আল্লাহর অগণন নেয়ামতের ভান্ডার আলবাহা
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৭ নভেম্বর, ২০১৩, ০২:১০:১০ দুপুর
ফজরের নামাজের পর হোটেলের জানালা খুলতেই কনকনে ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কায় প্রচন্ড শীত বোধ করছিলাম। যেহেতু আজ বিকেলেই আল বাহা হতে জেদ্দা ফিরতে হবে সেজন্য ভাবলাম সময়টা বরফের মত গলে যাবার আগেই যতটুকু পারি কাজে লাগাই। তাই ঝটপট বাচ্চাদের সবাইকে ডেকে উঠালাম। এরপর নাস্তা নিয়ে ছুটলাম পাহাড়ের চূড়ায়। এই পথ গুলো এত বিপদ সংকুল যে গাড়ি রাস্তা ছেড়ে ৪/৫ হাত পাশে গেলেই কয়েকশ ফুট গভীর খাদে তলিয়ে যাবে। আমি তো ভয়ে সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলাম। সব পিচ্চিরা দলবেঁধে আমাদের গাড়িতেই উঠেছে। ওরা তো হৈ চৈ জুড়ে দিল। আমার উনি ড্রাইভিং সিট হতে বলল- এই গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও। কি অদ্ভুত সুন্দর। আমার বাচ্চারা ও সমস্বরে বলল- আম্মু তাকাও, তাকাও। আমি ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বললাম-তোমরা ভালো করে জানো আমার হাইট ফোবিয়া আছে । তারপর ও আমাকে বাইরে তাকাতে বলা মানে ইচ্ছে করেই ভয় লাগানো। হায় আল্লাহ একেই বলে কপাল। কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। তোমাদের জন্যই তো এই ভয়ের জায়গায় বেড়াতে আসা। আমার এই হুতাশ শুনে পাজি গুলো মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলো।
পাহাড়ের মাথায় গাড়ি হতে নামার পর প্রথম বারের মত এই বার ও “ভয়ংকর সুন্দর’’ শব্দ দুটোই মনের মাঝে ঘুরতে লাগলো। প্রায় ২০/৩০ হাত সমতল একটি পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। পাশে গভীর খাড়া খাদ। একটু হাঁটাচলায় বেসামাল হলেই আকাশ হতে পাতালে পড়ার অবস্থা হবে। মিটে যাবে জনমের মত পাহাড়ে বেড়ানোর সাধ। এই পাহাড়ের লাগোয়া পাহাড় গুলোর মাথার কাছে বুড়ো দাদুর মাথার সফেদ চুলের মত সাদা মেঘ জমে আছে এখানে ওখানে। মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ওখানটায় নাস্তা সেরে আমরা আবার নীচের দিকে নামতে থাকলাম। যত তাড়াতাড়ি নামা যায় ততই মুশকিল আসান। কেননা ভেতরে ভেতরে আমার অবস্থা যে ‘ছেঁড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।‘
বাচ্চারা একটু মন খারাপ করলো ওদের পুরনো বন্ধু গতবারের বানরদের দেখা পেলনা বলে। সমতলে নেমে হাঁফ ছেড়ে আমি ওদের আক্ষেপের জবাবে বললাম- কি আর করা। বানর গুলো হয়তো বুঝতে পেরেছে দুষ্টমিতে তোমরা ওদের চাইতে আরো এক ধাপ স্মার্ট। তাই লজ্জায় কোথাও মুখ লুকিয়ে বসে আছে।
সমতলে নামতেই হঠাৎ চোখে পড়ল একটু দূরেই প্রায় মাথা সমান লম্বা কিছু গাছ স্কুলের বাচ্চাদের এসেম্বলীর ভঙ্গিতে সারি বদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতির সাথে আমার বরাবরই বেশ সখ্যতা। আমার বাসার চৌহদ্দির মাঝে যত গাছপালা আছে তাদের প্রতিদিনকার হালচাল আমার নখদর্পণে থাকে। আমি চেঁচিয়ে উঠে আমার হ্যাজব্যন্ডকে বললাম- এই চলনা ওখানটায় একটু ঢুঁ মেরে আসি। সবাই আমার কথায় সম্মতি দিল। ক্ষেতে ঢুকে দেখলাম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভুট্রা গাছগুলো দূর হতে ভারিক্কি চালে বেশ তাগড়া জোয়ান ভাব দেখালেও আসলে তারা এখনো নাবালকই। তাদের কোলে পিঠে ঝুলে থাকা ভুট্রার থোড় গুলো এখনো নিতান্তই নবজাতক।
ওমা গাছের নীচে তাকিয়ে দেখি কুমড়ো পাতার মত বড় বড় পাতার এক ধরনের গাছ পুরো বাগানেই সারিবদ্ধ করে লাগানো। গাছগুলো লম্বায় বিঘত দুয়েক উচ্চতার অধিকারী হলেও ওগুলোর পাতার ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য সবজি ধরেছে। বুঝলাম লম্বায় গাছ গুলো ভুট্রা গাছ গুলো হতে অনেক ছোট হলেও আসলে কিন্তু ইঁচড়ে পাকা। সবজি গুলো দেখতে খানিকটা আমাদের দেশের লাউয়ের মত । যদিও সাইজ লাউয়ের চাইতে বেশ ছোট। এগুলোকে যুক্কিনি বলে। কেউ বলে কুচা। আমাদের এক দঙ্গল বাচ্চাকাচ্চার মিছিল সমেত গ্রুপটিকে দেখে বাগান হতে লোকজন বেরিয়ে এলো। ওরা কাগজের কার্টুনে করে কুচা তুলছিল জমি হতে। আমারা কিনতে চাইলে লোকটি আরবীতে বলল- তোমরা আমাদের এই শহরের মেহমান। তোমাদের কাছে কি করে বিক্রি করি। ওরা হাদিয়া ( উপহার) স্বরুপ বিনে পয়সায় দুই কার্টুন সবজি আমাদের দিয়ে দিল। আমরা নিজেরা ও বেশ কিছু সবজি তুললাম। প্রায় ১৭/১৮ কিলো সবজি। বার বার টাকা নিতে সাধাসাধি করাতে লোকটি বলল- না, না এটা আয়েব । আমরা সেই বাগান হতে আঙ্গুলের নখের সমান এক ধরণের তীন পেড়ে খেলাম। বেশ মজার ফল গুলো।
