বসিয়ে রাখলো। আপ্যায়ন করা ছাড়া যেতে দেবেনা। মেয়েরা ও এসে জোর করে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেল। প্রায় মাইল খানেকের বেশী জায়গা জুড়ে বিশাল বাগানের মাঝে একটি বাড়ি। আমরা সবাই অবশ্য বসেছি বাড়ির সামনে সুন্দর শেড দেয়া একটি জায়গায়। পরিচয় হল এই বাগানের মালিকদের সাথে ও। বৃদ্ধা শাশুড়িই এই বাগানের মালিক। তিনি তার ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতনি ও কাজের মেয়ে নিয়ে বাগান বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। অনেকটা আরব ঐতিহ্যকে স্বাগত জানিয়ে শাশুড়ি ও ছেলের বউ একটু দুরত্বে আলাদা দুটি বাড়িতে থাকেন। তাই প্রতি শুক্রবার বৃদ্ধা ছেলে আর তার পরিবারকে নিয়ে দুপুরে এখানে এক সাথে খাওয়া দাওয়া করে সময় কাটান। আজ ও তাই এসেছেন। আলাদা কেয়ারটেকার আছে এই বাগান বাড়ির দেখাশুনার জন্য। অবাক ব্যাপার ওরা এই বাগানের কোন ফলই বিক্রি করে না। আত্নীয় স্বজনদের হাদিয়া হিসেবেই দিয়ে দেয়। ওদের শাশুড়ি বউয়ের মাঝে সুসম্পর্কটা দেখার মতই। আমার বান্ধবী ওখানেই বসে বলল- ইস আমাদের দেশে শাশুড়ি বউয়ের এই সম্পর্ক তো আজকাল চোখেই পড়েনা।



সে কি আন্তরিকতা দেখালো মানুষ গুলো যা কখনো ভুলে যাবার নয়। বিশাল এক বড় ট্রেতে করে খেজুর আর বাদামের বিস্কিট নিয়ে এলো। আমরা তো খানিক আগেই খেয়ে বেরিয়েছি। সুতরাং ভদ্রতা করে সবাই এক পিস করে নিলাম। কিন্তু বৃদ্ধা মানবে না। উনি যখন দেখলেন আমরা আর খাচ্ছিনা তখন নাতনি কে বললেন ট্রে-টি আমাদের গাড়িতে তুলে দিতে। আমরা না না করে উঠলে নাতনিটি দাদীকে ইশারা করে বলল- না আমার দাদী যেহেতু দিয়েছে তোমাদের নিতেই হবে। না হয় উনি মনে কষ্ট পাবেন। এরপর আঙ্গুর পাতায় মোড়ানো এক ধরনের ভাত। এটা এখানে বেশ জনপ্রিয়। আমাদের খেতে অনীহা দেখে এটা ও বুড়ো দাদীর নির্দেশে গাড়িতে চড়ে জেদ্দা যাবার হুকুম হলো। এরই মধ্যে ২/৩ দফা চা আর গাহওয়া খাওয়া হয়ে গেছে। কি মুশকিল। ওরা যে কি খাওয়াবে। আর কি করবে মনে হয় বুঝে উঠতে পারছেনা । একটি ব্যাপার চোখ এড়ালো না। কাজের মহিলা থাকা স্বত্তেও বৃদ্ধার ক্লাস থ্রী তে পড়ুয়া নাতনী আর বড় মেয়েটি হিজাবে আপাদ মস্ত ঢেকে একটু পর পর আমাদের পাশাপাশি ছেলেদের আপ্যায়নের জন্য ও এটা ওটা নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। মনে পড়লো হিজাব সম্পর্কে যাদের আপত্তি আছে তারা অনেকে বলেন- বোরকা পরা মেয়েকে বউ করে আনলে আত্নীয় স্বজনকে পর্দার দোহাই দিয়ে খেদমত করবেনা। কিন্তু এই মেয়েগুলোকে দেখে আমার মনে হল যারা হিজাব কে স্রষ্টার পক্ষ হতে নির্দেশিত ফরয ভেবে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিতে জানে তাদের ব্যাপারে অন্তত এ অভিযোগ কিছুতেই উথ্থাপন করা যাবে না। যে হিজাব পরা বউ আপ্যায়ন করতে জানে না । সেটা তার হিজাবের দোষ নয়। বরং তার স্বভাবের মাঝে পূর্ব হতেই নেই। একই রকম উষ্ণ আন্তরিকতা দেখালেন এই বাগানের বয়স্ক ভদ্রলোকটি ও। আমাদের হাজব্যণ্ডরা উঠে আসার সময় বিশাল বক্স ভর্তি কাচা পাকা খেজুর এটা ওটা ভদ্রলোক জোর করে দিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়। বিশাল বাগানের শেষ মাথায় সমতল ছেড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ভদ্রলোক তার বাড়ির অবস্থান ও ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন। বার বার অনুরোধ করলেন আজকের দিনটা তাদের মেহমান হতে। ভদ্রলোকের নিজের অবস্থানের বাড়িটির পাশাপাশি আরো একাধিক বাড়ি খালিই পড়ে আছে। ওয়াদা করিয়ে ছাড়লেন পরের বার আল বাহায় এলে হোটেলে না উঠে উনার বাড়ির মেহমান হবার। অনাত্নীয় এক আরব পরিবারের এই আন্তরিক আপ্যায়নে আমাদের প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল। আমরা যেখানটায় বসে আছি সেখান হতে বাগানের অনেক খানি অংশই চোখে পড়ে। একটু পর পর সুন্দর এক ঠান্ডা বাতাস এসে পরশ দিয়ে যাচ্ছিল অনবরত। মানুষের মনের গতিময়তা যে কত সুতীব্র! ওই আরব পরিবারটির আন্তরিক সান্নিধ্যে বসে থাকতে থাকতেই এক সময় আমার মাঝে কেমন এক ঘোর তৈরী হল। স্মৃতির পাতা উল্টে মন চলে গেল কোন দূর আতীতে। মনে হল আমার নিজেরই বৃদ্ধা দাদী আর মায়ের সাথে আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে বসে আছি। যদি ও এত সুন্দর নয়। কিন্তু ঠিক এমনি একটি গ্রামের বাড়ি আমাদের আছে। মনে পড়ে মা শহরের নার্সারী হতে গাছ নিয়ে নিয়ে লাগাতেন। বাড়ির সাথের লাগোয়া জমিতে প্রায় ৫০০ সুপারী গাছের এক বিরাট বাগান। জলপাই, বেল, আনার, আম, কাঠাল, নারকেল, জামরুল, কাঁঠাল, আমড়া, বেলেম্বু, আতা, লিচু কত রকমের ফলের গাছ ছিলো। বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে মা যখন গ্রামে যেতেন আমাদের নিয়ে কিছু দিনের জন্য তখন ঘুরে ঘুরে গাছ পালার তদারকি করতেন ।

