নৈতিক মূলবোধ সম্পন্ন পোষাক নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৩ মে, ২০১৩, ১১:৪৫:০৯ রাত

একটি সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাসন্তী নামের একটি মেয়ে নিজের লজ্জা ঢাকতে জাল পরার কথা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলো। অথচ আজ সংস্কৃতির উন্নয়নের নামে আধুনিক নারীদের চিন্তা চেতনায় এতটা পরিবর্তন এসেছে যে, তারা ফ্যশন শো’র নামে সেই জাল গায়ে জড়াতে ও দ্বিধা করছেন না। গত ২০১৩ এর ১৫মে আর টিভিতে ‘’ভিট লুক এট মি’’ নামে এক অনুষ্ঠানে ‘’নদী ও নারী’’ শিরোনামে এক ফ্যশন শো’তে কখনো জাল পরে কখনো কুচুরিপানা গায়ে জড়িয়ে প্রায় নগ্ন পোষাক পরা দু’জন নারী বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গিতে পোজ দিলেন ছবির। সেই সাথে এই কাজের সাথে জড়িত বাকীরা এই কাজ করতে পেরে কতটা গর্বিত তারই হাস্যজ্জল অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন। কতই না অধ:পতনে পৌঁছে গেছি আমরা আজকের নারী সমাজ। এক দরিদ্র নারীর জন্য তার পোষাকের অভাবের কারণে যা এক সময় লজ্জা ঢাকার উপকরণ হয়েছিলো সময়ের পরিবর্তনে তাই পরে প্রকাশ্যে নিজকে প্রদর্শনী করতে একজন নারী আজ গর্বিত বোধ করছে। আধুনিক এই নারীর আজ পোষাকের অভাব নয়। অভাব নৈতিক মূল্যবোধের । তার চাইতে ও বেশী অভাব পশুত্ব আর মনুষ্যত্যের পার্থক্য করার চেতনার।

মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রপথিক ছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি নিজে পর্দা করতেন। পর্দার পক্ষে কথা ও বলেছেন। তবে পর্দার নামে অযথা বাড়াবাড়ির কথা তিনি তার ‘অবরোধ বাসিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,’’অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। সকল সভ্য জাতিরই কোন না কোন রুপ অবরোধ প্রথা আছে। এই অবরোধ প্রথা না থাকলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে?.তবে সকল নিয়মের একটা সীমা আছে।...

এ দেশে অবরোধ প্রথা বেশি কঠোর হইয়া পড়িয়াছে।. আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুন্ঠনসহ (বোরকা) মাঠে বেড়াইতে আমাদের আমাদের আপত্তি নেই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলে ও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। তবে সেজন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস চাই। বিনা অভ্যাসে কোন কাজ হয়? (বোরকা, মতিচুর ,প্রথম খন্ড)

আজকাল এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা ধর্মের নামে নারীকে শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা হতে দূরে সরিয়ে রাখার যে ফতোয়া দেন তা ইসলাম সমর্থিত নয়।

পবিত্র কুরআনে এক জন নারী ফিরাউনের স্ত্রী আছিয়াকে বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর প্রতি তারএকনিষ্ঠ অনুগত্যের জন্য। আবার মারিয়াম (আঃ) এর কাছে জান্নাতী খাবার পাঠানো হত আল্লাহর পক্ষ হতে, যা অনেক নবী রাসূলের জন্য ও পাঠানো হয়নি। তাছাড়া রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে জানা যায় যে হযরত খাদিজা (রাঃ) কে আল্লাহর পক্ষ হতে সালাম জানানো হয়েছেলা সে মর্যাদা অনেক পুরুষের ভাগ্যে ও জুটেনি। ইসলাম কখনো নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর অনির্বার জ্ঞান পিপাসা মেটাতে সব সময় রাসূল (সাঃ) কে প্রশ্ন করতেন। তিনি ও আয়েশা (রাঃ) এর আগ্রহের জবাব দিতেন গুরুত্বের সাথে। আর তাই রাসূল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর ইসলামী জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার হতে মুসলিম সমাজ উপকৃত হয়েছে আয়েশা (রাঃ) এর মাধ্যমে। রাসূল (সাঃ) যদি নারী শিক্ষাকে অনুমতি না দিতেন তবে এটি সম্ভব হত না।হযরত শিফা বিনত আবদিল্লাহ একদিন রাসূল(সাঃ)এর কাছে এসে বললেন, আমি জাহেলী জীবনে ঝাঁড়-ফুঁক করতাম। আপনি অনুমতি দিলে তা আমি আপনাকে শুনাই। রাসূল(সাঃ) শুনে বললেন, এই ঝাঁড়-ফুঁকটি তুমি হাফসাকে শিখিয়ে দিও। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে রাসূল(সাঃ) শিফাকে বলেন, তুমি কি হাফসাকে এই ‘নামলা’র দু’আটি শিখিয়ে দেবে না যেমন তাকে লিখতে শিখিয়েছো? ( আসহাবে রাসূলের জীবনকথা ৫ম খন্ড পৃ. ২০০) এ ঘটনা হতে নারী শিক্ষার প্রতি রাসূল (সাঃ) এর সমর্থন স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠে।

বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিগত জীবন ও তার রচনাবলী থেকে প্রমানিত হয় যে, তিনি নারীদের পর্দা প্রথার বিরোধী ছিলেন না। তবে পর্দার নামে নারীকে কোণঠাসা করে রাখার ব্যাপারেই তার আপত্তি ছিলো। তাই তিনি বলেন,’’ আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হই নাই। কেউ যদি আমার( ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে) পর্দা বিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখতে না পান ,তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তম রুপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই। সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারী জাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগনই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের আলোচনা করিয়াছি।( অর্ধাঙ্গী, মতিচুর ১ম খন্ড)

অন্য একটি প্রবন্ধে একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন,’কুরআন শরিফের বিধান মানিলে অবলা- পীড়ন ও চলে না। অন্যায় অন্ত:পুর প্রথা ও চলে না।‘’( নারী পূজা,অগ্রন্থিত প্রবন্ধ) তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি ,আধ্যাতিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে ধর্ম। (ঐ পৃ: ৬১)

তিনি মনে করতেন,’’একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে তাহার প্রাপ্য অধিকার দান করিয়াছে;কিন্তু ভারতবর্ষে সেই মুসলিম নারীর দুর্দশার একশেষ হইয়াছে।‘( নূর ইসলাম, মতিচুর ২য় খন্ড, পূর্বোক্ত,পৃ. ২৩৫)

সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্ক তিনি বলেন,’’মুহাম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্য পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে।.তবে দেখিবেন কার্যত কন্যার ভাগ্যে শূন্য(০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।“ (অর্ধাঙ্গী, মতিচুর ১ম খন্ড, পূর্বোক্ত পৃ. ২৯) মূলত ইসলাম পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে মানুষ এর বিধান গুলোকে সহজে ফাঁকি দিতে পারছে।

আমাদের দেশে কাউকে ধর্মীয় পোষাক পরতে বাধ্য করা যাবে না। আবার একই ভাবে ধর্মীয় পোষাক পরা বা ইউনিফর্ম ঠিক রেখে যদি হিজাব বা ফুলহাতা পরে তবে তাকেও বাধা দেয়া যাবেনা সংবিধানের এই নিয়মকে আশ্রয় করে এক শ্রেণীর ব্যক্তিরা ধর্মের গায়ে কুঠারাঘাতে নেমেছেন। সম্প্রতি উদয়ন স্কুলে প্রিন্সিপল ড. উম্মে সালমার নির্দেশে সেই স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপল শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজুর স্ত্রী মাহবুবা খানম কল্পনা নিজ হাতে স্কুলের মেয়েদের ফুল হাতা শার্টের হাতা কেটে দিয়েছেন। অনেক অনুরোধ করে কেঁদে ও ছাত্রীরা রেহাই পায়নি শিক্ষিকার হাত হতে । এমন কি কারো কারো হাত ও কেটে গেছে সে সময়। প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রীর সাথে তিনি এই ব্যবহার করেছেন। একটি মুসলিম দেশের জন্য এই আচরণ সত্যই লজ্জার। তার চাইতে ও বেশী ধিক্কার সেই সব মুসলিম নামধারী নারীদের প্রতি যারা শিক্ষাদানের মহৎ পেশায় থেকে এর অপব্যবহার করছেন। এ বিষয়ে মাহবুবা খানম প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ছেলেদের শার্ট এবং মেয়েদের কামিজের হাতা কুনুই পর্যন্ত হবে। এ নির্দেশনা স্কুলের ডায়েরিসহ বিভিন্ন জায়গায় দেয়া আছে। তাদের বারবার সতর্ক ও করা হয়েছে। তারপরও নবম ও দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর কিছু শিক্ষার্থী( ছেলে মেয়ে) নিয়ম না মানায় আগে যে ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হত এবার ও তাই নেওয়া হয়েছে। জামার হাতা কেটে দেয়ার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক নির্যাতন নয় বলেও উল্লেখ করেন মাহবুবা খানম।

ভারতের নয়া দিল্লিতে ৫ বছর বয়সী এক শিশু কন্যাকে ধর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে- ২০০১ সাল হতে ভারতে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে শতকরা ৩৬ ভাগ। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড বিষয়ক ব্যুরোর উদ্ধৃতি দিয়ে এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে,২০০১ হতে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতে ৪৮৩৩৮ টি শিশু ধর্ষনের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১১ সালে এ সংখ্যা বেড়েছে ৭১১২টি। মধ্য প্রদেশে রয়েছে শিশু ধর্ষণের তালিকার শীর্ষে। এরপরেই রয়েছে মহারাষ্ট্র। সেখানে শিশু ধর্ষণ হয়েছে ৬৮৬৮ টি। উত্তর প্রদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। সেখানে ধর্ষিত হয়েছ ৫৯৪৯ টি শিশু। এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ( এসিএইচআর) পরিচালক সুহাস চাকমা বলেছেন, বিপুল সংখ্যক শিশু ধর্ষিত হচ্ছে ভারতে। তার মধ্যে এগুলো হল ক্ষুদ্র সংখ্যা। কারণ ধর্ষিত সবাই মামলা করতে আসে না। ‘ইন্ডিয়াস হেল হোলস: চাইল্ড সেক্সুয়াল আ্যসল্ট ইন জুভেনাইস জাস্টিস হোমস’ এ বলা হয়েছে, ভারতে শিশুদের ওপর যৌন হয়রানি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার পরিচালিত কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে শিশুর ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৭৩৩। নারীর ওপর সহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোটিউর রাশিদা মনজু ভারত সফর করেছেন ২২ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত। তার হাতে এই রিপোর্ট তুলে দেয়া হয়।( সাপ্তাহিক সোনার বাংলা২৬ এপ্রিল ২০১৩)

সংস্কৃতির নামে নগ্নতা ,অশ্লীলতা যখন আমাদের সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে পড়েছে তখন সে সমাজ কোমল মতি শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা পর্যন্ত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে ভারতীয় বিষাক্ত সংস্কৃতির নগ্নতার ছোবলে আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আমাদের দেশের ফুলের মত শিশুদের জীবন ও। নারীর নিরাপত্তাহীনতার এই স্রোতের সময় যারা হিজার ফরয হওয়া একটি স্কুল ছাত্রীর ফুলস্লিভ হাতা কেটে ছোট করে দেবার মত মানসিকতার পরিচয় দেন তারা আসলে নারীদেরকে কতটা অধপতিত অবস্থায় দেখলে সুখ পাবেন তা জানতে বড়ই ইচ্ছে করছে।

তথ্যসূত্র-

ব্লগার- রাতদিন

ব্লগার-আতিকুল জুয়েল

বিষয়: বিবিধ

২৫৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File