কিছু ফেলনা ঢাকনা যদি জীবনে দেয় গতি
লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ২৮ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৬:৩৯:৩৯ সন্ধ্যা
রাস্তার ধারে কিংবা ডাস্টবিনে অবহেলায় ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের গ্যলনের কিংবা পানির বোতলের ঢাকনা যদি কোন স্থবিরতায় মুষঢে পড়া জীবনে দেয় গতিময়তা তবে ব্যাপারটি কেমন হয় বলুন তো ?
গত দুমাস আগে আমার ক্লাস ওয়ানে পডুয়া মেয়েটি স্কুল হতে এসে বললো- আাম্মু ,তুমি দুধের গ্যলন,তেলের,পানির ,জুসের ঢাকনা গুলো ফেলে দিওনা। ওগুলো দিয়ে আমরা গরীব মানুষদের জন্য হুইল চেয়ার কিনে দেব। আমি বুঝতে না পেরে সেভেনে পড়ুয়া আমার বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম। তখন ও বলল ওদের স্কুল হতে সব রকমের প্লাস্টিকের ঢাকনা কালেক্ট করা হচ্ছে। রিসাইকেল কোম্পানি গুলো প্রায় ১০০০টি ঢাকনার বিনিময়ে একটি করে হুইল চেয়ার দেবে। আর এই সব হুইল চেয়ার স্কুলের পক্ষ হতে বিভিন্ন গরীব দুস্থ মানুষ যারা পঙ্গু কিংবা প্যারালাইজড তাদেরকে দান করা হবে। উদ্যোগটি আমার খুব ভালো লাগলো।
মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশে ও যদি এ ধরণের ব্যবস্থা থাকতো। শৈশবে কত মানুষ দেখেছি যারা জন্মগত ভাবেই চলাফেরা করতে অক্ষম। অথবা যারা কোন দূর্ঘটনার শিকার হয়ে তাদের মূল্যবান পা হারিয়েছেন। কিংবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে গেছেন। যাদের কাছে জীবনের গতিময়তা স্থবিরতার কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। এই মানুষগুলোর অনেকেরই সামর্থ নেই হুইল চেয়ার কেনার। তাদের জন্য এই ধরণের ব্যবস্থা কতইনা কার্যকর হত।
গত দু'মাস ধরে আমি প্রতিদিনই ঢাকনা গুলো না ফেলে জমিয়ে রাখছি। আর প্রতিদিন ২/৩ বার আমার ছোট মেয়েটি কিচেনে এসে আমার কাছ হতে সেগুলো ওর ছোট মুঠিতে তুলে নেয় অপার উৎসাহে। একটি গুরুত্বপূর্ণ কিছু করতে পারার আনন্দ দেখি আমি ওর চোখে মুখে। আমি ও সব সময় ওর এই কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছি যাতে ও আরো উৎসাহ পায়। ওকে বলেছি, সামনে কিছু পিকনিকের দাওয়াত আছে। সেখানে আমি ওকে পানির বোতলের ঢাকনা সংগ্রহ করতে সাহায্য করবো। ও জিজ্ঞেস করে- অন্যরা কিছু মনে করবেনা তো? আমি বলি - মানুষ তো সব সময় কিছু না কিছু বলে। কিন্তু তোমাকে নিজকে ভেবে নিতে হবে তুমি যে কাজ করছো সেটা ভালো কিনা? ব্যস এরপর আর চিন্তা করার দরকার নেই। ও বেশ খুশি আমার পরামর্শে।
গত মাস খানেকের বেশী ধরে আমার মেয়েটি আমাকে অসংখ্য বার জিজ্ঞেস করেছে- আম্মু, আল্লাহ গরীব মানুষদের কেন বানিয়েছে? আমি ওকে বুঝিয়ে বলি, যাতে আল্লাহ যে তোমাকে অনেক নেয়ামত দিয়েছেন সেটার জন্য তুমি তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। আর তোমার যা আছে সেখান হতে যাদের নেই তাদের ভাগ দিতে পারো। আসলে আমি প্রায়ই আমার বাচ্চাদের মনে করিয়ে দিই পৃথিবীর অভাবী ,বঞ্চিত মানুষ আর শিশুদের কথা। তাই বুঝতে পারি ওদের প্রতি মমত্ববোধ হতেই আমার মেয়েটি এই প্রশ্ন করে।
একটি বিষয় গত কয়েকদিন ধরে মনের ঘরে বেশ তোলপাড় করছে। তাই না লিখে স্বস্তি পেলাম না। আমার ক্ষুদ্র ইসলামী জ্ঞানের আলোকে বুঝি কারো নাম না উল্লেখ করে শিক্ষার উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলা হয় তবে সেটা গীবতের আওতায় পড়বেনা। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আইনী জটিলতার কারণে জেদ্দায় বেশ কিছু পরিবার আছেন যারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমি এক ঈদ পার্টিতে উপস্থিত প্রবাসী মহিলাদের বললাম- বোনরা দেখুন, এবারের ঈদ উপলক্ষে আপনারা আপনাদের পরিবার পরিজনদের জন্য কত কিছু শপিং করেছেন। নিজেরা এক একজন বাংলাদেশী টাকায় ১০/১২ হাজার টাকা খরচ করেছেন শুধু নিজের জন্য। কিন্তু আপনারা জানেন কি? এই প্রবাসেই আমাদের মতই কিছু বাংলাদেশী পরিবার আছে যাদের ঘরে চুলাই জ্বলেনি আজ। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাদেরকে লোক লজ্জা ত্যাগ করে ভিক্ষা বৃত্তিতে পর্যন্ত নামতে হচ্ছে। তাদের সন্তানরা টাকার অভাবে স্কুলে যেতে পারছেনা। চিকিৎসা করাতে পারছেনা........ আমরা কি পারিনা আমাদের এই আনন্দের দিনে ওদের প্রতি একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে? দেখলাম উপস্থিত অনেকের চোখই অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। অনেকেই সাহায্য দেবার ওয়াদা করলেন। কেউ কেউ তখনই দিলেন। এক মহিলা দেখলাম আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে সরে গেলেন। হাতের মুঠি খুলে দেখলাম ১০ রিয়াল। কারো দানকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। আমি ভাবলাম মনে হয় মহিলার সামর্থ খুব একটা ভালো নয়। পাঠক এ প্রসঙ্গের অবতারণা করার জন্য আমি আবারো আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। কেননা কাউকে ছোট করার উদ্দেশ্যে আমার এই লেখনি নয়।
গত কিছু দিন আগে বাংলাদেশ ইন্টারন্যশনাল স্কুল(ইংলিশ) হতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে স্কুল হতে ছাত্র অভিভাবকদের একটি প্রতিনিধি দল আমেরিকা সফরে গিয়েছিলো। আমি শুনে অবাক হলাম সেই মহিলা ৩০ হাজার রিয়াল খরচ করে তার সন্তানকে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পাঠিয়েছেন। পাঠক আমি বিস্মিত, আহত ও নিজের বিবেকের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হলাম। যে মহিলা এতগুলো নিরন্ন পরিবারের এত কষ্টের কথা শুনে মাত্র ১০টি রিয়াল দিলেন। সেই তিনিই কি করে সন্তানের নিছক আনন্দের যোগান দিতে এতগুলো টাকা অবলীলায় খরচ করলেন? আমাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা হতে আমার সন্তানরাই বা কি শিখবে?
পাশাপাশি আর এক মহিলার কথা বলি। গত জুলাইতে দানের উপর প্রকাশিত আমার বইটি পড়ে অনেকেই দেখি আজকাল আমাকে দান সংক্রান্ত প্রশ্ন করেন। আসলে আমার সীমিত জ্ঞানের আলোকে আমি কখনো ফতোয়া দেয়ার দুঃসাহস করিনা। তবে কিছু পরামর্শ দেবার চেষ্টা করি। সেদির এক ভাবী আমার বাসায় এলেন। তিনি সাদকা দিতে চান। কি দিলে এবং কোথায় দিলে ভালো হয় সেটা নিয়ে জানতে চাইলেন। ভদ্র মহিলা সামর্থ ও ইচ্ছের আলোকে আমার সাথে আলোচনা করে স্থির করলেন তিনি দেশে শীতার্তদের মাঝে বেশ কিছু শীত বস্ত্র দেবেন। মহিলার দানের মানসিকতা আমাকে মুগ্ধ করলো।
এর কয়েক দিন পর এক অনুষ্ঠানে মহিলার মেয়ের সাথে দেখা। দেখি ছোট মেয়েটির হাতের মুঠিতে একটি প্লাস্টিকের ব্যগ ধরা। কিন্তু আবার কিছু বলছে ও না। আমি তখন বললাম- মা, তোমার হাতে ওটা কিসের প্যকেট? তখন ছোট মেয়েটি লাজুক গলায় বললো- সেদিন আপনাদের বাসায় দেখেছি আপনার ছোট মেয়েটি বোতলের ঢাকনা জমাচ্ছে গরীবদের জন্য । তাই আমি বাসায় যেয়ে এ কয়েক দিনের ঢাকনা গুলো সব জমিয়ে রেখেছি। আপনি নেবেন? আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ওকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করলাম। আর মনে মনে অবাক হয়ে ভাবলাম- এত ছোট মেয়ে কি করে ব্যাপারটা খেয়াল করলো? পরে মনে হলো আসলে একটি সন্তানের জন্য তার মা শিক্ষার অনেক বড় একটি পাঠশালা। মেয়েটির মাঝে এই গুণটি তৈরী হয়েছে মায়ের কাছ হতেই।
তাই আসুন পাঠক, নিজের জন্য নয়। সবার জন্য, সবাইকে নিয়েই বাঁচি। নিজের সংকীর্ণ হৃদয়ের দরজাটা খুলে দিই আপন পর সকলের জন্য। আর নিজের আত্নজদের শিখাই কি করে হৃদয়কে প্রসারিত করে সেখানে ঠাঁই দিতে হয় সবাইকে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন