আমার বাচ্চাদের মানোজগতে বিশ্বজিত হত্যাকান্ডের প্রভাব

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০২ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:০৮:৩৮ রাত

আমি এক কানাই মাষ্টার/ পড় মোর বিড়াল ছানা তিনটি / আমি তাদের বলি ক খ গ ঘ ঙ/ আর তারা কেবল বলে মিঁউ মিঁউ...

বাচ্চাদের ষাণ্মাসিক পরীক্ষা চলছে। আর আমি বেচারা অভিনয় করছি কানাই মাষ্টারের রোলে। ছোটজনকে একটু তাড়াতাড়িই ছুটি দিলাম সেদিন। দেখি ছুটি পেয়ে সুবোধ বালিকার মত বিছানায় বসে গেল কি যেন আঁকতে। বেশ অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে আমার সামনে একটি পেপার তুলে ধরে বললো- আম্মু ,দেখতো আমি কি লিখেছি? লিখাটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বিস্ময়ে আমার চোখ রীতিমত কপালে উঠে গেল।

এই ফাঁকে একটু বলি আমার বাচ্চারা যে স্কুলে পড়ে সেখানে প্রথম ল্যঙ্গুয়েজ ইংরেজী, দ্বিতীয় আরবী, তৃতীয় ফ্রেঞ্চ। গোটা স্কুল মিলিয়ে ৫/৬টি বাংলাদেশী স্টুডেন্ট। তাই বাংলার আশা সুদূর পরাহত স্বপ্নের মত। আমার ছোট মেয়েটি বাংলা বলতে পারলে ও লিখতে কিংবা পড়তে পারেনা। ও আবার আমাকে তাগাদা দিলো। আম্মু পড়ে দাওনা আমি কি লিখেছি? আমি পড়ে শোনালাম- ১৮ দলীয় জোটের ডাকে সারাদেশ ব্যপী অবরোধ ও হরতাল।

আমি বললাম- এটা কি করে লিখেছো? সে তখন একটি পত্রিকার কপি আমাকে দেখালো। বুঝলাম সেটা কপি করেছে না বুঝেই। এরপর ও আমাকে বললো আম্মু নীচে কি এঁকেছি দেখ? আমি তাকিয়ে দেখলাম বেড়া জাতীয় কিছু। একপাশে লাল লাল কিছু চিহ্ন। আর এ পাশে বেশ কালো রং। আমি বললাম- কি এঁকেছো বুঝতে পারছিনা।

তখন আমার মেয়ে আমাকে বলল- আম্মু, টিভিতে দেখনা হরতাল হলে পুলিশ ধরে ধরে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। এই বেড়া বেড়া জায়গাটা এঁকেছি জেলখানা। আর লাল লাল দাগ গুলো হচ্ছে বিশ্বজিতের রক্ত। আর এই পাশে কালো জায়গাটা হচ্ছে কবর।

সম্মানিত পাঠক, আমার ৬ বছরের মেয়ের অনুভবের এই বাস্তব চেহারা দেখে বিস্ময়ে আমার মুখে কিছুক্ষণ কথা জোগালনা।

এদিকে বিশ্বজিতকে যে দিন মারা হল আমি হাতের কাজ করতে করতে খবর শুনছি। দেখি হঠাৎ আমার ক্লাস ফাইভে পড়া মেঝ মেয়েটি এসে আমাকে ঝাপটে ধরলো। দেখলাম ও বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর ধাতস্ত হয়ে মেয়ে আমায় জড়ানো গলায় বললো- আম্মু ওটা দিয়ে ..ওটা দিয়ে মানুষ মারতে হয়না। ওটা ওটা তো কোরবানির গরু কাটার জন্য। আমি থতমত খেয়ে বললাম - কি বলছো তুমি। তখন বড় মেয়েটি উত্তেজিত গলায় বলল- আম্মু ওরা চাপাতি দিয়েই মানুষটিকে মারছিলো। আসলে হাতের কাজ করছি বলে খবরটি শুনলে ও আমি দেখতে পাইনি তখন। তাই আমি বাচ্চাদের বললাম- কি যা তা বলছো। চাপাতি দিয়ে মানুষ মারবে কেন? আমার বাচ্চাদের উত্তেজনা দেখে আমি পরবর্তী নিউজের জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করলাম।

