মুমিনের জীবনের বাঁকে বাঁকে বদরের সেই স্মৃতি আজো ডাকে.....

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২০ জুন, ২০১৩, ০৭:০০:৪২ সন্ধ্যা



বাচ্চাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। ''মা ছুটিতে বাড়ি ফিরছি- বলার অদম্য ইচ্ছেটা নিয়তির কালো থাবায় এক প্রবাসী হৃদয় হতে ফেরারী হয়ে যাওয়ায় ছুটলাম মদীনার পানে। সাথে আছেন এবার অষ্ট্রেলিয়া হতে নবাগত একটি পরিবার । উনারা এই প্রথম বারের মত মদীনায় যাচ্ছেন। তাই চলার পথের দৃষ্টি সীমানায় দেখা শুধু পাথুরে পাহাড় আর জনহীন ধুধু মরুপ্রান্তর নিয়ে উনাদের বিস্ময় ছিল অনেক। পথে পথে দেখা ভেড়ার পাল আর উটের দল উনাদের বাচ্চাদের অনেক প্রশ্নের খোরাক জোগালো। কেননা অষ্ট্রেলিয়ায় বাচ্চাগুলো ক্যাঙ্গারু দেখেই অভ্যস্ত ছিল। তাই এই প্রাণীগুলোর নতুন পরিচিতি তাদের মুগ্ধ করলো। সুর পাগল মানুষ আমি গাড়িতে চলতে থাকা সুরের মূর্ছনায় ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ফিরছিলাম- কতদূর ওই মদীনার পথ/ ওহুদের মাঠ আর কতদূর/.........কতদূর রাসূলের রওজা বল/..............কোথা সেই বেলালের আযানের সুর/...মুমিনের জীবনের বাঁকে বাঁকে/ বদরের ওই স্মৃতি আজো ডাকে...... এরই মাঝেই কখনো কখনো বাস্তবে ফিরতে হচ্ছিলো সহযাত্রী ভাবীর প্রশ্নের জবাব দিতে। উনি যাত্রা শুরু হতে ফেরা অবধি একাধিকবার বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন এই পাথুরে ভূমির আড়ালহীন প্রখর সূর্যকিরণ মাথায় নিয়ে বিজন মরুতে রাসূলের সেই কষ্টময় হিজরতের কথা। আমি দু'চোখে মুগ্ধতা নিয়ে বললাম- ইসলামের মত এমন এক মহান ও মর্যাদাপূর্ণ ধর্মের নেতা হবার পথটা তো বন্ধুর হবেই।





নবাগত পরিবারটিকে নিয়ে মদীনায় পৌঁছার পর বিকেলে বের হলাম ঐতিহাসিক স্থান গুলো দর্শনে। মোবাইল হতে লোকেশন নিয়ে খুব তাড়াতাড়িই হোটেল হতে ওহুদের প্রান্তরে পৌঁছালাম। ওরে বাবা, শেষ বিকেলের মরা রোদটার ও যে কি রুক্ষ চাহনি। রুমা পাহাড়ে উঠতেই আমরা ঘেমে একাকার । তৃষ্ণায় সাথে রাখা পানি ও শেষ। এরপর যে কতবার পানি কিনতে হল হিসেব রাখা ও সম্ভব হলনা। ওহুদের শহীদদের কবরের দিকে তাকিয়ে মনটা বেদনায় ভরে ভরে গেল -আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করতে অভুক্ত পেটে,যুদ্ধের তেমন কোন সাজ সরঞ্জাম ছাড়া,সূর্যাকিরণের প্রচন্ড উত্তাপকে মাথায় নিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে কতটা দ্বিধাহীন চিত্তেই না জীবনের কুরবানী দিতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মানুষগুলো। আর এই যুগে আমরা দ্বীনকে খুঁজে ফিরি কত বিদায়াতী পদ্ধতিতে। সাথে আসা দর্শনার্থীদের কাউকে দেখি রুমা পাহাড়ের মাটি ঝোলায় ভরছেন। আর কেউবা ওহুদের শহীদদের কবরের ঘেরা দেয়া গ্রীল ও মুছে নেন কাপড় দিয়ে। একদল নিবেদিত প্রাণ মুমিনের নিঃস্বার্থ জীবন কুরবানীর যে রক্ত পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে জমিনে একদিন ইসলাম কায়েম হয়েছিল। সেই ইসলাম কি সেই যুগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ময়দানের মাটিকে তাবিজে ভরে বা চুমু খেলেই আজ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে? যদি তাই হত তাহলে কি দরকার ছিল হামযা(রাঃ) আর তাঁর সাথীদের সেই বেদনা বিধুর আত্নদানের?



পরদিন গেলাম মসজিদে কেবলা তাইন এ। দুপুরের প্রখর সূর্যাকিরণের মাঝে ও দেখলাম দর্শনার্থীদের ভিড় অগণন। সেই ৯৯ সালে হতে এ পর্যন্ত দেখছি হাজীদের সংখ্যা কি বিপুল হারে বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। প্রশ্ন জাগে তবে কেন এত অধঃপতিত অবস্থায় আমারা আজকের মুসলিম জাতি? বুকের ভেতর জন্ম নেয়া দীর্ঘশ্বাসটাকে মুক্ত করতে করতে মসজিদে কেবলাতাইনে দঁড়িয়ে মনে হল- জীবনের যে কোন পর্যায়েই আল্লাহর নির্দেশ শুনেই 'সামিনা 'ওয়াতানা' বলার দৃঢ় ঈমানী জজবাই তো শেখায় এ স্থান আমাদের।



এরপর গন্তব্য খন্দকের সেই ঐতিহাসিক সাত মসজিদ। মুমিনের জীবনে ঈমানের পরীক্ষা অনিবার্য। আর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য চাই সাচ্চা ঈমান ও হিকমতের সমন্বয়। যে সব মুসলিম ইসলামকে শুধু নামাজ,রোযা,হজ্জ,যাকাতের মাঝেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেন তাদের জন্য এই স্থান গুলো নতুন চিন্তার খোরাক যোগাবে। আমি মনে করি যদি তিনি গভীর ভাবে ভাবতে পারেন। জমিনে ইসলাম যদি প্রতিষ্ঠিতই না থাকলো তবে জীবন চলার শান্তিময় পরিবেশ কি করে নিশ্চিত হবে? ত্যাগ কুরবানীর মানসিকতাই যুগে যুগে ইসলামের বিজয় এনেছিল সে কথাই স্মরিয়ে দিল যে খন্দকের এই স্মৃতিময় স্থান নতুন করে।

আহারে এই স্থান গুলো ঘুরতে ঘুরতে একটি কথা মনে হল। সেই শৈশব হতে দেখেছি কত হাজী সাহেবরা হজ্জে আসেন। দেশে ফিরে আত্নীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের খেজুর ,জমজম আর মিষ্টি তেঁতুল বিলান। সেই সাথে একটু কষ্টা করে যদি উনারা ইসলামকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারার শিক্ষাটি ও সাথে করে নিয়ে যেতেন। আর সেই হাদীয়ার সাথে নতুন করে আত্নপলব্দির জ্ঞানকে ও একটু একটু করে স্বজন বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতেন তবে বোধহয় মুসলিম জাতির জীবনে একটি আলোকিত ভোরের আগমন অনেক বেশী ত্বরান্বিত হত।



এবার ফেরার পালা। সাথের পরিবারটির বাচ্চাদের কথা দিয়েছিলাম বানর দেখাবো। মদীনা হতে জেদ্দায় ফেরার পথে বানরের বসতিটি আসতেই বাচ্চারা তো খুশিতে চিৎকার। এর মাঝে বেরসিক এক বড় বানর বেশী ভাব দেখাতে গিয়ে চড়ে বসলো আমাদের গাড়ির সামনের দিকটায়। আর অমনি সাথে থাকা পরিবারটির ৪ বছরের মেয়ে রুমাইসা কেঁদে কেঁটে এক হাঙ্গামা বাঁধালো। বুঝলাম জীবনের কিছু কিছু প্রত্যাশারা যখন প্রাপ্তিতে এসে গড়ায় তখন সব সময় তা কল্পনার মত সমান সুখকর হয়ে ধরা দেয় না। কিন্তু ওর ছোট ভাইটি গাড়ির ভেতর হতে বানরের সাথে হাত বাড়িয়ে খেলতে লাগলো। আমরা গাড়ির ভেতর হতে যতই খাবার ছুড়ি বড় বানরটা একাই সব নিজ দখলে নিয়ে নেয়। বুঝলাম মানুষ মানুষকে কেন অবলীলায় বানর বলেই গালি দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

শেষ বিকেলের কনে দেখা আলোয় আমরা জেদ্দার চেক পয়েন্টের কাছে এসে পৌঁছালাম। যাত্রা শুরু হতে এই অবধি একটানা ক্লান্তিহীন ভাবে গেয়ে চলা গায়কের কন্ঠে তখন - রাত কটেছে স্বপ্নে বিভোর/ দিন কেটেছে ভাবতে/ কতটা সময় লাগবে তোমার দিনের পথে নামতে.....

অস্তমিত দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম- প্রভুগো, জীবনের দিগন্ত হতে বিলীন হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত আমার জীবনের বাকী পথ চলা যেন তোমার আনুগত্যে পরিপূর্ণ ভাবে আত্নসমর্পিত বিশ্বাসী মানুষের সারিতেই হয়।

বিষয়: বিবিধ

৩২৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File