ভাবনার আয়নায় নিজকে দেখি

লিখেছেন লিখেছেন নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা ১৫ মে, ২০১৩, ০১:৪৫:২০ দুপুর

অনেকেই অভিযোগ করেন আজকাল, আপা আপনি অনেক দিন ধরে লিখছেন না। লিখালিখি কি ছেড়েই দিলেন? আসলে আমি মনে করি কলমের গতির সাথে মনের বেশ ঘনিষ্ঠ একটি সংযোগ রয়েছে। এ দু'য়ের মিল না হলে লিখার চেষ্টা করা অসাধ্য সাধনের মতই। তাই বেশ কিছুদিন হতে হাত গুটিয়ে ভাবনার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি।

আমার মনের সাথে বাইরের প্রকৃতিরও বেশ সম্পর্ক আছে। যেদিন আমার মন খারাপ থাকে সেদিন আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় যেন, সারাটা আকাশের গায়ে কষ্টের নীলাভ আভা। বাগানের দিকে তাকালে মনে হয় যেন, চামেলী,জবার থোকাগুলোও কি যেন এক বিষন্নতায় মুখ লুকানোর ভঙ্গিতে ঝুঁকে আছে মাটির মুখোমুখি। গাছের ডালে উড়ে বেড়ানো চড়ুইটার ছুটাছুটির গতিতে ও যেন শ্লথ বিষন্নতার ছোঁয়া।

আবার যেদিন মন ভালো থাকে সেদিন মনে হয় আকাশটা যেন সোনারঙা রোদের কুচি মাখা। বাগানের ফুলগুলো যেন উচ্ছল আনন্দে উপচে পড়ছে। পাখিদের চলার গতিতে ও যেন এক ছন্দময় প্রাণ স্পন্দন।

গত বেশ কিছু দিন হতে মনের ঘরে কষ্টের বসবাস। সাভারের ধ্বংস স্তুপের সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর সাথে আমিও এক বুক কষ্ট আর অনিরুদ্ধ অশ্রু নিয়ে দিগন্ত টিভির সামনে বসে প্রতীক্ষা করেছি জীবিত প্রাণ স্পন্দনের আশায়। এক,দুই, তিন দিন অধীর অপেক্ষার পর যখন জীবনের স্পন্দন হারানো মানুষ গুলো পচা গলিত লাশে পরিবর্তিত হতে শুরু করলো । তখন আমার ভাবনারা ও যেন অন্যপথে ছুটে চললো।

উপলব্দি ,মূল্যায়ন আর আত্নবিশ্লেষণে ডুবে গেলাম নিজের মাঝেই নিজে। কে আমি? কোথা হতে এলাম? কোথায় ফিরে যাবো? সেই জীবনের আয়োজন কতখানি হল? এমনি হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করলো মনের দেয়ালে।

ইমাম গাজ্জালীর একটি কথা বার বার মনে হচ্ছিলো-''মানুষ যখন জীবিত চলাফেরা করে তখন সে তার পাকস্থলীতে নোংরা বর্জ্য বহন করে, নাকে থাকে শ্লেষ্মা, কানে থাকে ময়লা, বগলের নীচে থাকে দুর্গন্ধ। তাকে সৃষ্টি ও করা হয়েছে ময়লা হতেই এবং তার পেটের মধ্যে ময়লা স্থায়ীভাবেই স্থান করে নিয়েছে। আর যখন সে মরে যাবে তখন সে হবে দুর্গন্ধযুক্ত লাশ। তাহলে কিসের অহংকার সে করে?''