আমি আর ছোট ভাইয়া দুটি বড় সিমেন্টের সিড়িতে বসে আনারের লালা টকটকে ফুল দিয়ে খেলতাম। দাদী আমাদের সাথে বসে থাকতেন। সেই সব দিন গুলো আজ শুধুই স্মৃতি। দাদী চলে গেছেন আজ অনেক বছর। মা নিজেও বার্ধক্যে। আমার খেলার সাথী ছোট ভাইয়া আর আমার মাঝে জীবন টেনে দিয়েছে এক বিশাল দূরত্ব। প্রিয় জনের সান্নিধ্য পাই মাঝে মাঝে স্কাইপ-এ। আর সেই বাগান বাড়িটি আমাদের অনুপস্থিতিতে স্থানীয় মাস্তান আর তের ভুতের লুটপাটের আস্তানা হয়েছে। স্মৃতির ভেলায় চেপে জীবনের তাগিদে মুহূর্তে আবার বাস্তবে ফিরে এলাম। ফেরার পালা এবার। জেদ্দায় ফেরার পথে সাথে নিয়ে চললাম অচেনা আরব্য উপন্যাসের পাতা হতে উঠে আসা গল্পের মত এক আরব পরিবারের অন্য রকম আন্তরিকতা মধুর ছোঁয়া নিয়ে। এখানে ও শেষ নয়। আমরা জেদ্দা পৌঁছার পর সেই মহানুভব বয়স্ক লোকটি খোঁজ নিয়েছেন আমরা নিরাপদে পৌঁছালাম কিনা। মাঝে মাঝে ফোন করে তিনি এখনো আমাদের খোজ খবর নেন। গড়ায় দিন। হারায় বেলা। আজকের মধুর কোন আলাপন সময়ের পিঠ চেপে আগামীর জন্য শুধু স্মৃতি হয়ে রয়। জানিনা আর আল বাহায় যাওয়া হবে কিনা। কিন্তু সেই আরব পরিবারের আন্তরিকতার স্মৃতি গাঁথা থাকবে হৃদয়ে চিরদিন।



বিষয়: বিবিধ

৩৪৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File