এরপর সেই সবজি ক্ষেত হতে বেরিয়ে আমাদের সামনের গাড়িটি কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা..... এই দুরভিসন্ধি নিয়েই যেন একটি অজানা পথের ধূলো মাড়িয়ে ছুটে চলল স্কুল পালানো বালকের দুরন্তপনায়। বেশ অনেকখানি গিয়ে রাস্তাটি খাড়া পাহাড় হতে সোজা নিচে গড়িয়ে পড়লে যে রকম হয় ঠিক তেমনি উঁচু রাস্তাটি ছেড়ে নাক বরাবর সোজা মার্বেলের মত গড়িয়ে নেমে গেল। এক যাত্রায় তো দুরকম হবার যো নেই তাই আমরা ও আগের গাড়ির অনুসরণ করে ঠিক সেই ভাবে গড়িয়ে পড়লাম। ভয়ে সবার চোখ বন্ধ করে সে কি আর্তচিৎকার। যখন চোখ খুললাম দেখি পুরো পরিবেশটিই বদলে গেছে।
চারপাশে অদ্ভুত এক সবুজের সমারোহ। ছোট ছোট পাখিদের কিচির মিচির উড়াউড়ি। মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। একটু দূরে হঠাৎ চোখে পড়লো লাল লাল বলের মত কি যেন গাছে ঝুলছে। আমি সেদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে গাড়ি ঘোরাতে বললাম। গাড়ি হতে নামার পর সত্যিই বিস্মিত হলাম। আশে পাশে পুরো এলাকাটি জুড়ে কেবল বাগান আর বাগান। গাছে গাছে লাল বলের মত জিনিস গুলো সব পাকা পাকা আনার।
একটু কাছে যেতেই লতানো গাছের গায়ে গায়ে চোখে পড়লো অসংখ্য আঙ্গুরের থোকা। পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে ফল খাচ্ছে। নিজের অজান্তেই হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ ‘সুবহানাল্লাহ’ শব্দটি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। চারপাশের বাগানের গাছগুলোতে যত না পাতা তার চাইতে বেশী পাকা আনার। আমরা একটি বাগানের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু চারপাশ কেমন সুনশান নিরবতায় ভরা। কেউই বেরিয়ে এলনা। হঠাৎ দেখি এর পাশেই আর একটি বাগান একদম খোলা । কোন গেট কিংবা দেয়াল নেই। আমরা সবাই সেখানে দলবেঁধে ঢুকে পড়লাম। স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি সম্ভার দেখলাম অপলক চোখে। বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলো কোনটি লাল লাল আপেলে ভর্তি, কোনটি প্লামে ভর্তি, কোনটিতে নাশপতি, কোনটিতে সবুজ আপেল, লতানো গাছে থোকা থোকা সবুজ ,কালো আঙ্গুর। যে পরিমাণ গাছে ধরে আছে সেই পরিমাণ ঝুড়ি ঝুড়ি ফল গাছের নীচে পড়ে আছে।
কত অগণনবার যে আমরা কৃতজ্ঞতার স্বতঃর্ফুত বহিপ্রকাশ হিসেবে সুবহানাল্লাহ বললাম। কেননা মরুভূমির রুক্ষতার মাঝে এই প্রাণ সম্ভারের অস্তিত্ব আমাদের কাছে সত্যিই যে অকল্পনীয়। এসব ফল যে এখানে জন্মে তাই আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল।
আশে পাশের বাগান গুলোতে ও খোঁজ নিয়ে কারো দেখা মিললো না। সময়টা জুমার নামাজের সময়। বুঝলাম স্রষ্টার অবারিত নেয়ামতের শোভা এইসব বাগানের পরিচর্যাকারীদের মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে সচেতন করতেও ভুলেনি। সময়টি যেহেতু জুমার নামাযের। সব বাগানের লোকেরা আগে আগেই নামাযে চলে গেছে। এত বিশাল বিশাল ফলভর্তি বাগান গুলো এমনি অরক্ষিত রেখে লোকজন সব নামাজে চলে গেছে! প্রভুর প্রতি কি অদ্ভুত তাওয়াক্কুল । আমরা গোনাহগার,নগন্য বান্দারাও সেই বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এই অরক্ষিত বাগান গুলোর একটি পাতা ও ছিঁড়লাম না। মুগ্ধতার এই ভরা জোয়ারে ও আলহামদুলিল্লাহ আমরা চেতনা হারালাম না। বাচ্চাদের সতর্ক করে দিয়ে বললাম- আমরা শুধু বাগানটি দেখতে ঢুকেছি। কারো অনুমতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত খবরদার কেউ গাছের একটি পাতা ও ছিঁড়বেনা। (আগামী পর্বে সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
২৩৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন