নাটকের পেছনে নাটক

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০২:১২:০৭ দুপুর

গত প্রায় বছর খানেক আগের কথা। একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নাটকের প্রস্তুতি নিতে হবে। মোটামুটি ভেবে একটি নাটক রেডি করলাম। নাম দিলাম"কলিকাল''। মূল বিষয়বস্তু ছিলো একটি ইসলামী নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন পরিবারে বড় হওয়া সন্তানদের জীবন কত সুন্দর হয়। আর পাশাপাশি একটি উগ্র আধুনিক, নৈতিক মূল্যবোধহীন পরিবারের সন্তানদের জীবন ড্রাগ , ইভটিজিং,ধর্ষণ এইসব কালো থাবার কবলে পড়ে কি করে ধ্বংস হয়ে যায়।

প্রথম পর্যায়ে দু'টি মা চরিত্রে দু'জন মহিলা সহ ১৭জন ছাত্রীকে বাছাই করলাম নাটকের চরিত্রগুলোর জন্য। কিন্তু প্রথম রিহার্সসেলের দিন দেখা গেল প্রায় ২৫ জন উপস্থিত। চিন্তায় পড়ে গেলাম কাকে রেখে কাকে নিই। আমি জানি প্রবাসে বড় হওয়া এই সব শিশু কিশোরীদের জন্য জীবনের আনন্দায়জন কত সীমিত। তাই এই আগ্রহ করে আসা মুখ গুলোকে ফিরিয়ে দিতে বেশ মায়া লাগলো। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বাদাম ওয়ালা, ভিক্ষুক, সহপাঠী এ ধরণের বাড়তি কিছু চরিত্র ক্রিয়েট করে সবাইকে নিয়ে নেব।

প্রথম দিন সবাইকে গল্পের মূল ঘটনা বুঝিয়ে বললাম। চরিত্র গুলো ভাগ করে দিলাম। আধুনিক মা চরিত্রে নুপুর ভাবী ও তার মেয়ে জেরিন চরিত্রে মাওয়া দু'জনই প্রথম দিনই সাবলীল ভাবে অভিনয় করলো।

সমস্যা দেখা দিলো ইসলামী পরিবারের মা এবং মেয়ে চরিত্রটি নিয়ে। আমি মা চরিত্রে শেলী ভাবীকে সিলেক্ট করলাম। বেচারী ভয়ে ভয়ে বললো- এই তোর কি মনে হয় আমাকে দিয়ে অভিনয় হবে? আমি তো আগে কখনো করিনি। আমি সাহস দিয়ে বললাম-আমি আপনাকে যতটুকু স্টাডি করেছি তাতে মনে হয় ইনশাআল্লাহ আপনি পারবেন। আর দর্শকদের সামনে দাঁড়ানোর জন্য যে মানসিক কনফিডনস সেটা আপনার আছে। ভাবী খুশী হলেন। পরে সত্যিই তিনি অসাধারণ ভালো অভিনয় করেছিলেন। এরপর সমস্যা হলো ইসলামী পরিবারের মেয়ে 'মারিয়াম' কে নির্বাচন নিয়ে। ২/৩ জন কে নিয়ে বাদ দিতে হল। পরে চরিত্রের সাথে সামজস্য রেখে লাজুক, খুব শান্ত প্রকৃতির বুশরাকে সিলেক্ট করলাম। মেয়েটি এতই লাজুক যে শব্দই বের হয় না মুখ দিয়ে। আমার মনে হল মেয়েটির যথেষ্ট কনফিডেনসের অভাব। শুধু বলছিলো- আন্টি, আমাকে দিয়ে হবেনা। যতবারই রিহার্সসেল করি ও দেখি মায়ের সাথে ক্লোজ হতে পারেনা।

পরে আমি শেলী ভাবীকে বললাম- মেয়েটিকে একটু সময় দেন। যাতে আপনার সাথে ওর অপরিচিতের আড়টা ভেঙ্গে রিলেশনটা ক্লোজ হয়ে উঠে। শেলী ভাবী এরপর হতেই রিহার্সসেলে আসলেই- এই আমার মারিয়াম কোথায়? আসতো আম্মু। এভাবে উনি রিহার্সসেলের ফাঁকে ফাঁকে সময় দিতে লাগলেন। মেয়েটি প্রথম দিন লাজুক স্বরে বললো- আন্টি, আমিতো বাসায় ও আম্মুকে জড়িয়ে ধরিনা। আর আম্মুর সাথে ওতটা ক্লোজ হয়ে কথা ও বলিনা। আমাদের দেশে সন্তান বড় হয়ে গেলে যা হয়। শেলী ভাবী হেসে বললেন- মনে কর আমি তোমার খালা। খালার সাথে তো ক্লোজ হওয়া যায়। শেলী ভাবীর চেষ্টায় মেয়েটি শেষ পর্যণ্ত এত ভালো অভিনয় করেছিলো যে নাটক দেখার পর ওর মা এসে আমাদের বললেন- ভাবী, আপনারা তো অসাধ্য সাধন করে দেখালেন। ও এত বেশী শান্ত যে আমরা বাসায় ওর গলার সাউন্ডই পাইনা। আমি বললাম- অসাধ্যের কিছু না। ওর মধ্যে প্রতিভা তো ছিলোই । আমরা শুধু সেটাকে টেনে বের করে আনলাম।

এরপর আধুনিক গৃহকর্তী কাজের মেয়েকে মারার দৃশ্যে একটি হাসির ব্যাপার ঘটলো। কাজের মেয়ে চরিত্রে মাহাদিয়া এত পারফেক্ট অভিনয় করলো যে ওর কান্না শুনে ওর ছোট বোন মানাহেল আর আমার ছোট মেয়ে জুয়াইরিয়া ভাবলো আন্টিটি বোধহয় সত্যি সত্যিই ওকে মারছে। ওরা টেনে হিঁছড়ে যেয়ে আন্টির কাছ হতে মাহাদিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। যতবারই এ দৃশ্য আসে পিচ্চি দু'জন একই বিহেভ করে। ওরা বুঝতে পারছেনা এটা আসল নয়। আমাদের আশংকাকে সত্যি প্রমাণ করে ফাইনালের দিন ও ওর ওরা স্টেজে উঠে একই কান্ড করে বসলো। ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি পর্দা টেনে দেয়াতে দর্শকরা বুঝতে পারেনি।

এদিকে মাস্তান চরিত্রে নাজিহার ঢাকাইয়া উচ্চারণ আর অঙ্গ ভঙ্গিতে আমরাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবার যোগাড় হত। আবার একটি হিন্দি গান- ইন্ডিয়া চে আয়া তেরা দোস্ত/ দোস্তকো সালাম কর/ রাতকো খাও পিও/ দিনকো আরাম কর..এ গানটি কেউ ঠিকমত করতে পারছিলো না। ওমা আমার পিচ্চিটা দেখি সাবলীল ভাবে সেটা গেয়ে যাচ্ছে। সে মিনা কার্টুনে সেটা শুনেছে। এরপর হতে প্রতিবার গানটির জন্য সে মাস্তানদের সাথে বসে যায়। পরে বায়না ধরলো ওকে পিচ্চি মাস্তানের একটি কারেক্টার দিতে। বাকী মাস্তানরা ও বলল- আন্টি মজা হবে দিয়ে দেন। সবার আগ্রহে ওকে বললাম- ঠিক আছে। ভাবলাম ফাইনালের দিন অনেক বন্ধুদের পেলে খেলতে গিয়ে হয়তো ভুলে যাবে। আর ওই সুযোগে ওকে বাদ দিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু ওমা আমি ওকে যতবারই দেখি ও যেয়ে মাস্তান ৫ জনের সাথে গম্ভীর মুখ করে বসে থাকে। অন্যরা খেলতে ডাকলে বেশ গাম্ভীর্য দেখিয়ে বলে দেখছো না - আমি আপুদের সাথে পিচ্চি মাস্তান হয়েছি। কিছুক্ষণ পর দেখি ভ্রুতে মোটা করে কালি লাগিয়ে গালের এক পাশে কালো বড় তিল আর কানের পাশে যেভাবে জুলপি লাগিয়ে এলো তাতে আমারই হাসি চেপে রাখা মুশকিল হল।

এর মধ্যে আমার এক পুরনো ছাত্রী কি করে যেন খবর পেল আমি নাটক করাচ্ছি। মেয়েটি খবর পেয়ে এসে হাজির। আমার এক সময়ের খুব প্রিয় ছাত্রী। কি করে ফেরাই? আবার মেয়েটির চেহারা আচরণ সব মিলিয়ে এত ইনোসেন্ট টাইপ যে আমি চরিত্র নির্বাচনে সমস্যয় পড়ে গেলাম। পরে নাজিহার বুদ্ধিতে ওকে মাস্তান চরিত্রে নেয়া হল। ওরা ওকে দিয়ে বোকা বোকা কিছু ডায়ালগ বলালো। জেরিনকে এসিড মারার পর যখন সব মাস্তানরা পালিয়ে গেল তখন ও তাহেরা বোকা সেজে স্টেজেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তখন নাজিহা- আবে পটলা, তাড়াতাড়ি আয়। নইলে পাবলিকের ধোলাই খাইয়া বারোটা বাজবো বলে এত সুন্দর করে ওকে টেনে নামালো দর্শকরা তো হাসতে হাসতে ভিমরি খাবার জোগাড়। ফাইনালের দিন আমি সবাইকে বললাম- একটি কথা মনে রাখবে এই নাটকের হুবুহু ডায়ালগ কি ছিলো সেটা তোমরা ছাড়া দর্শকদের কেউ কিন্তু জানেনা। তাই ডায়ালগ ভুলে গেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে যেহেতু মুল ঘটনাটি সবাই জানো তাই সামজস্য পূর্ণ কিছু একটা বলে দেবে। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ এত সুন্দর দক্ষতার পরিচয় দিলো আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।

সব চরিত্রই সুন্দর প্রস্তুতি নেয়া হল। কিন্তু ঝামেলা বাঁধালো ফকির ৪জন। একজন ঠিক করে বলে বাকীরা লজ্জায় মুখ খুলেনা। তখন শেলী ভাবী বললেন- আহারে পেটের তাগিদে মানুষের মন পটাতে যে ভিক্ষার গান সেটা কি এদের মুখ দিয়ে বের হবে? প্রায় প্রতিদিনই আমি ওদের সাথে বসে ভিক্ষুকের গান গেয়েছি। যেদিন একা করতে দিলাম দেখি পারছেনা। তখন শেলী ভাবী কুমিল্লার লোকাল ভাষায় যে একখানা ফকিরের গান ধরলেন সবাই তো হেসে লুটোপুটি। ভাবী আমাদের অবস্থা দেখে বললেন- তোরা চাইলে আমি ফকিরনি হতে পারি। আমার কাছে ওই রকম একটি থালা ও আছে। পুরো নাটকে কখনো শিক্ষা, কখনো বাস্তবতা, কখনো করুণ আবহ, কখনো খোঁচা মেরে বিবেককে জাগানো সব কিছুরই মিশেল রেখেছি। কিন্তু হাসির দৃশ্যে ফকিরদের নিয়ে মুশকিল হলো। পরে আমার হ্যজব্যন্ডের সাথে পরামর্শ করলাম। ওই সুন্দর বুদ্ধি দিলো। আমি শেলী ভাবীকে ফোনে বললাম- ভাবী আপনি কি ফাইনালের দিন ফকিরদের সাথে বসবেন? ভাবী এক কথায় রাজি। তখন বললাম -যাতে একই ব্যক্তিকে দুই কারেন্টারে দেখে দর্শক বিভ্রান্ত না হয় তাই আপনি একটি পুরনো বোরখা পরে মুখ ঢেকে ভিক্ষা করবেন। আর ভাবীর বছর খানেকের ছোট বাচ্চাটি দীর্ঘক্ষণ মাকে না পেয়ে যদি কাঁদে তাই বললাম- ভাবী সৌদি আরবে আফ্রিকান মহিলা গুলো যেমন বোরখা পরে একটি কাপড় দিয়ে বাচ্চাকে পিঠের সাথে বেঁধে নেয় আপনি সেরকম করে আপনার বেবিকে বেঁধে নিতে পারেন। ভাবী আমার আইডিয়ায় হাসতে হাসতে রাজি হলেন।

এরপর শেলী ভাবী এক মজার খবর দিলেন। বেচারীর তিন ছেলে কোন মেয়ে নেই। কিন্তু মেয়ের খুব শখ। এই নাটকে মারিয়ামের মায়ের দৃশ্যে অভিনয়ের পর হতে তার হ্যজব্যন্ড তাকে ঘরে আসলেই -এই মরিয়মের মা ভাত দেও। এভাবে প্রতিটি ব্যাপারে মরিয়মের মা বলে সম্বোধন করে। উনি বললেন- যাক তোর নাটকের উসিলায় হলেও আমি মেয়ের মা হতে পারলাম।

আমার বড় মেয়েটির মুখটি সব সময় হাসিমাখা। তাই ডাক্তার দৃশ্যে এসিড দগ্ধ মেয়েটির মৃত্যুর খবর যতবারই বলে আমার মনে হয় ও হাসছে। আমি দৃশ্যটি আবার করাই। বেচারী বাসায় এসে আয়নার সামনে বার বার প্যকটিস করে। আর পেরেশান হয়ে আমাকে বলে- ইস আম্মু আল্লাহ কেন যে আমাকে হাসি মুখের বানালেন।

ফাইনাল অনুষ্ঠানের দিন সবাই আমার প্রত্যাশার বাইরে অসম্ভব রকম সুন্দর অভিনয় করলো। যার যা ক্রটি ছিলো সব মেকাপ করে ফেললো। জেরিনের মৃত্যু দৃশ্য, তার এসিড দগ্ধ মুখ, মায়ের কান্না ইনসেটে করুন মিউজিক দিয়ে কিছু কথা যা বিবেককে ছুঁয়ে যায় সব কিছু দর্শকদের অশ্রুসজল করে তুললো। অনেকে কেঁদেই ফেললেন। আমি স্টেজ হতে ঘোষনা দিয়ে নেমে আসার পর তোজ্জাম্মেল খালাম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন- বেটি ,তোমার নাটকের প্রতিটি ডায়ালগ প্রতিটি দৃশ্যই আমার এত পছন্দ হয়েছে! আমি দোয়া করি তোমার প্রতিটি নেক কাজের যোগ্যতা আল্লাহ আরো বেশী করে বাড়িয়ে দিন।

অনুষ্ঠান শেষে যখন ঘরে ফিরলাম তখন আলোকিত দিনটি ঢেকে গেছে রাতের আঁধারের সামিয়ানার নীচে। প্রচন্ড মাথা ব্যাথাটা সময়মত এসে জানান দিলো ব্যস্ততার ঘোরে সারাটা দিন পেট বেচারার উপর বেশ জুলুম করেছি। লিখার পরিধি আরো বেড়ে যাবার ভয়ে নাম উল্লেখ না করলেনও সেদিনের সে নাটকের জন্য প্রতিটি ব্যক্তিই যারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন সবার জন্য আন্তরিক শুভ কামনা রইলো।

বিষয়: বিবিধ

১৬২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File