আমার সেভেনে পড়ুয়া বড় মেয়েটি একদিন স্কুল হতে ফিরে দেখলাম ডায়রীতে কি যেন লিখছে। আমি বললাম- কি লিখছো? তখন ও করুণ মুখ করে বলল- আম্মু, আমি বিশ্বজিতকে মারার ঘটনাটি লিখে রাখছি। শুনে খারাপ লাগলো আমার। আমার মেয়েটি গত কয়েকদিন ধরে আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছিলো কাউকে কেউ অন্যায় ভাবে মেরে ফেললে কি শাস্তি হয় এ সংক্রান্ত বিষয় গুলো। আজ আমার মেয়েটি নরম গলায় বললো- মাম আই ওয়ান্ট টু প্রে ফর বিশ্বজিত। আমি ওর দিকে নিরব চোখে তাকিয়ে বললাম- মানে। তখন আমার মেয়েটি বলল- আম্মু, এটা কেমন কথা। একটা মানুষকে এমন করে কুপিয়ে মেরে ফেললো। ও হিন্দু হলে ও আমি ওর জন্য দোয়া করতে চাই । আল্লাহ যেন ওকে জান্নাত দিয়ে দেন। আমি দেখলাম আমার মেয়ের ফর্সা মুখটা আবেগে লালচে হয়ে উঠেছে। তাই নরম গলায় বললাম- দেখ মা,তুমি যেমন পার্সপোর্ট ছাড়া কোন দেশে ট্রাভেল করতে পার না। তেমনি ঈমান না থাকলে ও জান্নাতের হকদার হওয়া যায়না। তবে তুমি ওর জন্য প্রার্থণা করতে পারো। আল্লাহ তো রাহমানু রহিম। তিনি যদি তোমার দোয়ায় ওর পরাকালীন জীবনে শাস্তি কমিয়ে দেন।

আমার মেয়ে আর একদিন স্কুল হতে এসে বলল- আম্মু, আজ আমার সাউথ আফ্রিকান বান্ধবীটি আমাদের জিওগ্রাফি ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করেছে- ম্যাডাম ম্যাপে দেখাচ্ছে পাকিস্তান বাংলাদেশ হতে অনেক দূরে। তবে ওরা কেন বাংলাদেশকে নিয়ে নিতে চেয়েছিলো? তখন ম্যাডাম বললেন- তাই তো ওরা ১৯৭১এ বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলো। আমার মেয়ে বললো- আমি তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললাম- ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস।

আর একদিন স্কুল হতে ফিরে আমার বড় মেয়েটি বলল- আম্মু, আমার ফ্রেন্ড বলেছে ওদের দেশে যারা যত বেশী দুর্নীতি করে তারাই বেশী ক্ষমতায় যায়। ও আমাকে প্রশ্ন করেছে আমাদের দেশে ও কি এরকম? আমি জবাবটা এড়িয়ে গেলাম্। বুঝলাম ও ওর বান্ধবীদের সাথে সব কিছু শেয়ার করছে। সেদিন বিশ্বজিত হ্ত্যাকান্ডের পর বললাম- তুমি কি এটা তোমার ফ্রেন্ডকে বলেছো? ও মুখ নীচু করে বললো- হ্যাঁ।

পাঠক আমি শংকিত আমার বাচ্চাদের নিয়ে ওরা দেশের এইসব সংঘাতপূর্ণ ব্যাপার গুলো স্কুলে ও শেয়ার করছে। সেদিন এক ভাবীকে যখন কথাটা বললাম তখন উনি বললেন- এক কাজ কর ওদেরকে টিভি নিউজ দেখতে দিওনা।

আমার তখন আল মাহমুদের মত মনে হল- আমি অণ্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকবে?

সামনে পরীক্ষার পর দু'সপ্তাহের বন্ধ। বাচ্চারা জীবনে এই প্রথম বারের মত এই ছুটিতে বাংলাদেশে যেতে আবদার ধরলো না। আমার মনে হল আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা আজকের উপ্তত্ত বাংলাদেশকে দেখে প্রবাসে বেড়ে উঠা আমার শিশুদের দেশের প্রতি বিরাগ ভাজন করে তুলবে না তো?

বিষয়: বিবিধ

১২৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File