আকাশের সীমানায় পাহাড়ের ঠিকানায় (চলুন ঘুরে আসি)
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১২ নভেম্বর, ২০১৩, ১২:৫৪:১৪ রাত
সারাক্ষণ অক্টোপাশরে মত ঝাপটে ধরে জড়িয়ে থাকা ব্যস্ততার চাদরটাকে মাঝে মাঝে যখন দূর্বহ মনে হয়। ঠিক তখনি সবুজ প্রকৃতির প্রশান্তিময় নির্জনতা যেন দু'হাত বাড়িয়ে স্নেহময়ী মায়ের মত ডেকে ওঠে- আয় খুকু আয়...। সেই সম্মোহনী ডাক উপেক্ষা করা তখন সত্যিই মুশকিল হয়ে পড়ে। আসলে শহুরে জীবনের মেকী অবয়বটা যদি ও জীবনের তাগিদেই সয়ে নিতে হয়। কিন্তু তারপর ও মনটা ঠিকই সারাক্ষণ একটু শান্তির পরশ পেতে মুখিয়ে থাকে। মনের এই উম্মাদনা টের পেতেই চট করেই ছুটলাম - আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ....। ঠিক সেখানটায় । যাত্রাটা ছিলো -উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে এজাতীয় আকস্মিক।
এখন বাচ্চাদের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার। আমার উনার ও তাই। আমার বান্ধবী নাহিদের হাজব্যন্ড সাইফুদ্দিন ভাইর সমস্যা মাথায় রেখে আমরা বৃহস্পতিবার দুপুর ২.৩০ এ বের হলাম। যাত্রাসঙ্গী হিসেবে আমাদের দুটি পরিবারের সাথে আর আছেন আমার বান্ধবীর কাজিনের হাজব্যন্ড বাবুল ভাই।
যাত্রা হল শুরু। জেদ্দা থেকে বের হতে এত বেশী পরিমাণ জ্যামে পড়তে হল যে মেজাজটা একটু খিঁচড়ে গেল। আমার বাচ্চারা দেখি বেশ খুশিই আছে। গাড়ির জানালা দিয়ে মনের আনন্দে লোহিত সাগরের ছবি তুলছে। অবশ্য দুপুর গড়ানো এই সময়ে রোদের আলোর কুঁচি সাগরের পানির গায়ে অন্যরকম এক বর্ণিল আবহের সৃষ্টি করেছে। যাক তাও ভালো। কেননা বাচ্চারা একবার বিগড়ে গেলে সব কিছুই পন্ড হবার উপক্রম হয়।
দীর্ঘ সময়ে জ্যাম ছাড়িয়ে আমরা এবার মূল যাত্রা পথে পড়লাম। যাত্রা পথটি খুবই ফাঁকা। আশে পাশে গাড়ির উপস্থিতি হাতে গোনা যায়। দু'পাশে মরুভূমিতে মাঝে মাঝে উট আর ভেড়ার পাল। এখানকার ভেড়ার পাল গুলোকে দূর হতে আমার কাছে তুলার বল এর মতই মনে হয়। এরা এত বেশী স্থির প্রকৃতির! প্রায়শই দেখি নট নড়ন চড়ন। আমি আমার হাজব্যন্ডকে বললাম- আমাদের দেশের গরু ছাগল দেখেছো? কি পরিমাণ চঞ্চল। দৌড়াদৌড়ির সাথে তাল রেখে গলাবাজি ও করে সমান পরিমাণ। আর এখানে প্রাণী গুলো মনে হয় বেশ আলসে টাইপের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া ছাড়া আর তো কিছু করতে দেখিনা।
গাড়ির ফ্রন্ট মিরর দিয়ে আমার দৃষ্টি ছুটে যাচ্ছিল বারংবার প্রায় ফাঁকা রাস্তা ছুঁয়ে দিগন্তের কাছে। রাস্তার মাঝে মাঝে মরু মরীচিকা পানির অস্তিত্বের মিথ্যে ধারণা জাগাচ্ছে মনে। আমার মনের ভাবনার সুইচ আলহামদুলিল্লাহ সব সময়ই অন থাকে। নিরব মনটা আমায় বলল- জীবন চলার পথে মিথ্যে ভুলের তোড়ে নিজকে ভাসিয়ে না দিয়ে যে পথিক সোজা সঠিক গন্তব্য ধরে চলে সেইতো কেবল সঠিক মঞ্জিলে পৌঁছুতে পারে। আর মুক্তির সঠিক পথ ছেড়ে মিথ্যে মরীচিকার পানে ধায় তো কেবল নির্বোধেরাই। দৃষ্টি সীমায় ছড়িয়ে থাকা আকাশের শুভ্র চাদরটা আমায় মনে করিয়ে দিলো স্রষ্টার দেখিয়ে দেয়া সঠিক পথেই রয়েছে এই সফেদ আকাশের মত হেদায়াতের শুভ্রতা।