নিজকে যেন নতুন করে জানার চেষ্টা করালাম। ভাবলাম কি করছি পৃথিবীর বুকে? ধন,জ্ঞান কিংবা ক্ষমতার অহংকারে অন্যকে কত কষ্টই না দিই। কিন্তু যিনি এসবের একচ্ছত্র অধিকারী তার কাছে ফিরে গেলে আমার এই মিথ্যা আস্ফালনের পরিণতি কি হবে? আমি আলহামদুলিল্লাহ কাজের লোকদের অধিকারের ব্যাপারটা খুব খেয়াল করি। তারপরও মাঝে মধ্যে কোন ব্যাপারে যদি ওর কোন কাজের জন্য আমার রাগ এসে যায় তখন আমার হ্যাজব্যন্ডকে বলি- আমরা বেশী ভালো মানুষী দেখাই বলেই লোকটি এরকম ফাঁকি দেয়। অন্য বাসায় হলে তো বেতন কেটে রাখতো। তখন আমার স্বামী জবাবে একটি কথা বলে- দেখ, আল্লাহর সৃষ্টি একটি মানুষকে ক্ষমতার জোরে নিজের অধীনে পেয়ে এত কঠোর ভাবে বিচার করো না। তার চাইতে বরং আমরা যদি ওর প্রতি ক্ষমাসুলভ আচরণ করি হয়তো হতে পারে এর ওসিলায় আখিরাতে আল্লাহর দরবারে আমরা ও ক্ষমার হকদার হতে পারবো। কথাটি আমার খুব মনে দাগ কেটেছিলো।

সাভারের মৃত মানুষদের স্বজনদের সাথে আমি ও লাশের মিছিলে মিশে তাদের জানাজায় ও পৌঁছালাম মনে মনে। নতুন করে অবাক চোখে দেখলাম পৃথিবীর বুকে প্রাণের স্পন্দন নিয়ে জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুষগুলোর সমস্ত চাহিদা গুলো যেন কবরের সাড়ে তিন হাত মাটির মাঝেই ডুবে গেল। নিজকে আমি প্রশ্ন করলাম- যদি এটুকুই আমার প্রয়োজন হয় তবে কেন মিছিমিছি হাজারো জীবনোপকরণ অর্জনের জন্য নিরর্থক ছুটে চলি? কেন বোধদয় হয়না আমাদের?

যত বড় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিই হইনা কেন, না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর পর এর চেয়ে বেশী জমি তার কপালে জুটবেনা। জুটবেনা গাড়ি, বাড়ি ,এয়ার কন্ডিশনসহ জীবনের নানা আয়োজন। কোন ক্ষমতাধরের কবরেই এসব যাবেনা। সম্ভবত সম্রাট সিকান্দর শাহ বলেছিলেন, আমি মারা যাবার পর আমার হাত দুটো আমার কাফনের কাপড়ের বাইরে বের করে রেখ। উপস্থিত লোকেরা প্রশ্ন করেছিলো- কেন? তিনি জবাবে বলেছিলেন- মানুষ যাতে আমার শূন্য হাত দুটো দেখে বুঝতে পারে এতবড় শাসক হবার পর ও আমি দু'হাতে করে জাগতিক কোন উপকরণই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারিনি। তবে কি হল? সেই সামান্য শ্রমজীবি মানুষটির পরিণতির চাইতে আমার শেষ পরিণতিতে তো আসলে কোন পার্থক্য নেই।

ফেরাউন, নমরুদ, হিটলার কালের সাক্ষী হয়ে আজো আমাদের সামনে উপমা। মহা উদ্ধত নিয়ে যে ফেরাউন গর্ব করে বলেছিলো- আমিই তোমাদের রব। কোথায় সে আজ? কেউ মৃত্যুকে রোধ করতে পারেনি।

তবে শুধুমাত্র সফল সেই, যে নিজের জীবদ্দশায় আল্লাহর হক ও বান্দাহর হক উভয়ের ব্যাপারেই সমান সচেতন ছিলো। আল্লাহর হকের ব্যাপারে বলা হয়েছে শিরক ছাড়া আল্লাহর সাথে করা বাকী গুনাহের ক্ষমার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু বান্দাহর যে হক, তা শুধু বান্দাহই ক্ষমা করতে পারবে। আল্লাহ কখনো নিজে সেটা ক্ষমা করবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। তবে আজ যারা শ্রমিকের ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে নায্য মুজুরী দিতে চায়না, শাসক হয়ে ও শাসিতের অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেনা তাদের পরিণতি কি হবে? মজলুমের বুক ফাটা কান্নার নোনা জলে যে তার আখিরাতের জীবন বিফলে যাবে একবারও সে কথা আমরা মনে করি কি?

বিষয়: বিবিধ

২১৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File