চাকরিজীবী বঙ্গ ললনার হা হুতাশ

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০২:৪৪:৫৯ দুপুর

ভদ্র মহিলার সাথে পরিচয় হয়েছিলো একটি দাওয়াতে। হাসি খুশী প্রাণ খোলা মানুষ। বেশ মজা করে কথা বলেন। তাই প্রথম দর্শনেই ভদ্র মহিলাকে বেশ ভালো লেগে গেল। তিনি জেদ্দায় নবাগত।

এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বললেন- ভাবীরা, জানেন কয়েক দিন আগে না একটি কান্ড ঘটেছে আমার বাসায়। কে যেন এসে দরজার বাইর হতে কলিং বেল বাজালো। আমার স্বামী মটকা মেরে শুয়ে আছে। বেল শুনে আমাকে বললেন- এই যাও তো দরজা খুলে দেখতো কে এসেছে? জানেনই তো আমরা এখানে নতুন।

তাই আমি সভয়ে বললাম-আমিই যাবো? নাকি তুমিই যেয়ে দরজাটা খুলবে। ও বললো- সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এত ক্যাচালের কি দরকার? যাও তো তুমিই দরজাটা খুলে দাও। সুতরাং কি আর করা? আমিই গিয়ে দরজা খুললাম। ওমা দেখি দরজার সামনে সাদা তোপ পরা এক লোক দাঁড়িয়ে। আন্দাজ করলাম আমাদের পাশের প্রতিবেশী হবে। কিন্তু কি ব্যাপার ? আমাকে দেখে লোকটি সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। আরবী তো আর জানিনা। তাই ইংরেজীতে বললাম- কাকে চাই?

ভদ্রলোক বললো- তোমার স্বামীকে ডেকে দাও।

তখন আমি গিয়ে আমার স্বামীকে ডেকে দিলাম। ও কতক্ষণ পর এসে বিরক্ত হয়ে বলল- বেকুব লোক। এই কথা দরজা খোলার পর তোমাকেই তো বললে হয়ে যেত । আমাকে শুধু শুধু ডাকার কি দরকার ছিলো?

আমি তখন দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম- এই যে প্রতিটি ব্যাপারে আমাকেই সামনে ঠেলে দাও। আমার তো মনে হয় এ দেশে থাকলে তোমার শিক্ষা হয়ে যাবে। যখন তখন আমাকে দিয়ে অন্তত দরজা খুলতে পাঠাবেনা।

এরপর আমি মনে মনে ভাবলাম লোকটি কেন আমার সাথে কথা বললো না? সে কি মহিলা দেখে আমাকে আন্ডার স্টিটিমেট করলো। মনে পড়লো এক আত্নীয় সৌদি আরব আসবো শুনে আফসোস করে বলেছিলেন- তুমি সেই বর্বরদের দেশে যাবে। যারা এক সময় ভেড়া ছাগল চরিয়ে এখন হালে বড়লোক হয়েছে। ওরা তো মেয়েদের সম্মান করেনা। আমার মনটা সত্যিই খুব খারাপ হল। কিন্তু আমার সে ভুল ভেঙ্গে গেল গত কয়েক দিনে। আমি যখনই আমার বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতে বের হই যতবরই লোকটির সামনে পড়ি দেখি সে তাড়াতাড়ি এক পাশে সরে গিয়ে আমাকে আগে যাবার সুযোগ করে দেয়। লিফটের সামনে গেলে ও সে সরে আগে আমাকে আর আমার বাচ্চাদের অগ্রাধিকার দেয়।

আমি চুপচাপ কথা গুলো শুনে বললাম- কিন্তু ভাবী আপনি কেন দরজা খুলতে যান? ভাইয়া বাসায় থাকলে উনিই তো খুলবেন। আমার স্বামী বাসায় থাকলে আমি জীবনেও দরজা খুলতে যাইনা।

মহিলা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলেন- ভাবী,আপনারা তো উপরওয়ালার কাছ হতে বিশেষ ভাগ্য নিয়ে এসেছেন। আর আমি তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি। অন্যরা বেশ উচ্চস্বরে তার কথায় হাসলো। বুঝলাম তার পায়ে কুড়াল মারার গল্প বাকীরা জানে। আমি ছাড়া। তাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলাম।

ভদ্র মহিলা আবার বললেন- জানেন বিয়ের পর আমার প্রথম বাচ্চাটির জন্মের সময় যখন ডাক্তার দেখাতে যাবো তখন অফিস হতে ফিরে ফোন করে ওকে বললাম- এই শোন তাড়াতাড়ি এসো। আমি ডাক্তারের কাছে যাবো।

তখন ও বললো- কেন সমস্যা কি? তুমি তো একাই চলে যেতে পারো। না হয় তোমার মা'কে সাথে নাও।

বাচ্চাটার জন্মের আগে যতবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছি ও মাত্র হাতে গোনা কয়েকবার আমার সাথে গিয়েছে। অথচ আশেপাশের বেশির ভাগ মহিলাদের দেখতাম তাদের স্বামীরা ও সাথে যেত।

আমি শুনে অবাক হয়ে বললাম- কেন ভাবী ভাইয়া কেন এই রকম করতেন?

ভদ্র মহিলা আবার উনার নিজস্ব ভঙ্গিতে একটু টেনে টেনে বললেন-ওই যে বললাম, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছি। অন্যদের মাঝে আবারো হাসির রোল উঠলো। আমি বেচারা আগের মতই চুপ।

ভদ্র মহিলা আবার শুরু করলেন- জানেন, আমার দ্বিতীয় বাচ্চাটার জন্মের আগে ডাক্তারের কাছে যখন প্রথম বার গেলাম তখন বয়স্ক নার্সটি আমাকে হাত ধরে সাহায্য করতে গেলে আমি বললাম- না না অসুবিধা নেই । আমি যেতে পারবো। তখন মহিলা হেসে বললো- আরে বুঝনা কেন এখনই তো স্বামীর কাছ হতে বেশী বেশী এটেনশন পাওয়ার সময়। কারণে অকারণে শুধু উহু আহা করে শব্দ করবে। দেখবে তোমার স্বামী কেমন টেনশন নিয়ে তোমার জন্য ছুটে আসে। তা না করে এই রকম গটগট করে হেঁটে চললে সে তো তোমার জন্য ছুটে আসবে না।

ভদ্র মহিলা বললেন- আমি নার্সকে কিছু বললাম না। কিন্তু মনে মনে বললাম- সেই এটেনশন পাবার পথ তো আমি নিজ হাতেই বন্ধ করে দিয়েছি। আমি তো নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছি।

সবাই হাসতে হাসতে বলল- আহারে বেচারী।

আমি আর চুপ থাকতে না পেরে বললাম- ভাবী আপনার নিজের পায়ে কুড়াল মারার রহস্যই তো আমি বুঝলাম না।

তখন উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ওহ সরি আপনার সাথে তো আজকেই পরিচয়। তাই বলা হয়নি। বাকীরা জানে সে গল্প। আমি তো বিয়ের অনেক আগ হতে বেশ দাপটের সাথে চাকরি করতাম। উনি একটি বড় প্রতিষ্ঠানের নাম ও উল্লেখ করলেন। সেই সাথে পজিশন ও। কিন্তু বেচারী নিরহঙ্কারী গলায় বললেন- জানেন ভাবী, সেটাই আমার কাল হয়েছে। বিয়ের পর হতেই দেখি আমার স্বামীর আমার উপর ওভার কনফিডেন্স। বলে-তুমি তো স্বাবলম্বী। একা একাই সব করতে পারো। একারণে আপনাদের হাউজ ওয়াউফদের মত কারণে অকারণে স্বামীর মনযোগ পাওয়া তো দূরের কথা । অনেক সময় ও ওর দায়িত্বগুলো ও আমার কাঁধে চাপিয়ে দিতো। আমি ও নিরবে করে যেতাম। কেননা আমি সেটা পারি। কিন্তু আজ দু'টো সন্তানের মা হবার পর মনে হচ্ছে আমি ঠকে যাচ্ছি। স্রষ্টার পক্ষ হতে নারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমি মনে হয় নিজেই নিজের জীবনটা কঠিন করে ফেলেছি। আর অনেষ্টলি বলছি। আপনাদের স্বামীরা যখন বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আবার রাস্তা পার হওয়ার সময় আপনাদের হাতটা ও অনেক ভালো বাসায় মুঠোয় পুরে নেয় তখন মনে হয় সত্যিই আমি খুব ঠকে যাচ্ছি। এই ভালোবাসা পাবার অধিকারটা তো আমারো ছিলো। শুধু মাত্র নিজের অর্জিত মেধাকে নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি কম্পিটিশনে নামতে গিয়ে নিজকেই যে নিজে ঠকিয়ে চলেছি।

কথার এই পর্যায়ে ভদ্র মহিলার গলায় আর দুষ্টমির আঁচ পেলাম না। মনে হল চিরায়িত সেই নারীই যেন আধুনিকতার রংচটা মেকাপ মুছে নিজের আদি অকৃত্রিম অঙ্গনে ফিরে যাবার দাবী জানাচ্ছে। আমি অবাক হলাম।

কিন্তু দেখলাম অন্যরা তখন- না, ভাবী আপনি অনেক লাকি। নিজস্ব আর্থিক স্বাধীনতা আছে। যখন যা খুশী করতে পারেন। এই ভাবে কথার ধুয়া তুললো।

মহিলা হাসতে হাসতে বলেন- হু আর্থিক স্বাধীনতা। আমি তো অনেক সময় আমার জন্য জিনিস পত্র কিনতাম নিজের টাকাতেই। কেননা সে সামর্থ আমার ছিলো। আর আপনাদের স্বামীরা তো তাদের টাকায় কিনে এনে যখন বলে দেখি চোখ খোল তো - দেখ পছন্দ হয় কিনা। সেই রোমান্টিক মুহূর্ত গুলো তো আমার জীবনে কখনো এলোই না।

আমি চুপচাপ চাকরিজীবী আর গৃহিণীদের পরস্পরের ভিন্ন ধর্মী মতামত শুনেই যাচ্ছেলাম। ভদ্র মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- কি ব্যাপার? আপনি দেখি একদম চুপ।

আমি বললাম- ভাইরে আমি এখন কবিতার বাঁকে বাঁকে হেঁটে চলেছি নিরবে। ওই যে সেই কবিতাটা- নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস/ ওই পাড়েতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস।

সবাই এবার এক যোগে হো হো করে হেসে উঠলো। সম্মানিত পাঠক,স্বামী সন্তানদের নিয়ে একটি সুপ্রিয় সান্নিধ্যের আকুলতা আর একটি ভালোবাসাময় নিরাপদ গৃহকোণ পাওয়ার লোভে ভাবীটি শেষ পর্যন্ত আর চাকরীর পথে পা'ই মাড়াননি।

বিষয়: বিবিধ

১৪০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File