মরুভূমির এখানে ওখানে পরস্পর হতে বেশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলো আমার ছোট মেয়েটির মনে চিন্তার খোরাক জোগালো। -আম্মু এই গাছগুলো একটি হতে অন্যটি এত দূরে দূরে কেন? আমি বললাম- আমি তো জানিনা। মনে হয় ওদের ঝগড়া হয়েছে। সে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে সায় দিলো আমার কথায়। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম- সে এখন এই পরস্পর বিচ্ছিন্ন গাছগুলোকে ওর আপুদের মত কুঁদুলে স্বভাবের বলেই ভাবছে হয়তো।
মজার একটি বিষয় চোখে পড়লো কিছুক্ষণ পর পর দলবেঁধে বেশ কিছু ধূলো মরুভূমি হতে রওনা হয়ে রাস্তার ডান হতে বাম পাশে পাড়ি দিচ্ছে। দৃশ্যটি বেশ মজার। আমার পিচ্চিটার চোখে পড়তেই সে হৈ চৈ করে উঠলো। বললো- আম্মু, ওরা দল বেঁধে কোথায় যাচ্ছে একটু পর পর। আমি মজা করে বললাম- ওপাশের মরুভূমিতে আজ বোধহয় ওদের দাওয়াত পড়েছে। সে আমার কথায় বেশ মজা পেল। উচ্চ স্বরে হেসে উঠে বলল- তাহলে সবাই কেন যাচ্ছে না সেই দাওয়াতে? আমি বললাম- বারে সে কি কথা? একই দাওয়াতে সবাইকে বুঝি ডাকা হয়? যাকে দাওয়াত দেবে সেই তো কেবল যেতে পারে। ও বুঝলো। এরপর সারারাস্তায় যতবার এই ধূলো উড়ার দৃশ্য দেখল ও মজা করে বারে বারে বলতে লাগলো- আম্মু, দেখ ওদের ও বুঝি দাওয়াত পড়েছে।
তবে ধূলোদের এই পথ অতিক্রম হতে একটি বিষয় আমার মনে হল। প্রচন্ড বেগে দল বেঁধে উড়তে থাকা ধূলো গুলো আকস্মিক ভাবে ছুটে আসা কোন চলন্ত গাড়ির চাকার নির্মমতায় বিশৃংখল হয়ে সাময়িক যাত্রা বিরতি দিলেও পরক্ষণেই ওদের দলবদ্ধ দূর্বার গতি ঠিকই ওদেরকে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। আমার নিরব মন বলল- ঠিক এমনি করেই একদল সুশৃংখল মানুষের দূর্বার আন্দোলন আকস্মিক কোন ঝড়ে সাময়িক ভাবে মুখ থুবড়ে পড়লেও তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ঠিকই এক সময় সেই অভিযাত্রীদের কাঙ্খিত স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপে পৌঁছে দেবেই দেবে। তবে এর জন্য চাই এই ধূলোদের মত নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে শৃংখলাবদ্ধ হয়ে গন্তব্যের পানে পথ চলা। সাময়িক আঘাতে মুষঢ়ে না পড়ে পথ চলা অব্যাহত রাখা।
পথে নামাজের জন্য আমাদের যাত্রা বিরতি দিতে হল সময়ে সময়ে।এমনি করে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সমতল ভূমি ছেড়ে বিপদ সংকুল পাহাড়ী ২৫টি ট্যানেল পেরিয়ে জেদ্দা হতে প্রায় ৪৩০ কি. মি. দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা রাত দশটায় পৌঁছালাম পাহাড়ের মাথায় ''আল বাহা''য়। বেশ সুন্দর এক ঝটকা প্রশান্তিময় ঠান্ডা আবহাওয়া স্বাগত জানালো এই অনিমন্ত্রিত অতিথিদের অকৃপণ ভাবে দু'হাত বাড়িয়ে। সেই রাতে আর কোথাও যাওয়া হল না। হোটেলে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট নিলাম আমরা। ছেলেরা একটি ফ্ল্যাটে মেয়েরা অন্যটিতে। দীর্ঘ প্রায় এক কুড়ি বছর পর আমরা দু'বান্ধবী সারারাত জেগে জম্পেশ এক আড্ডা দিলাম। কত স্মৃতি,কত বিস্মৃতির গায়ে বিলীন হয়ে যাওয়া স্মৃতিদের খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁচিয়ে তোলা। ( সম্মানিত পাঠক,বাকী গল্প অন্যদিনের জন্য তোলা রইলো।
বিষয়: বিবিধ
২৭৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন